#প্রজাপতির_রং🦋
#Last_Part(প্রথামাংশ)
#Writer_NOVA
সময় তার নিজস্ব গতিতে ছুটে চলে।তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারো নেই। এতটা দ্রুত সময় চলে যায় যে তার হিসেব করতে গেলেও আমরা অবাক হয়ে বলি, “এতদিন চলে গেছে!!!”আর আমরা কেউ টেরও পেলাম না।সুখের সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়।দুঃখের সময়টা হয়তো কাটতে চায়না বলেই এত দীর্ঘ মনে হয়।
সেদিন পার্টির থেকে ফেরার পর আমার জীবন থেকেও পাঁচ মাস চলে গেছে। পাঁচ মাস আগে সবাই একসাথে কত আনন্দ করেছিলাম পার্টিতে।অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা।পাঁচ মাসে বদলে গেছে অনেককিছু। আরিয়ান,এরিন, আদর,মুসকান, তায়াং ভাইয়া, নূর আপি, রোশান, জারা ওদের চার জুটির বিয়ে হয়ে গেছে। তারা এখন যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।মাস তিনেক আগে হিমির তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। শুনেছি হিমির বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজছে তার পরিবার।আরিয়ান ও মুসকানের বিয়ের পরই আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি।চার রুমের এই ফ্লাটে আমি, এনাজ, নাভান ছাড়াও নীতু,এনাম ও এনায়েতও রয়েছে। তাদের দুই ভাইয়ের একটাই কথা এক ফ্ল্যাটেই তারা থাকবে।ঠিকানাবিহীন বাড়ির লোকজন সেখানে থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করেছে।কিন্তু এনাজ থাকতে নারাজ।দুই ভাই একসাথে অন্যের বাসায় থাকবে বিষয়টা খারাপ দেখায়।তাই এনাম,এনাজ একসাথে এই ফ্ল্যাটটা কিনে নিয়েছে। সারাটাদিন আমাদের দুই জা-এর ভালোই কাটে।রান্নাবান্না করা আর সংসার, বাচ্চা সামলানো।আরজে ক্যারিয়ার ও কোম্পানির চাকরী দুটোই পাঁচ মাস আগে ছেড়ে দিয়েছি।এখন চোখের পলকে দিন চলে যায়।এনাজ ও আরিয়ান মিলে এখনো কোম্পানি চালাচ্ছে। এনাম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্কিটেকচার হিসেবে জয়েন করেছে। কিছুদিন আগে আমাদের বিয়ের চার বছরের এনিভার্সারি পালন করেছি আমরা।আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি।জীবনটা যে এরকম হবে তা কখনো ভাবতেও পারিনি।স্বপ্নের মতো সবকিছু কাটছে।
এতসব ভাবনার মধ্যে নীতুর ডাকে হুশ ফিরলো।কখন যে ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও জানি না।
নীতুঃ চুলো তো খালি যাচ্ছে ভাবী।কি বসাবো এখন? ও ভাবী কোথায় হারিয়ে গেলে?
আমিঃ হ্যাঁ, কিছু বলছিলে।(চমকে)
নীতুঃ হ্যাঁ বলছিলাম।তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
আমিঃ পুরনো কথা ভাবছিলাম।
নীতুঃ সেসব কথা পরে ভেবো।এখন বলো কি রান্না করবো? মেহমান তো চলে আসবে।
আমিঃ সরো আমি করছি।
নীতুঃ একদম না।তুমি বলো আমি করে নিচ্ছি। তাছাড়া মিতা কাকি(কাজের লোক) তো আছেই।তাকে নিয়ে আমি করতে পারবো।তোমার এই অবস্থায় কিছু করতে হবে না। পরে কোন অঘটন ঘটে গেলে বড় ভাইয়া আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে।আমি বাবা আমার সংসার হারাতে পারবো না।
নীতুর কথা বলার ভঙ্গিতে আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম।
আমিঃ আমি বুঝিনা মাত্র তিনমাস চলছে আমার।কিন্তু তোমরা সবাই যেমন শুরু করেছো তাতে মনে হচ্ছে কিছু দিন পর বেবী হবে।
নীতুঃ আমি এতকিছু বুঝি না বাপু।তুমি চুলোর সামনে আসতে পারবে না, ব্যাস এটাই শেষ কথা। দূরের টুলে বসে আমাকে বলে দেও কিভাবে কি করতে হবে?
আমিঃ নাভান কোথায়?
নীতুঃ এনানকে দেখলাম এনায়েতের দোলনা ধাক্কা মারছে।তার ছোট ভাই জেগে থাকলে তার কি আর কিছু লাগে?
যুদ্ধ করেও সফল হতে পারলাম না।কিচেনে ঢুকতেই দিলো না নীতু।এনাজ মহাশয়ের আদেশ আমি যেনো কিচেনের আশেপাশেও না থাকি।আমার যেনো কোন কাজ না করতে হয় তার জন্য মিতা কাকিকে রেখেছে। ভারী কাজগুলো উনি করে দেয়।বাকিটা নীতু করে নেয়।এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন এত যত্ন কিসের জন্য?হ্যাঁ, আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসবে।আমরা তিনজন থেকে এবার চারজন হবো।তিন মাসের প্রেগন্যান্ট আমি।অথচ বাড়ির সবাই এমন হাব-ভাব করে যেনো আর কয়েকদিন বাকি আছে বেবী হওয়ার।সব অবশ্য এনাজের পাগলামি। আজ আমাদের বাসায় মেহমান আসবে।মেহমান অন্য কেউ নয়।গ্রাম থেকে আম্মু, আব্বু ও ইভা আসবে।তার জন্য এত রান্নাবান্না। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর একপ্রকার যুদ্ধ করেই আম্মু-আব্বুর অভিমান ভাঙাতে পেরেছি।এনাজের কথাটা অবশ্য তায়াং ভাইয়া তার বিয়ের দিনই আব্বু-আম্মুকে বলে দিয়েছিল।তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি।তারপর তায়াং ভাইয়ার মুখে সবটা শুনে বিশ্বাস করে নিয়েছে। কারণ তায়াং ভাইয়া মিথ্যে বলার ছেলে নয়।তারপর চলেছে আমাদের মান-অভিমানের পালা।আমি এতদিন তাদের সাথে যোগাযোগ করিনি বলে সেকি রাগ।অবশেষে গত পরশু তাদের রাগ ভেঙেছে। আজ সপরিবার আমাদের বাসায় আসবে।কোলিং বেলের শব্দে ভাবনার জগতে আবারো ছেদ পরলো।
নীতুঃ উনারা বোধহয় চলে এসেছে।
আমিঃ আমি খুলে দিচ্ছি। তোমরা কাজ করো।
নীতুঃ কিচ্ছু করতে হবে না তোমার। তুমি এখানে বসো।আমাকে কি তোমার চোখে পরে না।
আমিঃ সারাদিন এভাবে শুয়ে-বসে থাকতে কার ভালো লাগে। একটা কাজও করতে দেও না তোমরা।এভাবে থাকতে থাকতে আমি গুলুমুলু হয়ে যাচ্ছি। সেদিকে খেয়াল আছে কারো?
নীতু কিচেন থেকে এক গ্লাস ফলের জুস এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো।
নীতুঃ কথা কম বলে এতটুকু শেষ করো তো।
আমিঃ পেয়েছো কি তুমি? আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে কি মেরে ফেলবে নাকি।একটু আগে না একগাদা ফল জোর করে খাওয়ালে।এখন আবার এসব।আমি কুমড়ো পটাস হয়ে যাবো।
নীতু আমার কথার উত্তর দিলো না।আমার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিলো।ততক্ষণে আবার কোলিং বেল বেজে উঠলো।
নীতুঃ এসতেছি।একটু ওয়েট করেন।
নীতু ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলতে চলে গেলো।মেয়েটাকে যত দেখি তত অবাক হই।বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকে বড় হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।জন্ম অবশ্য বাংলাদেশে।বাবা-মা অনেক আদর-যত্নে বড় করেছে তাকে।অথচ নেই মনে কোন অহংকার, দাম্ভিকতা।বর্তমানে পুরো সংসার নীতুই সামলাচ্ছে। সবদিকে ওর সমান নজর।এমনকি আমি কি খাবো না খাবো সেদিকেও তার খেয়াল।অল্প সময়ে সবার মন জয় করতে পারে। আমি নীতুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিলাম।আমাকে উদ্দেশ্য করে মিতা কাকি মসলাগুঁড়া করতে করতে বললো।
মিতাঃ রাজ-কপাল রে মা তোর।যেমন তোর জামাইডা ভালা।তেমনি দেওর, দেওরের বউ।আজকালকার দিনে এমন জাল(জা) পাওয়া যায় না।আমি তো প্রথম প্রথম মনে করছিলাম তোর আপন বোইন।এমন ভাগ্য সবার হয় না রে।তোর মাত্র তিন মাস তাও দেখ সবাই তোর কিছু হইলে পাগল হইয়া যায়।তোরে মাথায় কইরা রাখে।আর আমগোর বড় পোলার পর যহন ছোট মাইয়াডা হইলো।তহন নয় মাসের পেট লইয়াও সংসারের সব কাম করতে হইছে।কেউ একটু উঁকি মাইরাও দেখে নাই।
আমিঃ আপনি ঠিক বলছেন কাকি।আমার জামাই,দেবর,জা সবাই অনেক ভালো।এই যুগে নীতুর মতো জা পাওয়া ভাগ্যে ব্যাপার।মেয়েটা আমাকে নিজের বড় বোনের মতো মনে করে।যেখানে আমি আছি সেখানে ও আছে। আমি যেখানে নেই সেখানে ও নেই। সবকিছু আমার কথাই করবে।যেদিন থেকে শুনলো আমি প্রেগন্যান্ট সেদিন থেকে কোন কাজে হাত লাগাতে দেয়না।আর নাভানের আব্বু তো আরেক পাগল।সবসময় আমার খেয়াল রাখবে।অফিসের ফাঁকে ফাঁকে এতবার কল দেয় আমি নিজেও বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্তু নাভান হওয়ার সময় আমার খালাতো ভাইটাকে ছাড়া আর কাউকে পাইনি।আমার ভাইটা আমার জন্য যা করছে এই সময় নিজের আপন ভাইও হয়তো এতো করে না।হয়তো ছেলের সময় এত কষ্ট করেছি বলেই আল্লাহ এই সন্তানের সময় এত সুখ রেখেছে।
মিতুঃ পুরান কথা আর মনে করিস না তো।যেগুলা মনে করলে মন খারাপ হইবো তা কখনো মনে করবি না।তার চেয়ে এহন কত ভালো আছোত তা ভাইবা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাবি।
আমিঃ ঠিক বলেছেন কাকি।
নীতুঃ ভাবী,দেখে যাও কারা আসছে।
ড্রয়িং রুম থেকে নীতুর ডাক আসতেই আমি সেদিক ছুটলাম।গিয়ে দেখি আম্মু-আব্বু, ইভা চলে এসেছে। আমি সামনে এগিয়ে যেতেই ইভা আমাকে জোরে জাপটে ধরলো।তা দেখে আম্মু চেচিয়ে উঠলো।
আম্মুঃ ইভা আস্তে ধর।পেটে ব্যাথা পাবে তো।
ইভাঃ কেমন আছো বোইনে?
আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
ইভাঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। যদি এনাজ ভাইয়া গাড়ি না পাঠাইতো তাহলে আমি এতক্ষণে হাফ মরা হয়ে যেতাম।জানোই তো বাসে উঠলে বমি করি।
আমিঃ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।আসসালামু আলাইকুম আব্বু।কেমন আছো?
আব্বুঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা।তুই কেমন আছিস? নাভান কোথায়? ওকে যে দেখছি না।
আমিঃ নাভান, নাভান।দেখে যাও কে আসছে।
নীতুঃ তুমি তাদের সাথে কথা বলো।আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি।
আমিঃ আচ্ছা।
নীতু কিচেনের দিকে চলে গেল।আমি নাভানকে ডাকতেই রুম থেকে বের হয়ে এলো।নাভানকে আব্বু কোলে তুলে নিয়ে কথা বলতে লাগলো।আমি গুটি গুটি পায়ে আম্মুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মু মাত্রই বোরখা খুলেছে। আমি সামনের থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
আম্মুঃ এই বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন?এখন কি তোর কান্নার সময়।এখন রেস্ট নিবি।আমাদের নাত-নাতনীর কোন সমস্যা হলে তোর খবর নিয়ে ফেলবো।
আমিঃ সরি আম্মু।আমার তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার দরকার ছিলো।আমি শুধু নিজের দিকটাই ভেবেছি। তোমাদের দিকটাও ভাবা উচিত ছিলো।(কান্না জড়ানো কন্ঠে)
আম্মুঃ ধূর বলদী মেয়ে। বাদ দে তো এসব।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।আমাদেরও তোর দিকটা ভেবে দেখা উচিত ছিলো।আমরাও তো জোর করে তোর ওপর আমাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিলাম।এখন ভাবি কতবড় ভুল হতো যদি তোর সাথে রোশানের বিয়েটা হয়ে যেতো।তাই এসব ভুলে যা।পুরোনো কথা মনে করে একদম প্রেশার বাড়াবি না।নিজের খেয়াল রাখ।যে আসছে তাকে কষ্ট দিস না।
আম্মু আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।তারপর কপালে একটা চুমু দিলো। আমি শক্ত করে তাকে আবার জড়িয়ে ধরলাম।
আমিঃ যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আব্বু চলো তোমাদের রুমে নিয়ে যাই।
আব্বুঃ জামাই কোথায়? নাভানের চাচ্চুকেও তো দেখতাছি না।
আমিঃ তারা দুপুরের খাবারের সময় আসবে।এখন কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলো সবাই।
আম্মুঃ হ্যাঁ রে নোভা।তোর খালামণিরা আসবে না?
আমিঃ খালামণি ও খালু নাকি সকালে তাদের গ্রামের বাসায় গেছে। তাদের জমিজমা নিয়ে নাকি সমস্যা হইছে।তন্বীকে বলছিলাম।কিন্তু তন্বী অসুস্থ আসবে না। তায়াং ভাইয়ার কাজ আছে। কাজ শেষ করে সন্ধ্যার সময় নূর আপিকে নিয়ে চলে আসবে।
আমি আম্মু,আব্বুকে রুম দেখিয়ে নাভানকে নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম।আম্মু-আব্বুকে শরবত নাস্তা দিয়ে নাভানকে খাওয়াতে বসতে হবে।সকাল থেকে আমার ছোট সাহেব কিছু মুখে দেননি।
🦋🦋🦋
রাতে খাবার টেবিলে………
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সবাই। আমি, নীতু,নূর আপি সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছি। আম্মু,আব্বু,ইভা,
এনাম,এনাজ,তায়াং ভাইয়া খাবার খাচ্ছে। নাভান, এনায়েতের সাথে সোফায় বসে খেলছে।এনায়েত খিলখিল করে হাসছে।সেই হাসির ঝংকার আমাদের কানেও এসে বারি খাচ্ছে।
নীতুঃ ভাবী তুমিও বসে পরো।আর নূর আপি আপনিও বসে পরুন।আমি সবকিছু সামলে নিতে পারবো।আমি থাকতে মেহমান কাজ করবে এটা কিন্তু ঠিক নয়।
নূরঃ না ঠিক আছে। তোমাদের রেখে আমি বসি কিভাবে? একসাথেই খাবো।নোভা তুই বসে পর।
আমিঃ হুম মানুষ খুঁজে পাও না।তোমাদের ছাড়া আমি খেতে বসবো।
নীতুঃ আমাদের সাথে তোমার জোড়া নয়।তোমার ঠিক সময়ে খেতে হবে।
তায়াংঃ এত ঝগড়াঝাঁটির দরকার নেই। তোমারা তিনজন একসাথে খেয়ে নিও। এখন এত কথা বাদ দেও।
আমিঃ তায়াং ভাইয়া তোকে কি দিবো? নাভানের আব্বু তুমি দেখছি কিছু নিচ্ছো না।এনাম কি লাগবে তোমার? আব্বু আরেকটু ভাত দেই।
আব্বুঃ তুই ব্যস্ত হোস না।আমরা নিয়েই খেতে পারবো।মেয়ের বাসায় আবার কিসের লজ্জা। কি বলো এনাম বাবাজী?
এনামঃ আমি আর কি বলবো আঙ্কেল?আপনার মেয়ের বাসা মানে আপনারও বাসা। তবুও যত হোক আপনি আমাদের মেহমান।আপনাদের যত্নআত্তি তো করতে হবে।
আমি অনেকখন ধরে একটা প্রশ্ন করার জন্য হাসফাস করতে লাগলাম।আসলে প্রশ্নটা এনামকে নিয়ে। কিন্তু কিভাবে করবো তাই খুঁজতে লাগলাম।এখন না করলে পরে সকালে আবার এনামকে পাবো না।একমাত্র রাতের খাবারের টেবিলেই ওকে পাওয়া যায়।আমাকে এমন অস্থির হতে দেখে তায়াং ভাইয়া বলে উঠলো।
তায়াংঃ কি রে শাঁকচুন্নি কি হয়েছে তোর?এতো ছটফট করছিস কেন?
তায়াং ভাইয়ার কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকালো। এনাজ তো পারলে তখুনি পাগল হয়ে যায়।আম্মু,আব্বু,নূর আপি,নীতু,ইভা সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলো।
এনাজঃ কি হয়েছে তোমার বাটারফ্লাই? তুমি ঠিক আছো তো? অনেক খারাপ লাগছে?
আম্মুঃ কি রে নোভা কি হলো তোর?
আমিঃ আরে আমি ঠিক আছি।তোমরা শুধু শুধু পাগল হয়ে যাচ্ছো।
নীতুঃ তায়াং ভাইয়া যে বললো তুমি ছটফট করছো? খারাপ লাগছে কি? বমি পাচ্ছে? তেঁতুল এনে দিবো?
আমি নীতুর সামনে গিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে বললাম।
আমিঃ আমার কিছু হয়নি রে বোন।তুমি থাকতে কি আমার কিছু হতে পারে। এমন একটা বোন পেয়েছি আমি।এটা তো আমার সাত কপালের ভাগ্য। তোমরা সবাই আমার যে খেয়াল রাখো তাতে তো মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার বেবী যেনো আরো ছয় মাসের বদলে বারো মাস পেটে থাকে।তাহলে আমি এই যত্ন গুলো আরো ছয়মাস বেশি পাবো।
নূর আপি আমার কথা শুনে পেছন থেকে কান টেনে ধরে বললো।
নূরঃ ওরে ফাজিল মেয়ে। তোর মনে এখন এসব ঘুরছে।এরকম আজগুবি কথা বাদ দে।
নীতুঃ আরো জোরে ধরো।আমি তো আর ধরতে পারি না।যত হোক বড় জা না থুক্কু বড় বোন হয় আমার।
আমিঃ ছাড়ো নূর আপি। লাগছে তো।
নূর আপি আমার কান ছেড়ে দিয়ে পিঠে হালকা করে একটা থাপ্পড় দিলো।আমি নীতুকে ছেড়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।সামনে তাকিয়ে দেখি খাবার রেখে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমিঃ কি হলো খাচ্ছো না কেন? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
তায়াংঃ তুই কি কিছু বলবি?
আমিঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি কিছু বলতে চাইছিলাম।
আমার কথা শুনে সবাই আবার উৎসুক চোখে তাকালো।এনাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
এনাজঃ কি কথা?
আমিঃ এভাবে তাকানোর কিছু হয়নি।আসলে এনামের বিষয় একটা কথা জানার ছিলো।এতদিন কথাটা মাথায় ছিলো না। এখন সারাদিন আজাইরা থাকি তো তাই এসব কথা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে।
এনামঃ কি কথা ভাবী?
আমিঃ এনাম যে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলো সেটা কার সাহায্যে? আর সেবার মারামারি করার সময় এনাজ তুমি বলেছিলো এনামকে তুমি ফ্ল্যাট বিক্রি করে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছিলো।কিন্তু তখন কি তোমাদের দুই ভাইয়ের একে অপরের সাথে যোগাযোগ ছিলো? না মানে এনাম কি করে জানলো এনাজ বেঁচে আছে? আর ওর সাথে যোগাযোগ কি করে হলো?
এনামঃ এই কথা, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম কি না কি বলবে ভাবী?
এনাজ বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে আমার ওড়নায় মুখ মুছলো।তারপর হাত মুছতে মুছতে বললো।
এনাজঃ তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি। আমি যখন সুস্থ হলাম তখন তোমাদের সবাইকে খুঁজেছি।তোমাদের কাউকে তো পাইনি।তখন এনামের খোঁজ লাগানো শুরু করলাম।এনামকে পেতেও আমার মাসখানিক লাগলো।আমি যে এনাজ সেটা ওকে বিশ্বাস করাতে লাগলো আরো একমাস।ও তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না আমি ওর ভাই। তারপর আমার পালিত বাবা ওকে সবকিছু বলায় বিশ্বাস করে। এই আহাম্মকটা আমায় তায়াং-এর কথা তখন জানায়নি।তাহলে তো আমি তায়াং-এর সাথে দেখা করে তোমায় খুঁজে পেয়ে যেতাম।যখন বললো তখন আমি ইংলেন্ডে ছিলাম।ওকে বিশ্বাস করানোর পরই আমি ফ্ল্যাট বিক্রি করে ওকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিলাম।যেহেতু এনামের ওপর একবার হামলা হয়েছে তাই আমি ওকে নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম।আমিও বাংলাদেশে থাকবো না।ট্রিটমেন্টের জন্য ইংল্যান্ডে চলে যাবো, এদিকে এনামকে নিয়ে টেনশন, অন্য দিকে তোমাকেও খুঁজে পাই না।তখন আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ করে বাবা(মুরাদ সাহেব) আমাকে বুদ্ধি দিলো এনামকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে।আর ওর কোন খোঁজ কাউকে না দিতে।আমিও সেই অনুযায়ী কাজ করলাম।ওকে পাঠানোর জন্য টাকার প্রয়োজন ছিলো।ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিলাম।এবার বুঝেছো? আমাদের দুই ভাইয়ের আগের থেকেই যোগাযোগ ছিলো।অস্ট্রেলিয়ায় থাকা অবস্থায় আমাদের প্রতিদিন কম-বেশি কথা হতো।
আমিঃ ওহ এই ব্যাপার।বাপরে!! কত প্যাচগোচ।
এনায়েতের কান্নার আওয়াজ পেতেই নীতু জলদী সেদিকে চলে গেল।তখন নাভান দৌড়ে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
নাভানঃ আম্মু, আমাদের পুতুল বেবী কবে আসবে? ওকে এখুনি নিয়ে আসো না প্লিজ।
আমিঃ এখন কি করে আনবো মানিক? সে তো এখনো বড় হয়নি।আরো ছয়মাস পর আল্লাহ যেদিন পাঠাবে সে সেদিন আসবে।
নাভানঃ না আমার এখন লাগবে। একটা বোইনা লাগবে।
এনাজঃ এদিকে আসো তো বাবাই।আমার কাছে এসো।
এনাজ দুই হাত বাড়িয়ে নাভানকে ডাকলো।নাভান আমাকে ছেড়ে ওর বাবার কোলে চলে গেল।
আমিঃ ছেলে হলে কি দোষ 😕?
আমার কথা শুনে সবাই একসাথে বলে উঠলো,,,,
#চলবে
#প্রজাপতির_রং🦋
#Last_Part(শেষাংশ)
#Writer_NOVA
আমার কথা শুনে সবাই একসাথে বলে উঠলো,,,,
— না মেয়ে চাই!!!
আমি সবার দিকে চোখ বুলিয়ে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে উত্তর দিলাম।
আমিঃ মেয়ে কি এখন আমি বানিয়ে আনবো?আল্লাহ খুশি হয়ে যা দিবে তাতেই আমি সন্তুষ্ট।
আম্মুঃ আল্লাহ যা দিবে তাতেই খুশি।
আমিঃ তোমাদের জামাই,নাতি তো পুতুল বেবীর জন্য পাগল হয়ে গেছে। জানো আম্মু এনাজ ছেলের মাথাটা খেয়েছে।ওকে পুতুল বেবী চাই বলে উসকানি দিয়েছে।প্রথম যেবার অফিসে বেবীর কথা বললো।সেদিন নাভানের কানে কানে কি জানি বলে ওকে রাজী করে ফেললো।পরে জিজ্ঞেস করে জানি সে নাকি বলেছে যদি আমার কাছে পুতুল বেবী চায় তাহলে নাভানকে অনেকগুলো ট্রয়(খেলনা) কিনে দিবে। সেই খুশিতে আমার ছেলে এই যে শুরু করলো পুতুল বেবী চাই। শেষ অব্দি তার আবদার মানতে আরেকজনকে আনতেই হচ্ছে।
নূরঃ নোভা, তুই বেশি বেশি নামাজ পরে মেয়ে চাইবি।তাহলেই আল্লাহ মেয়ে দিবে।
আমিঃ আমি একা চাইলে হবে না। আপনারাও চাইয়েন।আমার ছেলেকে মেয়ের জামাই বানাতে চাইলে জলদী জলদী মেয়ে নিয়ে আসেন।
আমার কথা শুনে নূর আপি মাথা নিচু করে ফেললো।তায়াং ভাইয়া আপিকে কি জানি চোখের ইশারায় বললো সেটা দেখে নূর আপি তাকে চোখ রাঙালো।এনাজ,এনাম,নিতু,নাভান, নূর আপি,তায়াং মোট কথা সবাই মেয়ে বাবুর জন্য পাগল হয়ে গেছে। এবার আল্লাহ সবার কথা কবুল করলেই হলো।
তায়াংঃ নূর, খেয়ে রেডি হও।আমাদের বের হতে হবে তো।
আমিঃ কোথায় যাবি তুই? এই রাতের বেলা কোথাও যেতে পারবি না। তোর যদি যেতে হয় তাহলে চলে যা।নূর আপি কোথাও যাচ্ছে না।
আব্বুঃ এলেই তো সন্ধ্যার সময়।এখন আবার কোথায় যাবে রাতটা থেকে যাও,তায়াং।এত রাতে যাওয়ার দরকার নেই।
এনাজঃ কোথাও যাচ্ছিস না তোরা।এক পা বাইরে দিয়ে তো দেখ।তোর সাথে আর কোন কথা নাই।
তায়াংঃ কিন্তু এনাজ!!!
আম্মুঃ তোর খালু, জামাই যখন বলেছে থাকতে তাহলে আবার কিসের কথা।কতদিন পর সবাই একসাথে হয়েছি।আবার কবে হবে তার ঠিক আছে।
তায়াং ভাইয়া আর মানা করতে পারলো না।এনায়েতকে খাইয়ে,ঘুম পারিয়ে নীতু চলে এলো।সবশেষে আমি,নীতু ও নূর আপি খেতে বসলাম।আমার খাওয়া মাটিই গেলো।এক পিস মাছ নিয়ে খেতে বসছিলাম তারপর ইতিহাস।গা গুলানো শুরু হয়ে গেলো।বমি বমি লাগতেই না খেয়ে উঠে পরলাম।
🦋🦋🦋
সবাই একদফা গল্প করে ১২ টার দিকে ঘুমাতে গেলো।সবার বিছানা ঠিক করে দিয়ে, খাবার-দাবার গুছিয়ে আমি রুমে ঢুকলাম সাড়ে ১২টার দিকে।নীতু একা কত সমলাবে।অবশ্য আমাকে করতে মানা করেছিলো।কিন্তু আমি জোর করে বাকি কাজগুলো করে নিয়েছি।রুমে ঢুকতেই দেখি এনাজ নাভানকে ঘুম পারিয়ে ফেলেছে। সে নিজেও ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ঝিমাচ্ছে। আমার আসার শব্দ পেয়ে ফট করে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো।
আমিঃ কি ব্যাপার ঘুমাচ্ছো না কেন?
এনাজঃ তোমার আসার সময় হলো?
আমিঃ রান্নাঘরের কাজ সেরে ফিরলাম।
এনাজঃ তুমি বসো আমি আসছি।
আমিঃ কোথায় যাচ্ছো? সবাই তো শুয়ে পরেছে।আগামীকাল অফিসে যাবে তো তুমি। এবার ঘুমাও।আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। একটু তেল দিলে বোধহয় ভালো লাগতো।
এনাজঃ কে বলেছিলো কাজ করতে যেতে?
আমিঃ কিরকম কথা বলো? মেয়েটা একা একা সারাদিন সব করলো।এখনো কি কষ্ট দিবো? তাছাড়া মেহমান তো আমার এসেছে। আমি যদি কাজ এগিয়ে না দেই তাহলে কি বিষয়টা ভালো লাগে।
আমার কথার মধ্যে এনাজ ল্যাপটপটা পাশে রেখে খাট থেকে উঠলো।তারপর ডেসিং টেবিল থেকে তেলের বোতল নিয়ে এলো।
এনাজঃ হ্যাঁ,বুঝেছি কামিনী মহাশয়া।এবার এদিকে আসেন।চুপ করে খাটে বসেন তো।আমাকে একটু আপনার সেবা করতে দেন।
আমিঃ তুমি তেলের বোতল দিয়ে কি করবে?
এনাজ আমার দুই বাহু ধরে খাটে বসিয়ে দিলো।তারপর কোন কথা না বলে পেছনে বসে খুব যত্ন সহকারে তেল দিতে মনোযোগ দিলো।
এনাজঃ এতো নড়ো কেন? চুপ করে বসে থাকো।আমাকে ঠিকমতো তেলটা তো দিতে দিবে।
আমিঃ কই নরলাম? এই শুনো না।
এনাজঃ হুম বলো।
আমিঃ তুমি কি ঠিকানাবিহীন বাড়ির সবাইকে আগামীকাল দুপুরে আসতে বলেছো তো? মুসকান,আদরকে বলেছো তো?কেউ বাদ রইনি তো আবার?
এনাজঃ সবাইকে বলেছি।ঠিকানাবিহীন বাসায় নিজে গিয়ে বাবা-মাকে আসতে বলেছি।আদরের বাসায়ও গিয়েছিলাম। একটা সুখবর আছে।
আমিঃ কি?
এনাজঃ তোমাকে এরিন কিছু বলেনি?
আমিঃ এরিন কল করেছিলো কিন্তু আমি ধরতে পারিনি।কিন্তু সুখবরটা কি?
এনাজঃ এরিনও তো প্র্যাগনেন্ট।
আমিঃ সেকি!!! কয়মাস?
এনাজঃ দুই মাস।
আমিঃ মুসকানের খবর কি গো? মেয়েটার সাথে ঠিকমতো কথাই হয় না।
এনাজঃ মুসকানের খবর ভালোই। ওদের পরিবারে এখনো কোন সদস্য আসেনি।তবে খুব শীঘ্রই আসতে পারে।যদি ওরা প্রসেসিং শুরু করে।
আমি মাথা উঠিয়ে এনাজের বুকে একটা হালকা চাপর মেরে বললাম।
আমিঃ ছোট বোন হয় তোমার।কথাবার্তা সাবধানে বলো।
এনাজঃ আমি কি ভুল কিছু বলছি?
আমিঃ আরিয়ানের সাথে থাকতে থাকতে তোমার মুখেও কিছু আটকায় না।
এনাজঃ নেও তোমার মাথায় তেল দেয়া হয়ে গেছে। এবার একটা বেণী করে দেই।
আমিঃ দিবে যখন মানা করে কে? নাভান কখন ঘুমালো?
এনাজঃ মিনিট দশ হবে।
এনাজ সুন্দর করে মাথায় তেল দিয়ে চুল বেণী করে দিলো।তারপর আমার মাথাটা পেছন দিকে উঁচু করে কপালে গাঢ় করে একটা চুমু খেলো।
এনাজঃ হয়ে গেছে। এবার তুমি একটু বসো।আমি আসছি।
আমিঃ কোথায় যাবে?
এনাজঃ তুমি যে রাতে কিছু খাওনি তা কি আমি জানি না ভাবছো।চুপ করে বসে থাকো।কোথাও যাবে না।
আমিঃ এখন আর কিছু খাবো না।
এনাজঃ তুমি না খাও।আমার মেয়েকে আমি না খাইয়ে রাখবো না।
আমিঃ ইস, এখন আসলের থেকে সুদের মায়া বেশি। কথা নেই তোমার সাথে। যাও ভাগো।
আমি অভিমানি সুরে কথাগুলো বলে গাল ফুলিয়ে রাখলাম।এনাজ ডেসিং টেবিলে তেলের বোতলটা রেখে আমার সামনে এসে বললো।
এনাজঃ এখন গাল ফুলালেও কাজে দিবে না। তুমি রাতে না খেয়ে ঘুমাতেই পারবে না।
🦋🦋🦋
কথাটা বলে হনহন করে কিচেনে চলে গেল এনাজ। আমি উঠে আয়ানায় সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথার মধ্যে জামাই আমার ইচ্ছে মতো তেল দিছে।তেলের আন্দাজ করতে পারেনি।সেগুলো বেয়ে-চেয়ে আমার কানের পাশ দিয়ে, কপাল দিয়ে পরছে।সেগুলো মুছে নিলাম।বেণীটা খুব সুন্দর করে করেছে। জামার ওপর দিয়ে একটু পেটে হাত দিলাম।পেটটা এখনো ফুলেনি।স্বাভাবিকভাবেই আছে। আমি কত মোটা হয়ে গেছি😵।দিনকে দিন আরো হবো। সেটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো নাভান ঘুমের মধ্যে বিরবির করছে।আয়না দেখা বাদ দিয়ে নাভানের মুখের সামনে কান পাতলাম।
নাভানঃ না আমার একটা মেয়ে পুতুল বেবী চাই,পুতুল বেবী চাই । আমার বোইনা লাগবে।
লোও ঠেলা,পোলা আমার ঘুমের মধ্যেও বোন চাইছে।এবার আল্লাহ সবার কথা শুনে একটা মেয়ে দিলেই হলো।
এনাজঃ কি করছো?
এনাজের কথায় চমকে গেলাম।তাড়াতাড়ি নাভানের কাছ থেকে সরে চুপ করে বসলাম।
আমিঃ তোমার ছেলে ঘুমের মধ্যেও বোন চাইছে।তাই শুনছিলাম।
এনাজঃ আল্লাহ এবার কবুল করলেই হলো।এদিকে আসো।
আমিঃ আমি এখন খাবো না। আজকের মতো মাফ করো।
এনাজঃ তুমি জীবনে ভালো কথায় কিছু করলে না।আমি এখন একটা ধমক দিবো তাহলে এখানে আসবে।তাই ভালোয় ভালোয় বলছি বকা খাওয়ার আগে চলে এসো।
আমিঃ দেখেন ভাই চমক, আমারে দিবেন না ধমক।
এনাজঃ এটা কি??
আমিঃ এটা একটা নাটকের ডায়লগ বললাম আরকি।আর কিছুই না।হে হে!!
এনাজের ভয়ে আমি গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে এসে বসলাম।সে হাত ধুয়ে আমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য এক লোকমা ভাত মুখের সামনে ধরলো।ওমনি আমার গা গুলানো আরম্ভ হয়ে গেলো।আমি এক হাতে নাক ধরে আরেক হাতে মুখ আটকে রাখলাম।
এনাজঃ হাত সরাও।
আমিঃ আমার বমি পাচ্ছে।
এনাজঃ পাক,বমি পেলে খেয়ে বমি করবে।
ভাতের প্লেটটা নিচে রেখে আমার হাত সরিয়ে জোর করে এক লোকমা ভাত মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো।আমি কাঁদো কাঁদো ফেস করে তা বহু কষ্টে চাবাতে লাগলাম।পুরো এক প্লেট ভাত আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়ে তবেই উঠলো।আমি যে কত কষ্টে তা শেষ করেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি।খাওয়া শেষ হতেই এনাজ আমাকে পানি খাইয়ে প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেল।এর এত এত কেয়ারিং মাঝে মাঝে বিরক্ত ধরে যায়।যেমন এখনও ধরেছে।কে বলছিলো এখন নিজের ঘুম বাদ দিয়ে এতগুলো ভাত খাওয়াতে আমাকে।
এনাজঃ এখনো বসে আছো।ঘুমাবে না?
আমিঃ কথা নেই তোমার সাথে😶।
এনাজঃ আচ্ছা। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলি তাহলে।
আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পেটের মধ্যে নিজের কানটা রাখলো।আমি একটু নড়েচড়ে সরতে নিলেই আমার দুই বাহু শক্ত করে ধরলো। যাতে আমি দূরে সরতে না পারি।
এনাজঃ আমার আম্মুটা কি করতাছে?তুমি কি ঘুমাচ্ছো মা-মণি।তোমার আম্মু দেখো কত কেয়ারলেস। ঠিকমতো খাবার খেতে চায় না।আমি জোর করে খাইয়ে দিলে উল্টো আমার সাথে রাগ করে।তুমি পৃথিবীতে এলে আমি, তুমি আর তোমার ভাইয়া মিলে তোমার আম্মুকে বকে দিবো।ওকে?
আমিঃ সরো তো।এই রাত দুপুরে কি শুরু করছো?আমি ঘুমাবো।
এনাজঃ আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলছি
দেখছো না।
আমিঃ আমার ঘুমে ধরছে।
এনাজঃ এই হুটহাট রাগগুলো কবে কমাবে? এখন তো আরো বেড়ে যাবে।সেই ক্লাশ নাইনের বাচ্চা মেয়ের মতো এখনো ছেনছেন করো।
যদিও আমি জানি কেন ক্লাশ নাইনের কথাটা বললো।তারপরেও না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম।
আমিঃ ক্লাশ নাইনে আমি এমন করতাম তা জানলে কিভাবে?
এনাজ ফ্লোরের থেকে উঠে আমার কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো।তারপর আমার হাত ওর চুলে রেখে বললো।
এনাজঃ মাথায় বিলি কেটে দেও তো।
আমিঃ আমি কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম।
এনাজঃ কেন তুমি জানো না? তোমাকে যে আমি ক্লাশ নাইনে থাকতে প্রথম দেখেছিলাম।আচ্ছা আবার বলি তাহলে।
এনাজ একটু থেমে রূপকথার গল্প বলার মতো করে বলা শুরু করলো।
এনাজঃ সেই বহুকাল আগের কথা। আমি ও তায়াং গিয়েছিলাম গ্রামে।আমাদের দুজনের একটা কাজ ছিলো।আর সেদিনই তায়াং-এর মা আমাদের পাঠিয়েছিলো সেই বাচ্চা মেয়েটার বাড়িতে।সিলেট থেকে অনেক কিছু এনেছিলো আন্টি।মূলতো সেগুলো দিতেই আমাদের গ্রামে যেতে হবে।এদিকে কলেজে সেদিন নবীন বরণ অনুষ্ঠান। তার দায়িত্ব পরেছিলো আমাদের কাঁধে। আন্টিও পিড়াপিড়ি শুরু করছে যাওয়ার জন্য। কাঁচা বাজার হওয়ায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে বলে আমাদের দুজনকে ভোরে পাঠিয়ে দিলো।সময় কম থাকায় বাসায়ও যেতে পারবো না। তাই শীতের সকালে জ্যাকেট,টুপি,মুখে মাফলার পেচিয়ে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম গ্রামের দিকে। বাসার সামনে তায়াং তার বাচ্চা খালাতো বোনকে আসতে বলেছে।ওর কাছে সবকিছু দিয়ে আবার চলে আসবো।বাসায় গেলে আবার ঝামেলা।মেয়েটার বাসার সামনের তিন রাস্তা মোড়ে শীতে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কারো আসার নাম নেই। বাইকে করে আসায় শীতটা বেশি লাগছে।কিছু সময় পর স্কাট পরহিত, খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে আমাদের সামনে দৌড়ে এসে থামলো।গলায় ওড়না পেঁচানো, মাথায় এক ঝুটি।পরনে পেস্ট কালার একটা সোয়েটার।শীতের সকালে তাকে খালি পায়ে আমার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আমাদের সামনে এসে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাত হাঁপাতে তায়াং কে বললো,”রাস্তায় জুতো ছিঁড়ে গেছে। তাই ফেলে দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম।জলদী কি দিবি দে,নয়তো চলে যাবো কিন্তু।” বাচ্চা মেয়ের মুখে শাসানো কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।সে এতটাই ব্যস্ত ছিলো তায়াং-এর সাথে কথা বলতে যে আমার দিকে খেয়ালই করিনি।জিনিসপত্র নিয়ে আবার ছুটলো বাসার দিকে।হয়তো তারও আমাদের মতো তাড়া ছিলো। সেই যে ঐ বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পরে গেলাম।আজ অব্দিও তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আর সেই মেয়েটা এখন আমার বউ।
🦋🦋🦋
আমি মিটমিট করে হাসলাম।এই ঘটনাটা আমি এনাজের মুখে আগেও বহু শুনেছি।তারপরেও আমার শুনতে ভালো লাগে। আমি মুচকি হেসে বললাম।
আমিঃ তোমাকে চিনবো কি করে? তুমি তো মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলে।তাছাড়া তায়াং ভাইয়া আসলে মাঝে মাঝেই তার কোন না কোন বন্ধুকে নিয়ে আসে।তাদের দিকে আমি কখনো তাকাতাম না।আমার ধারণা ছিলো তায়াং ভাইয়ার মতো ওর বন্ধুগুলো বদের হাড্ডি। কিন্তু আমার কাছ থেকে যখন সব আপন মানুষগুলো দূরে সরে গেলো, তখন আমি নতুন তায়াং-কে আবিষ্কার করলাম।যার মধ্যে পুরনো কোন অভ্যাসই ছিলো না।সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে আমাকে সেভ রেখেছে। ওর মতো ভাই পেয়ে সত্যি আমি ধন্য।কিন্তু তোমাকে আমি দেখেছিলাম অনার্স ১ম বর্ষে।সিবিআই এর ট্রেনিং শেষ করে যেদিন বিদেশ থেকে ফিরলে সেদিন তো আমি তায়াং ভাইয়ার সাথে তোমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম।সেদিন প্রথম দেখা।আমি কিন্তু তোমাকে মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছিলাম।তা মহাশয় আমাকে ক্লাশ নাইনে দেখলেও আমার সামনে এত বছর পর কেন এসেছিলে? যদি তোমার আগে আমাকে অন্য কেউ নিয়ে যেতো।
এনাজঃ এত সোজা নাকি😏!! এনাজের প্রাণপাখি অন্য কেউ নিয়ে যাবে।আর এনাজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো বুঝি।কখনো না।তাকে মেরে তোমায় তুলে আনতাম।
আমিঃ হইছে ঢপ কম মারেন।কেন এতবছর পর আমার সামনে এসেছিলেন তাই বলেন।(মুখ ভেংচিয়ে)
এনাজঃ আমি নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম।নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাতে তোমার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারি তার জন্য নিজেকে সময় দিচ্ছিলাম।আর তোমার সামনে এলে এসব বাদ দিয়ে প্রেম করতে মন চাইতো। তাই তোমার দূরে থেকেছি।তবে তায়াং-এর থেকে তোমার কম-বেশি সব খবরই নিতাম।
আমি চুপ হয়ে গেলাম।আলতো হাতে এনাজের চুলে বিলি কাটতে লাগলাম।মানুষটা আমায় একটু বেশি ভালোবাসে।এতটা ভালোবাসার যোগ্য কি আদোও আমি?তাও মাঝে মাঝে ভাবি।
এনাজঃ বাটারফ্লাই!!!
আমিঃ হুম।
এনাজঃ তোমার নাম আমি বাটারফ্লাই কেন রেখেছিলাম জানো?
আমিঃ কেন?
এনাজঃ তুমি না ছোট থাকতে অনেকটা প্রজাপতির মতো ফরফর করতে।কোন কিছুতে স্থির হয়ে থাকতে না।প্রথম দেখায় তুমি কিরকম ছটফট করছিলে।অনেক চঞ্চল টাইপের ছিলে।প্রজাপতি যেমন কোন ফুলে স্থির হয়ে থাকে না। তার মধু পান শেষ হলেই অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য ছটফট করে।তুমিও তেমন করতে।তাই তোমার নাম রেখেছিলাম বাটারফ্লাই।
আমিঃ আর আপনি আমাকে তায়াং ভাইয়ার মতো, না ভাইয়ার থেকে বেশি শাসন করতেন বলে আমি রেগে আপনাকে আনাইজ্জা কলা বলতাম।
এনাজঃ পাগলী একটা। ভালোবাসি!!!
আমিঃ আমিও।
এনাজঃ বাকি জীবনটা কি আমাকে প্রজাপতির রং-এ রাঙিয়ে রাখবে।প্রমিস আর কখনো ছেড়ে যাবো না। আল্লাহ যতদিন হায়াত রেখেছে ততদিন তোমার সাথে থাকবো।
আমি মুচকি হেসে তার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললাম।
আমিঃ রাখবো। সারাটা জীবন প্রজাপতির রং না ভালোবাসার রং দিয়ে রাঙিয়ে রাখবো।
এনাজঃ প্রজাপতির রং।
আমিঃ না ভালোবাসার রং।
এনাজঃ এটাকে ভালোবাসার রং না বলে প্রজাপতির রং বলবে।
আমিঃ আচ্ছা তাই বলবো।তবে তুমি কিন্তু আবার প্রজাপতির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেয়ো না।
এনাজঃ কখনো না।আল্লাহ না নিলে আমি এই জীবনে তোমায় ছাড়ছি না।
আমিঃ তাহলে আমিও প্রজাপতির সব রং নিয়ে বাকি জীবনটা তোমার সাথে কাটাতে চাই।
এনাজঃ জানো বাটারফ্লাই, সবশেষে আমি একটা কথাই বলবো।যেটা আমি আগেও বলতাম।ভালোবাসা হলো প্রজাপতির মতো।আলতো করে ধরবে তো উড়ে যাবে। শক্ত করে ধরবে তো মরে যাবে।আর যত্ন করবে তো কাছে রবে।আমি আমার ভালোবাসাকে শক্ত করেও ধরিনি, আলতো করেও ধরিনি।বরং যত্ন করেছি।তাইতো আমার প্রজাপতি আজ আমার কাছেই রয়েছে। সবার উচিত ভালোবাসাকে যত্ন করার।
আমিঃ সবাই তোমার মতো বুঝতো।তাহলে হয়তো পৃথিবীতে নারী নির্যাতন নামক কোন শব্দই থাকতো না।
এনাজ মুচকি হাসলো।তবে কোন উত্তর দিলো না।মাথা উঠিয়ে টুপ করে পেটে একটা চুমু খেলো।তারপর শক্ত করে তার দুই হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এমনভাবে ধরেছে যেনো ছেড়ে দিলেই আমি চলে যাবো। আমি একবার এনাজের দিকে তাকিয়ে আরেকবার নাভানের দিকে তাকালাম।যেই আমিটা সাত মাস আগেও একা ছিলাম।আজ আমার সব আছে। একেই হয়তো সৌভাগ্য বলে।আজ নিজের একটা ঘর আছে, সংসার আছে, স্বামী আছে, সন্তান আছে। ভরসার একটা হাত আছে। জড়িয়ে ধরে কান্না করার জন্য একটা মানুষ আছে। আর কি লাগে আমার?আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। তিনি আমার সব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এসব ভেবে চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।এনাজ চট করে মাথা উঠিয়ে ফেললো।উঠে আমার চোখের পানি মুছে দিলো।এই মানুষটা কি করে জানি বুঝে যায় আমার মনের কথা।আমি নিঃশব্দে কাঁদলাম তাও টের পেয়ে গেলো।চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে রেখে দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।পারলে আমায় তার হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে রাখে।আমার আর কি করার, তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।ভালোবাসি এই মানুষটাকে। ভীষণ ভালোবাসি!! এই মানুষটাকে ভালো না বেসে আমি থাকতেই পারবোই না।কারণ সে যে আমার জীবনকে রাঙিয়ে দিতে, প্রজাপতির রং নিয়ে হাজির হয়েছে।
~~~~~~~~~~~~(সমাপ্ত)~~~~~~~~~~~~~