Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমাপ্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-১৫+১৬

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-১৫+১৬

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৫

সৌহার্দ্য নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। রাত নেমেছে। চারপাশে আঁধার, নিস্তব্ধতা! তরীদের বাড়ি থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে সৌহার্দ্য। এরপর তরীর কোনো খোঁজ সে আর করেনি। করেও কোনো লাভ নেই। মিস্টার আফনাদ বলেছেন, তরী নাকি নিজেই ফিরে আসবে। অহেতুক নিজের পরিশ্রান্ত শরীর ও মনকে আর খাটাতে চায়নি সৌহার্দ্য। মাঝরাস্তায় একটা সুনশান পরিবেশে গাড়ি থামিয়েছে তাই। ক্ষণে ক্ষণে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুনগুন কানে ভেসে আসছে।

সৌহার্দ্য অশান্ত মন আজ আরো বেশি অশান্ত হয়ে উঠেছে। যেই নিরাশা এতোদিন ওকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে নিঃশেষ করছিল, সেই নিরাশা দূরীভূত হয়ে তাতে আজ নতুন করে আশার প্রদীপ জ্ব*লে উঠেছে। সবটা সত্যি বলে বিশ্বাস করতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

পকেট থেকে চেইনসহ লকেটটা বের করলো সৌহার্দ্য। চোখের সামনে সেটা ঝুলিয়ে ধরে দেখলো অপলক। আকাশে আজ ঠিক লকেটের আকৃতির মতোই একটা চাঁদ উঠেছে। দুটোকে পাশাপাশি দেখে সৌহার্দ্যের কাছে লকেটের চাঁদটাকেই বেশি সুন্দর লাগছে। তার চাঁদ তার কাছে বরাবরই সুন্দর, পৃথিবীর সবকিছু থেকে সুন্দর!!

সৌহার্দ্যের মাথার ভেতর এখন অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। সবটা সে ধীরে-সুস্থে করবে। তার যে অনেক কাজ! কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু জানা বাকি। আজ যা জানলো, তার থেকেও আরো ভ*য়া*ব*হ কিছু আছে যা সবারই অজানা। একটা ভাবুক হৃদয় ও মস্তিষ্ক নিয়ে সৌহার্দ্য পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিলো।

বাড়ির গেইটের কাছাকাছি আসতেই বিপরীত দিক থেকে কাউকে অগ্রসর হতে দেখলো সৌহার্দ্য। সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় অবয়বটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। সৌহার্দ্য দ্রুত গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এসে তার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালো।

তরী আনমনা হয়ে হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে। সামনে -পেছনে, আগে-পরে কারো দিকে কোনো নজর নেই তার। হঠাৎ কারো সাথে আকস্মিক ধ্বাক্কায় তরী হকচকিয়ে গেল। ভড়কানো দৃষ্টি সৌহার্দ্যের মুখের ওপর থামলো। সৌহার্দ্য কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে! তরী ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।

-“কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?”

সৌহার্দ্যের অদ্ভুত শান্ত কন্ঠস্বর। তরীর কেমন যেন ভয় লাগলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে ওভাবে হুট করে চলে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে ও। সৌহার্দ্য তরীর দিক থেকে নজর সরিয়ে বললো,

-“কাজটা কতটুকু ঠিক করেছো তুমি, একবার ভেবে দেখতে পারো। যেখানেই যাও একববার জানিয়ে গেলেও পারো। তোমাকে কেউ বাঁধা দেবে না। এভাবে সবাইকে হয়রানি করিয়ে, চিন্তায় ফেলে কী লাভ পেয়েছো, আমি জানি না। জানতেও চাই না। তোমার কাউকে নিজের সম্পর্কে জানানোর প্রয়োজন না থাকলেও কিছু কিছু মানুষের তোমার সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে। কারণ বৈধভাবে তাদের সাথে তুমি নিজের জীবন জুড়ে নিয়েছো!”

তরী অবাক হলো। এমন ঠান্ডা কথা দিয়ে কেউ রাগ ঝাড়তে পারে, তরীর জানা ছিল না। কী অদ্ভুত কান্ড! তরীর অবাকতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শীতল কন্ঠে বললো,

-“তোমার যতটা মনে হয় যে, তুমি কারো লাইফে ম্যাটার করো না, তার থেকেও কয়েক গুন বেশি ম্যাটার তুমি করো। আমার ভালোলাগায় তুমি অতোটাও অপ্রিয় নও, যতোটা তুমি নিজেকে মনে করো।”

সৌহার্দ্য কালক্ষেপ করলো না হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। শেষের কথাটার মানে ওর মস্তিষ্কে ধরা দিলো না।

সৌহার্দ্যের পিছু পিছু তরীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। দাদী লাঠি ভর করে এগিয়ে গিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,

-“কী রে, নাতবৌ! কই চইলা গেছিলি একলা একলা? সারাদিনে আর কোনো খবরই নাই তোর! বলি একবার আমারে জানাইয়া যাইলে কি আমি তোরে নিষেধ করতাম?”

সুজাতা সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“ওকে কোথায় পেয়েছিস, বল তো!”

-“কোথায় পেয়েছি? কোথায় গিয়েছিল? এসব কথা এখন বলে কোনো লাভ আছে? খুঁজে যে পেয়েছি, এটাই বড় কথা! এখন এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করা অফ করো। প্রচন্ড টায়ার্ড আমি। সারাদিন খোঁজা খুঁজি, দৌড়ঝাঁপের ওপরে থাকায় অনেক ধকল গেছে। একটু রেস্ট দরকার।”

সৌহার্দ্য পা চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তরী আরেক ধাপ বিস্ময় নিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য ওকে খুঁজেছে? কেন খুঁজেছে? বিষয়টা হজম হলো না তরীর। আর কাউকে কোনো কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে মিস্টার রায়হান বললেন,

-“তুমিও ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, বউ মা। আর এরকমটা করো না কখনো। সবাই কত চিন্তা করছিলাম আমরা!”

তরী মাথা নাড়ালো। দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

২৫.
মধু নিজের আলমারির কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পুরোনো ব্যবহার্য পোশাকগুলো এখনো সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে ও। প্রহরের কথাগুলো কানে বাজে তার এখনো।

-“একবার আগের মতো সেজে আসবে একদিন? মেয়েলি সাজ!”

কেন প্রহর ওকে এই কথা বলেছিল? প্রহরকে ও শুধু নিজের স্বার্থে সাহায্য করেছিল। তরীর খবরাখবর প্রহরকে দেওয়ার পেছনে ওর নিজের স্বার্থ ছিল বলেই ও প্রহরের সাথে যোগাযোগ রেখেছে এ কয়দিন। কিন্তু এখন তো আর এসবের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই!

ভাবনার মাঝেই মধু ধরাম করে আলমারিটা লাগিয়ে দিল। মানুষের অতীতের সুন্দর মুহূর্ত গুলো মনে তেমন দাগ না কে*টে থাকলেও, অতীতের তিক্ততা গুলো মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। প্রহর ওর অতীতের অতি সুন্দর একটা অধ্যায় ছিল। শুধুমাত্র একটা অপ্রত্যাশিত উপসংহারের জন্য এখন সেটা তার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। শুধু মাত্র প্রহরের জন্য সে বেঁচেও থেকেও বেঁচে নেই! ভালো থেকেও ভালো নেই। তার জীবনের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে শুধু প্রহরের কারণে।

বার বার ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। সেদিনের পর থেকে মধু-ই প্রহরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই প্রহরের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল এতোদিন। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ওর ভেতরে জমে থাকা ঘা আবার পীড়া দেওয়া শুরু করেছে। পরীক্ষায়ও বসেনি ও সেকারণে। এ কয়েক দিনে প্রহর সবরকমের চেষ্টা করেছে মধুর সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু মধু হোস্টেলও চেঞ্জ করে ফেলেছে। প্রহর চাইলে ওকে খুঁজে বের করে দেখা করতে পারত। তবে ও চায় মধু ওর সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলুক।

“শেষ বারের মতো একবার কথা বলবে না? শুধু শেষ বার।”

মেসেজটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলেও মধু ওপর থেকে দেখলো শুধু। সিন না করে প্রহরকে ব্লক করে দিলো সব জায়গা থেকে। নাহ্! যা শেষ হয়ে গেছে, তা আবার শুরু করা যায় না। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগে না কখনো। মধু নিজের জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চায় না। সে যেমন আছে, তেমন করেই বেঁচে থাকতে চায়। হোক না সেটা একা কিংবা নিঃস্ব হয়ে! একাকিত্বে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে। সবার ভাগ্যে সেই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ থাকে না। আর যার ভাগ্যে থাকে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কারো নেই।

২৬.
সৌহার্দ্য বাড়ি ফেরার পর থেকে তরীর সাথে একটা কথাও বলেনি। তরীর ভীষণ গায়ে লাগছে ব্যাপারটা। ঠান্ডা মাথায় রাগ করে কথা বন্ধ করে দেওয়া মানুষগুলো খুব ভ*য়ং*ক*র হয়। এদের রাগ ভাঙে না সহজে। তরী বিছানায় বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবছে কীভাবে সৌহার্দ্যের সাথে সব মিটমাট করিয়ে নেওয়া যায়!

সৌহার্দ্য খাওয়াদাওয়া শেষ করে আরো দশ মিনিট পর ঘরে ঢুকলো। তরী ওকে দেখে চমকালেও মুহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। সৌহার্দ্য ওর দিকে এক পলক তাকালো শুধু। তেমন পাত্তা না দিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। তরী হুড়মুড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্য তরীর পথ আগলে দাঁড়ানোতে খানিকটা চমকে গেল। ওকে অবাক করে দিয়ে তরী নিজের কান ধরে অসহায় মুখ করে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে হাতের ইশারায় বললো, সে আর কোনোদিন এরকম করবে না।

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় বোঝালো কথা দিতে। তরী সৌহার্দ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ওর মুখের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য ভ্রু নাচালো। তরী বুঝতে পারলো, কথা না দিলে সৌহার্দ্য ওর সাথে আর কথা বলবে না। ইতস্ততবোধ নিয়েই তরী বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্যের হাতের ওপর হাত রাখলো। সম্মতিপূর্ণ প্রথম স্পর্শ! হাতের দিকে সৌহার্দ্য অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। হাসির মানেটা তরী বুঝতে পারলো না। তরীর হাতটা আগলে নিয়ে ওর অবুঝ চাহনির দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য বললো,

-“ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।”

তরী মাথা নাড়িয়ে বিছানার দিকে চলে গেল। সৌহার্দ্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো অনেকক্ষণ। যখন ঘরে ফিরে এলো, তখন মাঝরাত। ঘড়ির কাঁটা তিনটার কাছাকাছি। তরী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ওর ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ সৌহার্দ্যের কানে আসছে। জানালা ভেদ করে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে, যার আলো সরাসরি তরীর মুখের ওপর পড়ছে। সৌহার্দ্য ওর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। তরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আপনমনে বললো,

-“আমার চাঁদের কাছে ঐ আকাশের চাঁদের সৌন্দর্য বরাবরই ফিকে হয়ে যায়। কারণ আমার চাঁদের পূর্ণিমায় প্রণয়াসক্ত হই আমি, যা ঐ সাধারণ চাঁদ কখনো করতে পারবে না আমায়! প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা শুধু আমার চাঁদ-ই আমার জীবনে নিয়ে আসতে পারে। শুধু আমার চাঁদেরই সেই ক্ষমতা আছে। কারণ সে আমার চাঁদ! শুধুমাত্র আমার!!”

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৬

-“সৌহার্দ্য তোকে ঠকিয়েছে! ভালোবাসার নাটক করেছে ও তোর সাথে। নয়তো এতো সহজে তোকে ভুলে গিয়ে ঐ বো*বা মেয়েটাকে নিজের বউ বলে মেনে নিল কেন? ওর নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে।”

নিজের বাবার বলা এতো গুলো কথায় কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও শেষোক্ত কথাটা শুনে অরুণী নড়েচড়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরমান সাহেবের রাগী মুখটার দিকে। পরমুহূর্তেই সকল সংশয় মন থেকে সরিয়েও নিলো। আবার দেয়ালের সাথে ঘেঁষে গুটিশুটি মে”রে বসে রইলো সে।

আরমান সাহেব অরুনীর পাশে গিয়ে বসলেন। মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন,

-“কেন এমন করছিস, মা? নিজেকে স্বাভাবিক কর। একটা প্রতারক ছেলের জন্য এভাবে নিজের জীবনটা শেষ করে দিবি?”

অরুণী র*ক্তি*ম দৃষ্টিতে তাকালো তার বাবার দিকে। ঝাড়া মেরে তার হাত সরিয়ে দিলো নিজের মাথার ওপর থেকে। কর্কশ গলায় বললো,

-“শাট-আপ, বাবা। সৌহার্দ্যকে প্রতারক বলার সাহস আর কখনো দেখাবে না। নয়তো আমি ভুলে যাবো যে, তুমি আমার বাবা।”

বলেই অরুনী হাতের কাছে থাকা একটা ফুলদানি অদূরে ছুঁড়ে ফেললো। আরমান সাহেব দ্রুতগতিতে সরে গেলেন নিজের মেয়ের কাছ থেকে। অরুণী ফোঁ*পা*চ্ছে প্রচন্ডভাবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সে। কাউকে আঘাত করতে না পেরে নিজেই নিজেকে আঘাত করছে অনবরত।

আরমান সাহেব চোখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। অরুণীকে এখন ঘুমের ওষুধ না দিলে ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কোনো মতেই সম্ভব নয়।

আরমান সাহেব পাশের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট নিলেন। হিসেব করে দেখলেন, তিনি অরুণীকে দ্বিতীয় ইনজেকশনটা দিয়েছেন এক সপ্তাহ আগে। এরপর থেকেই অরুণীর আচরণে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। তার মানে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই সবটা আগাচ্ছে। আজকে অরুণীকে তৃতীয় ইনজেকশনটা দেওয়াবেন তিনি। এজন্য ওর শ*রী*রে ঘুমের ইন*জে*ক*শন পুশ করাটা জরুরি। তাই তিনি তড়িৎ গতিতে সি*রি*ঞ্জ ফিল-ইন করে অরুণীর কাছে গেলেন। অরুণীর হাত ধরতেই সে ক্ষিপ্ত নজরে তাকালো। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরমান সাহেব বেশ নি*ষ্ঠু*র ভাবে অরুনীর হাতে ইন*জে*ক*শনের সূঁচটা গেঁথে দিলেন। অরুণী একটা চিৎকার দিলো। কিন্তু সেই চিৎকারের তীব্রতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেল আর অরুনী নিজেকে এলিয়ে দিলো কোনো এক অন্ধকার রাজ্যে।

-“দেখুন মিস্টার আরমান! আপনি যেটা চাইছেন, সেটার পরিণতি কিন্তু মোটেও ভালো হবে না। আমার তো এখন নিজের সন্দেহ হচ্ছে যে, এই মেয়েটা আপনার নিজের মেয়ে কি না! নিজের মেয়ে হলে ওর জীবনটা আপনি এভাবে নিজ দায়িত্বে নষ্ট কীভাবে করছেন?”

আরমান সাহেব ডাক্তারের দিকে রাগী দৃষ্টি তাক করে বললেন,

-“আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কী করবো সেটা আপনার বলে দিতে হবে না। ওর কীসে ভালো, কীসে মন্দ আমি বেশ ভালো করেই জানি ও বুঝি। আর আমি যা করছি ওর ভালোর জন্যই করছি।”

ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই মেয়েটা তার মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম উচ্ছ্বল ও হাসিখুশি মেয়ে ছিল। আর আজ? কোনো এক অজানা কারণে মেয়েটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিজেও কিছু করতে পারছেন না। এমন অপারগতা তাকে প্রচন্ড কষ্ট দিচ্ছে। আচ্ছা, তিনি যে অরুণীকে এভাবে নির্দোষ মনে করছেন! আসলেই কি সে নির্দোষ? নাকি এটা অরুণীর কোনো পাপের শাস্তি? বিষয়টা আসলেই জটিল!

২৭.
সকাল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে। ঠিক আকাশের মেঘের মতোই মন খারাপের কালচে মেঘ জড়ো হয়েছে তরীর মনেও।

‘স্বপ্ন’ জিনিসটা প্রচন্ড অদ্ভুত। আর সেই স্বপ্নের সাথে যখন জীবনের রঙ মিশে যায়, হাজারো আশার যোগসূত্র তৈরি হয়, যখন সেই স্বপ্ন পূরণের মাঝেই মানুষের জীবনের সুখগুলো পুঞ্জীভূত হতে হতে একাকার হয়ে যায়, ঠিক তখনই মানুষ স্বপ্নকে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ মনে করে। পৃথিবীর সকল কিছুর অস্তিত্ব সেই স্বপ্নের সামনে ফিকে হয়ে দাঁড়ায়! আর সেই স্বপ্ন ভঙ্গ যেন জীবনের সব রঙগুলো একমুহূর্তে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এমনটা হওয়ার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণ জড়িত বলে প্রায় সব মানুষ-ই এই রকম মানসিকতা নিজের ভেতর পুষে রাখে।
তরীর মানসিক পরিস্থিতি ঠিক সেরকমই বর্তমানে।

আজ তরী এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট দেখার পর থেকে নিজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেশ সন্দিহান। বেশ গুমোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে বারান্দায়। অনেকটায় নির্বিকার, নীরব সে আজ।

-“এভাবে মন খারাপ করলে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়- এই ধ্রুব সত্যটাকে মেনে নাও।”

তরী পেছন ঘুরলো না। সৌহার্দ্য প্রতিটি কথা তার ইন্দ্রিয়ে পৌঁছালেও তেমন ভাবাবেগ দেখালো না সে।
আচ্ছা, তার কি কান্না করা উচিত? কিন্তু তার যে হাজারো কষ্টেও কান্না পায় না। কাঁদতে সে ভুলেই গেছে সেই সুদীর্ঘ কাল আগে। মন থেকে শেষ যেদিন কেঁদেছিল, সেদিনই তার চোখের সব পানি ফুরিয়েছে। এরপর যতবার কাঁদতে হয়েছে, সবটাই ছিল নাটকীয়তা। লোকসম্মুখে ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিকতা উপস্থাপন করার অভিনয় মাত্র।

তরীর নীরব ভাবুক মুখশ্রীর দিকে সৌহার্দ্য নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু একটা ভেবে বললো,

-“সিলেক্টেড ক্যান্ডিডেট-দের লিস্টে তোমার নাম আসেনি তো কী হয়েছে? সরকারিতে নাই-বা হলো! আমি তোমাকে প্রাইভেটে পড়াবো।”

তরী শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। সৌহার্দ্যের মনে কী চলছে তা সে বুঝতে পারছে না। বোঝার চেষ্টাও তার মধ্যে নেই। জীবন থেকে একের পর এক জিনিস হারাতে হারাতে অনুভূতিরা সব মরে গেল নাকি?

সৌহার্দ্য পুনরায় কিছু বলার জন্য নড়ে উঠতেই তরী নিজের হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বোঝালো, সে ডাক্তার হবে না। সৌহার্দ্য অবাক হলো। তবে অসম্ভাব্যতা উপলব্ধি করতে পেরে মলিন হাসলো। হয়তো তরী বাস্তবতাটা বুঝতে পেরেছে। আবেগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্তটার অযৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে পেরেছে সে হয়তো। ভেবেই সৌহার্দ্য তরীর মাথায় আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে বললো,

-“তোমার হাতে আরো অনেক সুযোগ আছে, তরী! অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড-টাইম সিস্টেম আছে। আই উইশ, তুমি সেখান থেকে বেস্ট একটা সাবজেক্ট পাবে। শুধু আগের থেকে পড়াশোনায় মনযোগটা বাড়িয়ে দাও।”

একটা ভরসার হাত পেয়ে তরীর মনটা ভালো হয়ে গেল। কিছু না পাওয়ার মাঝেও অনেক প্রাপ্তি লুকিয়ে থাকে। তরী সুনয়নে সৌহার্দ্যের দিকে তাকাতেই সৌহার্দ্য কাজের কথা বলে চলে গেল। তরী ভাবতে লাগলো আনমনে অনেককিছু। অনেক চিন্তা, পরিকল্পনার আবহ ঘোরাঘুরি করতে লাগলো ওর মনোজগৎ জুড়ে।

সৌহার্দ্য গাড়িতে উঠেই প্রহরকে কল করলো। মিস্টার আফনাদের বলা কথাগুলোর পেছনের রহস্যটা জানতে হবে তাকে, আর এ ব্যাপারে শুধু প্রহর-ই সাহায্য করতে পারবে। কল দেওয়ার পর একবার রিং হতেই প্রহর রিসিভ করলো,

-“হোয়াট’স আপ, ড্যুড? আমাকে স্মরণ করার কারণ জানতে পারি?”

সৌহার্দ্য আনমনে হেসে দিলো। পরমুহূর্তে বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় আসতেই মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,

-“একটা দরকারে ফোন দিয়েছি আপনাকে, মিস্টার অভীক শাহরিয়ার। আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”

প্রহর নাকমুখ কুঁচকালো। বললো,

-“উফ! কেমনে পারিস তুই আমার সাথে এতো ফর্মালিটি দেখাতে? অসহ্য!! আমার ক্লাস ছিল আজকে। ক্যান্সেল করে দিচ্ছি, ওয়েট। পারলে চলে আয় জাহাঙ্গীরনগরে!”

-“ক্লাস ক্যান্সেল করতে হবে না। আমার জন্য কেন তুই এসব করতে যাবি? ফ্রি হয়ে তারপর না-হয়……”

-“শাট-আপ! আমি এখন কী করবো না করবো তোর কাছ থেকে শিখে নেবো না নিশ্চয়ই! আর তুই তো আসবি তোর বউকে নিয়ে কথা বলতেই! ভাবীর বেশ ভালোই ইফেক্টস পড়েছে তোর ওপর দেখছি। অরুণীর ভুত তোর মাথা থেকে নামিয়ে দিয়েছে। ভাল্লাগলো দেখে। আয়, তাহলে!”

-“আসছি! বিশ মিনিটের মতো লাগবে।”

সৌহার্দ্য কান থেকে ফোন নামিয়ে নিলো। ওয়ালেটের ভেতর থেকে চাবি বের করার সময় ওয়ালেটের একপাশ জুড়ে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে ছবিটায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবলো,

-“ধন্যবাদ, চাঁদ। আমার কাছে আবার ফিরে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। তুমি ফিরে আসবে আমি কোনোদিন এক্সপেক্ট-ই করিনি। তুমি না ফিরে এলেও আমার মনে তোমার স্থান তুমি পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলে। সেই স্থান আমি কাউকে দিতে পারতাম না। হয়তো দ্বিতীয় বার প্রেম আসতো আমার জীবনে! কিন্তু তোমার মতো কেউ হতো না। তোমার মতো প্রেমও আসতো না। তুমি অনন্য! আকাশের বুকে যেমন একটাই চাঁদ, আমার হৃদয়াকাশেও তুমি একমাত্র অনন্যা! আমার চাঁদ। ভীষণ ইচ্ছে করে তোমায় বুকে আগলে নিতে, তোমার সিক্ত প্রণয়ে পুরোপুরি আসক্ত হতে! একবার হারিয়ে যখন ফিরে পেয়েছি, তখন তোমায় নিজের সাথে সম্পূর্ণ আবদ্ধ করবোই আমি। ভালোবাসি, চাঁদ! মা-রা-ত্ম-ক ভালোবাসি!!!”

-চলবে…..

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ