#প্রকৃতির_বিচার
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
নয়না তার শাশুড়ীর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী তার বিয়ের গল্প নয়নার সাথে করছে। তার শাশুড়ীর কথায় নয়না হেসে হেসে উঠছে। নয়নার হাসি মাখা মুখ দেখে নয়নার শাশুড়ীর প্রশান্তি পাচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী হামিদার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। অনেক চেষ্টা করেও উড়ানের পর আরেকটা সন্তানের মুখ তিনি দেখতে পারেননি। এতে তার কোনো দুঃখ নেই। বিধাতা যদি তাকে পুত্রসন্তান দিয়ে খুশি হন তাহলে বিধাতার খুশিতেই তার খুশি। নয়নার এই মানুষটার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে বিরক্ত লাগে। যখন উড়ান বাংলাদেশ ছিল। তখন হামিদা বেগমকে নয়নার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু জোহানের সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে আর কাউকে ভালো লাগে না। নয়নার শাশুড়ীর ভালোবাসা নয়নার কাছে বিষাক্ত লাগছে। নয়না বিরক্ত নিয়ে চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী হাসতে হাসতে বলল,
–জানো মা আমার ছেলে তো বিয়েই করতে চাইতো না। আমি তো আমার ছেলেকে চিনি। ছেলেটা আমার খুব দাম্ভিক। খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারে না। কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে না। নিজের আবেগ গুলো নিজের মধ্যে চাপা রাখে। উড়ান আমাদের ভালোবাসে জানি, সে আমাদের ভালো রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। কিন্তু উড়ান যদি বিয়ে না করে বিদেশ যেত। তাহলে উড়ানের পিছুটান হতো না। তুমি আছো বলেই উড়ানের পিছুটান তৈরি হয়েছে। আমার ছেলেটা যখন ফোনে কথা বলে তখন খুব সুন্দর করে বলে মা আর তিনটা বছর তারপরে আমি তোমাদের কাছে চলে আসব। অথচ বিয়ের আগে এই ছেলে আমাকে বলতো। অনেক টাকার মালিক না হওয়া পর্যন্ত সে দেশে আসবে না। আর আজ দেখো বলে কি না দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে যাবে। আমার ছেলেটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার ছেলের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। তুমি কখনো আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিও না। আমি আমার ছেলের ব্যথা সহ্য করতে পারব না।
নয়না কৃত্রিম হেসে বলল,
–আমি অনেক ভাগ্যবতী জানেন, মা। তা না হলে আপনাদের মতো একটা পরিবার আমি পাই। আপনার মতো শাশুড়ী পাওয়া এই যুগে খুবই দুষ্কর। এই যুগের শাশুড়ীরা পরের মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে বাঁচে। সেখানে আমি নয়টায় ঘুম থেকে উঠি তবুও আপনি আমাকে কিছু বলেন না। উল্টো আমার সুখের কথা চিন্তা করে বাসায় কাজের লোক রেখেছেন। আমি এত সুখ রেখে কোথায় যাব বলেন? আমার এই সুখে কারো নজর না লাগুক। আপনি, আব্বা, উড়ান এই তিনজন আমার পৃথিবী। আপনারা না থাকলে আমার পৃথিবী থাকবে না। আপনারা কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি যদি কখনো ভুল করি তাহলে বকে দিবেন। আমি আমার ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমি আপনাদের কিছুতেই হারাতে চাই না।
–আমার একটা মেয়ের অনেক শখ ছিল জানো, বউ মা। আমি অনেক চেষ্টা করেও আরেকটা বাচ্চা নিতে পারিনি। আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। যে আমার ছেলের বউ হয়ে আসবে। আমি তাকে আমার মেয়ের মতো করে আগলে রাখব। আমি কখনো বুঝতেই দিব না সে আমার ছেলের বউ। আমি তোমাকে কখনো নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। আমি আজকালকার যুগের মতো শাশুড়ী হতে চাই না। আমি একটু ভিন্ন ধরনের শাশুড়ী হতে চাই। যে শাশুড়ী ছেলে তার বউকে বেশি ভালোবাসলে ঈর্ষা করবে না। যে শাশুড়ী ছেলের বউয়ের ঘুমানো সহ্য করতে পারবে না। ছেলের বউ কাজ না করলে যে শাশুড়ী হাজারটা কথা শোনাবে। আমি তোমার শ্বশুরকেও বলে দিয়েছি। আমরা বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসব কোনো কাজের মেয়ে না। আমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। সেই কষ্ট তোমাকে পেতে দিব না।
–আপনি এত ভালো কেন বলতে পারেন? আপনার মতো চিন্তাধারা যদি সব শাশুড়ীর হতো। তাহলে প্রতিটি সংসারে অশান্তি নামক কোনো শব্দ থাকতো না। আপনি যে আমায় এতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসার মূল্য আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিয়ে যাব, মা। আপনি সারাজীবন এমন থাকবেন আর আমাকে এভাবে ভালোবেসে যাবেন। আপনার ছেলে বিদেশ থেকে আসলে আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু।
–পাগলি মেয়ে একটা! মা কখনো তার মেয়েকে ভুলে যেতে পারে? তুমি আমার কাছে বসো আমি তোমার চুলে তেল দিয়ে বিনুনি করে দেই। এতে তোমার চুল সুন্দর হবে।
নয়নার শ্বশুর রমিজ রহমান চা হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। রমিজের পেছনে পেছনে কাজের মেয়ে নীলাও আসলো। নয়নার বুঝতে বাকি রইল না। নীলার কষ্ট হচ্ছিল তাই রমিজ নীলাকে সাহায্য করছে। নয়না মানুষ দু’টোর ব্যবহার দেখে আসলেই মুগ্ধ হয়। একটা মানুষ এতটা ভালো কীভাবে হতে পারে? রমিজ একটা একটা করে চা সবার হাতে তুলে দিল। রমিজ বিছানায় বসে পায়ের ওপরে পা তুলে বলল,
–আমাকে রেখেই তোমরা সব গল্প করে ফেলছো। আমি তোমাদের এতটাই পর হয়ে গেলাম? বুঝেছিস নীলা তোকে আর আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই বাড়িতে সবাই আমাদের রেখেই একা একা আড্ডা দেয়।
নীলা দাঁত কেলিয়ে বলল,
–হেহে আপনি কী যে কন না, বাজান। আপনে এই বাড়ির মালকিন। আপনে যদি গৃহত্যাগী হন তাইলে উড়াই ভাই আইয়া আমাগো হগলরে বাড়ি থাইকা বার কইরা দিব।
নয়না কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–আপনি আমার বাবা হন। মেয়ে কখনো তার বাবাকে ভুলে যেতে পারে। আমি জানতাম আপনি নামাজ শেষ করে এই ঘরেই আসবেন। তাই আমি আর মা মিলে চুলে তেল দিচ্ছিলাম।
রমিজ হেসে বলল,
–বুঝলে বউমা। আমি একটা বুদ্ধি করেছি। আমার একটা জায়গা খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের আল্লাহর রহমতে কোনো ঋণদেনা নেই। আমরা চাইলেই একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারি। আমার ছোটো বেলা থেকেই একটা বাড়ি বানানোর অনেক শখ ছিল। কিন্তু আমরা তো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম। তাই চাইলেও সব শখ পূরণ করতে পারতাম না৷ আমার পোলাডা আল্লাহর রহমতে ভালো টাকা ইনকাম করে। কয়টা বছর খাটাখাটুনি করলে একটা বাড়ির দেওয়ার টাকা হয়ে যাবে। আমি অনেক বড়ো বাড়ি দিব। সেখানে আমাদের চারজনের সংসার হবে। আমার নাতিনাতনি আসলে আমি তাদের নিয়ে খেলব। শেষ বয়সটা নাতিনাতনিদের সাথে হেসে খেলে পার করতে চাই। আমাদের বাসায় অনেক মানুষ ভাড়া থাকবে। সেই ভাড়ার টাকায় আমাদের সংসার চলে যাবে। আমাদের পোলাকে আর বিদেশ যেতে হবে না। আমি ভাবছি উড়ানকে কথা গুলো বলব। আমার পোলার কষ্টের টাকা অযাচিত কাজে যাতে ব্যবহার না হয়। সেদিকে আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে। আমার পোলাকে তোমরা সবাই সময় দিবে বেশি বেশি। পোলাডা আমার দশ বারো ঘন্টা কাজ করে। কাজ শেষে যদি আমাদের সাথে কথা বলতে না পারে তাহলে তার কষ্ট দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে। আমরা যত পারব উড়ানকে সঙ্গ দিব। উড়ানকে কখনো একাকিত্ব অনুভব করতে দিব না।
নয়না অভিমান করে বলল,
–আমাকে এতটুকু ভরসা করেন না, আব্বা। আপনার ছেলে না খেলে আমি খাই না। দু’জন ভিডিও কলে বসে একসাথে খাই। উড়ান ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ফোন রিসিভ করি। আমাকে আপনি এভাবে বলতে পারলেন?
–আমি শুধু তোমাকে না সবাইকে বলেছি, মা৷ তুমি আমার কথায় কষ্ট পেও না। এখন বলো জায়গা কেনা আর বাড়ির দেওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সবার মতামত কী?
নয়না বলল,
–আপনি বাড়ি দিবেন এটা তো ভালো কথা।
হামিদা বেগম বলল,
–তবে সব ছেলের উপরে চাপিয়ে দিও না। আমাদের এই বাড়িটা বিক্রি করে জায়গা কিনবে আর উড়ানের টাকায় বাড়ি দিবে ঠিক আছে।
–এটা তুমি মনের মতো কথা বলেছ।
–আমি সব সময় মনের মতো কথা বলি।
হামিদা বেগম আর রমিজ রহমানের খুনসুটি শুরু হয়ে গেল। তাদের খুনসুটি দেখে নীলা আর নয়না হেসে ফেলল।
চলবে…..