#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#অন্তিম_পর্ব
“এই বাচ্চা দু’টো তোমার কে হয়?”
তরীর হতবিহ্বল দৃষ্টি আর এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে সৌহার্দ্যের ভ্রুযুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেল। কিছুক্ষণ একভাবেই তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্য। তরীর প্রশ্নটা হয়তো ওর হজম হচ্ছে না! ভ্রূকুটি করে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
“মাথায় কোনো প্রব্লেম হলে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। আর যদি এটা যদি তোমার নতুন কোনো নাটক বা অভিনয় হয়, তাহলে আমার পথ ছাড়ো। প্রণয়ের পায়ে বেশ আঘাত লেগেছে।”
তরী নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য সেটা একবার দেখেও এড়িয়ে গেল। প্রণয়কে কোলে নিয়ে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। প্রণয়ী তরীর কাছে এসে দাঁড়ালো। তরী রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসেছিল। প্রণয়ী ওর কাছে গিয়ে ওর মুখে নিজের ছোট ছোট হাত দু’টো ছুঁইয়ে দিলো। নিষ্পাপ হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো,
“তুমি অনেক সুন্দর, আন্টি!”
তরীর চোখ দুটো চকচক করছে। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করছে! নিজের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে দ্বিধান্বিত হয়ে গেল সে।
প্রণয়ীকে নিজের সাথে হাঁটতে না দেখে থেমে গেল সৌহার্দ্য। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, প্রণয়ী তরীর সাথে কী যেন বলছে! সৌহার্দ্য গলা ঝেড়ে প্রণয়ীকে ডাক দিলো,
“প্রিন্সেস! এসো তাড়াতাড়ি। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
প্রণয়ী সৌহার্দ্যের দিকে একবার তাকিয়ে তরীর থেকে দূরে সরে আসতে আসতে বললো,
“আসছি, পাপা।”
প্রণয়ী ছুটে চলে গেল সৌহার্দ্যের পিছে পিছে। তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ওদের দিকে। সৌহার্দ্যকে ‘পাপা’ বলে ডাকলো? সে ঠিক শুনলো তো? পাপা বলে কেন ডাকলো? তরী সপ্রতিভ চোখে তাকাতেই দেখলো, সৌহার্দ্যের গাড়ি ইতোমধ্যে দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে গেছে।
তরী যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কোনো রকমে পা টেনে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মস্তিষ্ক ক্রমেই সচল হতে থাকলো ওর।
প্রথমত, অর্থী প্রথম দিন প্রণয়-প্রণয়ীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল, ওরা অর্থীর ভাইয়ের বন্ধুর ছেলেমেয়ে। ভাইয়ের বন্ধু মানে প্রহরের বন্ধু! আর প্রহরের বন্ধু মানে তো সৌহার্দ্য-ই!
দ্বিতীয়ত, হসপিটালে প্রণয়ীর সাথে কাল হসপিটালে দেখা হওয়ার পর ও বলেছিল, ওর পাপাও সেই হসপিটালের ডক্টর। এই বিষয়গুলো ওর মস্তিষ্কে আগে কেন নাড়া দেয়নি? ভেবেই তরীর নিজের প্রতি ক্রোধ জমা হলো মনে। হতভম্ব দৃষ্টি ক্রমশ কুঞ্চিত হতে লাগলো। ঠোঁট ভেঙে এলো। ভয়ানক কান্নারা হানা দেওয়ায় তৎপর হতেই তরী একহাতে নিজের মুখের নিম্নভাগ চেপে ধরলো। তার সন্তান দু’টো আজও বেঁচে আছে। শুধুমাত্র একটা ভুল তথ্য তার জীবনের মোড় এভাবে ঘুরিয়ে দিলো! চোখের কোণ বেয়ে মোটা মোটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়তে লাগলো তরীর।
সৌহার্দ্য বেশ থমথমে মুখে প্রণয়ের পায়ে ব্যান্ডেজ করছে। প্রণয়-প্রণয়ী দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। তবে ওদের দুজনের চোখে মুখে থাকা ভীতি সৌহার্দ্যের চোখে অনেক আগেই ধরা পড়েছে। তাই সে এখনো কিছু বলছে না।
হঠাৎ সৌহার্দ্যের চেম্বারে প্রহর প্রবেশ করলো। কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিয়েও সেটা বলতে পারলো না। বরং অবাক হয়ে প্রণয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এ কি? ওর হাঁটুতে কী হয়েছে?”
“ছিঁলে গেছে আবার! সারাদিন ছুটোছুটি করলে তো ব্যথা লাগবেই!” সৌহার্দ্যের ক্লান্ত ও হতাশ কন্ঠ।
প্রহর প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে কাতর কন্ঠে বললো,
“ইশ! অনেক ব্যথা হচ্ছে, তাই না?”
প্রণয় তড়িৎ গতিতে না বোধক মাথা নাড়িয়েও আবার মুখ ছোট করে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ালো। সৌহার্দ্য সেটা দেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“যাইহোক! তুই কিছু বলবি? এই সময়ে আমার সাথে দেখা করতে এলি যে!”
“আসলে আমি কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যাচ্ছি। তাই জানাতে এলাম!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তো ফোনে জানিয়ে দিলেও তো পারতি!”
“ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই রিসিভ করছিলি না। এছাড়া কেন যেন ইচ্ছে করছিল তোর সাথে একবার দেখা করে যেতে। তাই নিজের মনকে আর আটকালাম না। চলে এলাম।”
সৌহার্দ্য মলিন হাসলো। বললো, “কবে ফিরছিস তাহলে?”
“দু-এক সপ্তাহ পর।” বলেই প্রণয়-প্রণয়ীকে চুমু দিলো প্রহর।
সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরতেই সৌহার্দ্য হাসি হাসি মুখে বললো,
“বিদেশে যাওয়ার আগেও তো এতো ভালোবাসা দেখাতি না কখনো! আজ হঠাৎ এমন জড়াজড়ি করছিস যে?”
প্রহর ম্লান মুখে হেসে বললো,
“জানি না, ইয়ার! হঠাৎ খুব করে ইচ্ছে হলো। আসি।”
সৌহার্দ্য প্রহরকে বিদায় জানিয়ে প্রণয়-প্রণয়ীকে বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য বেরিয়ে গেল।
৫৬.
তরী সৌহার্দ্যের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো। নিজের কম্পিত হাতে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এতোবছর নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত সাহসী মনে হলেও আজ তরী বুঝতে পারছে, সে একটা জায়গায় অনেক দূর্বল। আর সেই দূর্বলতার নাম সৌহার্দ্য। প্রণয়-প্রণয়ীর আগমনে দূর্বলতার ভিত যেন আরো বেশি মজবুত হয়ে গেছে।
গাড়িটা পার্ক করে গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তরী। সৌহার্দ্যের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কম্পিত হাতে কলিং বেল বাজালো। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে ওর। এই অদ্ভুত হৃদকম্পন কি অন্যরাও শুনে ফেলবে? সবাই কি বুঝে ফেলবে যে, তরী ভয় পাচ্ছে? সেই অতিমাত্রায় সাহসী তরী আজ ভীতসন্তস্ত্র! ব্যাপারটা হজম করতে পারবে তো সবাই?
ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার আওয়াজে কেঁপে উঠল তরী। বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠলো যেন! চকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখলো সেই বৃদ্ধা রমনীকে, যে একসময় চাঁদ বলতে অজ্ঞান ছিল। সে হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। হয়তো চোখের জ্যোতি অনেক কমে গেছে বার্ধক্যের ভারে।
“কে? কেডা তুমি?”
হাতের লাঠি তরীর দিকে তাক করে প্রশ্ন করলো সৌহার্দ্যের দাদী। তরী অবাক চোখে তাকালো। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো মুহুর্তেই! কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আমায় তুমি চিনতে পারছো না, দাদী?”
অকস্মাৎ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দাদী। হতবিহ্বল হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। কয়েক পা এগিয়ে তরীর বাহুতে হাত রেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নিজের হাত দিয়ে তরীর মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বললো,
“চাঁদ? তুই আমাদের তরী? নাকি আমি কানে ভুল শুনলাম?”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার মানে দাদী এখন চোখে ঠিক মতো দেখতে পায় না? আর সৌহার্দ্যও এবাড়ির কাউকে ওর ব্যাপারে জানায়নি? এতো অভিমান! হয়তো অভিমান করাটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘশ্বাস ফেললো চোখের পানি মুছলো তরী। নাক টেনে বললো,
“হ্যাঁ, দাদী! আমি এসেছি। তোমাদের তরী। আমাকে দেখতে পাচ্ছো না তুমি?”
দাদী নির্বাক হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাড়ির সবাইকে ডাকা শুরু করে দিলেন,
“বউমা, রায়হান, সৌহার্দ্য রে! কে কোথায় আছিস? দেখ কে এসেছে? কই তোরা সবাই? দেইখা যা!”
“কে এসেছে, মা? এভাবে ডাকছেন….. ”
সুজাতা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে তরীর দিকে নজর পড়তেই তার কথা আটকে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তরীর মুখের দিকে। সৌহার্দ্যের বাবার হাত ঘড়ি পরতে পরতে এগিয়ে এসে বললেন,
“আমি একটু চেকআপের জন্য সৌহার্দ্যের হসপিটালে যাচ্ছি। বুঝলে, সুজাতা?”
সুজাতা কোনো উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিস্টার রায়হান বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কিছু বলছি তোমাকে! ঐ দিকে তাকিয়ে আছো কেন এভাবে? কী আছে ঐ দি….”
মেইনডোরের দিকে তাকিয়ে মিস্টার রায়হানও বিস্মিত হলেন। হতভম্ব কন্ঠে বললেন,
“তরী?”
এতো বছর পর নিজের কাছের মানুষগুলোকে দেখে আবেগান্বিত হলো তরী। এক পা এগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে কানে ভেসে এলো কারো গাম্ভীর্যপূর্ণ বাক্যস্রোত,
“কেন এখানে এসেছো তুমি?”
পেছন ঘুরে তাকালো তরী। সৌহার্দ্য এসেছে, সাথে প্রণয়-প্রণয়ী। দু’জনকে দুইহাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সৌহার্দ্য। চোখে মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা, যা তরীর অচেনা, আবার অনেকটা চেনাও!
তরী টলমলে চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার বাচ্চারা!”
প্রণয়-প্রণয়ী অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এতো বছরে মনে পড়লো? দেরীটা একটু বেশি-ই হয়ে গেল না?”
“তুমি আমায় ভুল বুঝছো, সৌহার্দ্য!”
তরীর বিমর্ষ দৃষ্টি মেলে তাকালো। সেই চোখে চোখ পড়তেই সৌহার্দ্য নিজের ভেতরে সেই চিরপরিচিত আলোড়ন অনুভব করলো। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! এই এক অনুভূতির সামনে রাজ্যের সব রাগ, দুঃখ, অভিমান যেন নিজেদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়! একটা শ্বাস টেনে সৌহার্দ্য নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। কোনোরকমে নিজের দৃঢ়তা বজায় রেখে বললো,
“যখন আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন ছিল, তখন তুমি ছিলে না। তবুও আমার বিশ্বাস ছিল, একদিন তুমি আসবে। সেই দিনটা সম্ভবত আজ! কিন্তু একটা তিক্ততাপূর্ণ সত্য কি জানো? আজ তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি আমি।”
তরী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমাকে ছাড়া?”
“হ্যাঁ, তোমাকে ছাড়া। দূরত্ব যেমন ভালোবাসা বাড়ায়, ঠিক তেমনি মানুষকে ভেতর থেকে পাথর বানিয়ে তোলে। একসময় ভাবতাম তোমাকে ছাড়া হয়তো বাঁচতেই পারবো না! হয়তো এমনটাই হতো যদি তুমি আমায় শূন্য করে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু না! তুমি আমাকে বেঁচে থাকার কারণ দিয়েছিলে। প্রণয়-প্রণয়ীকে রেখে গিয়েছিলে। ওদের জন্যই এতোবছর বেঁচে আছি আমি। আর বাকি জীবন ওদের জন্যই কাটিয়ে দিতে পারবো।”
সৌহার্দ্য প্রণয়-প্রণয়ীর দুই হাত ধরে তরীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তরী কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। কীভাবে আটকাবে সে ওদের? হঠাৎ পেছন থেকে সৌহার্দ্যের গলা শুনতে পেল তরী,
“কিন্তু আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন না থাকলেও প্রণয়-প্রণয়ীর জীবনে ওদের মায়ের প্রয়োজন আছে। আমি চাই না, ওরা সারাজীবন মায়ের অভাব অনুভব করুক। কারণ আমি পৃথিবীর সেরা বাবা হলেও প্রণয়-প্রণয়ীর মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবো না।”
সৌহার্দ্য প্রণয়-প্রণয়ীর হাত ছেড়ে দিলো। অগত্যা দৃপ্ত পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। একবারের জন্যও পেছন ঘুরে তাকালো না। প্রণয়-প্রণয়ী সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ঘুরিয়ে তরীর মুখের দিকে তাকালো।
তরী হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। হয়তো সে ভাবতেই পারেনি, সৌহার্দ্য এমন কোনো কথা বলবে! সৌহার্দ্যের কথাটা হজম হচ্ছে না ওর।
“তার মানে তুমিই আমার মা?”
হঠাৎ নিজের হাতে টান অনুভব করায় চোখ নামিয়ে সামনে তাকালো তরী। প্রণয়ী ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশেই প্রণয় এসে দাঁড়ালো। ওর চোখ দুটো পানিতে ছলছল করছে। প্রণয় কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে বললো,
“তোমার কথায় কেমন যেন মায়ের শাসনের সুর ভেসে আসতো কানে! এজন্য তোমায় আমার একটুও ভালো লাগতো না। আমার মায়ের জায়গায় কেউ বসতে চাইলে সহ্য-ই হতো না আমার! তুমি কি সত্যি সত্যিই আমাদের মা? পাপা কি সত্যি বলে গেল আমাদের?”
তরী কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সব আবেগ গলায় এসে আটকে গেল। বুক ভার হয়ে এলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাপানির স্রোতে কোনো বাঁধা না দিয়েয় হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো তরী। মাথা নাড়িয়ে কোনোরকমে ‘হ্যাঁ’ বলে দু’হাতে নিজের বুকে আগলে নিলো প্রণয়-প্রণয়ী। ওদের সারা মুখে অগণিত চুমু এঁকে দিলো। জীবনে প্রথমবারের মতো মায়ের আদর পেয়ে চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো প্রণয়-প্রণয়ীর। দূর থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে মুখে হাসি ফুটলো সৌহার্দ্যেরও!
৫৭.
অর্থী হসপিটাল থেকে ফিরছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। গাড়ির জানালা ভেদ করে বাইরে চোখ পড়তেই অবাক হলো সে। পাশের পার্কে ঘাসের ওপর একা একা বসে আছে অর্ণব। দূর থেকে হলেও অর্ণবকে চিনতে অসুবিধা হলো না অর্থীর। হুট করে গাড়ি থামিয়ে চলে গেল অর্ণবের সাথে কথা বলতে।
“একা একা কী করছিস এখানে? কাউকে মিস করছিস?”
অর্থী এসে হুট করে অর্ণবের পাশে এসে বসলো। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে অর্থীর দিকে তাকালো। বললো,
“তুই?”
“কেন? অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করছিলি মনে হচ্ছে?” অর্থী ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো।
“মন-মেজাজ ভালো নেই। তোর খোঁচা মারা শেষ হলে যেতে পারিস!” অর্ণবের চোখে মুখে বিরক্তি। অর্থী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ হতাশার শ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
অর্থীকে পা ঘুরিয়ে চলে যেতে দেখে অর্ণব অবাক হলো। মেয়েটা ওর কথা শোনা শুরু করলো কবে থেকে? বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“চলে যাচ্ছিস?”
“তুমিই তো চলে যেতে বললে!”
“আমি বললেই চলে যাবি?”
অর্থী থামলো। মুখ ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার প্রশ্ন বুঝিনি আমি।”
“বুঝতে হবে না। পাশে এসে বোস!”
অর্থী দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে পুনরায় পাশে গিয়ে বসলো। অর্ণব খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তরীর সাথে কথা হয়েছে তোর?”
“হয়েছে। ভালো আছে ও। সৌহার্দ্য যদিও এখনও রেগে আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে শীঘ্রই!”
“সৌহার্দ্য রেগে আছে কেন? তরীর তো কোনো দোষ নেই! ”
“সৌহার্দ্য ভাইয়া ভাবছে তরী সব জেনেও নিজের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে ছিল। কিন্তু তরী জানতো, ওর বাচ্চারা মারা গেছে। আমরাও তো জানাইনি তরীকে কিছু। একটা মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।”
“ও সুখে থাকলেই চলবে।”
অর্ণবের কথায় ওর দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো অর্থী। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“তরীর জীবনে সুখের একমাত্র নাম হলো সৌহার্দ্য। ওকে ওর সুখ থেকে এতোবছর দূরে সরিয়ে রেখে এখন আবার তরীর সুখের আশা করছিস?”
অর্ণব গুরুতর ভঙ্গিতে বললো,
“সৌহার্দ্যের সঙ্গ ওর জীবনে শুধু দুঃখ-ই এনেছে। এজন্যই ওকে দূরে সরিয়েছিলাম আমরা।”
অর্থী মলিন হাসলো। ক্ষণিকের নীরবতা শেষে প্রশ্ন করলো,
“শুধু দুঃখ থেকে দূরে সরানোই উদ্দেশ্য ছিল। তরীকে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তোর?”
“সেই অন্যায় ইচ্ছেকে তো সেদিনই মেরে ফেলেছিলাম, যেদিন তরীর চোখে সৌহার্দ্যের জন্য প্রেম দেখেছিলাম।” অর্ণবের মুখে দুর্বোধ্য হাসি। “ভালোবাসলেই পাওয়ার ইচ্ছে রাখতে নেই। ভালোবাসা মানে স্বার্থহীনতা, প্রিয়জনের সুখের জন্য ত্যাগ বরণ করা।”
“তুমি তো ত্যাগ করোনি!”
“করেছিলাম। আমি সবসময় চেয়েছি সৌহার্দ্যের সাথে তরী সুখে থাকুক। কিন্তু আমি এটাও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তরীর একফোঁটা চলো জলের কারণ সৌহার্দ্য হলে সৌহার্দ্য তরীকে হারাবে। এটা সৌহার্দ্যও জানতো। এর ফলও ভোগ করেছে ও।”
অর্থী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছেলেটাকে আজীবন একটা নিকৃষ্ট মানুষের নজরে দেখেছে ও। কিন্তু ভাবেইনি যে, এই মানুষটা এতোটা স্বার্থহীন! ভাবনার মাঝে অর্ণবের হতাশ কন্ঠ শুনতে পেল অর্থী,
“তরী কোনোদিনও আমার হতো না। এক তরফা ভালোবেসেছি ওকে আমি। এই সত্যটা অনেক আগেই মেনে নিয়েছিলাম।”
“তাহলে বাকি জীবন কি একাই কাটাতে?”
“একা কেন কাটাবো? সারাজীবন ব্যর্থ-প্রেমিকের মতো কাটায় কেউ? বিয়ে তো করতামই!”
“কাকে?” অর্থী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।
“তোকে!” অর্ণবের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। অর্থী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
অর্ণব চিন্তিত মুখে বললো,
“মেডিক্যাল স্টুডেন্ট থাকাকালীন সময় থেকে আমায় ভালোবাসিস! সেই ভালোবাসার কারণে পড়াশোনা শেষ করার পরও দেশে ফিরিসনি। এতো বছর আমার জন্য কুমারী থেকে গেলি? এখন কি আমায় রিজেক্ট করবি? করলেও সমস্যা নেই! তুলে নিয়ে বিয়ে করবো। কিন্তু বিয়ে তো আমি তোকেই করছি! প্রেমটা না-হয় তোর সাথে বিয়ের পড়েই হবে!”
৫৮.
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অরুণী চট্টগ্রামে চলে এসেছে। এখানকার গ্রামীণ এলাকার একটা ক্লিনিকে রোজ বসে সে। ডক্টর নামক ব্যক্তি এখানে দূর্লভ-ই বলা চলে! সকল হাতুড়ে চিকিৎসকদের ভীড়ে নিজের অবস্থান বেশ শক্ত করে ফেলেছে সে ইতোমধ্যে। তবুও নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হয় নিজের চোখে। জীবনে কম অপকর্ম তো সে করেনি! নিজের স্বার্থের কথা ভেবে একাধিক খু*ন করেছে সে। ভাবনার মাঝেই কেউ এসে বললো,
“ম্যাম, পাশেই একজনের বাসায় গিয়ে একটা পেশেন্ট দেখে আসতে হবে!”
“এ আর নতুন কী? চলো!”
অরুণী বেরিয়ে গেল ক্লিনিক থেকে। এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে আজ। কাল রাতে ঝড় হয়েছিল। এরপর থেকে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। অরুণী যখন গন্তব্যে পৌঁছালো, তখন চারপাশে অন্ধকার। ফোনের আলো জ্বালিয়ে কোনোরকমে বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। একতলা আলিশান বাড়ি। চার-পাঁচজন সার্ভেন্ট আছে, তবে সবাই-ই মেয়ে। ব্যাপারটায় কিছুটা অবাক হলো অরুণী। ভেতরে প্রবেশ করতেই অন্ধকারে কারো গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো,
“ডক্টর এসেছে?”
গলাটা পরিচিত লাগলো অরুণীর। কিন্তু হঠাৎ শোনায় ধরতে পারলো না কার গলা। পাশের মহিলাটা বললো,
“জ্বি, স্যার। ভেতরে নিয়ে যাবো?”
“মেয়ে নাকি ছেলে?”
“মেয়ে!”
লোক হাত তুলে ইশারায় অনুমতি দিলো। অরুণী ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। সার্ভেন্ট মোমের আলো নিয়ে এলো। একটা মেয়ে মুখ গলা পর্যন্ত ঘোমটা টেনে বসে আছে। অরুণী গিয়ে মেয়েটার পাশে বসে বললো,
“অনেক কনজার্ভেটিভ পরিবার মনে হচ্ছে। আমার সামনে এভাবে বসতে হবে না। দেখি, তাকাও আমার দিকে!”
মেয়েটা একচোখ উন্মুক্ত করে অরুণীর দিকে তাকালো। কিন্তু তার ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে অরুণীর মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল না। বললো,
“তোমার কন্ঠটা এতো পরিচিত লাগছে কেন? কে তুমি?”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে বললো, “পরিচিত তো আমারও লাগছে! তুমি কে বলো তো!”
“ও যে-ই হোক! তোর জানতে হবে না। চলে যা আমার বাড়ি থেকে।”
অরুণী অবাক হয়ে পেছন ঘুরে তাকালো। প্রহরকে দেখে বিস্মিত চোখে একবার প্রহরের দিকে, আরেকবার বিছানায় বসা মেয়েটার দিকে তাকালো।
“তার মানে এটা মধু? ও মারা যায়নি! তুই ওকে লুকিয়ে রেখেছিস?”
“তুই এটা জেনেছিস! আর কেউ যেন এসব জানে!”
অরুণী অতিমাত্রায় অবাক হয়ে বললো,
“মানে? তুই কীভাবে করেছিস এসব? মধু কীভাবে তোর কাছে এলো? এসব কীভাবে সম্ভব?”
প্রহর অরুণীকে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে এনে চাপা কন্ঠে বললো,
“সব রহস্যের গভীরে ঢুকতে নেই। তোরও এতো প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে না।”
অরুণী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তাহলে কি তুই ওকে সারাজীবন লুকিয়ে রাখবি?”
“যেদিন ও পৃথিবীর বুকে স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়াতে পারবে, সেদিনই ওর পরিচয় প্রকাশ করবো আমি।”
অরুণী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রহরের দিকে। এতো বড় একটা সত্য এতো বছর সবার চোখ থেকে কীভাবে আড়াল করে রেখেছে প্রহর?
★পরিশিষ্ট★
একবছর পর……..
নিজের চেম্বারে বসে কয়েকটা কেইসের ফাইল ঘাঁটছে মধু। চোখে মোটা চশমা আর মুখের একপাশ ওড়নায় ঢাকা। হঠাৎ তরী ভেতরে এসে প্রবেশ করলো। বিনা অনুমতিতেই চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“উকিল সাহেবা, আপনার ব্যস্ততা কাটলে আমার কথা একটু শুনবেন?”
মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তুই নিজেই তো ব্যস্ত মানুষ! তোর সময় আছে আমার কথা শোনার?”
তরী আফসোসের সুরে বললো,
“আমি তো এতো বছরেও নিজের নাম বিখ্যাত করতে পারলাম না। আর তুই? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সমাজের সবার মুখে সুপরিচিত একটা ব্যক্তি হয়ে গেলি! অসহায়, নির্যাতিত মেয়েদের একটা বিশ্বস্ত অবলম্বন আপনি।”
মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আচ্ছা? এখানে এসব কথা বলতে এসেছিস?”
“নাহ্, প্রহর ভাইয়ার সাথে এসেছি। ভাইয়া গাড়িতে বসে বসে বলছিলো, কত জোর খাঁটিয়ে এতো বছর তোকে পড়াশোনা করিয়েছে!”
মধু আনমনে হেসে বললো,
“আমার মনের জোর তো ও-ই ছিল! যত দূরে ঠেলেছি, সে তত কাছে এসেছি। যতবার ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছি, ততবার আমায় জুড়ে দিয়েছে। এক চোখের অন্ধত্বে সেই চোখের দৃষ্টি হয়েছে প্রহর। যাইহোক, তুই কেন এসেছিস? সেটা বল!
তরী হতাশ গলায় বললো, “ভুলে গেলি? আজ প্রণয়-প্রণয়ীর জন্মদিন।”
“আরেহ্, আমি তো ভুলেই গেছি! কিন্তু আমি এখন…..”
“সরি, ম্যাম! ডিস্টার্ব করার জন্য। আসলে একজন নতুন এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। সেটার ফাইল জমা দিতে এলাম!”
মধু পিএ-এর দিকে তাকিয়ে বললো, “রেখে যাও!”
পিএ ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল। তরী উৎসুক হয়ে ফাইলটা হাতে নিয়ে বললো,
“আমি একটু দেখি, হ্যা? আমার এসব কেইস নিয়ে জানার ইচ্ছে অনেক!”
মধু হেসে বললো, “আচ্ছা, পড়!”
তরী ফাইলটা হাতে নিলো৷ একটা ষোড়শী মেয়ের কেইস। মেয়েটার চোখের সামনে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে আর সেই মৃত্যুর কারণ হলো মেয়েটার বাবা। মেয়েটা নিজের বাবার বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছে। সাক্ষ্য থাকলেও যথেষ্ট প্রমাণ নেই এখানে। মেয়েটার মধ্যে নিজের সত্তাকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারলো তরী। তরী মনেপ্রাণে চায়, মেয়েটা সৌহার্দ্যের চাঁদের মতো হোক, তবে প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমার ‘তরী’ না হোক। কে জানে? তার এই ইচ্ছে পূরণ হবে কি না! হয়তো এজন্যই লোকে বলে, “ইতিহাস বারবার ফিরে আসে!”
🖤সমাপ্ত🖤