#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪১
সৌহার্দ্য আজকে খেয়াল করেছে, সকাল থেকেই প্রণয়ী বেশ থমথমে মুখ করে আছে। মেয়েটার মন খুব একটা ভালো তো নেই-ই, তার ওপরে কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তিতও সে। রাতে ডিনারের পর প্রণয়ীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে বলে ঠিক করলো সৌহার্দ্য।
খাবার টেবিলে সবাই যখন একত্রে খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ প্রণয় মিস্টার রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“দাদু, আজকে খাবারের আইটেম গুলো একদম ভালো না। তুমি জানো না, আমার কোয়ালিটি ফুড ছাড়া খেতে ভালো লাগে না?”
মিস্টার রায়হান ছোটখাটো ঢোক গিলে টেবিলে বসা সবার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সবাই মিটমিট করে হাসছে। এটা নতুন কিছু নয়! প্রণয় বরাবরই এমন অদ্ভুত। রাগ, বিরক্তি আর অভিযোগ গুলো সে প্রকাশ করে ফেলতেই অভ্যস্ত সবসময়। আর এই পরিবারের সবাই প্রণয়ের এই স্বভাব সম্পর্কে ভালো করেই অবগত। অন্য দিকে, প্রণয়ী একদম প্রণয়ের বিপরীত। সে অনেকটা ধীরস্থির ও কোমল স্বভাবের। এই ভাইবোন দুজনেই আলাদা ও স্বকীয়, তাদের মা-বাবার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন- ভেবেই অবাক হয় সৌহার্দ্য। প্রণয়ের রাগ ও হঠকারী আচরণ লক্ষ করেও সৌহার্দ্য কিছু বলে না কখনো। সে জানে, প্রণয় ওপর দিয়ে যতটা শক্ত, ভেতর দিয়ে তার থেকে কয়েকগুণ নরম। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনযোগ দেয় সৌহার্দ্য। মিস্টার রায়হান প্রণয়ের বিরক্তি মিশ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে কপট হাসলেন। বললেন,
“এখানে তো সব আছেই, দাদুভাই! আর সবই তো তোমার পছন্দের খাবার, তাই না?”
“কই? না বিফ আছে, আর না আছে চিকেন! খাবারের মেনুতে এগুলো সবসময় চাই আমার।”
বলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার রায়হান আর সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য চুপচাপ খাচ্ছে। কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। মিস্টার রায়হানকে দেখে সুজাতা আর সৌহার্দ্যের দাদী মুখ চেপে হাসছে। প্রহর এখন এই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা, এই পরিবারের একটা অংশ। সে হাসলো কি, হাসলো বুঝতে পারলো না কেউ। প্রণয় আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেয়ে চলে গেল ঘরে।
খাওয়া শেষে সৌহার্দ্য টিস্যু দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বললো,
“আমি আজও প্রণয়ের আচরণের মানে বুঝে উঠতে পারলাম না। ছেলেটা এভানে হুট হাট রেগে যায়। কাছের মানুষদের রাগ দেখিয়ে পরে ঘরে গিয়ে কান্নাকাটি করে। আমি বা তরী কেউ তো এমন ছিলাম না!”
সৌহার্দ্যের দাদী মাথা নাড়িয়ে বিমর্ষ মুখে বললেন,
“আরে ও তো তোদের মতো হয় নাই! ও হইসে আমার মধুর মতো। একেবারে মধুর কার্বনকপি হইসে আমার প্রণয়! মেয়েটার সাথে ঝগড়া না করলে আমার দিন কাটতোই না। আর আজ!!”
সৌহার্দ্যের দাদী আঁচলে মুখ গুঁজলেন। সুজাতা চোখের পানি আড়াল করতে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। মিস্টার রায়হান ভারী নিঃশ্বাস ফেলে প্রহরের দিকে তাকালেন। ছেলেটা নিজের প্লেটের এক-চতুর্থাংশের মতো খেয়েছে মাত্র। বাকি খাবার সামনে নিয়ে নির্জীব হয়ে বসে আছে সে। সৌহার্দ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“প্রহর, আমার একটা হেল্প লাগবে। তুই কি ফ্রী আ….”
“কাল শুনবো। আজ থাক!”
প্রহর খাবার ফেলে চলে গেল। সৌহার্দ্য হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু। মিস্টার রায়হান চোখের কোণের পানি মুছে বললেন,
“আমার দুটো মেয়েকেই আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিলো। আমি তো ওর নিজের ভাই, তাই না? কীভাবে পারলো ও আমার পরিবারকে এই ভীষণ কষ্টে পি*ষ্ট করতে!!”
সৌহার্দ্য কিছু বললো না। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো কোনো এক অজানা, শূন্য কোণে।
প্রণয়ী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। হঠাৎ কারো আগমন টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। প্রণয় এসেছে। কিন্তু কোনো কথা না বলেই চুপ চাপ বিছানায় নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়লো প্রণয়। প্রণয়ী অবাক হলেও কিছু বললো না। সৌহার্দ্য ঘরে এলো আরো ঘন্টা খানেক পর। প্রণয়ী বাবাকে দেখে বললো,
“বাবা, আজকে আমি বড় দিদুনের কাছে ঘুমাবো।”
সৌহার্দ্য হেসে সম্মতি দিতেই প্রণয়ী চলে গেল। সৌহার্দ্য চেয়ে দেখলো প্রণয়ের দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তরীর ঘুমন্ত মুখ। বেডে হেলান দিয়ে চোখের পাতা একত্রিত করে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো সেই স্মৃতিগুলো!
🍁🍂
তরী চলে গেছে প্রায় তিনমাস হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য হাজারো চেষ্টা করেও তরীর খোঁজ পায়নি। এমন কোনো জায়গা বাদ রাখেনি সে, যেখানে তরীকে খোঁজেনি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তরীর অনুপস্থিতিতে সৌহার্দ্য বুঝতে পারছে, সে আজ কতটা অসহায়! প্রহর নিজের দিক থেকে সব চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেও ব্যর্থ। তরী মেয়েটা অদ্ভুত, রহস্যময়ী! ও নিজেকে আড়াল যখন করে ফেলেছেই, তখন আর ওকে খুঁজে বের করা যাবে না। এটা প্রহর ভালো করে বুঝে ফেলেছে। কিন্তু সৌহার্দ্যকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না।
“যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ও স্বেচ্ছায় নিজেকে আড়াল করেছে। তোর বা আমার সাধ্য নেই ওকে খুঁজে বের করার।”
সৌহার্দ্য নির্জীব ভঙ্গিতে বললো,
“আমারই ভুল ছিল। আমি নিজের দেষে ওকে হারিয়ে ফেললাম। ওর কথা মেনে নিতাম, নয়তো ওকে জোর করতাম। যা কিছু করলেও ওকে নিজের থেকে আলাদা করার সুযোগ না দিলেই আজ এই দিন দেখতে হতো না!”
প্রহর হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। ছেলেটা হসপিটালে যাওয়া বন্ধ-ই করে দিয়েছে বলতে গেলে। মুখ দেখলেই বুঝা যায়, সে কতশত রাত নির্ঘুম কাটাচ্ছে। প্রহর ওকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“এতো ডিপ্রেসড্ হোস না! তরী বলেছে না তোকে যে, ও নিজেই ফিরে আসবে! দেখিস, ও নিজের কথা রাখবে।”
“কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ও কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কী করছে কিছু জানি না। তার ওপর ওর তো নিজের শত্রুরও অভাব নেই! আর ওর শরীরের অবস্থা….. ”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“শরীরের অবস্থা? মানে তোর এখনো মনে হয়, ও বাচ্চাটা রাখবে? এই বাচ্চা না রাখার জন্য তোর থেকে দূরে সরে গেল আর তুই এসপেক্ট করছিস যে…. হাহ! এতোদিনে এবোরশন করিয়ে ফেলেছে আই গেস।”
সৌহার্দ্য শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আসলেই তো! আমি আসলেই বোকা। তবে আমার ওকে লাগবে, প্রহর। চাঁদকে ছাড়া আমি আলোহীন, নিকষ। আমার অসহায়ত্ব তোকে কী করে বোঝাই!”
প্রহর আর কিছু বলে উঠতে পারলো না। সে নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তরীর বাবা মিস্টার আফনাদ সবটা জানেন। তিনি জানেন তরী এখন কোথায় আছে, কিন্তু তিনি কাউকে কিছু জানাতে নারাজ। বারবার রিকোয়েস্ট করেও কিছু জানতে পারেনি ওরা। প্রহর বেরিয়ে এসে মিস্টার আফনাদকে আরেকবার কল দিলো,
“আঙ্কেল! তরীর কোনো খোঁজ লাগবে না আমার। আপনি প্লিজ তরীকে বলুন ফিরে আসতে।”
“সম্ভব না, প্রহর। ও যা করছে, তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। নিজেকে বাঁচাতে হলেও ওকে দূরে সরতে হবে। ওকে জন্ম দেইনি আমি, কিন্তু আমার মেয়ে বলে তো ওকে-ই মেনেছি আমি। কীভাবে ওকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিতে পারি বলো?”
প্রহর কিছু বুঝতে পারলো না। অবুঝের মতো বললো,
“আপনি এসব কী বলছেন, আঙ্কেল? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
তখনই ওপাশ থেকে মোহনার কর্কশ কন্ঠ শুনতে পেল,
“বুঝতে হবে না। তোমাদের সাথে কোনো কথা নেই আমাদের। আর কখনো ফোন দিবে না। তরী যেখানেই আছে, ভালো আছে।”
বলেই ফোন কেটে দিলো। প্রহর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। বিরবির করে কিছু একটা বলে নিজের গাড়ির দিকে চলে গেল।
কেটে গেল আরো দুটো মাস! সৌহার্দ্য এ কয়েকদিন নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হয়নি। মধু আর প্রহরের এনগেজমেন্টও পেছাতে হয়েছে। মধু বলে দিয়েছে, তরী না ফিরলে সে এনগেজমেন্ট বা বিয়ে কিছুই করবে না। তরী ফিরবেই, এটা মধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। বাড়ির কেউ বর ওকে কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। বছর ঘুরুক! সৌহার্দ্য একটু স্বাভাবিক হলেই মধুর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলবে বলে ভেবে রেখেছেন মিস্টার রায়হান।
আজ সকাল সকাল সৌহার্দ্যকে রেডি হয়ে বের হতে দেখে মিস্টার রায়হান বললেন,
“হসপিটাল যাচ্ছো?”
“হুম, সিনিয়র ডক্টর অসুস্থ। আমার টিচার ছিলেন উনি। যেতে হবেই।”
“যাক, ভালো! রেগুলার যাওয়া শুরু করে দাও আজ থেকেই। তরী যেখানে আছে, ভালো আছে। ওকে নিয়ে এতো টেনশন করতে হবে না তোমার।”
সৌহার্দ্য নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার বাবার দিকে। মিস্টার রায়হান যে তরীর সব খোঁজ জানেন, এ ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু তিনিও কাউকে জানাতে চান না। সৌহার্দ্যের আজকাল নিজেকে ব্যর্থ সৈনিকের মতো মনে হয়। সে কাউকে নিজের মনের পরিস্থিতি বুঝাতে ব্যর্থ।
হসপিটালে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই কোথা থেকে হঠাৎ অরুণী সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“এতো দিন পর ঘর থেকে বের হলে তাহলে! বউয়ের শোক কাটিয়ে উঠতে পারছো না মনে হয়।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে অরুণীর পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতেই পেছন থেকে অরুণী বললো,
“তোমার বউ তার নিজের বাড়িতেই আছে। তুমি বোকার মতো সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছো!”
সৌহার্দ্যের পা থেমে গেল। হতভম্ব হয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই অরুণী বললো,
“কী? বিশ্বাস হচ্ছে না? আফনাদ আঙ্কেলকে কল করে দেখো।”
সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে ফোন বের করে মিস্টার আফনাদকে কল দিলো। তিনি রিসিভ করতেই সৌহার্দ্য বললো,
“তরী আপনাদের বাসায়ই আছে, তাই না?”
মিস্টার আফনাদ হতভম্ব হয়ে গেলেন সৌহার্দ্যের প্রশ্নে। তাড়াতাড়ি কল কেটে ফোন অফ করে দিলেন। সৌহার্দ্য আবার কল দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ শোনাচ্ছে। সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে অরুণীর দিকে তাকালো। আর কালক্ষেপ না করে দ্রুত গতিতে নিজের গাড়ির দিকে এগোতেই অরুণী ওর হাত আঁকড়ে ধরলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“তুমি যেভাবে তরীর দিকে এগোবে, তরীও সেভাবে মৃত্যুর দিকে এগোবে। তরীকে বাঁচতে দেবো না আমি, তোমাকেও শান্তি দেব না। তুমি আমার না হলে কারো হতে পারবে না, সৌহার্দ্য। কারো না!”
-চলবে…..
##প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪২
“অরুণীকে শীঘ্রই বিয়ে করছি আমি। তাই এখন থেকে ও এই বাড়িতেই থাকবে।”
সৌহার্দ্যের এমন কথায় উপস্থিত সকলের মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন! মিস্টার রায়হান বসা থেকে ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালেন। সুজাতা দ’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলেন। মধুর চোয়াল ঝুলিয়ে মুখ হা হয়ে গেল। সৌহার্দ্যের দাদী তো চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছেন। সকলকে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য সৌহার্দ্যের এই একটা কথা-ই যথেষ্ট ছিল।
মিস্টার রায়হান এগিয়ে এসে নিজের ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। সৌহার্দ্যের ঝুঁকে যাওয়া মুখটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,
“বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক নয়, মূলত তোমার জন্যই অস্বাভাবিক। তোমার স্ত্রী নিখোঁজ। তোমার অনাগত সন্তান সম্পর্কে তুমি অনিশ্চিত। কোনো খোঁজ পাচ্ছি না এখনো মেয়েটার। এই পরিস্থিতিতে তুমি এই মেয়েটাকে এনে বলছো যে, তুমি ওকে বিয়ে করবে? ওর নিকৃষ্ট বাবার সাথে থেকে ও কতটা মানুষ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু ওর ছায়া এ বাড়িতে পড়ুক, সেটা আমি চাই না। আশা করি, তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি!”
মিস্টার রায়হানের কাটকাট বক্তব্য শুনে সৌহার্দ্য মাথা তুলে তাকালো। বললো,
“তুমি সব জানো, বাবা। সবটা জানতে তুমি, তাই না? সব জেনেও আমাকে কিছু জানতে দাওনি। এই দিকে আমি তরীর চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতে ভুলে গিয়েছি, দম বন্ধকর একটা সময় পার করেছি এতো দিন! অন্য দিকে, তোমরা ওকে ওর বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছো সবাই মিলে। আমি সারা দুনিয়া ওকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেই হারিয়ে গিয়েছি মনে হচ্ছিল, আর তোমরা এভাবে আমাকে হয়রান করলে!”
“যা করেছি, সবার ভালোর জন্যই করেছি। তুমি বুঝবে না এতো কিছু। আমি তোমাকে যতটা বুঝদার মনে করতাম, ততটাও তুমি নও।”
“এজন্যই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবা। তোমাদের কারো মনে আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই। কেউ পরোয়া করো না আমার ভালো থাকা, খারাপ থাকা নিয়ে। সবাই নিজে ভালো থাকার কথা চিন্তা করে। তরীকে ছাড়া আমি থাকতেই পারবো না, এটা তোমরাও ভালো করে জানো। তরীও জানে। তবুও নিজের ভালো থাকাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছে ও। ওর কাছে ওর জেদ সবার আগে, আমি নই। যার কাছে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই, তার জন্য যে আমাকে ভালোবাসে তাকে এতো দিন দূরে ঠেলে রেখেছি আমি। কিন্তু আর না! অরুণী-ই আমার জন্য বেস্ট হবে, তাই ওকেই বিয়ে করছি আমি।”
সৌহার্দ্যের দাদী এমন কথায় নিজের বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। চোখ মুখ খিঁচে বললেন,
“আল্লাহ এই দিন দেখানোর আগে আমারে উঠায় নিলো না ক্যান? কী রে, রায়হান? ও বউমা! তোমার ছেলে কি পাগল হইয়া গেল? এমন না-জায়েজ কামকাজ কেমনে করবে ও? নিজের বউয়ের বড় বোনকে…… ছি ছি! এই দিন দেখার জন্য এতো দিন বাঁইচা ছিলাম?”
সৌহার্দ্য বললো, “সমস্যা নেই, দাদী! অরুণীকে বিয়ের আগে তরীকে ডিভোর্স দিয়ে দেব আ….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্যের বাঁ গালে সশব্দে একটা চড় পড়লো। প্রতিটি দেয়ালে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হতেই সবাই চমকে উঠলো। সৌহার্দ্য গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকালো নিজের বাবার দিকে। মিস্টার রায়হান গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন,
“এতোক্ষণ সহ্য করছিলাম তোমায়। দেখছিলাম যে, তুমি ঠিক কতটুকু নিচে নামতে পারো। কিন্তু তুমি তো সকল সীমা-ই পেরিয়ে ফেলেছো! আর নয়। তরীকে জানাচ্ছি আমি সবকিছু। ও আসবে নিশ্চয়ই। এরপরেও যদি তোমার সিদ্ধান্ত না বদলায়, তাহলে ভুলে যাবে যে তোমার কোনো বাবা ছিল।”
মিস্টার রায়হান নিজের ঘরে চলে গেলেন। সুজাতা সৌহার্দ্যের দাদীর পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। মধু চরম বিরক্তি নিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কিছু বলে তোমাকে আবারও ফাঁসিয়েছে, তাই না? আজকে যদি তরী আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়, তাহলে এই জঘন্য মেয়েটাকে এখানেই পুঁ*/তে ফেলবো আমি বলে দিলাম।”
মধু অরুণীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল। অরুণী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে। ও ভাবতেও পারেনি, সৌহার্দ্য এমনভাবে সবার সামনে কথা বলবে! সৌহার্দ্য অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ও? কেন তরীকে এতোটা ভালোবাসে, সেটা ও নিজেও জানে না! কেন অরুণী নামক অভিশাপকে নিজের জীবনে জড়িয়েছিল? আজ ওদের জীবন শেষ করার জন্য অরুণী উঠে-পড়ে লেগেছে। এখন আফসোস হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অরুণীর কথা শুনতে হচ্ছে ওর। নয়তো তরীকে বাঁচতে দেবে ওরা। কিন্তু সৌহার্দ্য এতো কাঁচা কাজ করবে না। মনে মনে অনেক বড় একটা দাবার ছক এঁকে রেখেছে সে। সেই অনুযায়ী-ই কাজ করবে। অরুণী আর ওর বাবাকে জব্দ করার জন্য বেশ বুদ্ধি খাটিয়েই কাজ করতে হবে ওকে। কিন্তু এখন তরী এলে ওকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, সেটা মাথায় আসছে না। নিজে তো বাবার হাতে থাপ্পড় খেয়ে বসে আছে! তরী তো সৌহার্দ্যের মুখে এসব কথা সহ্য-ই করতে পারবে না! ওকে সবটা বুঝিয়ে বলাও যাবে না। নাহ! কাউকেই বলা উচিত হবে না নিজের প্ল্যান সম্পর্কে। শুধু প্রহরকে জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো সৌহার্দ্য।
ভাবনার মাঝেই বাইরে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনতে পেল সৌহার্দ্য। তরী চলে এসেছে! এতো তাড়াতাড়ি! তরীর মুখোমুখি হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো ওর। অরুণী মনে মনে কুটিল হেসে ভাবলো,
“এখন জমবে আসল খেলা! তোর মন ভাঙতে দেখার তাড়া সহ্য হচ্ছে না আমার, অরিত্রী!! আরেকটু তাড়াতাড়ি আয়।”
“তরী, আস্তে হাঁট! এ সময়ে এভাবে ছোটাছুটি করিস না। ধীরে সুস্থে চল। কোনো বিপদ ঘটলে…….”
অর্ণবের কথা কানে ভেসে আসতেই সৌহার্দ্য পেছনে ফিরে তাকালো। অরুণী আর উপস্থিত সবাইও মেইন দরজার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মিস্টার রায়হান আর মধু ছুটে এলো নিজেদের ঘর থেকে।
নিজের শ্রান্ত, দূর্বল দেহটা নিয়ে তরী দরজার পাশের দেয়ালে হাত ভর দিয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। মিস্টার রায়হান বাদে সবাই চমকে উঠলো তরীকে দেখে। সৌহার্দ্য বিস্মিত চোখে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তরী আগের মতোই সাধারণ একটা সুতি শাড়ি পড়ে এসেছে। অসাধারণত্বের কিছু নেই ওর সজ্জায়। কিন্তু তরীর উঁচু উদরটা তাকে গর্ভধারিণীর এক মর্যাদাবান সত্তায় পরিণত করেছে। সৌহার্দ্যের বিস্ময় মাখানো চোখ দুটো অশ্রুপূর্ণ হয়ে গেল মুহুর্তেই। এটা কীভাবে সম্ভব! তরী বাচ্চাটা নষ্ট করেনি! তরীর উঁচু এই গর্ভ তো এটাই প্রমাণ করছে যে, সে ছয় বা সাতমাসের গর্ভবতী।
তরী নিভু নিভু চোখে সবার দিকে একবার তাকাতে তাকাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। অর্ণব ওর বাহু ধরে বললো,
“কথা শুনতে বলেছিলাম। এভাবে ছুটে আসার কী দরকার ছিল? নিজের না হলেও তোমার অনাগত বাচ্চাটার কথা তো ভাবতে পারো?”
“তুমি…. তুমি সরো আমার সামনে থেকে। আমি সৌহার্দ্যের সাথে দেখা করতে এসেছি। ওর সাথে কথা বলবো আমি।”
বলেই অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তরী। সবার মাঝখান থেকে
ওর দৃষ্টি সৌহার্দ্যের ওপরই পড়লো সবার আগে। সেটা বুঝতে পেরে সৌহার্দ্য নিজের চোখের পানিগুলো আড়ালে মুছে ফেললো। তরী এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“কী বলেছিলে তুমি? আমাকে ডিভোর্স দিবে? এই অরুণীর জন্য? এইবার কোন জাল ফেলেছে ও আবার? আমাকে মেরে ফেলবে বলেছে, তাই না?”
“মুখ সামলে কথা বল, অরিত্রী!”
অরুণীর কথায় কপট হেসে তরী বললো,
“তুমি তা ডিজার্ভ করলে বলতাম। এতো নিচে না নামলেও পারতে। জোর করে কখনো কোনো সম্পর্ক তৈরি করা যায় না। সৌহার্দ্যের জীবন থেকে পর চাঁদকে সরানোর চেষ্টায় তুমি কোনোদিনও সফল হবে না।”
তরীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে সৌহার্দ্য বললো,
“অরুণীর কোনো কথা শুনে আমি কিছু করছি না। যা বলেছি, আমি জেনে বুঝে নিজের ইচ্ছায় করছি। আর অরুণীকে বিয়ের সিদ্ধান্তও আমি স্বেচ্ছায় নিয়েছি। ওর কোনো কথা শুনে নয়।”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি আমাকে ভুলতে পারো না, সৌহার্দ্য। তোমার জীবন আমি ছাড়া শূন্য। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা প্রতিটা মুহুর্তে অনুভব করি আমি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবোরশন করার। কিন্তু আমি পারিনি। আমার দ্বারা সম্ভব-ই হয়নি, জানো? তাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছি সবার থেকে। শুধু মাত্র তোমার সন্তানটাকে বাঁচাবো বলে। নয়তো এই অরুণী বা ওর বাবা আমাদের বাঁচতে দেবে না। আর আমার বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারবো না আমি। তাই ভীতুর মতো গা ঢাকা দিয়েছি তোমার বাবার কথায়। তোমার সাথে শেষবার কথা হওয়ার সময় আমি বলেছিলাম, আমি ফিরে এলে তুমি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কারণ আমি তোমার সন্তানকে নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসতাম। তখন ওরা আমার ক্ষতি করতে পারতো না। আর তুমি এই অরুণীকেই এখন বিয়ে করতে চাইছো?”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তরী। এখন তোমার আর আমার মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা এই বাচ্চার দোহাই দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করো না। সেটা কখনো সম্ভব নয়।”
সৌহার্দ্য যত সহজে এই কথাটা বললো, তত দ্রুতই এই কথাটা তরীর হৃদপিণ্ডে আঘাত করলো। সেকেন্ডেই চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো ওর। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য ওকে এই কথাটা কীভাবে বলতে পারলো? সৌহার্দ্যের বাহু চেপে ধরে তরী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এটা তুমি কীভাবে বললে আমায়? আমি আমার বাচ্চার দোহাই দিচ্ছি? তুমি পাগল হয়ে গেছো, সৌহার্দ্য!”
সৌহার্দ্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“সবার সামনে এসব সিনক্রিয়েট করো না। অসুস্থ তুমি। বাসায় চলে যাও। গিয়ে রেস্ট নাও। নিজের খেয়াল রেখো।”
তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের থমথমে স্বাভাবিক মুখটার দিকে। তার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না, সৌহার্দ্যের এমন পাষাণ রূপ। নিজের চোখ মুছে বললো,
“তুমি মুখে যত যা-ই বলো না কেন, সৌহার্দ্য! তোমার ঐ মনের ভেতর শুধু আমারই রাজত্ব। আর ঐ জায়গাটা কেউ নিতে পারবে না কোনো দিন। এটা আমার বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস যদি ভেঙে যায়, তাহলে আমিও সেদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবো। বলে দিলাম!!”
-চলবে……..