প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৪৩+৪৪

0
1563

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪৩

তরী চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরও সৌহার্দ্য নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সৌহার্দ্যের ভাবলেশহীনতায় মধু যার-পর-নেই অবাক হলো। এগিয়ে এসে কটাক্ষের সুরে বললো,

“তরী চলে গেল, ভাইয়া! ও চলে গেছে। তুমি ওকে আটকাবে না? এতোদিন তো ওর জন্য কতো কি করলে! এখন যে ওকে এতো কষ্ট দিয়ে এখান থেকে খালি হাতে চলে গেছে বাধ্য করলে, তোমার কি খারাপ লাগছে না? ও তোমার স্ত্রী, ভাইয়া! তোমার অনাগত সন্তানের মা ও। আই কান্ট বিলিভ দিস যে, তুমি……”

“আমি কিছু শুনতে চাই না। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি… কিচ্ছু না!!!”

সৌহার্দ্য কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ভেতর থেকে চাপা বিরক্তিগুলো নাভিশ্বাস আকারে বেরিয়ে এলো মধুর। তার ভাইয়ের মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। কিন্তু সেটা সৌহার্দ্য প্রকাশ করছে না। এদিকে সবটা সামলিয়ে ওঠার জন্য সৌহার্দ্যের কার্যকলাপও ওর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল। তরীর অবস্থার কথা মনে পড়তেই চেপে রাখা রাগগুলো তরতরিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মধুর। অরুণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

“আর কত ধ্বংস চাও তোমরা বলো তো? আর কত? ছোটবেলা থেকে তোমার হিংসুটে স্বভাব নিজের চোখে দেখে এসেছি। এই হিংসা তোমায় এখন এতোটাই হিংস্র করে তুলেছে যে, তোমার বিবেকবোধ-ই নষ্ট হয়ে গেছে। আর তোমার এই নষ্ট রুপটাই তোমার বাবা ব্যবহার করেছে। এখনও করছে। বড্ড বড় ভুল করছো তুমি! এখন বুঝতে পারছো না। কিন্তু যখন বুঝতে পারবে, তখন এই ভুলের মাশুল গোনারও সুযোগ পাবে না তুমি।”

অরুণী ভ্রু কুঁচকে মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,

“জ্ঞান দিচ্ছিস? এসব কথা অরিত্রীকে গিয়ে বললেই তো পারিস! কিন্তু ওর দোষ তো তোদের চোখে পড়বে না! এই যে, একটা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে এলো, ছেলেটার সাথে এতো মাখামাখি করলো, এসব তো…..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই অরুণীর গালের ওপর সপাটে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিলো মধু। অরুণী গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকালো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে যে, অরুণী অবাক হওয়ারও সুযোগ পায়নি। মধু রক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,

“তোর মতো মেয়ের মুখে অন্য কারো চরিত্রের সার্টিফিকেট মানায় না। আমার সামনে অন্তত মুখ সামলে কথা বলিস। আমার হাত দু’টো অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই চলে তুই হয়তো জানিস না।”

“তুই আমাকে থা*প্প*ড় মা*র*লি?”

“আরো আগেই মা*রা উচিত ছিল। কিন্তু দেরি করে হলেও তোর লিমিট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই হলো। এখন বের হ এইবাড়ি থেকে! নয়তো জা*নেই মে*রে দিবো তোকে।”

“এই থাপ্পড়ের চরম মূল্য চুকাতে হবে তোকে।”

বলেই অরুণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

মিস্টার রায়হান, সুজাতা আর সৌহার্দ্যের দাদী এতোক্ষণ নীরব দর্শকের মতো চেয়ে রইলো শুধু। তাদের এখন কিছু বলার ইচ্ছেও নেই, আগ্রহও নেই। তবে সামনের দিনগুলো খুব একটা ভালো যাবে না, এটা সবাই বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।

৪২.
জানুয়ারির এই তীব্র শীতেও হঠাৎ হালকা ঝিরঝিরে এই বৃষ্টিতে উত্তরে হাওয়ার বয়ে চলা যেন আজ তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিটি লোমকূপে হিমশীতলতা অনুভব করতেই শিউরে উঠলো অর্ণব। অস্ট্রেলিয়ার শীতের চেয়ে এখানকার শীতে ওর নাজেহাল অবস্থা, কারণ এই অসময়ের বৃষ্টি। দুই হাতে দুই মগ ধোঁয়া উঠানো কফি সাথে নিয়ে তরীর ঘরে ঢুকলো সে। নক করে বললো,

“আসবো?”

তরী ফিরে তাকালো না। কোনো উত্তরও দিলো। জানালার ফাক গলিয়ে ওর দৃষ্টি অজানা কোনো গন্তব্যে ঘুরঘুর করতে লাগলো। অগত্যা হতাশ মুখ নিয়ে অর্ণব বিনা অনুমতিতেই ভেতরে ঢুকলো। তরীর গায়ে একটা ফিনফিনে সুতি শাড়ি। এই কনকনে ঠান্ডায় ও শীতের হাত থেকে রেহাইয়ের জন্য নেই কোনো উষ্ণ আবরণ। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“একটা চাদর অন্তত গায়ে জড়িয়ে নে। শোকে কি পাথর হয়ে গেলি নাকি? কাইন্ড আ ফিলিংলেস লাগছে তোকে!”

তরীর নির্জীব কন্ঠ শোনা গেল,

“তোমার মনে হয় আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে গিয়েছি?”

“না, সৌহার্দ্যের বাড়ি থেকে আসার পরও তোর মধ্যে কষ্ট পাওয়ার কোনো লক্ষণ তো দেখলাম না! আগের মতোই খাচ্ছিস, ঘুমাচ্ছিস। মানে বুঝলাম না! এতো স্বাভাবিক কীভাবে আছিস তুই?”

তরী মলিন হাসলো। বললো,

“সবসময় আমরা চোখে যা দেখি, সেটা সত্য হয় না।এটা ভেবে কষ্ট পাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেরকম খারাপ লাগছে না। মনে মনে অনেকটা আন্দাজ করতে পারছি আমি। এতোটা আত্মবিশ্বাসের জন্যই আমার মন খারাপ লাগছে না। আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাচ্ছি শুধুমাত্র আমার বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে।”

অর্ণব ভ্রুকূটি করে তাকিয়ে বললো,

“বাচ্চাদের? মানে?”

“হ্যাঁ। ডক্টর আজকে জানিয়েছেন আমায়। টুইন বাচ্চা হবে।”

“এটা তো ভালো খবর! এতোক্ষণ জানাসনি কেন আমায়?”

“মনে ছিল না। এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও। কিছু ভালো লাগছে না আমার।”

অর্ণব কথা বাড়ালো না। তরীর সাথে এখন কথা বলতেই নিজের গলায় কম্পন অনুভব করে সে। সে তো চেয়েছিল অরুণীর কথা শুনে তরী আর সৌহার্দ্যের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে। কিন্তু তরীর জীবনে তার প্রবেশের পথ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তরীর শৈশবেই তো ওর প্রিয় মানুষ ওর জীবনে প্রবেশ করেছিল, ওর মনে পাকাপোক্ত স্থান তৈরি করে ফেলেছিল। সে জায়গা পাওয়ার আর কোনো রাস্তা তো নেই! তার ওপর এখন তরীর মধ্যে সেই মানুষটার অংশ বেড়ে উঠছে। ওপর দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে তীব্র জ্বলুনি অনুভব করে অর্ণব। তরীর দিকে তাকালেও এখন চোখ জ্বলে ওর। নিজের ভালোবাসাকে অন্যের অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানধারিণী আকারে দেখার সমান কষ্ট পৃথিবীতে আছে কিনা ওর জানা নেই। এর থেকে তো মরণও ভালো!

৪৩.
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে নিজের চেম্বারে বসে আছে। প্রহরের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। এই মুহুর্তে ওর সাহায্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাও ও-ই নেই। চরম বিরক্তি নিয়ে নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল সৌহার্দ্য। পিয়ন ওকে ওভাবে চলে যেতে দেখে অবাক হয়ে বললো,

“স্যার, কোথায় যাচ্ছেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আজকে অনেকগুলো।

সৌহার্দ্য ছোট করে বললো, ” অল ক্যান্সেল!”

পিয়ন অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। এই ছেলের হঠাৎ হঠাৎ কী হয়ে যায় কে জানে?

সৌহার্দ্য প্রহরের বাড়িতে এসে জানতে পারলো, প্রহর কানাডা গেছে গত পরশু। রিয়াদকে রেখে গেছে ওর বাড়িতে। সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে বললো,

“কানাডা? হঠাৎ? কিন্তু কেন?”

রিয়াদ বললো, “অর্থী ম্যাম নাকি অসুস্থ! তাই খবর পেয়েই স্যার তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে।”

সৌহার্দ্য হতাশা নিয়ে বেরিয়ে এলো। বোনের জন্য ছেলেটা এখনো এতো পাগল! দেশের বাইরে গেছে ভালো কথা! অন্তত অনলাইনে তো থাকতে পারে! বিরক্ত হয়ে গাড়িতে বসতেই সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠলো। অরুণী কল দিয়েছে। সৌহার্দ্যের ইচ্ছে হলো, ফোনটা দিয়ে নিজের মাথাটা ফা*টিয়ে দিতে। বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করতেই অরুণী কোনো হেয়ালি না করে বললো,

“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”

“আমি আসছি।”

ছোট করে উত্তর দিয়ে ফোন কেটে দিলো সৌহার্দ্য। এই মুহুর্তটা এতো দ্রুত এসে পড়বে ভাবেনি ও। আরমান আহমেদের সাথে কথা বলার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা যাবে না।

সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অরুণীর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। অরুণীদের বাড়িতে এর আগেও কয়েকবার এসেছে ও। কলিং বেল বাজাতেই কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলো। বললো,

“ম্যাম ঘরেই আছে।”

সৌহার্দ্য অরুণীর রিডিং রুমে বসলো। বেডরুমে ঢুকলো না৷ চেয়ার টেনে বসে আসে পাশে তাকাতেই দক্ষিণ দিকের একটা বুকশেলফের ওপরের দিকে ওর নজর আটকে গেল। এটা তো ঐ ব্যাগটা, যেটা ও আজাদ চাচার সিন্দুক থেকে নিয়েছিল। এটা অরুণীর কাছে কী করে এলো। সৌহার্দ্য ব্যাগটা হাতে নিলো। ভেতরের জিনিসগুলো দেখে নিশ্চিত হলো, এটা সেই ব্যাগটাই!

সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে ব্যাগটার দিকে, এমনসময় অরুণী সৌহার্দ্যের কাছে এসে বললো,

“আরে! তুমি এখানে বসেছো কেন? তোমাকে না বললাম, বাবা…..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্যের হাতে থাকা ব্যাগটার দিকে চোখ পড়তেই অরুণী চমকে গেল। হতভম্ব হয়ে বললো,

“এই ব্যাগ….. তুমি…”

সৌহার্দ্য বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে অরুণীর দিকে। ওর চোখের শুভ্র অংশটুকুতে লাল বর্ণের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অরুণীর বুক ধ্বক করে উঠলো সেটা দেখে। সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“অরুণী, তুমি এসব করেছো এতোদিন? সেদিন তুমিই আমার এক্সিডেন্ট করিয়েছিলে? আজাদ চাচা, আমার পিয়ন, বাবার অফিসের কর্মকর্তা এতোগুলো খু*ন তুমি করেছো? মানে সিরিয়াসলি!!”

অরুণী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আমতা আমতা করে বললো,

“নাহ! আমি…. আমি কিছু করিনি!”

“শাট আপ। এতোদিন আমি আর প্রহর তরীকে সন্দেহ করে এসেছি। তোমার কথা তো আমরা ভাবতেই পারিনি! কারণ তোমার এসবে ফোবিয়া ছিল। আর তুমি এতোদিন ভয়ের নাটক করে আসছিলে? যেন আমরা তোমাকে সন্দেহ না করি ! আমিও গাধা ছিলাম। তোমার ফোবিয়া তো কেটে যাওয়ার কথা এতো বছরে! এভাবে সবার চোখে ধুলো দিয়ে এতোগুলো খু*ন কী করে করলে, অরুণী? কেন করেছো এসব?”

সৌহার্দ্যের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলো অরুণী।

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪৪

টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোর খবর দেখে রাগে থরথর করে কাঁপছে তরী। চোখের কার্ণিশ থেকে ছিটকে জল বেয়ে পড়ছে। সব টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে যে, আরমান আহমেদ একজন সফল পলিটিক্যাল লিডার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। পাশ থেকে হাতড়ে রিমোটটা নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো তরী। বেড সাইড টেবিলের ওপর থাকা তার মায়ের ছবিটার দিকে জলসিক্ত চোখে তাকালো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,

“আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা। আমি হয়তো হেরে গেলাম! তোমায় দেওয়া কথাটা আমি রাখতে পারলাম না।”

ছবিতে চওড়া হাসি ঝুলানো মানুষটা শুনলো কি না কে জানে? তরী নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মিস্টার আফনাদের ঘরে গেল। তিনি নিজের ইজি চোয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। চশমাটা কপালে তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। তরী বাবার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। বাবার কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো সে।

মিস্টার আফনাদ হঠাৎ চমকে উঠলেন যেন। সোজা হয়ে বসে চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাটা পড়লেন। তরীর মাথায় হাত রাখলেন পরম যত্নে। তরীর চোখের মোটা অশ্রুকণা গুলো ওনার হাঁটুতে পড়ছে। তিনি বুঝতে পেরে আবেগপ্রবণ গলায় বললেন,

“মা রে! তোকে যেদিন নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়ে নিজের বুকে আগলে নিয়েছিলাম, সেদিন নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোর জীবনে বাবা-মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দিবো না। তোর সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করবো। তোর সাথে র*ক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মায়ার একটা অদৃশ্য বন্ধনে আমি বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবার অভাব পূরণে সফল হলেও তোর মায়ের অভাবটা সারাজীবন-ই রয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারতাম, মোহনা তোকে পছন্দ করতো না, কষ্ট দিতো। তুইও কখনো নিজের দূর্বল খোলসের নিচে থাকা কঠোর রূপটা কাউকে দেখাতে চাসনি। কিন্তু আমার নিজেকে সবসময় ব্যর্থ মনে হতো। তাই তুই আমার কাছে যা আবদার করতি, আমি সব আবদার পূরণ করতাম। তোর অন্যায় আবদার গুলোর বিরুদ্ধেও আমি তোকে কখনো কিছু বলিনি। যদিও মোহনা দেরী করে হলেও তোকে আপন করে নিয়েছে। আমার তখন মনে হচ্ছিল, তোর আসল পরিচয় আগেই ওকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে তোর শৈশবটা সুন্দর কাটতো। মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হতে হতো না। এখন তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে তোর মা কিন্তু বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে! এমনিতেই তোর প্রতি ওর পজেসিভনেস দিন দিন বাড়ছেই।”

মিস্টার আফনাদের কথা শুনে তরী নাক টেনে পুনরায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো,

“আমি আসলেই ব্যর্থ! ঐ লোকটার সাথে পেরে ওঠার আর কোনো ক্ষমতা আমার রইলো না।”

মিস্টার আফনাদ এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তরীকে তার বোঝাতে হবে। উচিত-অনুচিত ভুলে যেই প্রতিশোধস্পৃহা তরীর মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরছে, সেটা দমন করার প্রকৃত সময় এখনই। এই সময়টার উত্তম ব্যবহার মিস্টার আফনাদ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। শান্ত গলায় বললেন,

“তুই ড. আরমান আহমেদকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলি, এতে আমি কখনো তোকে বাধা দেইনি যদিও এটা অনুচিত ছিল। কারণ তোর যুক্তি ঠিক ছিল। আরমান আহমেদ এখন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। অসংখ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি অনেক চ্যারিটি, আশ্রম, স্কুল-কলেজ ওনার অনুদানে চলে। তার ভালোমানুষির এই শেকড় বহু গভীর যা উপড়ে তোলার ক্ষমতা নেই কারো। ওনার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা মানে সমাজে ওর প্রতিষ্ঠিত ভালোমানুষির বিরুদ্ধে যাওয়া। আর এখন তো সে নিজের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করেই ফেলেছে! এখন এটাই ভালো হবে যে, তুই ওকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করিস না আর। অতীতকে অতীতের জায়গায়ই রাখ! ভুলে যা অতীত। নিজের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে দে এবার!”

তরী অবাক হয়ে তাকালো মিস্টার আফনাদের দিকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এই মানুষটা ওকে কোনো কাজে বাধা দিচ্ছে। তাই সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,

“বাবা, তুমি এ কথা বলছো? সারাজীবন আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে আর না-তে না মিলিয়ে এসে আজ তুমি বলছো ঐ লোকটাকে ছেড়ে দিতে?”

মিস্টার আফনাদ হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“আমি তোকে বলিনি ওনাকে ছেড়ে দিতে। আমি শুধু বলেছি তোর অতীতটাকে ভুলে যা। মানুষ পৃথিবীতে সবসময় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বাধা, প্রতিকূলতার কাছে হার মানা মানেই হেরে যাওয়া না। কিছু কিছু বিচার কুদরতের হাতেও ছেড়ে দিতে হয়। উপরওয়ালা মানুষকে তার সব কাজের যথার্থ প্রতিদান দেন। সবটা এক সাইডে রেখে তুই একবার নিজের কথা ভাব, নিজের ভবিষ্যৎকে নিয়ে ভাব। তোর এই প্রতিশোধস্পৃহার শেষ পরিণতির জন্য তোর সন্তান মাতৃহীন হবে, সারা জীবন ভুগবে। সমাজে ওকে শুনতে হবে ওর মা খু*নী ছিল। কেউ কখনো ভালোমন্দ বিচার করতে আসবে না। তারা যা দেখবে ও শুনবে, তা-ই বিশ্বাস করবে। তাই সবদিক বিবেচনা করলে আমার বলা কথাটাই যৌক্তিক।”

তরী মলিন মুখে বললো,

“আমি ছেড়ে দিলেও উনি আমাকে ছাড়বে না, বাবা। সৌহার্দ্যকেও তো বুঝতে পারছি না। ওর সাথে আমার দূরত্ব কোনোদিনই হয়তো মিটবে না।”

মিস্টার আফনাদ তরীর চোখ মুছে দিয়ে বললেন,

“অতীতটাকে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দে, মা। ধরে নে, সৌহার্দ্যও তোর অতীতের একটা অংশ। এখন তোর জীবনটা শুধু-ই তোর সন্তানের জন্য। তুই বাঁচবি তোর সন্তানের জন্য। ড. আরমানের নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দিবো তোকে আমি। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”

মিস্টার আফনাদের কথা শুনে কেন যেন তরীর মনটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল! সে বাবার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো। হাসিতে প্রাণ না থাকলেও নিশ্চিন্ত একটা অনুভূতি ছিল। হঠাৎ মোহনার ডাক পড়লো,

“তরী! কই গেলি? তোর জন্য আচার আনিয়েছি। দেখে যা!”

তরী বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ধীর গতিতে ঘর থেকে চলে গেল। মিস্টার আফনাদ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, সামনে তার অনেক কাজ বাকি।

৪৩.
সৌহার্দ্য নিজের দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে বসে আছে। অরুণী ইতস্তত করে ওর কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসলো। সৌহার্দ্য ওর দিকে তাকালো না। অরুণী ভয়ে ভয়ে বললো,

“আসলে এসব আমিই করেছি, সৌহার্দ্য! অরিত্রী কোনো খু*ন-টুন করেনি কখনো।”

সৌহার্দ্য শান্ত সুরে প্রশ্ন করলো,

“কেন করেছো এসব? সবকিছু করলেও আমার বাবার এক্সিডেন্ট কেন করিয়েছিলে তোমরা?”

অরুণী চুপ করে রইলো। আসল সত্যিটা কীভাবে সৌহার্দ্যকে বলবে ও? সৌহার্দ্য সবটা শুনলে মহাবিপদ হয়ে যাবে। অরুণী কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো,

“আমি বাবার অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারবো না তোমায়!”

সৌহার্দ্য কথাটা শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো অরুণীর দিকে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,

“আসল খু*নী তুমি হলে তুমি আসলেই একটা সাইকো, অরুণী। তোমার বাবা তোমাকে এমন বানিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না।”

সৌহার্দ্য অরুণীর বাসা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের গাড়িতে বসতেই দেখলো, আরমান আহমেদের গাড়ি বাড়িতে প্রবেশ করছে। সৌহার্দ্য ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিলো। হাতে থাকা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। সে জানে না এটার ভেতর কী এমন জিনিস আছে, যাতে ওর মনের সকল প্রশ্নের উত্তর আছে! হয়তো অজানা রহস্যের সমাধান এটার মধ্যেই আছে, যা তরীও এখনো জানে না। নয়তো এটা এতো বছর এতো যত্নে সিন্দুকে রেখেছিল কেন? আর অরুণী-ই বা এটা ওর হাতে যাওয়ার আগে সরিয়ে ফেলেছিল কেন?

সৌহার্দ্য বেরিয়ে যাওয়ার পরই অরুণী অর্ণবকে কল দিলো। ছেলেটাকে কয়েকদিন ধরে ফোন করেই চলেছে ও। কিন্তু অর্ণব ওর কল রিসিভ করছে না। অরুণীর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে এখন অর্ণবের ওপর।

অর্ণব অফিসে বসে একটা ফাইল চেক করছিল। ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় অরুণীর কল দেখেও রিসিভ করলো না। কিন্তু মেয়েটা কল দিয়েই যাচ্ছে। অর্ণব ফাইলটায় সাইন করে ম্যানেজারকে দিয়ে তাকে যেতে বললো৷ এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে অরুণীকে একটা টেক্সট পাঠালো,

“Don’t ever try to communicate with me.”

অর্ণব সব জায়গা থেকে অরুণীকে ব্লক করে দিলো। অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।

বিকেলের দিকে ক্লাস শেষে মধু একবার তরীর সাথে দেখা করে আসে। তরী মোটামুটি স্বাভাবিকই আছে। মনে কষ্ট চেপে রেখে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মেয়েটার। রিকশায় উঠে বসতেই ফোন ভাইব্রেট হলে চমকে ওঠে মধু। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রহর হোয়াটসঅ্যাপে কল দিচ্ছে বারবার। রাগে গা রি রি করে ওঠে মধুর। টানা সাত বারের পর অষ্টম বারে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে সে। শোনা যায় প্রহরে শ্রান্ত কন্ঠ,

“ফাইনালি! তোমরা দুই-ভাইবোন একই পদার্থ দিয়ে তৈরি নাকি? একজনও ফোন রিসিভ করছো না কেন? আশ্চর্য!”

মধু প্রহরের মুখে এমন কথা শুনে স্থান-কাল-সময় ভুলে ভেতরে পুষে রাখা সকল রাগ উগলে দিলো,

“তোর ফোনের মুখে জুতা! তোর ফোন আছে? ইউজ করোস তুই ফোন? তোর মতো পাবলিকের ফোম ব্যবহারের কোনো অধিকারই নাই। দরকারের সময় তো মঙ্গল গ্রহে চলে যাস। দ্যাখ, রাগ উঠাবি না একদম! আমার হাত কিন্তু আমি সব এঙ্গেলেই চালাতে পারি। কখন দেখবি কানাডা গিয়ে তোর মুখে একটা লাগিয়ে দিয়ে আসবো, অবাক হওয়ারও চান্স পাবি না। যত্তসব!”

প্রহর মিটমিট করে হাসতে লাগলো মধুর কথা শুনে। মেয়েটার হুটহাট রাগারাগি, গালাগালি বেশ লাগে ওর। হাসি থামিয়ে আবার স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

“তোমার গালিগুলো কিন্তু এতো দিন দারুন মিস করেছি।”

মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,

“গালি আবার মিস করে নাকি কেউ? আজব পাবলিক মাইরি!”

প্রহর আবারো হাসলো। কিন্তু মধুকে বুঝতে দিলো না। মধু বললো,

“আচ্ছা, এতোদিন যা যা হয়েছে কোনো খবর রেখেছো? দেশ ছেড়ে কি একেবারেই চলে গেছো নাকি?”

“অর্থীর শরীর অনেক খারাপ ছিল। কারো সাথেই যোগাযোগ করা হয়নি তেমন। কেন? কী হয়েছে? ”

মধু প্রহরকে সবকিছু খুলে বললো তরী, সৌহার্দ্য আর অরুণীর ব্যাপার। প্রহর সব শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো,

“এক সপ্তাহও হলো না দেশ ছাড়লাম, আর এরই মাঝে এতো কিছু! আচ্ছা, আমি দুই-তিনদিনের মাথায় ব্যাক করছি।”

-চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে