#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৩
সৌহার্দ্য তরীর কথা ভাবতেই বিরক্ত হলো। মেয়েটাকে সহ্য-ই হচ্ছে না। ফ্রেশ হয়ে ফোনটা একবার চেক করলো। অরুণী কোনো কল বা মেসেজ করেনি। করবেই-বা কেন? নিজে থেকেই তো কষ্ট দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো ওকে! নাহ! অরুণী ওর জীবনের সাথে মিশে গিয়েছে। মেয়েটাকে ভুলতে তো পারছেই না! আবার গ্রহন করার পথে হাজারো বাধা। উচিত-অনুচিত নিয়ে এক গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে গেল সৌহার্দ্য।
তরী দৌড়ে এসে ড্রয়িং রুমে মিসেস সুজাতার সামনে বসে হাপাতে লাগলো। সুজাতার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। সৌহার্দ্যের কথাগুলো তার ভেতরটায় অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যতই হোক, তিনি একজন মা। বাবারা নিজেদের শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখতে পারলেও মায়েরা পারে না। ছেলের শেষোক্ত কথাটা সুজাতার মনকে নাড়া দিয়েছে। বারবার কানে বাজছে কথাটা,
-“আমি ভালো নেই, মা! আমি ভালো নেই!”
কিন্তু অরুণীকে সৌহার্দ্য কখনো নিজের করে পেতে পারবে না। সেই পথ যে প্রথম থেকেই বন্ধ ছিল! সুজাতা চেয়েও এটা সৌহার্দ্যকে কখনো বলতে পারেননি। ভাবনার মাঝে তরীর দিকে নজর যেতেই সুজাতা ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন,
-“এখানে বসে আছো কেন? সৌহার্দ্য কিছু বলেছে তোমায়?”
তরী ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বললো। সৌহার্দ্যকে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। সুজাতা চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর তরীকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো,
-“এই ঘরে এখন থেকে তুমি থাকবে। আগে একজন ছিল। সে তো এখন আর নেই! জানি না আর ফিরবে কি না! তাই এখানে এখন থেকে তুমি থাকবে।”
তরী চারপাশে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
-“ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও। তোমায় নিয়ে বের হব আমি একটু পর।”
বলেই সুজাতা বেরিয়ে গেলেন। সৌহার্দ্য-ও এখনো কিছু খায়নি- ভেবে কিচেনে ছুটে গেলেন।
৬.
মিসেস সুজাতা সারাদিন তরীকে নিয়ে অনেক কিছু কেনাকাটা করলেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেনও। বিকেলবেলায় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য একটা ভালো কোচিং-সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এডমিশন সিজন বলে কোচিং-এ এখন অনেক ভীড়। সুজাতা ফর্ম তুলে এনে তরীর হাতে দিয়ে বললেন,
-“এটা ফিল-আপ করে সামনের ওই রুমে গিয়ে জমা দিয়ে আসিস তো, মা! আমি এই সুযোগে এখানে বসে একটু জিরিয়ে নেই।”
তরী মাথা নাড়ালো। ফর্মটা ফিল-আপ করে সাথে দুটো পেপার ও ছবি এট্যাচ করে নিলো। কিন্তু জমা দিতে গিয়ে তরীর চক্ষু চড়কগাছ। এতো ভীড় কেন আজকে? ভীড় ঠেলে সামনে এগোলো তরী। এক মেয়ে কাউন্টারে বসা লোকটার সাথে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে। মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো তরী। রোগা-পাতলা বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে। টিশার্টের ওপর একটা নরমাল শার্ট পরায় ঘামে হাতের দিকটায় শার্টটা লেপ্টে আছে।
ঝগড়ার মাঝেই তরী ফর্মটা জমা দিলো। লোকটা বিরক্ত হয়ে তরীকে বললো,
-“এই ব্রাঞ্চে মেডিক্যালের জন্য আর সিট ফাঁকা নেই। সব সিট বুকড। তাই অন্য ব্রাঞ্চে ভর্তি হয়ে নিবেন।”
তরী মুখ কালো করে ফেললো। তার বাড়ি থেকে এখানে আসতে সুবিধা হবে। অন্য জায়গায় গেলে তো দূর হয়ে যায়! তরী মন খারাপ করলো। ফিরে যাওয়ার জন্য উল্টো ঘুরতেই পাশে থাকা ঝগড়াটে মেয়েটা ওর হাত চে’পে ধরে কাউন্টারের লোকটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“ও এখানেই ভর্তি হবে। আমার সাথে। আপনাদের সাথে না ভদ্রতা দেখাতে-ই নেই! আর আমিও ভদ্র নই। আমার যেটা চাই, সেটা আমি আদায় করে নিতে জানি।”
-“মহা মুশকিলে পড়লাম তো! আপনি কিন্তু একঘন্টা যাবৎ এখানে ঝামেলা করছেন। এখান থেকে যান এখন!”
-“যাব না! যাব না!! যাব না!!! ভর্তি কনফার্ম করেন আমাদের দুজনের। এক্ষুনি।”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তো বেশ ডে’ঞ্জা’রা’স! বাকবিতন্ডায় লোকটা ব্যর্থ হলো। ভর্তি কনফার্ম করে বললো,
-“নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজটা করলাম!”
মেয়েটা মুখ ভেঙিয়ে বললো,
-“টাকা দিয়েই ভর্তি হবো। লাভ হয়েছে আপনাদের। আবার নিয়ম! হাহ!!”
বলেই তরীর হাত ধরেই আবার ভীড় থেকে বের হলো মেয়েটা। তরী এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটা সেটা খেয়াল করে বললো,
-“ওভাবে তাকিয়ে থাকার মতো কিছু করিনি। লোকটা বললো আর তুমি চলে যাচ্ছিলে কেন? একবার বলতে অন্তত পারতে!”
তরী হাত নাড়িয়ে বোঝালো, সে কী-ই বা বলবে? কথা বলতে পারলে তো!
মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বললো,
-“এভাবে হাত নাচানাচি করছো কেন? মুখে বলতে পারো না?”
এমনি এমনি বললেও তরী আঘাত পেল কথাটা শুনে। মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কথা বলতে পারে না। মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তরীর মুখের দিকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কিনা কথা বলতে পারে না! অবিশ্বাস্য!
-“সিরিয়াসলি! তবুও তুমি এডমিশনের জন্য পড়ছো? বাহ্! কিন্তু এইচএসসি পরবর্তী পড়াশোনাতে কথা বলতে পারাটা জরুরি। ভাইবা, থিসিস, প্রজেক্ট, রিপোর্ট, প্রেজেন্টেশন এসবে মুখে বলে সব বোঝাতে হয়! তোমার এই কথা বলতে না পারাটা অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে সামনে। মনোবল ধরে রেখো নিজের!”
তরী মলিন হাসলো। তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে অসংখ্য বাধা ছিল! ভবিষ্যতে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে, এটা ও আগে থেকেই নিশ্চিত। তবে তার জীবনের অপূর্ণতা ঘুচতে হলেও তাকে সামনে এগোতে হবে। প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তরীর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেয়েটি বললো,
-“বাই দ্য ওয়ে, আমি মধু। পুরো নাম মাধুর্য…. অব্ মানে মাধুর্যকে সবাই ছোট করে মধু বলে ডাকে আর কী!”
তরী হাসলো। ওর খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, “মধু নামটা তো তোমার বৈশিষ্ট্যের সাথে একটুও মানানসই নয়! ধানিলঙ্কা দিলে মানাতো ভালো।” মনের কথা মনেই চেপে গেল সে। মধু তরীর হাত থেকে টোকেন-টা নিয়ে ওর নামটা দেখলো,
-“তরী!! নাইস নেইম। আচ্ছা, চলো! টাকা জমা দিয়ে আসি।”
দুজন দু’পা এগোতেই মধু হুট করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো। তরী মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেটাকে বললো,
-“মেয়ে দেখলেই বাজে নজরে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে? অনেকক্ষণ ধরে তোকে খেয়াল করছি! বি’শ্রী নজরে তাকিয়ে আছিস তো আছিস-ই। চোখ দুটো গে’লে দিতে পারলে শান্তি মিলতো আমার। আজকের জন্য কিছু বললাম না আর! চলি বস্!!”
মধু ফোসফাস করতে করতে বেরিয়ে গেল। তরী এখনো অবাক চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন মেয়েও হয়! সে তো কখনো দেখেনি!!
৭.
সৌহার্দ্য সন্ধ্যার দিকে বাড়ি চলে এলো। আজ সারাদিন বেশ ধকল গিয়েছে। নিজেকে সারাদিন ব্যস্ত রেখেছে সে মূলত, যেন ঝামেলাগুলোর কথা মনে তেমন না আসে। কিন্তু দিনশেষে ঠিকই নিজের এ’লো’মে’লো জীবনটাকে নিয়ে আফসোস হয়। অরুণীর কথা মনে পড়েছে সারাদিন। কিন্তু নিজ থেকে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা সে করেনি। ভেবেই হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য।
বিছানায় বসতেই বেডসাইড টেবিলে চোখ গেল তার। অরুণীর ছবিটা নেই! অবাক হলো সৌহার্দ্য। ছবিটা তো সবসময় টেবিলেই থাকে! কোথায় গেল তাহলে? কেউ কি সরিয়েছে? কাল থেকে এই ঘরে শুধু তরী ছিল। তার মানে কি তরী-ই সরিয়েছে ছবিটা?
তরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে চুলে সিঁথি করছিল। হঠাৎ আয়নায় নিজের পেছনে দরজার সামনে সৌহার্দ্যের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো সে। হাত থেকে চিরুনিটা পড়ে গেল।
সৌহার্দ্য তরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ড্রেসিং-টেবিলের সাথে চে’পে ধর’লো। সৌহার্দ্যের রাগী দৃষ্টি দেখে তরী কাঁ’প’ছে। সৌহার্দ্য চিৎকার করে বললো,
-“তোমার সাহস কী করে হয় আমার জিনিস টাচ করার? হাও ডে’য়া’র ইউ? আমার জিনিসপত্র সরানো তো দূরে থাক, ছোঁয়ার-ও কোনো অধিকার নেই তোমার। কী ভেবেছো? কী ভেবেছো তুমি, হ্যা? তোমার এই রূপ দেখে আমি তোমায় নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেব? নেভার!!! তোমার কোনো যোগ্যতাই নেই। আমি ঘাড়ে শুরু মাত্র একটা দায়িত্ব তুমি। কাগজে কলমে তৈরি হওয়া একটা দায়িত্ব তুমি শুধু। তোমার সাথে ভালো-মন্দ কোনো প্রকার আচরণ করার ইচ্ছে আমার নেই। সো, ডোন্ট এভার ডে’য়া’র টু ক্র’স ইয়র লিমিট।”
বলেই তরীকে ধাক্কা দিয়ে নিজে থেকে সরিয়ে দিলো সৌহার্দ্য। এই দুইদিনের মানসিক, ক্রো’ধা’কা’রে তরীর ওপর ঢেলে দিলো সে। কিন্তু বুঝতেই পারলো না, আজকের এই আচরণ কত বড় ভুল ছিল তার!
-চলবে….
#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৪
তরী ব’জ্রা’হ’ত হলো যেন! মূ*র্তির মতো তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের চলে যাওয়ার দিকে। এতো কথা কেন শোনালো ওকে? সে তো জানামতে সৌহার্দ্যের কোনো জিনিসে হাত দেয়নি!
সৌহার্দ্য রাগান্বিত-ভাবেই নিজের ঘরে চলে এলো। রাগে ঘামছে সে। কপালের ঘাম মুছে সামনে তাকাতেই দেখলো, মিসেস সুজাতা তার ঘরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে অরুণীর সেই ছবিটা। সৌহার্দ্য অবাক হলো। সে কিছু বলার আগেই সুজাতা বললেন,
-“না জেনে, না বুঝে, হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার শিক্ষা আমি তোমায় দেইনি, সৌহার্দ্য। কিন্তু তুমি বরাবরই এই ভুলটা করো। কী বুঝে তুমি তরীকে এতো গুলো কথা শুনিয়ে এসেছো, আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু তোমার ধারণাটা ভুল।”
সৌহার্দ্য বির*ক্ত হলো। মন ও ম’স্তি’ষ্কে’র দ্বন্দ্বে মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না তার। তাই বললো,
-“মা, তুমি আবার কবে থেকে এতো পেচি*য়ে-ঘু*চিয়ে কথা বলা শুরু করলে বলো তো! আর তুমি বেশ ভালো করেই জানো, অরুণীর এই ছবিটা আমার কাছে কী? ঐ মেয়েটার সা’হ’স কী করে হয় এটা এখান থেকে সরানোর?”
-“ছবিটা তরী সরায়নি, সৌহার্দ্য! ইন ফ্যাক্ট, ও ছবিটাতে হাত-ই দেয়নি। ছবিটা আজ বিকেলে আমি সরিয়েছিলাম। তোমার বিয়ে হয়েছে, এটা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করো। আর বাকি রইলো অরুণীর কথা! ওকে নিয়ে সিদ্ধান্ত তুমিই নিবে যখন তুমি সবটা জানতে পারবে। এখনো অনেক কিছু অজানা তোমার, সৌহার্দ্য। অনেক কিছু।
বলেই সুজাতা ফ্রেম থেকে ছবিটা বের করে সাথে নিয়ে চলে গেলেন। ছবিহীন ফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য নিজের মায়ের বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো।
৮.
দুটো টিউশন শেষ করে কোচিং-এ ক্লাস করতে এসেছে মধু। ক্লাসে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে একদম পেছনে গিয়ে তরীর পাশে বসলো সে। দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো।
তরী মনযোগ দিয়ে পড়া বুঝলো, দরকারী জিনিসগুলো নোটও করে নিলো। মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটার পড়ায় একদম মনযোগ নেই। গালে হাত দিয়ে পড়া না শুনে অন্য কিছু ভাবছে সে। কোনো কিছু নোটও করছে না।
ক্লাস শেষে মধু তরীর খাতার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,
-“আ’রি'”ব্বা’স!!! এতো কিছু পড়িয়েছে আজকে!”
তরী মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললো,
-“তুমি খাতায় কিছু লেখোনি কেনো?”
মধু নাক-মুখ কুঁ*চ*কে বললো,
-“আরে, ধু”র! পড়াশোনা আমার দ্বারা হবে না কখনো, বুঝলি? কোথাও চান্সও হবে না আমার! পড়াশোনার চেয়ে বোরিং চি”জ এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা আছে বলে আমার মনে হয় না।”
তরী মধুর ব্যা”ঙ্গা”ত্ম”ক কথা শুনে হাসলো। বাসা কাছে বলে একা একাই যাওয়া-আসা করে সে। কাঁধে ব্যাগটা ঝু*লি*য়ে বেরিয়ে গেল মধুও।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে তৃতীয় টিউশনের উদ্দেশ্যে যাবে মধু এখন। যেতে আধঘন্টার মতো লাগবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মধু। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জ”ন্মা”নো সত্বেও আজ এই বয়সে তাকে এতো ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হয়। মধ্যবিত্তের মতো হিসেব করে পদক্ষেপ ফেলতে হয়। ভাবতে ভাবতে স্কুটার স্টার্ট দিলো সে।
ভেতরের দিকের রাস্তা বলতে গেলে ফাঁকা-ই। তাই স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিলো মধু। আর এতেই ম’হা’বি’প’দে পড়ে গেল সে। একটা গাড়ির সাথে মুখোমুখি সং*ঘ*র্ষ হলো তার। স্কুটারসহ ছি’ট’কে পড়লো সে মাঝরাস্তায়।
ব্য”থা”য় আ’র্ত’না’দ করছে মধু। বাঁ হাত যে ভে”ঙে গেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাই বোধ হয় গাড়ির ভেতরে থাকা সেই লোক। রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁ’তে দাঁ*ত চে*পে মধু বললো,
-“গাড়ি চালাতে পারেন না, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন কেন? আজব পাবলিক মা”ই”রি!”
-“হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ স্যায়?”
মধু কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁ’ড়া’তে খোঁ’ড়া’তে বললো,
-“ইংরে’জ বংশো’দ্ভূ’ত রাজা*কা*র নাকি! কোন পা’গ’ল-ছা’গ’লে’র খ’প্প’রে পড়লাম!! ধুর!! আর রাতে চোখে কেউ সানগ্লাস পরে। আপনার এই কালো চশমার জন্য আজকে আমার বারোটা বাজলো! আবার এখানে এসে…”
ছেলেটা বিরক্ত হলো। রেগে বললো,
-“এই যে, মিস! ইউ আর গেটিং মি রঙ্, ওকে? আমার গাড়ি আপনাকে ধা’ক্কা দেয়নি। যেই গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে, সেটা অলরেডি এখান থেকে পালিয়ে গেছে।”
মধু ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,
-“সত্যি? ”
-“বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। তবে সত্যি এটাই! আমি তো চপনাকে হেল্প করতে এসেছিলাম! আর আপনি আমাকেই গা*লা*গা*লি করা শুরু করে দিলেন!”
মধু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
-“লাগবে না আপনার হেল্প। আমার স্কুটারটা ঐ সামনের গ্যারেজে একটু রেখে দিয়েন পারলে। আমি একটা রিকশা দিয়ে সামনের ক্লিনিকে যাচ্ছি।”
বলেই মধু বিরবির করে বলতে লাগলো,
-“আমায় মা/রা/র চেষ্টা করেছিস! একবার হাতের কাছে পাই! মে*রে’ প*ঙ্গু’ যদি না বানিয়েছি একেকটাকে! তাহলে আমার নামও মাধুর্য না।”
পেছন থেকে ছেলেটাও বিরবির করে বললো,
-“অ*ভ*দ্র মেয়ে একটা! একবার থ্যাংকসও বললো না!!”
৯.
পেরিয়ে গেছে একটা সপ্তাহেরও বেশি সময়। অথচ সৌহার্দ্য অরুণীর সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। বাধ্য হয়ে অরুণী সৌহার্দ্যকে কল দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে।
টলমলে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে অরুণী সিদ্ধান্ত নিলো, সে সৌহার্দ্যের চেম্বারে-ই যাবে। চোখ মুছে কোনোরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল
বাড়ি থেকে। অরুণীর বাবা মেয়েকে পেছন থেকে ডেকে বললো,
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
-“সৌহার্দ্যের চেম্বারে।”
অরুণীর বাবা আর কিছু বললেন না। মেয়েকে আটকালেন-ও না। অরুণী চলে গেল। অরুণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অরুণীর বাবা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। মনে মনে বললেন,
-“মিস্টার রায়হান! তোমায় একবার ধ্বং”*স করে আমার তৃপ্তি মেটেনি। তাই দ্বিতীয়বার তোমার জীবন নিয়ে খেলতে নামছি আমি।”
অরুণী সৌহার্দ্যের চেম্বারে গিয়ে সৌহার্দ্যকে পেল না। পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
-“স্যারের তো আজকে সার্জারী আছে। ওটিতে আছেন উনি। ইদানীং স্যার প্রচুর ব্যস্ত থাকেন।”
অরুণী চেম্বারে ঘন্টা খানেক বসে রইলো। আজ সৌহার্দ্যের সাথে দেখা না করে যাবে না সে। সৌহার্দ্য এলো আরো দুই ঘন্টা পর। চেম্বারে ঢুকতেই অরুণীকে দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত ক’ম্প’ন অনুভব করলো সে। অরুণীকে দেখেও তেমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। এপ্রোন খুলতে খুলতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-“হঠাৎ! এখানে এলে যে?”
অরুণী এমন কথা মোটেও আশা করেনি। এতে বছরের সম্পর্কে তাদের নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান কম হয়নি। সবসময়ই সৌহার্দ্য অরুণীর রাগ ভা’ঙ্গি’য়ে বুকে জ’ড়ি’য়ে ধরত। আর আজ! আজ এইভাবে কথা বলছে সৌহার্দ্য!
-“এতো স্বাভাবিক তুমি? সবটা এতোই সহজ তোমার কাছে? কেন করছো আমার সাথে এরকম? আমি কোনো অপরাধ করেছি? কী হয়েছে তোমার?”
সৌহার্দ্য নীরব রইলো। কী বলবে, কীভাবে বলবে, বুঝতে পারছে না সে। অরুণী ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
-“একটা সপ্তাহ চলে গেছে, সৌহার্দ্য। আর তুমি আমার কোনো খোঁজ-ই নাওনি। তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারছি না আমি। কেন এভাবে মে*রে ফেলতে চাইছো আমায়? শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আমার! বলো, কী অপরাধ আমার?”
সৌহার্দ্য অরুণীর কান্নামাখা মুখশ্রীর দিকে তাকালো। পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। নিজের বুকও ভার হয়ে এলো সৌহার্দ্যের। কান্না আঁটকে কোনো মতে বললো,
-“তোমার অপরাধ একটাই। তুমি আমায় ভালোবেসেছ।”
অরুণীর কান্না থেমে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে সে বললো,
-“কীহ্?”
সৌহার্দ্যের অশ্রুপূর্ণ লালাভ চোখ দুটো চশমার বাহির থেকেই দেখতে পাচ্ছে অরুণী।
-“আমরা প্রেমে পড়তে পারি, একে-অপরকে ভালোবাসতে পারি, অরুণী। কিন্তু তোমায় এটা মেনে নিতে হবে যে, উই আর নট মেইড ফর ইচ আদার।”
এ কথা শুনে অরুণী আরো বেশি বি’ভ্রা’ন্ত হয়ে গেল। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সৌহার্দ্যের কলার চেপে ধরলো সে। রাগী কন্ঠে বললো,
-“এসব কী বলছো তুমি? পা”গ”ল হয়ে গেছো? তুমি কেন আমার হবে না? আর আমার না হলে আমায় ভালোবেসেছিলে কেন? এখন এসব কথা কেন বলছো তুমি?”
সৌহার্দ্য কলার থেকে অরুণীর হাত সরিয়ে নিলো। শান্ত গলায় বললো,
-“লিসেন, অরুণী! তুমিই আমায় আগে ভালোবেসেছ। এখন ওসব কথা টেনো না।”
-“তাহলে? আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কারণ কী?”
সৌহার্দ্য লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
-“আমি অনেক ভেবেছি, অরুণী। বাবা-মাকে বাদ দিয়ে তোমায় বেছে নিতে পারছি না আমি। এক সন্তানকে অলরেডি হারিয়েছেন আমার মা। আমাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। তাই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তরীকে ছাড়তে পারবো না আমি। তোমায় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে আমি আমার মা-বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যেটা সব সন্তানরা-ই তাদের মা-বাবার কাছে করে। সেটা ভঙ্গ করা অসম্ভব আমার জন্য।”
-“তরী? তরী কে?”
সৌহার্দ্য নীরব রইলো কিছুক্ষণ। তরীর পরিচয়টা প্রকাশ করতে বুক কাঁপছে ওর। জীবনে এই প্রথম সত্য প্রকাশে ভয় পাচ্ছে সে। তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“আমার স্ত্রী। বিয়ে করেছি আমি ওকে। স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। যেদিন তুমি আমার চেম্বারে লাস্ট এসেছিলে, তার কিছু মুহুর্ত আগে।”
-চলবে…