#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#সূচনা_পর্ব
১.
কবুল বলা মাত্রই বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। বাক’শ’ক্তি’হীন, বো’বা একটা মেয়েকে বিয়ে করার দায়িত্বটা শুধু পালন করলো আজ সে।
-“বা’ক-প্র’তি*ব’ন্ধী একটা মেয়েকে বিয়ে করে মহান হওয়ার নাটক শেষ হয়েছে আমার? বিয়ে তো শেষ! আই থিংক, এখানে আমার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। ”
এতক্ষণে মাথা তুললো তরী। অশ্রুপূর্ণ, টলমলে চোখে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। আজ শুধু কথা বলতে না পারাটাই তার দোষ! পরিবার, সমাজের কাছে বোঝা সে। মানুষটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, নি’তা’ন্তই অনিচ্ছায় বিয়ের দায়িত্বটা পালন করেছে সে। সৌহার্দ্যের বাবা ছেলের তাড়া দেখে থমথমে গলায় বললেন,
-“বিয়ে শেষ মানেই তুমি চলে যাবে নাকি? বিদায়ের পর বউ নিয়ে ফিরতে হয়। এটাই নিয়ম।”
নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে তা’চ্ছি’ল্যের হাসি হাসলো সৌহার্দ্য। বললো,
-“বিয়ের আরও অনেক নিয়ম-কানুন থাকে, বাবা! সেগুলোর একটাও যখন পালন করোনি, তখন এই বিদায়ের নিয়ম পালন না করলেও চলবে।”
বিয়ের ভরা আসরকে থমথমে বানিয়ে চলে গেল সৌহার্দ্য। একবারও পিছু ফিরলো না। ঘুরে দেখলো না তার চলে যাওয়ার পানে চাতক পাখির মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছলছল চোখ দুটোর দিকে।
তরী চোখ নামিয়ে নিলো। মেহেদী রাঙানো হাতের ওপর টুপটাপ অশ্রুকণা ঝরে পড়লো তার। চোখ দুটো কোনো রকমে মুছে অতি সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমনটাই তো হওয়ার ছিল! জন্মগতভাবেই বাক’শক্তি’হীন সে। তবে কথা বলতে না পারলেও তার শ্রবণশক্তিতে কোনো সমস্যা নেই।
সৌহার্দ্যের মা দো’মনা হয়ে বসে আছেন। বিয়েটাতে তিনি কতটুকু সন্তুষ্ট, সেটা তার মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই। তিনি এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, কী থেকে কী হয়ে গেল! এসেছিলেন বিয়ের নিমন্ত্রণে। আর সেখানে নিজের ছেলেরই বিয়ে হয়ে গেল! কিন্তু যেটা হয়েছে, সেটাকে তো কেউ চাইলেই বদলাতে পারবে না। বাস্তবতাটা মেনে নিতে হবে। তিনি এগিয়ে গেলেন নিজের পুত্রবধূর দিকে। তরীর পাশে বসে তার হাতটা আগলে নিয়ে বললেন,
-“সৌহার্দ্যের কথায়, আচরণে কষ্ট পেয়েছো জানি। পাওয়াটা-ই স্বাভাবিক। তবে সৌহার্দ্যের এমন আচরণ করাটাও কি স্বাভাবিক নয়? তুমি-ই একবার ভেবে দেখো! বিয়েটা কোনো যেন-তেন ব্যাপার নয়। সারাজীবনের সাথে সম্পৃক্ত একটা সিদ্ধান্ত এটা। আর আজ হুট করেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত ওর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা-ও তোমার স্বার্থে। সৌহার্দ্য-ও তোমার এবং তোমার পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা মেনে নিয়েছে। সবটাই নিয়তি, মা! জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এই তিনটা জিনিসের ওপর আমাদের কারো কোনো হাত নেই। এই সত্যিটা সৌহার্দ্যের মেনে নিতে কষ্ট হবে। ও তোমায় স্ত্রী-এর মর্যাদা কতটা দিবে, সেটা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে আমি তোমায় কোনো আশ্বাস-ও দিতে পারছি না। কিন্তু তোমার পাশে সবসময় থাকবো আমি; মা হিসেবে।”
তরীর কান্নামাখা মুখেই হাসি ফুটে উঠলো। সামনের অনিশ্চিত দিনগুলোতে একটা ঝড়ের আভাস দেখতে পাচ্ছে সে। তার প্রখর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, সংসারজীবনটা তার জন্য ঠিক কতটা সংগ্রামতুল্য হবে! তবুও মাতৃস্নেহ-হীন জীবনে একটা মা তো অন্তত পাবে, যে তাকে বুকে আগলে রাখবে সবসময়।
সৌহার্দ্যের বাবা মিস্টার রায়হান বিদায় মুহুর্তে ছেলের অনুপস্থিতিতে বিব্রতবোধ করলেন কিছুটা। সবসময় কনের বাবা বরের হাতেই মেয়েকে তুলে দেন। সৌহার্দ্য উপস্থিত না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তিনি এবং সৌহার্দ্যের মা মিসেস সুজাতা দুজনে মিলে তরীর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিদায়ের সময় তরীর বাবা মেয়েকে বুকে আগলে কান্নামাখা কন্ঠে বললেন,
-“আমাকে ক্ষমা করে দিস, মা। এ জীবনে তোর প্রতি বাবার কোনো দায়িত্ব-ই আমি ঠিকমতো পালন করতে পারিনি। মায়ের অভাব, বাবার অভাব দুটোই একসাথে সহ্য করেছিস তুই। আজ তোকে এভাবে বিয়ে দিয়ে নিজেকে বাবা হিসেবে সবচেয়ে স্বার্থপর ও ব্যর্থ পিতা বলে মনে হচ্ছে। ভালো থাকিস। আমি প্রতি মুহূর্তে তোর সুখ প্রার্থনা করবো।”
তরী নিঃশব্দে কাঁদলো। শব্দের তীব্রতা না থাকায় তার কষ্টের হাহাকার কেউ উপলব্ধি করতে পারলো না। গাড়িতে মিস্টার রায়হান ও সুজাতার মাঝে বসলো তরী। কান্নার ঘোরে থাকায় তরী উপলব্ধি করতে পারছে না যে, এক দম্পতি কন্যাস্নেহে তাকে আবদ্ধ করে রেখেছে। নিঃসঙ্গ জীবনে মা-বাবার অভাব পূরণ হয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু আগামী দিনগুলোর জন্য এটা কি আদৌ যথেষ্ট?
২.
সৌহার্দ্য নিজের চেম্বারে এসে বসেছে আধঘন্টা হলো। এই সময়টুকুর জন্য ব্রেক নিয়েছিল সে। কোনো এপয়েন্টমেন্ট রাখেনি। তাই এ মুহুর্তে সৌহার্দ্যকে দেখে অবাক হলো ওর পিয়ন।
-“আমি আজ কোনো পেশেন্ট দেখবো না। আটটার পর যার যার এপয়েন্টমেন্ট ছিল, সব ক্যান্সেল করে দাও।”
-“কিন্তু স্যার, একটা সার্জারির দায়িত্ব ছিল আপনার। আপনি নিজেই তো দায়িত্ব নিয়েছিলেন!
সৌহার্দ্য আঙুল দিয়ে কপাল স্পর্শ করালো। কিছু মুহুর্ত নীরব রইলো। ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
-“অল ক্যান্সেল!”
পিয়ন অবাক হলো খানিকটা। আমতা আমতা করে বললো,
-“কিন্তু স্যার, আপ্……….”
-“এক কথা বারবার বলা আমার পছন্দ নয়। আই হোপ, তুমি সেটা জানো।”
সৌহার্দ্য ঠান্ডা গলায় কথাটা বললেও পিয়ন বুঝলো, এই মুহুর্তে সে ভ’য়ং’ক’র রেগে আছে। হয়তো অরুণীর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই অরুণীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলো। পিয়ন অরুণীকে দেখেই প্রস্থান করলো।
সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে কপালে আঙুল ঘষতে ঘষতে গভীর চিন্তায় মগ্ন। অরুণীর উপস্থিতি এখনো টের পায়নি সে। অথচ তার চিন্তাজগত জুড়ে এখন অরুণী আর তরী নামক দুজন নারী বিচরণ করছে। একজন তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সুদীর্ঘকালের প্রেমিকা আর অপরজন তার সদ্য বিয়ে করা বউ। দুটো উপাধি তো একজন নারীর-ই পাওয়ার কথা ছিল! তার জীবনের সাথে যে শুধু অরুণীর-ই আবদ্ধ হওয়ার অধিকার! তবে কেন ভাগ্য তাদের মাঝে আরেকটা মেয়েকে নিয়ে এলো?
অরুণী তার প্রিয় পুরুষটির দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসলো। সৌহার্দ্যকে চিন্তিত অবস্থায় দেখতে বেশ লাগছে তার। এই মানুষটাকে প্রতিটা মুহুর্তে-ই ভালো লাগে তার। সবসময়ই! সব পরিস্থিতিতে!
-“ড. সৌহার্দ্য রায়হান এখন মিথ্যে বলা-ও শিখে গেছে দেখছি। কী ভেবেছিলে? আমি কিছু জানতে পারবো না?”
আচমকা এমন কথা শুনে সৌহার্দ্য চমকে উঠলো। অরুণীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কী জানার কথা বলছে মেয়েটা? কোনো ভাবে আজকের বিয়ের কথাটা জেনে গেল না তো? ভেবেই কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেল সৌহার্দ্য।
অরুণী মুখে হাসি বজায় রেখেই বললো,
-“তুমি না আজকে কার বিয়ের ইনভিটেশানে যাবে বলেছিলে? কিন্তু তুমি তো যাওনি দেখছি! মিথ্যে কেন বললে?”
সৌহার্দ্য মনে মনে বিরক্ত হলো। বিয়ের ইনভিটেশান! হাহ! নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে যে সে নিজেই ব*লি হয়ে গেছে, তার নিজেরই বিয়ে হয়ে গেছে, এটা কীভাবে বুঝাবে? এসব মনে পড়লেই প্রচন্ড রাগ লাগছে। তবুও ভরাট কন্ঠে বললো,
-“গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে ব্যাক করেছি।”
-“কী হয়েছে বলো তো! তোমায় কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। এনি প্রবলেম, সৌহার্দ্য?”
অরুণীর কপালে চিন্তার ভাজ। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে জানালার দিকে পা বাড়ালো। সন্ধ্যার গু’মো’ট আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। এই মেয়েটার কাছ থেকে কিছু লুকানো অসম্ভব। ও যে সৌহার্দ্যের সম্পুর্ণ সত্তাটাকে বেশ ভালোভাবে চেনে। সৌহার্দ্য মলিন হাসলো। বললো,
-“তুমি আমাকে এতো চেনো কী করে বলো তো!”
অরুণী কাছে আসলো। সৌহার্দ্যের বুকে মাথা রাখলো। সৌহার্দ্য ওকে এক হাতে আগলে নিতেই বললো,
-“ভালোবাসি, তাই। কখনো আমার থেকে কিছু লুকিও না, সৌহার্দ্য। তোমার সুসময়ে, দুঃসময়ে সবসময় তোমার পাশে ছিলাম। ভবিষ্যতেও থাকবো। শুধু আমাদের একে-অপরের বিশ্বাসের মধ্যে যেন বিন্দুমাত্র ফাটল না ধরে!”
সৌহার্দ্যের হাত আলগা হয়ে গেল। কিছুটা থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। একদিকে অরুণী, অন্য দিকে তরী! কাকে বেছে নেবে সে? তরীকে ছাড়তে হলে পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে হবে। সেটা তো কোনো মতেই সম্ভব নয়! আবার অরুণী যে তার জীবনের প্রতিটি অংশের সাথে জড়িয়ে আছে! ওকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতে পারে না সৌহার্দ্য। কী করবে এখন সে? কেন তরী ওদের মাঝে এভাবে ঢুকে পড়লো? ওদের সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনটাকে এলোমেলো করে দিলো! অরুণীকে সবটা বলে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মেয়েটা সহ্য করতে পারবে তো সত্যিটা!
বেশ কিছুক্ষণ পরিস্থিতি নীরব রইলো। নীরবতায় ইতি টেনে অরুণী বললো,
-“দেখেছো, সৌহার্দ্য! আজ আকাশে থালার মতো এক চাঁদ উঠেছে। আর কয়েকটা দিন পর এমনই কোনো ভরা পূর্ণিমায় আমরা জ্যোৎস্না-বিলাস করবো আর আমাদের দেখে প্রণয়াসক্ত হবে এই চাঁদটা-ও!”
সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেললো। এটা কি আদৌ কখনো সম্ভব? এই অ’গো’ছা’লো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার যে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে তার!
চলবে…..