#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যার ফারিশের হাত ধরে ক্রমাগত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। ফারিশের হাত শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে, যেন ছেড়ে দিলেই, ফারিশ পালিয়ে যাবে। ফারিশের কানে এখনো অবদি ‘ভালোবাসা ‘ শব্দটি বেজে যাচ্ছে। সে পিছনে ঘুড়ে অনন্যার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে, হাতটা অনন্যার কপালের কাছে ঠেকায়। অনন্যার আবারো জোড় এসেছে। পূর্বের থেকেও বেশি জ্বর হয়েছে। ফারিশের মনে পরলো, ডাক্তার সাহেব তাকে যাওয়ার পূর্বে বলে গিয়েছিলো, ‘ তোমার স্ত্রীকে একা ছাড়বে না কিন্তু। মাথার চটের জন্যে রাতে কিন্তু জ্বর হওয়ার একটা সম্ভবনা রয়েছে। ‘
ফারিশ ভাবলো আগের মতো করিমাকে ডেকে পাঠাবে কিন্তু রাত অনেক হয়েছে। করিমা হয়তো দরজা আটকে ঘুমিয়ে আছে। সে কি এখন করিমার দরজায় নক করে বলবে, ‘ মিস অনন্যার বেশ জ্বর উঠেছে। উনার এখন আপনাকে প্রয়োজন। আপনি এখন ঘুমাবেন না। উনার খেয়াল রাখুন।
ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুদ ঠেকলো ফারিশের কাছে। সে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফার্স্টটেড বক্স বের করে, থার্মোমিটার বের করে। সেই থার্মোমিটার টা অনন্যার মুখে লাগিয়ে দিয়ে, জ্বরটা মাপার জন্যে। কিছুক্ষন পরে, থার্মোমিটার টা নিয়ে ফারিশের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। জ্বর প্রায় ১০০ ডিগ্রির উপরে। ফারিশ বুঝতে পারছে না বর্তমানে তার কি করার উচিৎ! সে আবারো বক্স থেকে একটা ওষুধ বের করে যা ডাক্তার দিয়েছিলো। তিনি বলে গিয়েছেন জ্বর বেশি হলে যেন ট্যাবলেটটি অনন্যাকে খাওয়ানো হয়, তাহলে আস্তে ধীরে জ্বরটা কমে যাবে। ফারিশ তাই করলো। অনন্যার কাছে গিয়ে বলে ঠান্ডায় গলায় বলে উঠলো, ‘ মিস অনন্যা একটু উঠুন! আপনার গাঁয়ে অনেক জ্বর। আপনি মেডিসিন টা খেয়ে নিন।’
অনন্যা জ্বরে কেঁপে চলেছে। ফারিশের কথাগুলো বোধহয় তার কানে যায়নি। সে শুধু অনবরত বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ফারিশ বাধ্য হয়ে, নিজেই অনন্যার পিঠে হাত দিয়ে, অনন্যাকে বসানোর চেষ্টা করলে, অনন্যা গিয়ে ফারিশের বুকে ঢলে পরে। ফারিশ স্তব্ধ হয়ে যায়। আখিজোড়া হয়ে যায় তার বন্ধ। তার হৃদস্পন্দন বৃষ্টিভেজা সেই দিনের থেকেও তড়িৎ গতিতে চলতে শুরু করে। তার হাত এখনো অনন্যার পিঠে। সে আকড়ে ধরে আছে অনন্যাকে। অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলেই যাচ্ছে, ‘ আমাকে ভালোবাসবে একটু? আমার ভালোবাসা খুব প্রয়োজন। আমাকে ভালোবাসো না কেন তুমি?’
ফারিশের কানে অনন্যার প্রতিটি কথা পৌঁছাছে। সেই কথাগুলো যেন ফারিশের বুক ভেদ করে, হৃদয়ের গভীরে গিয়ে ঠেকছে। আজ ফারিশের কাছে নিজেকে কেন যেনো বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে অনন্যা বর্তমানে নিজের মধ্যে নেই, থাকলে বোধহয় এতোক্ষনে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতো। হয়তো মুখস্রী খানা টকটকে লাল হয়ে যেতো। ফারিশ খেয়াল করেছে লজ্জায় সেই মুখস্রীখানা অধিকতর সুন্দর হয়ে উঠে। ফারিশের মস্তিকে এইসব কথা চলে আসতেই, ফারিশ আপনমনে বলতে থাকে,’ওহ শিট! আমি এইসব স্টুপিডের মতো কিসব ভেবে যাচ্ছি?হাও কেন আই থট দিজ? পুরো মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার। ‘
সে আলতো করে অনন্যাকে নিজের থেকে সরিয়ে, অনন্যাকে বিছানার সাথে ঠেকিয়ে বসায়। অনন্যা অনাবরত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। ফারিশ কোনভাবে অনন্যার মুখটা নিজের দিকে এনে, জোড় করে মুখে ট্যাবলেটটা ঢুকিয়ে দিয়ে, পানি খায়িয়ে দেয়। অত:পর অনন্যাকে শুয়িয়ে দিয়ে সে।
____________________
অভি নিজের বাড়িতে এসে দরজা আটকে বসে আছে। সে আজকে রাতে খায়নি অবদি। তার মা দরজায় অনেক্ষন নক করেছেন এবং বার বার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ অভি! কি হয়েছে তোর? আজকে তো তোর জুঁইকে নিয়া আসার কথা ছিলো! তুই কি আদোও জুঁইয়ের খালার বাড়িতে গিয়েছিলি? কি হলো হঠাৎ? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? ‘
অভির থেকে কোনপ্রকার উত্তর না পেয়ে, অভির মা বাধ্য হয়ে চলে যান। অভি তার ফোন বের করে, অনন্যার সাথে প্রত্যেকটা মুহুর্তের ছবিগুলো ভালো করে দেখছে। বারবার জুম করে অনন্যার হাসিমাখা মুখস্রীখানা দেখছে। এমন হাসিখুশি সরল সোজা মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন বাজে ভাবে অপমান করে গিয়েছে! মেয়েটা কত কেঁদে কেঁদে বলেছে সে নির্দোশ অথচ তাকে বিশ্বাস না করে, সামান্য একটা ভিডিও দেখে সে তাকে অপমান করেই গিয়েছে। এমনকি আজও তার কঠিন সময়ে তার ঢাল না হয়ে তাকে আরো বাজে ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এসেছে। কথাগুলো মস্তিষ্কে চলে আসতেই, ‘ অনন্যা ‘ বলে মেঝেতে বসে অঝরে কাঁদতে থাকে অভি। সে ঠিক করেছে শেফালির থেকে কালকে শুরু থেকে সবকিছু শুনে, এইসব পিছনে যারা যারা তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দিয়ে সে তার অনন্যাকে ফিরিয়ে আনবে।সে অপলক দৃষ্টিতে আকাশের চাঁদখানার দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলতে থাকে, ‘ অনন্যা আজ মনে হচ্ছে, আজ আকাশের চাঁদের থেকেও তুমি সুন্দর। কারণ তোমার কলঙ্ক নেই। তুমি সবসময়ই স্নিগ্ধ, অপূর্ব সুন্দর। ‘
অভির মনে হচ্ছে ছবিতে থাকা অনন্যা যেন বিড়বিড় করে বলছে, ‘ তুমি কাঁদছো কেন অভি? তুমি কী জানো না? ছেলেদের স্ট্রং থাকতে হয়। তাদের কাঁদলে মানায় না। বি স্ট্রং! ‘
____________________
অনন্যা বিছানায় শুয়ে কেঁপে কেঁপে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ফারিশ রুমে পাইচারি করে যাচ্ছে। সে আবারো অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার গালে হাত দিয়ে দেখে অনন্যার জ্বর এখনো কমছে না। সে আর কিছু না ভেবে রুম থেকে বেড়িয়ে, পাশে থাকা বেসিং থেকে এক বাটি নিয়ে আবারো রুমে ঢুকে, রুমালটা বের করে, অনন্যার কাছে বসে। অত:পর রুমালটা পানিতে ভালো করে ভিজিয়ে, অনন্যার কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। মিষ্টির যখন জ্বর হয় তখন সে এইভাবেই মিষ্টির পাশে বসে সারারাত মিষ্টির কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। ফারিশ সারারাত ধরে অনন্যার কপালে অনাবরত জলপট্টি দিতে থাকে পাশে বসে। একটা সময় ভোরের দিকে সে চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পরে। রুমা খান ফজরের নামায পরে, অনন্যাকে এক পলক দেখতে এসে নিজেই অবাক হয়ে যান। অনন্যা ফারিশের আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়, অপরদিকে ফারিশও অনন্যার হাত ধরে চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে। খাটের পাশে থাকা জলপট্টির পানিভরা বাটি দেখে রুমা খানের বুঝতে বাকি নেই, ফারিশ নিজে সারারাত জেগে অনন্যার সেবা করেছে। রুমা খান বুঝতে পারছেন কালকের ঘটনার পর অনন্যার অবস্হার জন্যে মনে মনে বেশ অপরাধবোধে ভুগছিলো ফারিশ। তাই বলে যাকে শত্রু ভেবে বাড়িতে এনেছিলো, তাকেই রাত জেগে সেবা করলো? আদোও শুধুমাত্র অপরাধবোধের জন্যে নাকি ফারিশের মনেও নানারকম অনুভুতি ঘিড়ে ধরেছে অনন্যাকে নিয়ে? কথাগুলো মস্তুিষ্কে আসতেই, মুচকি হেসে ফেললেন রুমা খান। সে ভাবলেন অন্য কেউ যদি এখন দুজনকে একসাথে দেখে ফেলে, তাহলে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলবে, কালকের মতো। রুমা খান ঝাঁকিয়ে, ফারিশকে ডাকতে থাকে। রুমা খানের ডাক পেয়ে ফারিশ তড়িৎ গতিতে, উঠে গিয়ে বলে, ‘ দাদি! তুমি এখন? ‘
‘ হ্যা! আমি। তা এখানে কি হচ্ছিলো?’
ফারিশ আমতা আমতা করে বলে, ‘ আসলে দাদি..
ফারিশকে থামিয়ে বলে, ‘ এখন অনন্যার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, নিজের রুমে যাও। এভ্রিথিং ইজ ওকে নাও। ‘
রুমা খানের কথা শুনে ফারিশ দ্রুত অনন্যার হাত তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিয়ে, চলে যেতে নিলে, কি মনে করে যেনো আবারো অনন্যার কাছে যায়। অত:পর অনন্যার কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর নেই। অনন্যার জ্বর কমে গেছে বিধায় ফারিশ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে, দ্রুত চলে যায়। নাতীর এমন কান্ডে রুমা খান অবাক না হয়ে পারেন না। তিনি ফের হেসে উঠেন, যেনো বর্তমানে নায়ক- নায়িকার মজাদার সিকিউওয়্যাল চলছে।
_______________
সকালে অফিসের জন্যে রেডি হয়ে ফারিশ ড্রাইনিং টেবিলে বসে। সেখানে তার কাকাও বসে ছিলো। তিনি খাওয়ার মাঝে হুট করে বলে উঠলাম, ‘ শুনলাম দুই, একদিনের মধ্যেই ভাই দেশে আসছে।’
চলবে কী?
#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ঘুমন্ত অনন্যার দিকে নিষ্পলকভাবে তাঁকিয়ে রয়েছে ফারিশ। নিষ্পাপ সুন্দর মুখস্রী মেয়েটার। কালকের রাতের পর থেকে এক বাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ফারিশের। তা বাজে নাকি অদ্ভুদ অভ্যাস তা ঠিক বুঝে উঠতেপ পারছ না সে। অনন্যার ঘুমন্ত মুখস্রী দিকে তাঁকালেই তার সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আজ যখন নীচে তার কাকার খালেদ খানের থেকে শুনলো তার বাবা রাশেদ খান প্রায় ৫বছর পরে আবারোও দেশে ফিরছে, তখনি তার মেজাজটা বিগড়ে গিলো। সে খাবার টেবিলে থাকা খাবার গুলো একপ্রকার ছুড়ে ফেলে, রেগে হনহন করে উপরে চলে গেলো। সবকিছু নিরবের মতো পরিদর্শন করলেন খালেদ খান। তখন রুমা খান তার ছেলের কাছে এসে বললেন, ‘ তুমি এখুনি কেন বলতে গেলে যে, রাশেদ আসছে। তুমি কী জানো না? যেই কয়েকদিন রাশেদ থাকবে, সেই কয়েকদিন তো বাড়িতেই থাকবে না আমার নাতীটা। দেখবে এখুনি বাড়ি ছেড়ে গেলো বোধহয়। ‘
‘ তার মানে কি মা? তাই বলে কী ভাই আসবে না? তেমারও তো ভাইকে দেখার ইচ্ছে করে তাই না?’
‘ হ্যা। ইচ্ছে করে। ‘
‘ তাহলে? আগে জানালেও কি বা পরে জানালেও কি? ভাইয়া আসার খবর এমনিই পেয়ে যাবে ফারিশ, তখন তুমি তাকে চাইলেও আটকাতে পারবে না। ‘
ছেলের কথা শুনে রুমা খান হতাশার দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফারিশ উপরে উঠেই আশে পাশে যা পায় তাই ছুড়ে ফেলতে থাকে। রাশেদ খান নামক লোকটিকে আবারোও দেখতে হবে, ভেবেই কেমন গা শিউরে উঠে তার ঘৃণায়! ফারিশের ভাষ্যমতে লোকটা আগেও জঘন্য ছিলো এখনো আছে, এমনকি ভবিষ্যৎও থাকবে। এতো রাগ, ক্ষোভের মধ্যেও ফারিশের নজর যখন ঘুমন্ত অনন্যার দিকে যায় তখন সে স্হীর হয়ে যায়। সে আরেকটু এগিয়ে, অনন্যার রুমে ঢুকে, অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার কপালে হাত দিতে চাইলে তখনি চট করে আখিজোড়া খুলে ফেলে অনন্যা। অনন্যাকে বড় বড় চোখ করে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। ফারিশ হাল্কা করে হেসে দ্রুত সরে যায়। অনন্যা বিছানায় বসে, নিজের ওড়না ভালো করে জড়িয়ে, আশে পাশের অবস্হান বুঝার চেষ্টা করে। সে বিলাশবহুল একটি ঘরের বিছানায় রয়েছে। যেই রুমটা ফারিশের রুমের পাশে, কিন্তু সে কী করে এলো? সে তো রাস্তায় চলে গিয়েছিলো তখনি একটা ট্রাক তার দিকে তেড়ে আসে কিন্তু তারপর? তারপর কি হলো?
ফারিশ অনন্যার মুখস্রী দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, আসলে অনন্যা কি ভাবছে। ফারিশ পকেটে হাত দিয়ে, গম্ভীর সুরে বলে, ‘ মিস অনন্যা! আমি জানি, আপনি আসলে কী ভাবছেন। কিন্তু আপনি কি ভেবে দেখেছেন আপনি আসলে কী করছিলেন? কোন সেন্স আছে আপনার? আমি ঠিক সময়ে না আসলে কী হতো হ্যা? নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে, মেইন রোডে চলে গেলেন দৌড়াতে দৌড়াতে। সেখানে ট্রাকটা যেই গতিতে আপনার দিকে ধেয়ে আসছিলো, একটুর জন্যে আপনি বেঁচে গেছেন।’
ফারিশের কথার মাঝেই, চেঁচিয়ে বলে অনন্যা জবাব দিলো, ‘তো ম/রে যেতে দিতেন আমায়। কেন বাঁচিয়েছেন? ওহ হ্যা! কি যেন পুরনো প্রতিশোধের খেলা খেলছেন আপনি। সেই খেলা তো আর খেলতে পারতেন না। আমি যদি এতো সহজেই ম/রে যাই, তাহলে তো আপনার মজা শেষ! আপনার আনন্দ, আপনার ইঞ্জয়মেন্ট তো আমাকে তিলে তিলে মরতে দেখার মধ্যে বেশি রয়েছে এন্ড ফার্স্ট অফ অল! আমি রাগে নয় দু:খে আফসোসে কালকে বেড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম মি: ফারিশ খান। নিজের চরিত্রের পর দিনের পর দিন এমন নিকৃষ্ট অপবাদ আমি মেনে নিতে পারছি না। আমিও মানুষ! আপনার প্রতিশোধের জন্যে আপনি দিনের পর দিন আমাকে আপনার নোংরা গেমে জাস্ট ইউজ করে যাচ্ছেন। আমি আর পারছি না! জাস্ট পারছি না। ‘
বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকে অনন্যা। তার মধ্যে জমে থাকা সমস্ত দু:খ, ক্ষোভ, কালকের করা প্রতিটা অপমানের জন্যে জমে থাকা রাগ সবকিছু সে ফারিশের উপর উগড়ে দিয়েছে। অদ্ভুদের বিষয় হলো ফারিশ সবকিছু শুনলো শান্ত ভাবে, অথচ সে কোনপ্রকার উত্তর দিলো না। সে কোনপ্রকার জবাব না দিয়েই বেড়িয়ে গেলো। ফারিশ বেড়িয়ে যেতেই, হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে থাকে অনন্যা। তার ধারণামতে আজ বোধহয় সে ম/রে গেলেই সবকিছু শান্ত হয়ে যেতো। এতো অত্যাচার, অপমানের অবসান ঘটতো।
তার ভাবনার মাঝেই, রুমা খান রুমে ঢুকে বললেন, ‘ দিদিভাই কেমন লাগছে শরীরটা?’
অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে নিজের অশ্রু মুছে বলতে লাগলো, ‘ দাদি আপনি এইসময়ে। ‘
রুমা খান অনন্যার পাশে বসে, অনন্যার মাথয় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ কাল রাতে মাথায় চট পাওয়ার জন্যে তোমার অনেক জ্বর উঠেছিলো তা জানো অনন্যা? ‘
অনন্যা অবাক হয়ে বলে, ‘ আমার জ্বরও এসেছিলো।’
‘হ্যা! তুমি কালকে থেকে আজ অবদি সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে ছিলে। কোন হুশ ছিলো না। জ্বর ১০০ ডিগ্রির উপরে ছিলো তখন কে সারারাত জেগে সেবা করেছিলো, জানো?’
‘কে?’
অনন্যার এমন প্রশ্নের উত্তরে করিমা রুমে দুধের গ্লাস নিয়ে, ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘ কে আবার? ফারিশ স্যার! মাগো মা! আমি তো আপনারে ভোর বেলায় দেখতে আইছিলাম আপা। দাদিও দেখছে। বেডায় সারারাত৷ আপ্নারে ওষুধ খাওয়াইয়া,জ্বলপট্টি দিতে দিতে চেয়ারে ঘুমায় গেছিলো, বাবা যায়? ওইযে দেহেন আপনার বিছানার টেবিলেই, ওষুধ এবং জলপট্টির বাটিডা আছে। ‘
করিমা কথা শুনে বিছানার পাশে থাকা ওষুধ এবং বাটি দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় এক মুহুর্তের জন্যে অনন্যা।
যেই মানুষটা এতোটা কঠোর, নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ, সে তাকে সারারাত জেগে সেবা করে সুস্হ করলো অথচ তাকেই এতো বাজে ভাবে কথা শুনিয়ে দিলো।
করিমা আবারোও বলে উঠে, ‘ শুধু কি তাই? ফারিশ স্যার ওই কুটনি জুঁইরেও বাইর কইরা দিছে এমনকি মা- পোলারেও উচিৎ শিক্ষা দিছে, যারা আপ্নারে কালকে এতোগুলো অপমান করছিলো। ‘
করিমার কথার মাঝেই, রুমা খান অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকেন, ‘ আমার নাতীটা খারাপ নয় রে দিদিভাই।কিছু খারাপ মানুষ দিনের পর দিন সেই শিশু ফারিশের মনে একরাশ বিষাক্ত বেদনার উৎপত্তি ঘটিয়ে, আজ তাকে এমন কঠোর হতে বাধ্য করেছে। না পেয়েছে মাকে না পেয়েছে বাবাকে, কিন্তু কালকের ঘটনার পরে আমার কি মনে হচ্ছিলো জানো? তুমিপাথরের বুকে ফুল ফুটিয়েছো। কালকে আমি ফারিশের চোখে মিষ্টির পরে, কারো জন্যে দুশ্চিন্তা উদ্নীগ্ন খুঁজে পেলাম, সেই কালকে থেকেই কিছুটা অনুতাপ ছিলো। আজকে তোমার কথা শুনে সেই কষ্টটা আরো বেড়ে গিয়েছে তার। যাই বলো, আমার নাতীটা খারাপ না। তাকে বাধ্য করা হয়েছে দিনের পর দিন। ‘
বলেই আচলে মুখ ঢেকে রুমা খান বেড়িয়ে গেলেন। রুমা খানের সাথে করিমাও চলে গেলো।
____________________
ফাইভ স্টোরের একটি টেবিলে, শেফালি এবং অভি পরস্পর একে অপরের সামনাসামনি বসে আছে। শেফালি বারংবার নিজের ওড়না পেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি নীচে। অপরদিকে অভি তার বিরক্তির দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। কথাগুলো না বলে, মেয়েটা এমন অদ্ভুদ আচরণ করে যাচ্ছে কেন? যেন সে এক সদ্য বিবাহিত নববধু এবং কবুল বলার পূর্বে একজন বধুর মধ্যে লজ্জামাখা অস্বস্হিবোধ দেখা যায়, তেমনি অবস্হা লক্ষনীয় শেফালির মাঝে অভির ধারণামতে। অভি টেবিলে শব্দ করে নিজের হাতজোড়া দিয়ে ভর দিয়ে খানিক্টা দাঁড়িয়ে বলে,
‘ তুমি লজ্জা পাওয়া বন্ধ করো, আপাতত। আমার সবকিছু শুরু থেকে জানতে হবে।’
অভির কথা শুনে শেফালি মুখ তুলে তাঁকিয়ে বলে,
‘ লজ্জা পাচ্ছি না বরং অপরাধবোধের তীব্র আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। ‘
‘ সত্যি তোমরা বন্ধু হয়ে যা করেছো, তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য কিন্তু তুমি এতোকিছুর মধ্যেও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে, আমাকে সব না হলেও কিছুটা জানিয়েছো। তাই আমি মনে করি তোমাকে ক্ষমা করা যায়, কিন্তু অপরদিকে জুঁই! ছিহ! এতো নোংরা একটা গেম খেললো, শুধুমাত্র অনন্যাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার জন্যে। এখন তুমি বলবে প্লিয? সেদিন কি হয়েছিলো?’
শেফালি সংক্ষেপে বলতে থাকে, ‘ সেদিন আমার জন্মদিনে জুঁইয়ের কথামতো অনন্যাকে নেশা করিয়ে, আমার জন্মদিন যেই রেসর্টে করা হয়েছিলো, সেখানের একটি ঘরে অনন্যাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে বলা হয়েছিলো, অনন্যার সাথে ঘনিষ্টভাবে ছবি, ভিডিও তুলা হবে, তার কোনপ্রকার ক্ষতি কিংবা তার পোষাকে অবদি হাত দিবে না। সে অনুযায়ী জুঁই এবং আমার সাহায্যে ফারিশ খান শুধুমাত্র অনন্যার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার মিথ্যে ভিডিও ক্লিপ্স বানায়,যা সম্পূর্ন মিথ্যা। অর্থাৎ তখন অনন্যা অজ্ঞানরত অবস্হায় ছিলো এবং ফারিশ খান অনন্যাকে জড়িয়ে এমনভাবে ছবিগুলো নিয়েছে যেন মনে হয় তাদের দেখে মনে হয়, তারা ঘনিষ্ট অবস্হায় আছে। ব্যাস!’
শেফালি কথাগুলো বলে থেমে গেলো। অভির আখিজোড়া রাগে, ক্ষোভে লাল আভা ধারণ করা আছে। তার থেকে তার অনন্যাকে কেড়ে নিতে এতো বড় ষড়যন্ত্র করা হলো দিনের পর দিন এবং সে কোন কিছু যাচাই না করেই, এতোদিন ধরে অনন্যাকে অপমান করে গেলো। অভি উঠে দাঁড়ালো। শেফালি প্রশ্ন করলো, ‘ কোথায় যাচ্ছো?’
অভি অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে, হাল্কা হেসে বললো, ‘ নিজের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিতে। ‘
___________________
রাত বাজে ১২টা, অনন্যা পাইচারি করে যাচ্ছে, ফারিশ এখনো ফিরে নি। তার কেন যেনো প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। তখনি কেউ তার কাঁধে হাত রাখলো। অনন্যা না ঘুড়েই বললো, ‘ আপনি এসেছেন মি: ফারিশ খান?’
চলবে।।