প্রচলিত (শেষ পর্ব)

0
678

প্রচলিত (শেষ পর্ব)

আসগর আলীর রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুমন্ত লতিফার গায়ে হাত রাখে।মাছের মত শীতল শরীর। লতিফার ঘুম ভাঙে না। আসগর আলী বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বিড়ি ধরায়। চকিতে সুলতান শেখের ঘরের দরজার খুলে সাদা স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে সুলতান শেখ উঠানে নেমে এদিক সেদিক তাকায়। আসগর আলীর মনের ভেতর সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়। এমন তো নয় সে ঘুমিয়ে গেলে সুলতান শেখ আর লতিফার গোপন অভিসার চলে। খোদা! বারো বছরের সংসার জীবনে এই সর্বনাশ লেখা ছিল তার কপালে!

আসগর আলী পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগায়। ছেলে দুটো চৌকিতে জড়াজড়ি হয়ে ঘুমাচ্ছে। লতিফার ঘুমন্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে আসগর আলীর ইচ্ছা হয়,
-একটা লাথি দিয়ে মাগীর শরীরটা খাট থেকে নামাতে।
ঘুমের ভান ধরে! নটিগিরির জায়গা পায় না বজ্জাতটা।

সে নিজের শরীরটা যতটা সম্ভব লতিফার শরীর থেকে দূরত্বে রেখে শুয়ে পড়ে। কাল সকালে হয় সুলতান শেখের মাথা ফাটব নয়ত বান্দী মহিলা বাড়ি থেকে দূর হবে। থানা-পুলিশের ভয় দেখায়! কলঙ্কিনী মহিলার সাথে সংসার করার চেয়ে জেলের ভাত খাওয়া ভালো।

রাত গড়ায়। লতিফার ঘুম ভাঙে। নলকূপ থেকে খাবার পানি তুলে আনে, হাঁস মুরগীকে খাবার দিয়ে পরোটা ভাজতে বসে।এক ফাঁকে ঘর ঝাট দিয়ে ছেলে দুটোর ঘুম ভাঙায়৷ আধোঘুমে আসগর আলী সকল কাণ্ডকারখানা টের পায়। আজ তার সকাল সকাল উঠবার তাড়া নেই। দু একদিন কাজে না গেলে কি হয়! লতিফা কয়েকবার এসে ডেকে যায় সে সাড়া দেয় না।
বেলা দশটা বাজে। আসগর আলী আয়েশ করে জলচৌকিতে বসে নিম গাছের ডালা দিয়ে দাঁত ঘষতে থাকে আর দূর হতে লতিফারে লক্ষ্য করে।লতিফার পরনের নীল-হলুদ মিশেল প্রিন্টের শাড়ি, কচিপাতা রঙের ব্লাউজ ফর্সা বাহু খামচে ধরে আছে। তেল নিঙড়ানো পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল।এই সকালেও ও ফেয়ার এন্ড লাভলি ঘষেছে নাকি! গাল দু’খানা কেমন ফর্সা লাগে। গ্রাম্য মহিলাদের তুলনায় লতিফা বেশ পরিপাটি থাকতে ভালোবাসে। রোজ দুবার করে গা ধোয়, কায়দা করে শাড়ি পরে,ব্লাউজের শৌখিন ডিজাইন। ২৭ বছর বয়সেও লতিফার তলপেটে মেদহীন। আঁচলখানা কোমরে গুঁজে যখন উঠান ঝাট দিত আসগর আলীর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। এমন মেয়ে ব্যাপারী, মাতব্বরদের বাড়ির ঘরনী হয়, কপাল জোরে স্ত্রী পেয়েছে সে ।
আসগর আলীর দুঃখ হয়, কোনো সুখই চিরস্থায়ী না।

– তুই ঠোঙাই বানাবি? না কয়ডা খাইতে দিবি?

-তোমার দাঁত মাজন তো শেষই হয় না।

-রানছত কি?

-পান্তাভাত আছে খেসারি ডালের বড়া বানাইছি।চাইলে ডিম ভাইজ্জা দিমু।

-পোলা দুইডা খাইছে কি?

-ওগো রুটি ভাইজ্জা খাওয়াইয়া ইস্কুলে পাঠাইছি।

-মাগী,আমার লেগা আর দুইখানা রুটি ভাজলে কি তোর হাত ক্ষয় হয়া যাইত।

-ভাজতে হইলে ভাজত। এতগুলান ভাত আছে। হাঁসমুরগিতে খায়া শেষ হবে না।

আসগর আলী তেড়ে আসে। কাল রাতের তীব্র আক্রোশ শরীর ফেটে বেরিয়ে যেতে চায়। লতিফার চুলের মুঠি ধরে সামনে সাজানো স্তূপ করে সাজানো কাগজে লাথি মারে

লতিফা আকস্মিক রাগ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়।তার স্বামী তো এত সহজে রাগে না। ঝগড়া লাগলে তর্ক করে খুব কিন্তু কোনদিনও গায়ে হাত তুলে না। কিন্তু মাথায় ভীষণ ব্যথার অনুভূতি পেয়ে লতিফারও বোধজ্ঞান লুপ্ত হয়।মুরগির তাড়ানোর জন্যে লাঠি ছিল পাশে৷সেই লাঠি দিয়ে সজোরে আসগর আলীর পায়ে আঘাত করতে থাকে।

-বজ্জাতের পো,খাটাশের ঘরে খাটাশ! চুল ছাড় কইলাম নয়ত বাইড়াইয়া ল্যাংড়া বানাইয়া ফেলুম।

আসগর আলী দু’পা পিছিয়ে যায়। হাতের কব্জি ধরে মোচড় দিতেই লতিফা উ উ শব্দ করে হাতির লাঠি ছেড়ে দেয়,
-মাগী,তোর এতবড় সাহস! স্বামীর গায়ে হাত তুলছ! আজকা তোরে লাশ বানামু।

লতিফার সারা গায়ে ইচ্ছামত লাঠির বাড়ি পরতে থাকে। লতিফা দু’হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে আর যতটা জোরে পারে চিৎকার করতে থাকে। চেঁচামেচির শব্দে লোক জড়ো হয়।পাড়ার মহিলারা এসে লতিফাকে উদ্ধার কর। ওর সারা শরীর লাঠির আঘাতে টকটকে লাল। লজ্জায় অপমানে কাঁদতে থাকে।

বয়োজ্যেষ্ঠরা আসগর আলীকে বকতে থাকে। এরমাঝে সুলতান শেখ আসে। গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।

-নিজের বউরে মারন কাপুরুষের কাম। কোনো ভদ্রলোক বউয়ের গায়ে হাত তুলে না।

-তুই কোন ভদ্রলোকের বাল? পরের বউ দেখলে লেই কুত্তার মত জিব লে লে করে।

সুলতান শেখ ভাবতেও পারে নাই তারমত পয়সাওয়ালা গণ্যমান্য লোককে এতবড় অপবাদ দেওয়া হবে।

-আসগর আমি তোর রক্তের ভাই লাগি। আর তুই আমারে কস কি!

-হক কথা কই! নিজের বউ বারো মাসের রোগী। পাড়ার বউগো হারাদিন তুই চোখ দিয়া চাটস!

-তবে রে, ছোটলোকের বাচ্চার মুখে এতবড় কথা! তোর মায় খাটত আমগো বাড়ি বান্দী।

কথায় কথায় বড় ঝগড়া লেগে যায়৷ পুরুষের ঝগড়ায় মেয়েদের থাকতে নেই। লতিফাকে সঙ্গে নিয়ে মহিলারা যে যার বাড়ি চলে যায়। লতিফার গায়ে মালিশ করতে করতে পাড়ার বউঝিরা শুনতে চায় কি বৃত্তান্ত! এত বড় ঝগড়া কি জন্যে!

শক্ত-সামর্থ্য লতিফার চোখে আজ বাঁধ ভেঙে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলে৷ পাড়ার মহিলারা শুনে কেউ কেউ মাথা নাড়ে।

-তা দুইডা রুটি ভাইজ্জা দিতে কইছে দিতা। হেতের দোষ কি! পুরুষমানুষ ভালোমন্দ না খাইলে গতর খাটাইব কেমনে!

-হেই সুযোগটা দিল কই! তেড়ে মারতে আইল।

আরেকজন কয়,

-যাই কও বুজি,স্বামীর গায়ে হাত তোলা মহাপাপ।সময় কইরা মাফ চাইয়া নিও।

এইসব ছুটতে ছুটতে আসগর আলীর বড় ছেলেটা আসে

-মা বাড়ি চলো,আব্বায় সুলতান শেখের মাথা ফাডায়া ফেলছে।

লতিফার ছেলের পিছু পিছু দৌঁড়ে আসে। ঘটনা অর্ধসত্য।মাথা ফাটানোর জন্যে চ্যালাকাঠ নিয়েছিল পাড়ার লোকজন ছাড়ান দিছে।উঠোন লোকে লোকারণ্য। সুলতান শেখ নিজের সীমানায় উঠানে বসে হুমকি ধামকি দিচ্ছে।কিন্তু এদিকে আসার সময় সাহস পাচ্ছে না।আসগর আলী দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছে। যেন কিছুতেই তার আর কিছু যায় আসে না। নানা রকম মন্তব্য করতে করতে ধীরে লোক কমতে থাকে। দুপুর হয়ে আসছে। লোকজন যার যার কাজে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।

লতিফা চুলা ধরায়। ঝড় হোক তুফান হোক আর ঝগড়া লাগুক পেটে ভাতের যোগান তো দিতেই হবে।কলার মোচার বড়া, পুইশাক দিয়ে পুঁটি মাছের চচ্চড়ি,মাষকলাইয়ের ডাল। শয়তান বেটা মাষকলাইয়ের ডাল হলে এক প্লেট ভাত বেশি খায়। সকাল থেকে অভুক্ত। ছেলেটার স্কুল কামাই হল। উঠানে ঝিম ধরে বসে আসে। আসগর আলী ছেলেকে ডাকে।

-আয় আমার লগে।

-কই যামু আব্বা?

-আইতে কইছি আয়। ঘর থিকা দাও লইয়া আয়।

বাঁশ আর চাটাই দিয়ে বাপ-বেটা মিলে উঠানের এক মাথা থেকে অন্য মাথা বেড়া দিয়ে ফেলে। সুলতান শেখের বাড়ির একটা মাছিও যেন এ বাড়ির সীমানায় আসতে না পারে। সব কাজ শেষে ঘর্মাক্ত আসগর আলী
পুকুর থেকে দুই বালতি এনে দাওয়ায় রাখে । লতিফাকে শুনিয়ে বলে
-যত খুশি মরার গোসল কর। ঘাটে গোসল করতে গেলে ঠ্যাঙ ভাইঙা ফালামু।

হাবিবা সরকার হিলা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে