প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৫৪+৫৬

0
1962

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫৫

ক্লান্ত অপরাহ্নের শেষ প্রহর আগতপ্রায়! সারাদিনের উত্তপ্ততার শেষে সূর্য তার তেজ কমিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে। নির্মল আকাশের গায়ে সদ্য সৃষ্টি হওয়া হরিদ্রাভ আভাগুলোর দিকে দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে অরিত্রী। তার চোখ দুটো অজানা কারণে অদ্ভুত প্রাপ্তিতে হাসছে। ফুরফুরে হাওয়ায় গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করলো সে। সামনের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর পড়তেই অজানা আনন্দে ভরে গেল মন। সে ভাবতেও পারেনি, এখানে আসার পর তার এতোটা ভালো লাগবে।

অর্থী অরিত্রীর হাবভাব গুলো মনযোগ সহকারে দেখছে। মনে মনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটা অসম্ভব মায়াবী। জীবনের কাছে ওর অনেক সুখ আজও পাওনা। শুধু মাত্র কাছের মানুষগুলোর বোকামির জন্য ওর জীবন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মোড় নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই অর্থী বললো,

“আচ্ছা, তোর ছোটবেলার কোনো কিছু মনে পড়ে না? ছোটকালের কিছু কিছু স্মৃতি তো মানুষ কখনো ভোলে না!”

অরিত্রী অর্থীর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। বললো,

“অনেক কথা মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে দাদীর কথা। দাদী আমাকে এত্তো আদর করতো! সেটা দেখে মধু সবসময় রাগ করত আর দাদীর সাথে ঝগড়া করত। বড়আব্বু আর কাকিমনির কথা তো না-ই বলি! তবে অরুণী আমায় সবসময় মারতো। আমিও তখন কিছু বুঝতাম না!”

“সবার থেকে বেশি কে ভালোবাসতো বলে তোর মনে হয়?”

অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করলো কিছুক্ষণ। ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,

“সবাই-ই ভালোবাসতো। কিন্তু মায়ের থেকে বেশি তো কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তবে এটাও সত্যি, ঐসময়ে আমার সবচেয়ে বেশি কেয়ার করতো সৌহার্দ্য।”

অর্থী না জানার ভান করে বললো,

“সৌহার্দ্য? এটা কে? বাকি সবার কথা প্রায়ই বললেও এই নামটা তোর মুখে কখনো শুনিনি!”

“আমার কাজিন। আমার অনেক কাছের মানুষ ছিল ও। আমার থেকে বয়সে বেশ বড় হলেও ওকে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতো মনে হতো, যার কাছে ছিল আমার হাজারো আবদার। হয়তো ছোট ছিলাম বলে এমন মনে হতো! এখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সৌহার্দ্য হয়তো এতো বছরে আমাকে ভুলেও গেছে! কিন্তু ওকে তো আমি ভুলিনি! ইন ফ্যাক্ট, আমি কাউকেই ভুলিনি।”

অর্থী মনে মনে হাসলো। ভাবলো, “সারা পৃথিবী তোকে ভুলে গেলেও সৌহার্দ্য তোকে ভুলবে না কোনোদিন। কিন্তু এই মানুষটাকে তো তুই-ই ভুলে গিয়েছিস, তরী! আফসোস!”

অরিত্রীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অর্থী প্রশ্ন তুললো,

“ওদের কথা এতো মনে করিস! ওদের সাথে একবার দেখা করতে ইচ্ছে করছে না তোর?”

অরিত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“কী দরকার! প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। অনেকটা সময়! বদলে গেছে সবকিছুই। ওরা ওদের জীবনে ভালোই তো আছে! আমিও আমার পৃথিবীতে সুখী। সেখানেই আমি ভালো আছি। এখানে তো আমার প্রতিটা মুহুর্তে সেই সময়টার কথা মনে পড়বে! নিজের বাবার হাতে নিজের মায়ের র*ক্ত দেখার মতো কঠিন দৃশ্য দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হয় না। এখন যাদেরকে মা-বাবা বলে জানি, তারাই আমার দুনিয়া। এদের ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাই না আমি।”

“তাহলে কি এখানে শুধু এই দেশটা ঘুরে দেখার জন্য এসেছিস? আর কোনো উদ্দেশ্য নেই?”

অরিত্রী কিছুক্ষণ নীরব রইলো। আনমনে ভাবলো হয়তো কিছু! নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,

“কিছু কনফিউশান আছে। সেগুলো দূর করার ইচ্ছে আছে। এখন জানি না কী হবে?”

অর্থী অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিত্রীর দিকে। মেয়েটার মনে কী চলছে বুঝতে পারছে না ও! যেই সময়টা ও ভুলে গেছে, সেটা মনে করার কি বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর মনে নেই? ব্যাপারটা নিয়ে ওর মধ্যে কোনো কৌতুহল-ই দেখতে পাচ্ছে না অর্থী।

হঠাৎ ড্রাইভার সজোরে ব্রেক কষায় চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো অর্থী। দু’জনেই সামনে ঝুঁকে পড়লো। অরিত্রী কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“দেখে গাড়ি চালানো উচিত। এভাবে তো আপনি হুটহাট এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলবেন। আশ্চর্য!”

ড্রাইভার অসহায় কন্ঠে বললো,

“আমার কী দোষ, ডাক্তার আপা? ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে মা-বাবারা এভাবে রাস্তায় ছেড়ে দিলে তো ওরা গাড়ির সামনে চলে আসবেই!”

অরিত্রী দাঁত কিড়মিড় করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। গাড়ির দরজা খুলে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলো, একটা বাচ্চা মেয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে বকাবকি করছে! দু’জনকে দেখে সমবয়সী-ই মনে হলো অরিত্রীর। মেয়েটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে,

“বলেছিলাম তোকে, ভাই! এভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে মানা করেছিলাম। পার্ক থেকে কেন বের হয়েছিস তুই?”

ছেলেটা নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

“প্রণয়ীর বাচ্চা! প্যানপ্যানানি বন্ধ করে আমায় টেনে তোল আগে। পায়ে বেশ জোরে ব্যথা লেগেছে। উফ্!”

প্রণয়ী নিজের সব শক্তি দিয়ে প্রণয়ের হাত ধরে টান দিলো। প্রণয় আহ্ করে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বললো,

“উফ! আমার হাতটা শেষ করে দিলি, গাধী! হাতেও ছিঁলে গেছে, দেখ!”

প্রণয়ের হাতের কনুইয়ে ক্ষত থেকে রক্ত পড়তে দেখে প্রণয়ী অসহায় চোখে তাকালো। এখন কী করবে সে?

অরিত্রী এগিয়ে গিয়ে প্রণয়কে ধীরে-সুস্থে উঠিয়ে দাঁড় করালো। অর্থী গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে দেখে অবাক কন্ঠে বললো,

“আরেহ্! তোমরা এখানে এই অবস্থায় কেন?”

প্রণয়ী অর্থীকে দেখে ভরসা পেল। ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“অর্থী আন্টি, ভাই অনেক ব্যথা পেয়েছে। ওর হাত থেকে র*ক্ত পড়ছে। দেখো না!”

অরিত্রী কিছু বুঝতে পারলো না। অর্থীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“তুই ওদেরকে চিনিস? ওরা কারা?”

অর্থী তড়িৎ গতিতে ওদের পরিচয় বলতে গিয়েও বললো না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো,

“ওরা আমার ভাইয়ের বন্ধুর ছেলেমেয়ে। এজন্য চিনি ওদেরকে।”

“অহ্, আচ্ছা! তুই ফার্স্ট এইড বক্সটা আমার লাগেজ থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা কর। আমি ওদেরকে নিয়ে পার্কে গিয়ে বসছি।”

অর্থী মাথা নাড়াতেই অরিত্রী ওদেরকে নিয়ে পাশের পার্কে ঢুকে পড়লো। একটা চেয়ারে প্রণয়কে বসিয়ে অরিত্রী ওর সামনে ঘাসের ওপর বসে পড়লো। প্রণয়ী প্রণয়ের পাশে বসে ভাইয়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

অরিত্রী ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“রাস্তায় কী করতে গিয়েছিলে তোমরা?”

প্রণয়ী কয়েক বার মাথা নাড়িয়ে বললো,

“আমি যাইনি কোথাও? আমরা তো এখানে খেলতে এসেছিলাম! হঠাৎ দেখি প্রণয় পার্ক থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমিও ওকে ডাকতে ডাকতে বাইরে বের হতেই দেখি ও রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে, আর একটা গাড়ি ওর কাছে এসে থেমে গেছে।”

অরিত্রী চোখ ছোট ছোট করে প্রণয়ের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট উল্টে বললো,

“আমার কী দোষ? রাস্তা দিয়ে একটা আইসক্রিম ভ্যান যাচ্ছিলো। আমি তো প্রণয়ীর জন্য আইসক্রিম কিনতে যাচ্ছিলাম। আমি কি জানতাম নাকি যে, ঐভাবে পড়ে যাবো।”

অরিত্রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“যদি গাড়িটা তোমায় ধাক্কা দিতো? তখন কী হতো একবার ভেবে দেখেছো? তোমার মা-বাবা কতটা কষ্ট পেত কোনো আইডিয়া আছে তোমাদের!”

অরিত্রীর ধমকে প্রণয়ী হালকা কেঁপে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে প্রণয়ের দিকে তাকালো। প্রণয়ে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে অরিত্রীর দিকে। মায়ের কথা শুনলেই রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। প্রণয় চায় না কেউ ওর মাকে নিয়ে কোনো কথা বলুক! ভালো বা খারাপ কোনো কথাই না। কেউ কিছু বললেই তার সাথে প্রণয় রাগারাগি করে। এখন কি অরিত্রীর সাথেও একই আচরণ করবে? ভেবেই প্রণয়ী ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু খেয়াল করে দেখলো, প্রণয়ের চোখ দু’টো আজ বেশ স্বাভাবিক। সেখানে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। কেবল অবাকতা আর কিছু খুঁজে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্রণয়।

হঠাৎ অর্থী ফার্স্ট এইড বক্সটা এনে অরিত্রীর হাতে দিয়ে বললো,

“সরি, ইয়ার। বক্স খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগায় লেইট হয়ে গেল!”

“প্রব্লেম নেই”, বলেই অরিত্রী প্রণয়ের হাত ও পায়ের র*ক্ত গুলো মুছে দিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে দিতে লাগলো। অর্থী প্রণয়ের পাশে বসে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বললো,

” বেশি ব্যথা লেগেছে, বাবা?”

প্রণয় এক দৃষ্টিতে অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থীর কথা ওর কানে প্রবেশ করেও করলো না যেন। ব্যান্ডেজ করা শেষে অরিত্রী নিজের মুখের সামনে চলে আসা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে ফেললো। সেগুলো কানে গুঁজতেই প্রণয়ী ওর দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললো,

“তুমি অনেক সুন্দর!”

অরিত্রী হাসলো। প্রণয়ীর গাল টেনে দিয়ে বললো,

“আপনিও অনেক সুন্দর। একদম প্রিন্সেসের মতো।”

প্রণয়ী খুশি হলো। বললো, “আমার পাপা আর আঙ্কেলও এটা বলে। কিন্তু আমার মা আরো বেশি সুন্দর ছিল। হয়তো আপনার থেকেও বেশি সুন্দর।”

অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“সুন্দর ছিল মানে?”

প্রণয় বিরক্ত হয়ে বললো,

“আমাদের মা নেই। হারিয়ে আমাদের জীবন থেকে। আমাদের পাপা-ই আমাদের মা।”

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫৬

সূর্য ডুবে আকাশ নিকষ কালোয় নিমজ্জিত হয়েছে সবেমাত্র। হোটেলের পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি থামতেই অর্থী বের হয়ে গেল গাড়ি থেকে। ফোনে চটপট বাংলাদেশি একটা সিম কার্ড ইনসার্ট করেই ডক্টর ক্লারার নাম্বারে ডায়াল করলো। তিনি আগেই অর্থীকে নিজের নাম্বারটা দিয়ে রেখেছিলেন বাংলাদেশে এসে যোগাযোগ করার জন্য। অর্থী ডক্টর ক্লারাকে কল দিয়ে নিজের আগমন সম্পর্কে জানালো।

অরিত্রীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে গাড়ির ভেতরে তাকালো অর্থী। অরিত্রী নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়ির সিটে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে বসে আছে। অর্থী অবাক হলো। বাংলাদেশে আসার জন্য বরাবরই লাফালাফি করে বেড়ানো মানুষটার এমন হোলদোলহীন অবস্থা দেখে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। অর্থী ওকে কিছু বলতে যাবে, এমনসময় ডক্টর ক্লারার গলার আওয়াজ ভেসে এলো, তিনি সাথে আরও দুজনকে নিয়ে ওদের দিকে আসছেন আর বলছেন,

“এসে গেছো তোমরা? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

অর্থী ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বিরবির করে বললো,

“এখনো হয়নি কোনো সমস্যা! অর্ণব কোনো কান্ড ঘটালেই হলো। সেটার জন্যই ওয়েট করছি আমি।”

অরিত্রী নড়েচড়ে উঠে বসলো। গাড়ি থেকে বের হতেই ডক্টর ক্লারা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমরা ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাদের সাথে কথা আছে আমার।”

অর্থী আর অরিত্রীকে ওদের রুম দেখিয়ে দিয়ে ডক্টর ক্লারা চলে গেলেন। একটা রুমে দুজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই হিসেবে অর্থী আর অরিত্রী দু’জন এক রুমেই থাকবে। অর্থী তড়িৎ গতিতে দুজনের জিনিসপত্র আলমারিতে গুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অরিত্রী থম মেরে কিছুক্ষণ বেডে বসে রইলো। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ভো ভো করছে! অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে মস্তিষ্ক দলা পেকে থাকলে এমনটাই অনুভূত হয় ওর।

অর্থী বেরিয়ে এসে অরিত্রী এমন চিন্তিত মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটা কেমন অদ্ভুত ভাবে বসে আছে! চুলগুলো এলোমেলো, মাথাটা নোয়ানো। সে এগিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ভেজা চুলে তোয়ালে ডুবিয়ে বললো,

“টেনশান হচ্ছে? চিন্তা করিস না! আপাতত অর্ণব কিছু করতে পারবে না। এট লিস্ট এক সপ্তাহ এই দেশে থাকতে পারবি!”

“ওসব নিয়ে ভাবছি না!” অরিত্রীর নির্বিকার কন্ঠ।

অর্থী অবাক হয়ে বললো, “কেন ভাবছিস না? একমাসের জন্য এখানে এসেছি আমরা! তোর কি একমাস থাকার ইচ্ছেটাই নেই? অর্ণব আর মোহনা আন্টি জোরাজুরি করলে চলে যাবি?”

অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রোষিত কন্ঠে বললো,

“কী সব আজে বাজে বকছো? এতো কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে এলাম এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য নাকি? আমি না চাইলে আমাকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই এসব চিন্তার বিষয় না।”

অর্থী অরিত্রীর কথার মানে না বুঝে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো। ওর পাশে বসতে বসতে বললো ,

“তাহলে কী নিয়ে ভাবছিস?”

অরিত্রী আনমনে বললো, “ঐ বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে ভাবছি। বিশ্বাস করো, আপি! ওদেরকে যখন থেকে দেখেছি, তারপর থেকে একটা মুহুর্তে আমি শান্তি পাচ্ছি না। ওদের দুজনের নিষ্পাপ মুখ দু’টো আমার চোখের সামনে ভাসছে বারবার। সেই মুখে কারো আবছায়া ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি ওদের মাঝে আমি। এরকমটা কি শুধুই কো-ইন্সিডেন্স? নাকি ওদের মা নেই শোনার পর থেকে সিম্প্যাথির জন্য আমার এমনটা লাগছে? আমি বুঝতে পারছি না।”

অর্থী মনে মনে হাসলো। মাতৃত্ব হয়তো এমনটাই হয়! নিজের অস্তিত্বে ধারণ করা নিষ্পাপ সত্তাগুলোকে দেখে ভেতরে একটু আলোড়ন তো হবেই! বরং এটাই স্বাভাবিক। তবুও মুখে কিছু বললো না।

ডক্টর ক্লারা ট্রলিতে করে ওদের জন্য খাবার নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। অরিত্রীকে দেখে বললেন,

“এ কি! তুমি এখনো ফ্রেশ হওনি? ডিনার করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া উচিত তোমাদের। কাল থেকে কিন্তু খাওয়ার টাইমও ঠিকমতো পাবে না!”

“সরি, ম্যাম। একটু টায়ার্ড লাগছিল। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

অরিত্রী হকচকিয়ে গিয়ে নিজের কাপড়চোপড় নিয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেল।

খাওয়ার পর্ব শেষ করার পর ডক্টর ক্লারা ওদের হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“এই লিস্টটা দেখে নাও। এখানে ঐ সব হসপিটালের নাম আছে যেখানে তোমাদের ডিউটি দিতে হবে। লেইট করে বসায় এই পাঁচটা হসপিটাল-ই বাকি আছে, অন্য গুলোর জন্য ডক্টর এসাইন করা হয়ে গেছে। এই পাঁচটার মধ্যে থেকে তিনটা হসপিটাল তোমরা নিজেদের ইচ্ছে মতো সিলেক্ট করে নিতে পারবে। একটা হসপিটালে এক সপ্তাহ সময় দিবে। টোটাল তিনসপ্তাহ পর যেই নয়দিন বাকি থাকবে, সেসময় মেডিক্যাল ক্যাম্পিং করা হবে। সেই বিষয়ে পরে জানিয়ে দিবো।”

অরিত্রী মাথা নাড়ালো। ডক্টর ক্লারা আলতো হেসে বিদায় নিতেই অর্থী একবার নিজের লিস্ট, আরেক বার অরিত্রীর হাতে থাকা লিস্টটায় চোখ বুলালো। কিন্তু অরিত্রীর হাতে থাকা কাগজটার দিকে চোখ পড়তেই অর্থীর মুখ জুড়ে বিস্ময় খেলে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সে। বললো,

“তুই এই হসপিটালটা সবার আগে কেন সিলেক্ট করলি?”

“নামটা ভালো লেগেছে, তাই! ”

অরিত্রীর কাটকাট জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারলো না অর্থী। অরিত্রী প্রথমেই সৌহার্দ্যের হসপিটালটাই বেছে নিলো কেন? আসলে কি অরিত্রীর মনেই কিছু একটা চলছে নাকি সে-ই বেশি বেশি ভাবছে? মাথার মধ্যে প্রশ্নটা ঘোরাফেরা করতে লাগলো অর্থীর!

৫০.

সৌহার্দ্য রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের হাতে ও পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে ঠিক কী বলবে, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। সারাদিন হসপিটালে টানা ডিউটি দিয়ে এখন বাসায় এসে ছেলের এই অবস্থা দেখে দৃশ্যটা একদম কলিজায় আঘাত করলো তার। কিন্তু প্রণয়ের কাছে না গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজের জিনিসপত্র টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,

“কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”

প্রণয়ী প্রণয়ের পাশেই বসে ছিল। সে মিনমিন করে বললো,

“পার্কে গিয়েছিলাম, খেলতে।”

“এসব কীভাবে হলো?”

সৌহার্দ্যের থমথমে কন্ঠ শুনে প্রণয়ী ঢোক গিলে বললো,

“পাপা, ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। আসলে….”

প্রণয়ী কী বলবে, বুঝতে পারলো না। সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে ওদের দুজনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুজনের ভীতু মুখ দুটো পর্যবেক্ষণ করে বললো,

“আজকে আমারও হাত কেটে গেছে!”

প্রণয়-প্রণয়ীক চমকে উঠলো। এরকম কথা তারা আশা করেনি। ভেবেছিল, সৌহার্দ্য ওদের বকাবকি করবে। কিন্তু সৌহার্দ্যের হাত-কাটার কথা শুনে ওরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সৌহার্দ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সত্যি সত্যিই হাতের তালুর মাঝের দিকে বেশ মোটা ব্যান্ডেজ করা। প্রণয়-প্রণয়ী সৌহার্দ্য হাত টেনে ধরলো। সৌহার্দ্য একটু ব্যথা পেলেও সেটা প্রকাশ করলো না। প্রণয় সৌহার্দ্যের হাতটা নিজের কোলে নিলো। টলমলে চোখে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। নাক টেনে বললো,

“অনেক ব্যথা লেগেছে, না?”

প্রণয়ী চোখ মুছলো। সৌহার্দ্যের ব্যান্ডেজে নিজের ছোট ছোট হাত আলতো করে ছুইয়ে দিয়ে বললো,

“অনেক গুলো রক্ত পড়েছে তোমার? অনেকগুলো ব্যথা হচ্ছে, তাই না?”

সৌহার্দ্য হাসি হাসি চোখে তাকালো। বললো, “আপনাদেরও কি অনেক ব্যথা লাগছে এখন?”

প্রণয়-প্রণয়ী কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য প্রণয়ের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

“আমারও এমনটাই লেগেছে, যখন আমি ঘরে ঢুকেই আপনার এই অবস্থা দেখেছি।”

“আ’ম সরি, পাপা! আমি সবসময় নিজের খেয়াল রাখার চেষ্টা করলো।”

“গুড বয়! মনে থাকে যেন!”

প্রণয়ী নিজের চোখের পানি মুছে ভাঙা গলায় বললো,

“তুমিও প্রমিস করো। তুমিও নিজের খেয়াল রাখবে। তোমার কোনো কষ্ট দেখলে আমার অনেক কান্না পায়!”

সৌহার্দ্য হেসে প্রণয়ীর নাক টেনে দিয়ে বললো,

“আচ্ছা? ঠিক আছে, প্রমিস! এবার আমাকে বলো, প্রণয়ের এই অবস্থা হলো কী করে?”

প্রণয়ী সৌহার্দ্যকে সব কিছু খুলে বললো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। ছেলেটার সাহস দেখে সে অবাক না হয়ে পারে না! প্রণয়ী বললো,

“তারপর ঐ আন্টিটা-ই ভাইয়ের হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আর জানো, পাপা? প্রণয় আন্টিটাকে থ্যাংকসও বলেনি!”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “ব্যাড ম্যানার’স! উনি তোমাকে হেল্প করেছে। তোমার উচিত ওনাকে ধন্যবাদ দেওয়া!”

প্রণয় বিরক্ত হয়ে বললো, “আন্টিটা দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল! প্রণয়ীর সাথে ওনার চেহারায় অনেক মিল পাচ্ছিলাম আমি। কেমন যেন শাসনের সুরে কথা বলছিল। আমার পাপা ছাড়া আমায় কেউ শাসন করুক, এটা আমার পছন্দ না।”

প্রণয়ী রাগী কন্ঠে বললো, “একদম আজেবাজে কথা বলবি না, ভাই। আন্টিটা অনেক ভালো, অনেক সুন্দর। অর্থী আন্টি এলে তোর নামে নালিশ করবো আমি, দেখিস!”

সৌহার্দ্য ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“অনেক হয়েছে ঝগড়া। পাপা অনেক টায়ার্ড। এখন একটু রেস্ট নেবে। তারপর আমরা ডিনার করে অনেক গল্প করবো, ঠিক আছে?”

প্রণয়-প্রণয়ী একসাথে বললো, “ওকে, পাপা!”

৫১.

অর্ণব পাংশুটে মুখে বসে আছে মিস্টার আফনাদ আর মোহনার সামনে। মোহনা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

“আমি জানতাম, মেয়েটা এমন কিছুই করবে! ওর তো কোনো দোষ নেই! ঐ অর্থী-ই আমার মেয়েটার কানে এসব ঢুকিয়ে ওকে এদেশে এনেই ছাড়লো। আমার মেয়ের সুখ কারো সহ্য হয় না!”

মিস্টার আফনাদ মনে মনে বেশ খুশি। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। মোহনার প্রতি বিরক্তি দেখিয়ে বললেন,

“যা হবে, ভালোই হবে! তুমি অহেতুক মাথা ঘামিও না তো! এক মাসেরই তো ব্যাপার! এর মধ্যে যদি অরিত্রীর সব কিছু মনে পড়েও যায়, তাহলে সেটাই ওর জন্য ভালো।”

মোহনা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “ভালো? তোমার আদৌ এমনটা মনে হয়? আমার মেয়ের অতীত কোনো দিন-ই ওর জন্য সুখকর ছিল না!”

“কিন্তু সেটাই ওর জীবন ছিল, সেটাই ওর ভাগ্য। তুমি এতো বছর ওকে সেসব থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ঠিক করোনি।”

মোহমা অবাক কন্ঠে বললেন,

“তোমার এখনো মনে হয় আমি বেঠিক কাজ করেছি? তুমি একবার অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখো! ও এখন একজন সফল ডক্টর। ওর জীবনে কোনো দুঃখের ছায়াও নেই। আমি চাই না, সেই অতীতের দুর্বিষহ দিনগুলো ওর জীবনে আবার ফিরে আসুক।”

মিস্টার রায়হান হতাশ হলেন। মোহনাকে কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। এতো বছরেও যে কিছু বুঝতে পারলো না, সে আজকেও বুঝবে না, এটাই স্বাভাবিক।

মোহনা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“অরিত্রীকে খুঁজে বের করো। ওকে যত দ্রুত সম্ভব, আমি আমার সামনে চাই।”

অর্ণব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “আমি অনেক বার জানতে চেয়েছি, ওরা কোন এরিয়ায় গেছে। কিন্তু হসপিটালের অথরিটি কিছু জানালোই না। আমি এখন নিজের পদ্ধতি ব্যবহার করে ওকে খুঁজে বের করবো।”

“সময় নষ্ট করা যাবে না, অর্ণব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওকে নিয়ে কানাডা ফিরে যেতে চাই আমি।”

অর্ণব রহস্যের হাসি দিয়ে বললো, “চিন্তা করো না। এই সপ্তাহের মধ্যেই আমরা কানাডা ব্যাক করছি।”

-চলবে….

(ভুলত্রুটি মার্জনীয়!)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে