#প্রকৃতির_বিচার
#পর্ব_১
#কে_এ_শিমলা
দীর্ঘ চার বছর সংসার করার পর আজ মাহদিয়ার স্বামী দ্বিতীয় বার বিয়ে করে বাড়ি ফিরলো। মেইন দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ইশান আর তার পাশে দিনা। এই মিনিট কয়েক পূর্বে বাড়িতে ফিরেছে ইশান। সাথে দিনাও আছে। দু’জনেই কিছুক্ষণ আগে বিবাহের কার্য সম্পন্ন করেছে।
ইশানের মা ইমা চৌধুরী হাঁসি মুখে বরন করে ঘরে তুলছেন ছেলে আর ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীকে। ঘরের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে মাহদিয়া। তাঁর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসিঁ ফুটে উঠে।
তারমানে বাড়ির অন্যরাও জানতো আজ ইশান বিয়ে করেই বাড়ি আসবে। মাহদিয়া একপলক তাকায় ইশানের দিকে।”
এই মানুষটা ধনী হলেও মধ্যবিত্ত মাহদিয়ার জন্য যোগ্য ছিল না। যদিও আগে এটা বুঝতে পেরেছিল মাহদিয়া তবুও চুপ ছিল। দেখতে চেয়েছিল ইশান ঠিক কতটা দূর যেতে পারে এইভাবে। আর আজ যা করলো ইশান,হয়তো এই পর্যন্তই আসার ছিল ইশানের। এইবার সে ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে।
মাহদিয়ার ঠোঁটের কোণে হাঁসি দেখে অবাক হয় সকলেই। ইশান ভেবেছিল হয়তো মাহদিয়া কান্নাকাটি করবে ওকে এভাবে দেখে। যদিও সে সকালে ডিভোর্স পেপারের সাথে চিরকুট লিখে গিয়েছিল, যে আজ দিনা কে বিয়ে করে ওকে সাথে নিয়েই ফিরবে।’
মাহদিয়া চাইলে এখানে থাকতে পারবে সমস্যা নেই। ওর থাকা খাওয়ার দায়িত্ব ইশান নিতে পারে। তবে ডিভোর্স দিতেই হবে কারণ দিনার শর্ত এটা। কেননা দিনা চায়না মাহদিয়া আর ইশানের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক থাকুক।”
ইশান ভেবেছিল এসব দেখে মাহদিয়া কল করে কান্না করবে। বা ওকে আর দিনা কে একসাথে দেখে কিছু বলবে। কিন্তু ইশানের ভাবনা কে পুরোপুরি পাল্টে দিল মাহদিয়া।”
মাহদিয়া সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আজ সে অন্যঘরে নিজের থাকার ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য এটা ইশান বলেনি বা ইশানের মা ও বলেননি। মাহদিয়া নিজ ইচ্ছায় ইশানের ঘর থেকে তার সমস্ত জিনিস পত্র এনে, নিচের একটা কর্ণারের রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছে। রুমে ঢুকে মাহদিয়া একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তিক্ততার সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেলো তবে। মাহদিয়া হাসে মন খুলে হাসে। সত্যিই আজ সে মুক্ত। মাহদিয়া খাবার খেয়ে নিয়েছিল তাই হাতমুখ ধুয়ে এসে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তার আগে ঠিকমতো দরজা বন্ধ করে নেয়।”
বিছানায় শুয়ে ভাবে ইশান আর দিনার কথা। দিনা ইশানের প্রাক্তন। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ইশান আর তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। তাঁর পর সে চলে যায় দেশের বাহিরে। একবছর পূর্বেই সে দেশে ফিরে এসেছে। তাঁর পর থেকেই ইশানের পেছনে আবার পরে। প্রথম প্রথম ইশান তাকে ততটা পাত্তা না দিলেও একসময় সে ফিরে যেতে বাধ্য হয় দিনার কাছে। ভালোবাসতো তো একসময় এই মেয়েটাকে। যদিও বিচ্ছেদের পর দিনার খোঁজ রাখেনি ইশান। এতোটা খুঁটিয়ে দেখেওনি হঠাৎ করে তাদের এতো দিনের সম্পর্কে দিনার বিচ্ছেদ টানার কারণ। কিন্তু আজ পাঁচ বছর পর এসে যখন দিনা আবার ভালোবাসার কথা বললো তখন আবার তাকে নিজের করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইশান।”
~~ দিনার সাথে বিচ্ছেদের বেশ কিছুদিন পর মাহদিয়া কে দেখে ইশান। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর,তেমন সুন্দর তার কথাবার্তা,আচার-আচরণ। অনেকবারই ইশান তাদের অফিসে মাহদিয়া কে দেখেছিল। তাঁরপর তাঁর বাড়িতেই দেখেছে। তার ভাই ইহানের ছেলেকে পড়াতো মাহদিয়া। সেখান থেকেই দেখা হয় মাহদিয়ার সাথে। তারপর মাহদিয়ার ব্যাপারে জেনেশুনে সে বুঝতে পারে। এসব প্রেম-বিচ্ছেদের সম্পর্কে মাহদিয়া নিজেকে জড়াতে চায় না। তারপর বছরের মোরেই মাহদিয়া কে তাঁর জীবনসঙ্গীণি হিসেবে গ্ৰহন করে। ততদিনে মাহদিয়া কে ইশান তাঁর এবং দিনার কথা বলে দেয়। প্রথমে মেনে নিতে না পারলেও পরবর্তীতে মাহদিয়া মেনে নেয়। ভাবে হয়তো সত্যিই দিনা প্রতারণা করেছে। সে চেয়েছিল ইশানের দিনার থেকে পাওয়া কষ্ট,আঘাত গুলো তার ভালোবাসা দিয়ে মুছে দিবে। একজন ভেঙ্গে যাওয়া মানুষকে আবার গড়ে তুলবে। ভালোবেসে নিজের মনের মতো করে তৈরি করবে।
ইশানের থেকেও সে নতুন ভাবে নিজের জন্য ভালোবাসা, অনুভূতির জন্ম দিবে। সে দিনার মতো ইশান কে ছেড়ে যাবে না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তাঁর সাথে থাকবে। তাঁর হাতে হাত রেখেই জীবনের শেষ সময় পার করবে। ”
কিন্তু তার সব ভাবনা, স্বপ্ন সবকিছুই মাত্র তিন বছরের জন্য ছিল।”
~~নাহ! তাঁর পক্ষ থেকে সারা জীবনের জন্য ছিল। কিন্তু ইশানের পক্ষ থেকে তা মাত্র তিন বছরের জন্য ছিল। একজন যদি তিন বছরের জন্য হাত ধরে চার বছরে এসে দূরে ঠেলে দেয়। অপরজন একা কীভাবে সারাজীবন থাকবে। সারাজীবনের জন্য দেখা স্বপ্ন গুলো একা কীভাবে পূর্ণ করবে। মাহদিয়ার চেষ্টা কমছিল না প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে রাখার। কিন্তু সে ব্যর্থ, অনেক প্রতিবাদ তো সে করেছে কিন্তু সে পারেনি। পারেনি তাঁর ভালোবাসা কে তাঁর করে রাখতে। আসলেই কী সেই মানুষটা তাঁর ছিল কখনো?””
~~হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে যায় মাহদিয়ার। চোখ মেলে তাকায় সে। সূর্যের আলো প্রবেশ করছে ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে। অর্থাৎ রাতে জানালা বন্ধ করেনি সে। শোয়া থেকে ঝটপট উঠে বসে। পাশ থেকে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয় সাথে তৈরি হয়েই বের হয়। বিছানার কুঁচকানো চাদর ঠিক করে নেয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একপলক পরখ করে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। তারপর একহাতে ডিভোর্স পেপার এবং একহাতে ট্রলি নিয়ে ঘর থেকে বের হয় যায়। ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই দেখতে পায় ইমা চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। তার দিকে দৃষ্টি দেন তবে আজ সেই দৃষ্টিতে নেই ঘৃণা, তাচ্ছিল্যতা।”
মাহদিয়া মুচকি হাঁসে। এই মানুষটি তাকে প্রথম প্রথম মেনে নিতে না পারলেও পরবর্তীতে মেনে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু যখন বিয়ের বছর পেরিয়ে দুই বছর হয়ে তিন বছরে পা রাখে তখন থেকে আবারো তিনি সহ্য করতে পারেন না মাহদিয়া কে। কারণ মাহদিয়া বিয়ের তিন বছর হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাচ্চা জন্ম দিতে পারেনি। কিন্তু আসল সত্যিটা তিনি কখনো জানার চেষ্টা করেননি। যখন মাহদিয়া জানানোর চেষ্টা করেছিল তখনো তিনি শুনেনি। মাহদিয়া কেই সবসময় দোষারোপ করে গিয়েছেন।”
~~মুখে মুচকি হাঁসি ঝুলিয়ে মাহদিয়া ইমা চৌধুরীর পাশে এসে দাঁড়ায়। ডিভোর্স পেপার টেবিলে রেখে ইমা চৌধুরীর সামনেই সে সাইন করে। তারপর পেপারের উপর কলম রেখে ইমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, ডিভোর্স পেপার। ভালো থাকবেন, আশা করি খুব শীঘ্রই দাদি ডাক শুনবেন। কথাটা বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় সে। ইমা চৌধুরী পেছন থেকে বলে উঠেন, নাস্তা করে যাও। মাহদিয়া দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে না ঘুরেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার বাবার বাড়িতে অভাব পড়েনি।’ বলেই দ্রুত পায়ে বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে আসে। উপর থেকে একজন মাহদিয়ার চলে যাওয়া দেখলো। আজ থেকে নিশ্চয়ই তাঁর দু’টানার জীবন শেষ হলো।”
বাড়ির বাহিরে বের হয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে মাহদিয়া।হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন সে। বাড়ির দিকে আর ফিরে তাকায় না তবে মনে মনে বলে ‘প্রকৃতির বিচার’ অবশ্যই দেখবো। আমি হয়তো চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতাম। কিন্তু করবো না প্রকৃতিরও বিচার আছে। সেই বিচারের অপেক্ষায় না হয় থাকি আমি।”
~~সকালের নাস্তা করতে একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসেছেন ইমা চৌধুরী, ইশান এবং দিনা। মাহদিয়া চলে গিয়েছে এটা ইশান দেখেছে। ইমা চৌধুরীর থেকে দিনা শুনেছে মাহদিয়ার চলে যাওয়ার কথা। শুনে সে কিছু বলেনি তবে মনে মনে ভীষণ খুশি ও। এটা ভেবে, আগাছা পরিষ্কার হলো তবে।
ইমা চৌধুরী এবং দিনা কথা বলছেন এটা সেটা নিয়ে। দিনা কে খুব ভালো লাগলো ইমা চৌধুরী’র। তিনি যেন ভুলেই গেলেন এই মেয়েটা একদিন উনার ছেলে কে কতটা যন্ত্রণা দিয়েছে। এই মেয়ের রুপদেখে আর কথার মায়ায় পড়ে গেলেন। ভুলে গেলেন অতীতের কথা। ভুলে গেলেন এই মেয়ের করা সেই কাজগুলো।”
আর হয়তো ভুলে গেলেন আরো একটি পবিত্র ফুলের কথা।”
চলবে!