প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৫+৬

0
2504

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৫

অরুণী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

-“কীহ্? তুমি বিয়ে করেছো, সৌহার্দ্য? তুমি…তুমি বিয়ে করেছো?”

বলেই অরুণী হাসলো। চোখভর্তি পানি নিয়েই হাসলো সে। সেই হাসি দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো সৌহার্দ্য। অরুণী তার দ্বারা এতো কষ্ট পাবে, সে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি। অরুণী জড়ানো কন্ঠে বললো,

-“আমি ভাবতেই পারছি না, আমার সৌহার্দ্য এখন আর আমার নেই। বিশ্বাস-ই হচ্ছে না! আচ্ছা, তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলছো না, তাই না? একবার বলবে যে, তুমি যা বলছো, তা মিথ্যে ছিল? শুধু একবার বলবে, প্লিজ?”

সৌহার্দ্য ঢোক গিললো। কান্নাগুলো গলায় আঁটকে আসছে তবুও। অরুণীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। অরুণী সেটা খেয়াল করলো। নিজের চোখ মুছে সৌহার্দ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাক টেনে কান্না দমিয়ে বললো,

-“আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসেছি, সৌহার্দ্য। যদিও ভালোবাসাটা আমার দিক থেকে প্রথম এসেছিল, তবে প্রেমটা কিন্তু দুজনের মধ্যেই ছিল। এই ছয় বছরে ‘বিয়ে’ শব্দটা যতবার শুনেছি, প্রতিবার তোমার পাশে নিজেকে কল্পনা করেছি আমি। আমার সেই কল্পনা আজ কাঁচের মতো ঝনঝন করে ভে*ঙে গেল। তুমি তোমার স্ত্রীকে মেনে নিয়েছো, তাই না?”

-“দেখো, অরুণী! তরীর সাথে আমার বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, অরুণী। টোটালি আনএক্সপেক্টেড! তরী শুধু কথা বলতে পারে না বলে ওর বিয়েটা ভে*ঙে গিয়েছিল। আমার এখনো মনে পড়ে, আশেপাশের লোকজন ওকে যা-নয়-তাই বলছি। মনে মনে ভাবছিলাম, কেউ কি নেই এই অসহায় মেয়েটাকে এই সমাজের কটুক্তির হাত থেকে রক্ষা করার মতো? আমার চোখের সামনে আজও ভাসে, বিয়ে ভে*ঙে গিয়েছে বলে তরীকে ওর সৎমা কীভাবে বিয়ের ভরা আসরে সবার সামনে চ*ড় মে*রে*ছি*ল!”

অরুণী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আমি আর কিছু শুনতে চাই না, সৌহার্দ্য। তুমি ঠিকই বলেছো! আমরা একে অপরের প্রেমে পড়তে পারি, একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারি। কিন্তু আমাদের মিলন সম্ভব নয়।”

অরুণী চলে গেল। সৌহার্দ্য ওকে আটকালো না। আটকানোর চেষ্টাও করলো না। ভাগ্য খুব যত্ন করে ওদের দুজনকে এক সুতোয় বেঁধেছিল। আর আজ ভাগ্য-ই নিজ দায়িত্বে একটানে সেই সুতো ছিঁ*ড়েও দিলো। কথায় বলে, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে! প্রচলিত এই কথাটার বাস্তব প্রয়োগও দেখে নিলো আজ তারা। তিনটি মানুষের সাথে যা ঘটলো, তা মোটেও ভালো কিছু ঘটেনি। কিন্তু এতে তাদের মধ্যে থেকে কাউকে দোষারোপ করাও যায় না। বাস্তবতা মাঝে মাঝে এমন অসঙ্গায়িত রূপ-ও দেখায়! অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় সে রূপ!!

১০.
নিজের কেবিনে বসে বসে হাতের কলম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কিছু চিন্তা করছে প্রহর। মাথার ভেতর একটা ভাবনা আরেকটা ভাবনার সাথে সং*ঘ*র্ষ করছে বারবার। কী অদ্ভুত বিষয়! এই প্রথম এমন একটা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো, যা ওকে বারবার দ্বিধান্বিত করছে।

-“স্যার, এই মাসে যে দুজন খু**ন হয়েছে, তারা দুজনেই সরকারী কর্মকর্তা। তাদের সকল ডিটেইলস এই ফাইলটাতে আছে।”

প্রহর চোখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ নিজের সেক্রেটারি রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,

-“মধুর ব্যাপারে কোনো আপডেট আছে?”

-“ইয়েস স্যার। সেদিন মাধুর্য ম্যাম কখন কী করেছেন, সব ডেটা কালেক্ট করেছি। এইযে, এই ফাইলটা রেডি করেছি আজকে।”

প্রহর ফাইল দুটো হাতে নিলো। সবগুলো পৃষ্ঠা মনযোগ সহকারে দেখলো। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“ফাইল দুটোতে সন্দেহজনক কিছু নেই, আর না আছে কোনো ক্লু।”

রিয়াদ প্রহরের দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,

-“কিন্তু স্যার, কেইস দুটো তো আলাদা। আপনি দুটোকে একসাথে মেলাতে চাইছেন কেন?”

-“রিয়াদ! খু*ন দুটোর সাথে মধুর ব্যাপারটার একটা সূক্ষ্ম সংযোগ আছে। আর এটা আমার ধারণা নয়, বরং আমি এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না, মধুকে বারবার শুধু অ্যা*ট্যা*ক করা হচ্ছে। কিন্তু ওদের দুজনের মতো ওকে মে*রে ফেলার কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে। সেদিন ওর স্কুটারে ধাক্কা দিয়ে ওকে মে*রে ফেলার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে। আমি চাই না, মধুর কোনো ক্ষতি হোক।”

বলেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো প্রহর। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা আসতেই ফট করে চোখ খুলে ফেললো সে। রিয়াদের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে আরেকবার দেখলো। চোখ ছোট ছোট করে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করে একটা ছবি দেখিয়ে বললো,

-“তরী! এই মেয়েটার ব্যাপারে সব ডিটেইলস আমার চাই। আজকের মধ্যে ওর সম্পর্কে এ টু জেড জেনে আমাকে জানাবে।”

১১.
অরুণী জানালার পাশে আনমনা হয়ে বসে আছে। হাতে একটা বই। অরুণীর বাবা আরমান সাহেব খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে মেয়ের পাশে বসলেন। অরুণী বাবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইয়ে মনযোগী হয়ে তাকালো।

আরমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“বইটা উল্টো ধরে পড়া প্র্যাকটিস করছিস নাকি, অরুণী!”

অরুণী থতমত খেয়ে গেল। বাবার দিকে অবাক চোখে তাকালো।

-“যতই প্রিটেন্ড করিস না কেন যে, তুই বই পড়ছিস! এই বাবার কাছ থেকে লুকাতে পারবি না। আমি সেই ছোট থেকে আমি তোকে নিজ হাতে বড় করেছি। তোকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চিনে না রে, মা!”

অরুণীর চোখে আবার পানি জমা হলো। কিন্তু বাবার সামনে সেটা প্রকাশ করার ইচ্ছে নেই। লুকিয়ে চোখের পানি মুছতেই আরমান সাহেব আবার বললেন,

-“সৌহার্দ্য বিয়ে করেছে, এটা আমিও শুনেছি। তুই ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? ও যখন তোকে ভুলে গিয়ে আরেকজনের সাথে সংসার করতে পারে, তাহলে তুই কেন ওর জন্য চোখের জল ফেলছিস?”

অরুণী ভা*ঙা কন্ঠে বললো,

-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা। আমি সহ্য করতে পারছি না। সৌহার্দ্যকে দোষ দিতে পারছি না আমি। ও আমাকে সত্যি ভালোবাসতো। তবে ওকে কেন আজ দোষী মনে হচ্ছে? আমি পারবো না এভাবে বেঁচে থাকতে, বাবা! আমি পারবো না।”

বলতে বলতে অরুণী ওর বাবার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-“তোর যতই মনে হোক যে সৌহার্দ্য দোষী নয়! ওর দোষ অবশ্যই আছে। ও তোকে কষ্ট দিয়ে নিজে তো ঠিকই স্বাভাবিক আছে। ওর জীবনকে তো ও থামিয়ে রাখেনও! এদিকে তুই একা একা গু*ম*রে মরছিস!”

-“আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকবো, বাবা? আমার সাথে কেন এমনটা হলো?”

আরমান সাহেব মেয়েকে বুঝিয়ে অনেক কষ্টে খাবার খাওয়ালেন। অরুণীকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছেন তিনি। সৌহার্দ্যের প্রতি রাগ ছিল না তার। রাগ ছিল মূলত সৌহার্দ্যের বাবার ওপর। কিন্তু এখন দুজনের প্রতি-ই ক্ষো*ভ জমা হয়েছে তার মনে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন,

-“তোদের বা*প-ছেলেকে দেখে নেব আমি!”

১২.
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

আজ আকাশটা একটু মেঘলা। বাতাসের বেগ প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি। দুপুরের দিকে বারান্দায় বসে বসে খোলা হাওয়ায় চুল শুকাচ্ছে আর বই পড়ছে তরী। উপন্যাসের পাতা উল্টাতে ভালোই লাগে তার! চরিত্রগুলোকে জী*ব*ন্ত মনে হয়।

তরীর পাশের বারান্দায় সৌহার্দ্য এসে দাঁড়ালো। দুজনের ঘর পাশাপাশি হওয়ায় বারান্দা দুটোও পাশাপাশি। এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। সৌহার্দ্য আশে পাশে তেমন খেয়াল না করেই সি’গা’রে’ট জ্বা*লা*লো। এই অভ্যাসটা আগে থেকেই ছিল তার। কিন্তু ইদানীং এটার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। আজকের অপারেশনটা আনসাকসেসফুল ছিল। রোগীটা মা*রা গেছে। রোগীর স্ত্রীর কান্নাটা এখনো চোখে ভাসছে তার। এই রকম দৃশ্য ডাক্তারদের জন্য খুবই সাধারণ ব্যাপার হলেও আজকে ঘটনাটা মনে লেগেছে তার। সি’গারে’টে টান দিতে দিতে সৌহার্দ্য আজকে কথাগুলোই ভাবছিল।

অরুণীকে প্রায়ই দেখে সে। অরুণী যেই হসপিটালে ইন্টার্নশিপ করছে, সেখানে আজও গিয়েছিল সৌহার্দ্য। অরুণীর সাথে মুখোমুখি দেখা হলেও কথা বলা হয়নি। অরুনীও তার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয় বার তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আচ্ছা মেয়েটা কী তাকে ভুলে গেল?

ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠল। ওর বাবার নাম্বার থেকে কল এসেছে। মিস্টার রায়হান এই অসময়ে ওকে কেন কল করবে? সৌহার্দ্য কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠে কেউ বললো,

-“এই ফোনের মালিকের অ্যা*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। মনে হয় বাঁচ*বে না!”

-চলবে……

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৬

-“তরী মেয়েটা খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। আফনাদ আহমেদ-এর প্রথম পক্ষের মেয়ে ও। প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন-ই দ্বিতীয় বিয়ে করেন আফনাদ। তরী তখন মাত্র সাত বছর বয়সের বাচ্চা একটা মেয়ে। ক্যা’ন্সা’র আক্রান্ত হয়ে মারা যান তরীর মা। তরীর জায়গা হয় সৎমায়ের সংসারে। প্রথমদিকে তরীকে আদর করতেন তার সৎমা। কারণ তরী সুন্দরী, মায়াবী আর কথা বলার অপারগতার কারণে তরীর প্রতি হয়তো তার মায়া লাগতো। কিন্তু সৎমায়ের সন্তান হওয়ার পর থেকে তরীর সাথে অন্য সব সাধারণ সৎমায়ের মতোই আচরণ করতেন তিনি।মেয়েটা এখন এডমিশন ক্যান্ডিডেট। বিয়ে হয়েছে, যদিও সংসার জীবনে সে সুখী নয় যতটুকু জানতে পারলাম।”

এতোক্ষণ রিয়াদের কথাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে শুনলেও শেষের কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকালো প্রহর। অবাক হলো খানিকটা। বললো,

-“মেয়েটা বিবাহিত? ভাবতেও পারিনি!”

বলেই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহর। সবটা জেনে কিছুটা ক্লু পেয়েছে সে। তাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু স্বস্তিটা কিছুক্ষণ স্থায়ীত্ব পাওয়ার আগেই রিয়াদ বললো,

-“ইয়েস, স্যার। জানতে পারলাম, নিউলি ইনটার্নড্ কার্ডিও-সার্জন ড. সৌহার্দ্য রায়হানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। আর ……”

-“হোয়াটটট্!!!”

রিয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রহর চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। হঠাৎ কথার মাঝে প্রহরের চিৎকার শুনে রিয়াদ ভয় পেল খানিকটা। অবাক হয়ে তাকাতেই প্রহর কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-“আর ইউ শিয়র? ড. সৌহার্দ্য রায়হানের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে? ”

-“হ্যাঁ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছি। তাদের বিয়ের ছবি কালেক্ট করা সম্ভব হয়েছে। এই যে, দেখুন!”

ছবি হাতে ধপ করে বসে পড়লো প্রহর। মাথায় হাত দিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

-“ও মাই গড!”

-“স্যার, আপনি এই সাধারণ মেয়েটাকে নিয়ে এতো কেন ভাবছেন? আমার তো ওকে কোনো দিক দিয়েই সন্দেহজনক বলে মনে হয় না।”

অনেকটা নিশ্চিতভাবেই অকপটে কথাটা বলে ফেললো রিয়াদ। প্রহর জহুরি নজরে তরীর ছবিটা পরখ করতে করতে বললো,

-“সাধারণের মাঝেও অসাধারণ অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে। হয়তো যা আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনেও অন্য কিছু আছে, যা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে! অনেক যোগসূত্র মিলিয়ে যা অনুধাবন করতে পারছি, তা এই মেয়েটার দিকেই আকৃষ্ট করছে আমাকে। ওর মাঝে বিশেষ কিছু আছে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের আরো গভীরভাবে জানতে হবে ওকে। কেন যেন মনে হচ্ছে, সব নাটের গুরু এই মেয়েটা-ই! তরী উরফ মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান!”

১৩.
তরীর পাশে বসে চোখের পানি ফেলছেন সুজাতা। তরীর চোখেও পানি টলমল করছে। সে কীভাবে তার মা-তুল্য শাশুড়ীকে সান্ত্বনা দিবে, বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সুজাতার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার চোখ মুছে দিচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ ওটির সামনে পায়চারী করছে।

ঘন্টা তিনেক পর সৌহার্দ্য ওটি থেকে বেরিয়ে এলো। বি”ধ্ব”স্ত দেখাচ্ছে ওকে। ক্লান্তি, বিষাদ আর তিক্ততা আশেপাশে থেকে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। ভাগ্য কিসের পরীক্ষা নিচ্ছে কে জানে!

তরী সৌহার্দ্যের থেকে সবসময় শত হাত দূরে থাকলেও আজ সব ভুলে সৌহার্দ্যের সামনে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ যে মানুষটা মৃ’ত্যু’র মুখে পতিত, সে তো তাকে নিজের বাবার থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছে! তার এই পরিস্থিতি কীভাবে সহ্য করছে, সেটা শুধু তরী নিজেই জানে।

তরীকে দেখে সৌহার্দ্য কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে গেল। মায়ের কান্না দেখে বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো সৌহার্দ্যের! সুজাতার পাশে বসে মাকে নিজের বুকে আগলে নিলো। নিজের চোখের পানিগুলো মুছে বললে,

-“বাবা ভালো আছে, মা। মাথায় আঘাত পেলেও এখন ডে’ঞ্জা’র-জোনের বাইরে আছে। দেখবে, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, বাবা! সবসময়ের মতো দিনভর আমায় বকাঝকা করবে। দেখে নিও।”

মা-ছেলের কান্ড দেখে তরী কান্নামাখা হাসি দিলো। অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি! এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। যাক! মিস্টার রায়হান ভালো আছেন এখন। আবার সৌহার্দ্যের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

-“এমনিতে তো গোম*ড়া*মুখো! তবে নিজের মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তোর ছেলেমেয়ে তোকে একদমই ভালোবাসবে না। দেখে নিস! এই তরীর অ*ভি*শা*প বিফলে যায় না।”

পরমুহূর্তেই নিজের চিন্তাধারা বুঝতে পেরে চোখ বড়বড় করে ফেললো। এসব কী ভাবছে সে? কী অদ্ভুত ব্যাপার!!

১৪.
বিছানায় বসে বসে অংক করছে মধু। ভাঙা বাঁ হাতটা নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছে সে! হাত ভালো থাকলেও পড়ায় মনযোগটা বসাতে পারতো না সে। পড়াশোনায় প্রচন্ড অনীহা তার ছোটবেলা থেকেই। অংক না পারার বিরক্তি হাতের ওপর ঢেলে বিরবির করে বললো,

-“এইসব ম্যাথ যে আবিষ্কার করেছে, তার জীবনে বিয়ে হবে না। ধুরর!! আর এই ভাঙা হাত কত বছর গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে ঘুরতে হবে কে জানে?”

বই-খাতা সরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে তরীকে একটা টেক্সট করলো মধু। একমাস পর কোচিংয়ে ক্লাস করতে গিয়েছিল আজকে সে। কিন্তু তরীকে কোথাও দেখতে পায়নি। তরী তো এমনি এমনি ক্লাস মিস দেওয়ার মেয়ে না!

ভানার মাঝেই কল এলো মধুর ফোনে। আননৌন নাম্বার। মধু কল রিসিভ করে বললো,

-“হ্যালো! কে বলছেন?”

-“কল রিসিভ করে ভদ্রতার সাথে সালাম দিতে হয়। মিনিমাম কমনসেন্স আর ভদ্রতা কি তোমার মধ্যে নেই?”

মধু অবাক হওয়ার আগেই রেগে গেল। মেয়েটা এমনই! ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেওয়ার বৈশিষ্ট্যটা তার ব্যক্তিত্বের কোথাও নেই!

-“কে রে তুই? রাত-বিরেতে মেয়েদের কল দিয়ে বিরক্ত করিস! আবার ভদ্রতা শেখাতে এসেছে আমাকে? তুই নিজে ভদ্র? ভদ্র হইলে কখনো অপরিচিত মানুষদের কল করে ‘তুমি’ সম্বোধন করতি না!”

ওপাশ থেকে অবাক কন্ঠ শোনা গেল,

-“মানে? আমি তো তাও ‘তুমি’ সম্বোধন করে কথা বলছি! তুমি তো একেবারে ‘তুই’-তে চলে গেলে! আশ্চর্য!! তুমি জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছো?”

মধু বিরক্তি নিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো,

-“না, জানি না। কার সাথে কথা বলছি জানিয়ে দিয়ে ফোন কা*ট্!”

ওপাশ থেকে দাতে দাত চেপে প্রহর বললো,

-“আমি প্র… মানে অভীক শাহরিয়ার। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।”

-“তো আমার কী? তোকে চিনি না, জানি না! ভয় কেন পাবো রে? আর বড় কথা হলো, আমি জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হবো না! আমি মেডিক্যালের জন্য পড়াশোনা করছি।”

প্রহর একগাল হাসলো। বললো,

-“মেডিক্যাল? হা হা হা! আর হাসিও না আমায়। তোমার মাথাভর্তি গোবর। এ দিয়ে মেডিক্যালে চান্স হবে তোমার? আর আমাদের ভার্সিটি তুমি চান্স পেলে তো ভর্তি হবে?”

মধু রাগী কন্ঠে বললো,

-“দেখ! আমি জানি আমি কোথাও চান্স পাবো না। দরকার হলে আমি প্রাইভেটে পড়বো। তাতে তোর কী বে?”

-“ইস, পুরো গোল্লায় গেছো দেখছি। মুখের ভাষা শুনে আমার মাথা ঘুরছে!”

-“প্যাঁচাল শোনার মুড নাই আর। তুই ফোন কাটবি? নাকি তোর মাথা ফাটাবো আমি?”

প্রহর বিরক্ত হয়ে ‘চ্’ ধরণের শব্দ করে বললো,

-“তোমাকে এখন আমার সাথে দেখা করতে হবে। হোস্টেলের গেস্টরুমে বসে আছি আমি।”

-“মগের মুল্লুক। তোর সাথে দে…..”

মধুর চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই প্রহর বললো,

-“তুমি না এলে কিন্তু আমি এখানে নিজেকে তোমার হাসবেন্ড বলে পরিচয় দেব। আমি সাথে একটা নকল রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে এসেছি। কীসের রেজিস্ট্রি পেপার, জানো? তোমার আর আমার বিয়ের!”

প্রহর গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে। মধু প্রচন্ড অবাক হলো। রেগেও গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“আজ তোর একদিন, নয়তো আমার একদিন! ”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এই ছেলের আজ বারোটা না বাজালে ওর শান্তি নেই। গেস্ট রুমে এসে দেখলো, শুধু একটা ছেলে বসে আছে। ছেলেটার মুখ দেখে মধু থমকালো। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-“আপনাকে এতো চেনা চেনা লাগছে কেন? আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো!”

-চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে