#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ০৬
নুসরাত বলে উঠলো, -“এই তুই তো দরজা বন্ধ করেও ক্রেয়ার দেখাতে পারিস। দরজা খুলে এগুলো কি?”
আদিল পিছনে তাকিয়ে দেখলো দরজার সামনে নুসরাত দুটো খাবার প্লেট হাতে নিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে। আদিল নুসরাতের কাছে গিয়ে নুসরাতের কান ধরে বলতে লাগলো,
-“খুব কথা বলতে শিখে গেছিস তাই না। আমি ক্রেয়ার দেখাই আর যাই করি তোর কি আর তুই নক করে ঢুকতে পারিস না।” নুসরাত মুখ বাকিয়ে বলল,
-“আমার হাত বন্ধ দেখতে পারছিস না। আর আমি কি জানি নাকি। যাইহোক নে এগুলো খেয়ে নিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।” (বেডের পাশের টেবিলে প্লেট রাখতে রাখতে বলল কথাটা।) আড়চোখে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বলল কাল ভার্সিটি চল ধামাকা আছে তোর জন্য। বলেই নুসরাত রুম থেকে চলে গেল। শুভ্রা নুসরাতের কথায় সেরকম গুরুত্ব দিলো না। সে বেড থেকে উঠে সোফার দিকে যেতে নিবে তখনই আদিল এসে কোলে তুলে নিল। শুভ্রা বলল,
-“এই কি করছেন?”
আদিল বলল, -“তোমাকে আমি উঠতে বলছি, যে উঠছো। শুভ্রা অমতা অমতা করে বলল, -“না মানে খেতে হবে না।” আদিল বলল, -“হুম” তাই বলে সোফায় বসিয়ে দিলো শুভ্রাকে। শুভ্রা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আদিল খেতে পারছে না ওর হাতের জন্য। চামচও ধরতে পারছে না। আদিল কিছু না বলে হাতের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। শুভ্রা আদিলের দিকে তাকিয়ে বিষয়টি বুঝতে পেরে আদিলের মুখের সামনে খাবার ধরল। আদিল একবার শুভ্রার দিকে আর একবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছে। শুভ্রা বলল,
-“নিন খেয়ে নিন। আর চুপ করে থাকতে হবে না।” আদিলের মুখ চিকচিক করে উঠল। চোখদুটো টলমল করছে। শুভ্রা বলল,
-“কি হলো কান্না করছেন কেন কি হয়েছে? ”
আদিল নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-“কিছু না।”
শুভ্রাও আর মাথা ঘামালো না। খাওয়া শেষ হলে আদিল প্লেট নিয়ে চলে গেল। আর শুভ্রা ঘুরে ঘুরে রুম দেখতে লাগলো। রুমটা তার ভালোই লেগেছে। সে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
আদিল রুমে এসে দেখলো শুভ্রা নেই। আদিলের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। সে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো
-“শুভ্রতা শুভ্রতা কোথায় তুমি?”
আদিলে এমন ডাকে শুভ্রা কেপে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে রুমে এসে বলল, -” কি হয়েছে এমন করছেন কেন?” আদিল দৌড়ে শুভ্রার কাছে গেল আর বলল,
-“আমি তোমাকে একখানে থাকতে বলছি না। এতো ছোটাছোটি করা লাগবে কেন? যাও বেডে গিয়ে চুপ করে বসো।” শুভ্রা মুখ বাকিয়ে বলল,
-“একটু বারান্দায় ই তো গিয়েছি এতো বকা লাগবে তাই বলে। যান আপনার সঙ্গে আর কথাই নেই।” বলেই ধুপধাপ পা ফেলে বেডে গিয়ে বসলো। আদিল শুভ্রার কথায় মুচকি হাসলো সে বেডের পাশের ড্রয়ার থেকে এক বক্স চকলেট বের করে তার থেকে দুটো চকলেট বের করে আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো বক্সটা। শুভ্রা আড় চোখে সব দেখলো। আদিল শুভ্রার দিকে চকলেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই নেন মেডাম আর ড্রয়ারের সব চকলেট এ আপনার কিন্তু আমি যখন যেটুকু দিবো সেটুকুই শুধু নিবেন বুঝলেন। এগুলো বেশি খাওয়া ঠিক না।” শুভ্রা মুখ বাকিয়ে বলল,
-“লাগবে না কোনো চকলেট।” আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
-“আচ্ছা থাক তোমার আর খেতে হবে না। আমিই না হয় খাই।”
বলেই আদিল যেই খেতে নিবে তখনই শুভ্রা এসে আদিলের হাত থেকে চকলেট নিয়ে নিলো। আদিল হাসলো আর বলল,
-“কি হলো তোর লাগবে না বলে তাহলে এখন কি করলে এটা!”
শুভ্রা বলল,-“আমার ইচ্ছা আমি যা ইচ্ছা তাই করবো।”
আদিলও আর কথা বাড়ালো না। শুভ্রাকে রেস্ট নিতে বলে সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
নুসরাত গুটিগুটি পায়ে এসে দিলো শুভ্রার কানের কাছে এসে হাউ করে উঠলো। শুভ্রা পিছনে তাকিয়ে দেখলো নুসরাত দাঁত কেলিয়ে হাসছে। শুভ্রা রেগে গেলো। শুভ্রা নুসরাতকে মারার জন্য ওর পিছনে দৌড়াতে লাগল। শেষ পর্যায়ে গিয়ে শুভ্রা আর না পেরে বলল,-“থাম ভাই হয়েছে” দুইজনই হাপিয়ে দিয়ে বেডে সুয়ে পরল। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। শুভ্রা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-“কিরে তুই এখানে কি মনে করে। আর তোর ওই শয়তান ভাই কোথায় গেলো।” নুসরাত ভ্রু উচিয়ে বলল,
-“কেন রে তুই আমার ভাই মিস করছিস নাকি। সে যাইহোক আমার ভাইটাই আমাকে তার বউয়ের কাছে পাঠালো। নে ঘুমা এখন কাল সকালে তোর জন্য আবার চমক রয়েছে।” শুভ্রা মুখ বাকিয়ে বলল,
-“আজাইরা পেচাল।” দুইজনই শুয়ে পরল। নুসরাত ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু শুভ্রার কিছুতেই ঘুম আসছে না। সে অনেকক্ষণ যাবত এদিক ওদিক করে শুয়ে রইলো কিন্তু না ঘুম কিছুতেই তার চোখে ধরা দিচ্ছে না।
সে উঠে বারান্দার দিকে গেল। মৃদু বাতাস বইছে চারিদিকে,চারিদিকে নিরব মানুষের কোনো সারা শব্দ ও নেই। শুভ্রা দাড়িয়ে আছে বাহিরের দিকে তাকিয়ে তার এই পরিবেশ ভালোই লাগছে। সে খেয়াল করলো একটা কালো ছায়া বাড়ির মেইন দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে। শুভ্রার বিষয়টা খটকা লাগল। কার ছায়া ওটা। হঠাৎ, করেই লোকটির সামনে একটি গাড়ি এসে দাড়ালো। লোকটি গাড়িতে উঠতে নিয়েও পিছনে ঘুরে আবার একবার তাকিয়ে চলে গেলো। শুভ্রার ব্যাপারটা যেন কেমন লাগল! সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত আড়াইটা বাজে। সে চিন্তাভরা মস্তিষ্কের বারান্দায় রাখা দোলনায় বসলো।
——————-
সকালের মিষ্টি রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেলো শুভ্রার। সে খেয়াল করলো কেউ তাকে আলতো করে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। শুভ্রা দেখলো এটা আর কেউ না আদিল। কিন্তু কেমনে কি তার ঠিক মনে আছে সে বারান্দায় ছিলো আর নুসরাতই বা কোথায় গেল। শুভ্রার ভাবনার মধ্যেই আদিল চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলো,
-“এতো ভাবার কিছুই নেই। আমিই তোমাকে বারান্দা থেকে রুমে নিয়ে আসছি আর নুসরাতকে ওর রুমে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন একটু চুপ করে শুয়ে থাকো তো। আমি ঘুমাই।”
শুভ্রা বলল, -“আপনি ঘুমাবেন তো ঘুমান আমাকে এইভাবে জরিয়ে রাখতে হবে কেন। দেখি ছাড়েন আমি উঠব।”
আদিল আরো শক্ত করে পেচিয়ে ধরলো শুভ্রাকে। শুভ্রা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। আদিলের সঙ্গে না পেরে সে চুপ করে রইলো।
কিছুক্ষণ পরেই দরজায় নক করার আওয়াজে আদিল বিরক্ত হলো নুসরাত ডাকছে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে সে। আদিল চরম বিরক্ত নিয়ে বলল,
-“এই তুই যাবি এখান থেকে নাকি মার খাবি।” আদিলের কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় নক করার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আদিল কিছু না বলে শুভ্রাকে ছেড়ে দিলো। শুভ্রাও কিছু না ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।
——————-
খাবার টেবিলে বসে টোকাটুকি করছে শুভ্রা আর নুসরাত। আদিল আসলেই তারা নাস্তা শুরু করবে। আদিলে মা বাবা কিছু কাজে বিদেশ গেছেন। কয়েকমাস পর ফিরবেন। আদিল একদম ফরমাল লুকে এসে হাজির। সে চেয়ার টেনে বসে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আর শুভ্রা হা করে আদিলকে দেখছে। আদিলকে ব্লাক শার্টে এতো সুন্দর লাগছে যে বলার বাহিরে। নুসরাত আস্তে করে শুভ্রার মুখ বন্ধ করে বলল,
-“তোরই জামাই পরে দেখলেও চলবে এখন খেয়ে নে।”
শুভ্রা নুসরাতের কথায় লজ্জা পেলো। আদিল মিটিমিটি হাসছে। খাওয়া শেষে আদিল বলল, -” নুসরাত তুই আর শুভ্রা বাড়ির একটা গাড়ি নিয়ে চলে যা। আমার কিছু কাজ আছে আমি যেতে পারছি না।” বলেই আদিল ওর রুমে চলে গেল শুভ্রা আদিলকে মুখ বাকিয়ে মনে মনে বলল, -“ঢং”
ভার্সিটিতে এসে লুভার মুখে শুনলো আজকে নাকি একসঙ্গে তিনজন টিচার নতুন জয়েন করবে। শুভ্রা বসে আছে ক্যান্টিনে এমন সময় রাইসা ওদের ক্লাসমেট এসে বসলো তাদের পাশে। সে এসেই বলতে শুরু করলো, -” জানিস নতুন তিন টিচারের মধ্যে দুইজনই ছেলে। দুইজনই একদম ক্রাশ খাওয়ার মতো সুদর্শন। আমি তো দেখেই ক্রাশ খাইছি।” শুভ্রা লুভা নুসরাত ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে ওরা ক্লাসে চলে গেলো। ওরা ক্লাসে আসার কিছুক্ষণ পরেই প্রিন্সিপাল আসলো তাদের ক্লাসে দুটো ছেলে আর একটা মেয়েকে নিয়ে। শুভ্রা বিষয়টিতে অনেকটাই অবাক হলো কারণ ছেলে দুইটাকেই শুভ্রা চেনে একটা অনিক আর একটা আদিল। কিন্তু আদিল কিজন্য সেটাই তো বুঝতে পারছে না শুভ্রা। শুভ্রা নুসরাতের দিকে তাকালো। নুসরাত দাঁত কেলিয়ে হেসে শুভ্রার কানেকানে বলল,
-“এটাই তোর চমক”
প্রিন্সিপাল সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়ে টিচারের নাম হচ্ছে তাসনীম ইসলাম। আদিলকে ক্লাসের দ্বায়ীত্বটা দিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার ওনাদের নিয়ে চলে গেলেন। আদিল ওর সানগ্লাস খুলে শার্টের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলো। শুভ্রা এতোক্ষনে খেয়াল করলো ক্লাসের সকল মেয়ে বড়বড় চোখ নিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রা বিষয়টা বিরক্ত লাগছে এতো কেন তাকিয়ে থাকা লাগবে আজব। আদিল ক্লাস শেষ করিয়ে যেতে নিয়ে আবার শুভ্রা কাছে এসে দাড়ালো আর বলল,
-“আমার কেবিনে এসো কথা আছে।”
বলেই আদিলে বের হয়ে গেল। শুভ্রা মুখ বাকিয়ে বলল, -“ঢং এর কথা। যাবো না আমি তোর কাছে যাহ।”
লুভা বলল, -“যা দোস্ত তাছাড়া আবার ভাইয়া রাগ করবেনি।”
শুভ্রা বলল, -” করুক আমার কি তাতে?”
নুসরাত বলল, -“দোস্ত ভাইয়া কিন্তু একবার রেগে গেলে তোর খবর করে ছাড়বে।”
শুভ্রা বলল, -“হুম তোর ভাই আমার খবর করবে আর আমি কি ছেড়ে দিবো নাকি। এখন চুপ থাকবি নাকি তোকেও দুচারটা দেওয়া লাগবে।”
নুসরাত আর কিছু বলল না লুভাও চুপ করে রইল। ওরা তিনজন মিলে গিয়ে ক্যান্টিনে বসল। শুভ্রা বলতে শুরু করলো,
-“কিরে ওই হাবলুকে তো আজকে দেখছি না। সকাল থেকে কোনো খবর নাই। মরলো নাকি!”
লুভা বলল, -” কি যে হয় তো মরছে।”
লুভার কথার মাঝখানেই ওর ফোন বেজে উঠলো। লুভা দেখলো ওর আম্মু কল করেছে। লুভা কল রিসিভ করে করে কানে ধরতেই ওর মা বলল,
-“তুই যেখানেই থাকিস না কেন এখনি বাসায় আয়। আমি কোনো কিছু শুনতে চাই না।” বলেই কল কেটে দিলো।
লুভা তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ নিয়ে যেতে লাগলো। শুভ্রা ওকে আটকিয়ে বলল,
-“কিরে আন্টি কি বলল?তোকে এমন অস্থির লাগছে কেন? কি হয়েছে?”
লুভা বলল, -” জানিনা কিছু বলে নি আমাকে শুধু বলল তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে।”
শুভ্রা বলল, -“যা তাহলে দেখ কি হলো!”
নুসরাত বলল, -” কল করে জানাস কি হয়?”
লুভা চলে গেলো। নুসরাত আর শুভ্রা কথা বলছিলো এমন সময় নুসরাতের ও ফোন বেজে উঠলো। অভ্র কল করেছে। সে শুভ্রার দিকে তাকাতেই শুভ্রা বলল, -” যা কথা বল।” নুসরাত একটা হাসি দিয়ে ওখান থেকে সরে গেল।
শুভ্রা বসে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। হঠাৎ, অনিক এসে শুভ্রার পাশে বসলো। শুভ্রা ফোন রেখে অনিকের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো।
আদিল অনেকক্ষণ ধরে শুভ্রাকে খুজছে। ওর কি পরিমাণ সাহস হয়েছে যে ও ওর কথা না শুনে। আদিল ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে আসতেই ওর চোখ পরে অনিক আর শুভ্রা বসে একসঙ্গে গল্প করছে। এই দৃশ্য দেখে আদিলের মাথা রক্ত উঠে যায় ও হনহন করে শুভ্রার সামনে গিয়ে দাড়ায়।
শুভ্রা আদিলের দিকে তাকাতেই ভয়ে কুকরে যায় কারণ, আদিলে রাগের কারণে থরথর করে কাপছে,ওর নাক আগা লাল বর্ণ ধারন করছে, চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। আদিল অনেকটা চেচিয়ে বলে উঠল,
-“তোকে আমি আমার কেবিনে ডাকছিলাম না কথা বলার জন্য আর তুই এখানে অন্য ছেলের সঙ্গে কথা বলছিস। কি মনে করিস নিজেকে কিছু বলছিনা দেখে যা খুশি তাই করবি। কালকেই মানা করছি আর আজকেই আবার। যা এখান থেকে। সোজা আমার কেবিনে যাবি। আমি যেন আর একমুহূর্ত ও তোকে এখানে না দেখি।”
শুভ্রা কিছু না বলে ওখান থেকে চলে গেল। আদিল অনিকের কলার ধরে বলা শুরু করলো,
(চলবে)