#পারফিউম
শেষ পর্ব
“ম্যাডাম আর কিছু লুকাবেন না। আপনার কীর্তিকলাপ সবকিছু আমরা জানতে পেরেছি?”
দিতিয়া শান্ত গলায় বলল,
“আপনি কী মিন করছেন? আমি আমার বোন কে মেরেছি? সিরিয়াসলি!”
পুলিশ অফিসার ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন যে আমি কী মিন করছি। ”
দিতিয়া তবুও দমলো না। চোখে, মুখে নেই কোনো অনুতাপ। খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গায় এই মেয়েটাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। চাকরি চ্যুত হয়েছে। এজাজ রহমান শাসিয়ে যাচ্ছেন সমানে। ফল ভালো হবে না। আহনাফও তার সমস্ত রূপ দেখাচ্ছে মুখোশের আড়াল থেকে। নেহাল কে টাকা দিতে হবে দ্বিগুণ। দিতিয়াকে তবুও বিচলিত লাগছে না। এমন কনফিডেন্ট যার আছে তাকে দরকার ছিলো ভালো কোনো ক্রিয়েটিভ কাজে।
দিতিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“এই খুনের ব্যাপারে কী কী প্রমাণ পেয়েছেন আমার বিরুদ্ধে। ”
পুলিশ অফিসার হেসে বললেন,
“আপনাকে খুনী বানিয়ে আমার কী কোনো লাভ আছে ম্যাডাম?”
“তাহলে বললেন যে আমার কীর্তিকলাপ? ”
“আপনার ব্যাংক, ব্যালেন্স। আশুলিয়ায় প্লট বুকিং, সবকিছু তো এখন আয়নার মতো সবার সামনে এসেছে। ”
“এর জন্য কী এরেস্ট করবেন আমাকে?”
দিতিয়ার ঠোঁটে তীর্যক হাসি। না দিতিয়াকে এরেস্ট করা যাবে না। এজাজ রহমান ফ্যামিলি পার্সন। তিনি এই বিষয়ে আর জল ঘোলা করতে চাইছেন না। অলরেডি মিডিয়া নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব। কোম্পানি এজাজ রহমান কে অবজার্ভেশনে রেখেছে। তার অবস্থা দিতিয়ার চেয়েও বেশি খারাপ। তারচেয়ে বড় কথা এরা চাইছে দিতিয়াকে উল্টো বাঁচাতে। কিছু তো আছে এই মেয়ের কাছে। এতো বড় বড় মাথাওয়ালা মানুষজন পর্যন্ত পিছু হটছে।
পুলিশ অফিসার বললেন,
“আপনার জন্য একটা ভালো খবর আছে। ”
“বলুন। কেন যেন মনে হচ্ছে আপনার ভালো খবরটাও আমার জন্য ভয়ংকর হবে। ”
“না না। এটা ভালো খবর। নেহাল সাহেব কে নয় লাখ টাকা দিলেই হবে। উনি এর বেশী চাইছেন না। ”
দিতিয়া ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আচ্ছা। ”
“নেহাল সাহেব কিন্তু ভদ্রলোকই ছিলো ম্যাডাম। কেন যে আপনি….
দিতিয়া কথা শেষ করতে দিলো না। বলল,
” আমি আমার পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ”
পুলিশ অফিসার বিরস মুখে বলল,
“আচ্ছা। যেতে পারেন আপনি। কেস ক্লোজ না হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে দেখা হবে৷ গুড লাক। ”
দিতিয়া স্মিত হেসে বিদায় নিলো।
***
নেহালের নয় লাখ টাকা দিতিয়া ঝামেলা ছাড়াই দিয়েছে। সেই সঙ্গে টেক্সট লিখেছে,
“সবচেয়ে বেশী সারপ্রাইজ তো তুমি আমাকে করেছ ডিয়ার। আই এম ইমপ্রেসড। ”
নেহাল সেই টেক্সটের জবাবে কিছু লিখে নি। ওর লেখার দরকারও বোধহয় নেই। দিতিয়া শাস্তি পাচ্ছে প্রতি পদে। এখন যে হম্বিতম্বি দেখাচ্ছে সবই মিথ্যে।
***
আহনাফ বিয়ে করে নিলো মায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে। শ্বশুর বিশাল বড়লোক। জামাই কে বিয়ের গিফট হিসেবে পঁচিশ লাখের গাড়ি পাঠালো। বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। হওয়া উচিত ছিলো বটে। দিতিয়ার আঘাত টা ভোলার দরকার ছিলো যে। ফ্যামিলি খুব টেনশনে ছিলো আহনাফ কে নিয়ে। যা ধকল গেল বেচারার। এখন সময় টা ভালো কাটুক।
***
দিতিয়ার এখন স্বাধীন জীবন। খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে আর ল্যাপটপে কী যেন করছে। দিলারা মেয়েকে নিয়ে খানিকটা চিন্তিত। দিতিয়া ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে না। সবসময় ই কাজে ডুবে থাকতে পছন্দ করে।
দিতিয়াকে দেখে অতো বিচলিত মনে হচ্ছে না। এখন ওরা অন্য একটা বাসায় আছে। এখানে ও’কে তেমন কেউ চেনে না বলে সমস্যা হচ্ছে না। দিতিয়া চাকরিচ্যুত হওয়া নিয়েও খুব বেশী বিচলিত নয়। ওর অপশন আছে অন্য। দুই তিন বছর চাকরি না করলেও দিব্যি চলবে। কিন্তু ঘরে বসে থাকা ব্যাপার টা ভীষণ বোরিং। চাকরি মানেই নতুন মানুষ, নতুন এক্সপেরিমেন্ট, নতুন এডভেঞ্চার।
এখন ও সারাক্ষন ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে একটা বিশেষ কারণে। একজন বিশেষ মানুষের এক্টিভিটি চেক করার জন্য। সেই বিশেষ মানুষ টাকে ও একটা বিশেষ সারপ্রাইজ দিতে চায়। ঠিক এক ঘন্টা পর সে সারপ্রাইজ টা পাবে।
“দিতি শোন। ”
দিতিয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকালো। বলল,
“পুলু কে ওর বাপ দিয়ে যেতে চায়। ”
“তোমার ইচ্ছে। আমার মনে হয় পুলু তোমার সঙ্গে থাকলেই ভালো হবে। ”
“শয়তান টা মনে হয় আবার বিয়ে করবে! তিনটা মাস যেতে না যেতেই….
দিলারার গলা বুজে আসে। দিতিয়া কিছু বলে না।
***
“আজ সব তোর পছন্দের রান্না হয়েছে। কতদিন ভালো কিছু রাঁধি না।”
দিতিয়া চিংড়ি মাছের বাটিটা সরিয়ে রাখলো। পুলিশ অফিসার লোকটা আজ আবার এসে জ্বালিয়ে গেছেন। কেস ক্লোজ করতে চাচ্ছেন। কারণ ওনারা কোনো ক্লু পাচ্ছে না। দিতিয়া হ্যাঁ, না কিছু বলে নি।
ফাইনালি বিশেষ মানুষ টাকে সারপ্রাইজ দেয়া গেল। আহনাফ নতুন বউকে নিয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছিলো। তার মধ্যেই ও চাপে ফেলে দিলো। ওর ইমেইল হ্যাক করা দিতিয়ার কাছে তেমন কঠিন ছিলো না। ওর কিছু নিজের মানুষ আছে যাদের কে মিষ্টি করে বললেই কাজ টা করে দেয়। এজাজ রহমানের বোকা মেয়েটাকেও ফাঁদে ফেলতে ওর বেশী সময় লাগে নি। একটা লিংক পাঠিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপে। ব্যস সবকিছু চলে এলো। এই মেয়েটার চরিত্র বাপের চেয়েও ভয়ংকর। দিতিয়া নিজেও কনফিউজড ছিলো যে ও আসলে কার ব্যাপার টা সামনে আনবে। তারপর মনে হলো এজাজ রহমান কে ধাক্কা দেবার জন্য আসলে টিচার টাই ঠিকঠাক।
“মাংস টা নে। কষা মাংস তো তোর পছন্দ। ”
“তুমি খাও আগে। ”
দিলারা আজ খুশি। পুলিশের ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পেতে যাচ্ছে অবশেষে। সেই খুশিতেই এই আয়োজন। দিলারা কষা মাংস টা নিলো। দিহানের পছন্দ ছিলো। সেদিন রান্নাও করেছিলেন দিহানের জন্য। শেষবারের মতো! দিলারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা মরলো নিজের দোষে। দিতিয়া বাইরে কী করে বেড়ায় সেগুলো নিয়ে দিলারার আপত্তি নেই। ওরকম টুকটাক দোষ সবার থাকে। তারও ছিলো কম বেশী। তার পরিবারও ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিলো। সংসার করতে এসে দেখেন মুলো, আলু, কচু ছাড়া কপালে তেমন কিছু জোটে না। এভাবে কতদিন! বাড়িওয়ালার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। দেয়া নেয়ার সম্পর্ক। দিলারার শাড়ি, গয়নায় ভর্তি হতে লাগলো আলমারি। দিহানের বাবা কিছু বোঝেন না। এর ওর গিফট বলে দিব্যি চালাচ্ছিলেন। গয়নাগুলো এমিটিশন বলেও বুঝ দেয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু ঝামেলা করলো দিহান। একদিন দেখে ফেলল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে চুপ করে রাখলেও মেয়ে সুযোগ নিলো। বাবাকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে সব হাতিয়ে নিচ্ছিলো। বিয়ের সময় গুনে গুনে সবগুলো গয়না নিয়ে গেল। দিতিয়ার জন্য রাখা অল্পকিছু গয়নাও ছাড় দিলো না। ওদের বাবা মরে যাবার পরও দিহান শোধরালো না। সেই সঙ্গে নতুন বিষয় টানলো। দিতিয়া আর নেহালের ব্যাপার নিয়েও শুরু করলো ব্ল্যাকমেইল। দিতিয়াকে দেখলে আদুরে ভঙ্গিতে কথা বললেও দিলারাকে এসে বলতো,
“মা দিতিয়াকে বোলো তো আমাকে এক জোড়া হিরের দুল কিনে দিতে। নেহালের ব্যাপার টা ভুলে যেও না। ওইটা আমিই সামাল দিচ্ছি। ”
দিলারা বুঝতে পারছেন মেয়ের খিদে দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। এখন চাচ্ছে দিতিয়ার কেনা ফ্ল্যাট যেন দিলারার নামে হয় তাহলে ও কব্জা করতে পারবেন।
দিলারা সিদ্ধান্ত নিলেন দিহান কে সরিয়ে দিবেন। তার কাছে ব্যাপার টা সহজ ছিলো না। খাবারে বিষ মেশানো, গলা টিপে মারা এসবে ধরা পড়ে যেতেন। তাই পারফিউমে বিষের প্ল্যান করলেন। এই বিষদেয়া পারফিউম এসেছে বিদেশ থেকে। পাঠিয়েছে সেই মানুষ টা যার সঙ্গে দিলারার অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো। সংসার জীবনে ভীষণ অসুখী মানুষ টার মনে এখনো একটু বিশেষ জায়গাজুড়ে দিলারা আছে। তাই সে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
দিলারা জানতো এই পারফিউম দিতিয়া ব্যবহার করবে না। কোনো ব্র্যান্ড নাম নেই দেখেই ও ফেলে দিবে। নিজেকে নিয়ে দিতিয়া খুব সচেতন। এই ভুল ওর করার সম্ভাবনাও জিরো পার্সেন্ট৷ তবে দিহানের যে অল্পতেই পছন্দ হবে সেই বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। হলোও তাই।
দিলারার মন টা খারাপ হয়। দিতিয়া খুব বিপদে পড়লো। তবে এসব বিপদের চেয়েও বড় বিপদ থেকে বাঁচালো। দিহানের প্রেশার নেয়া যাচ্ছিলো না আর!
দিতিয়া কষা মাংস থেকে এক টুকরো মাংস খেল। মা যেহেতু খাচ্ছে সেহেতু খাওয়া যায়। পারফিউমে বিষের ব্যাপার টা যে মায়ের কারসাজি সেটা দিহানের পোস্টমর্টেম যেদিন এলো সেদিন ই বুঝলো। মায়ের সঙ্গে দিহানের অন্য হিসাব আছে সেটা দিতিয়া জানে। কিন্তু ওর খটকা অন্য জায়গায়। পারফিউম বক্সটা দিহান কে সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারতো। দিতিয়াকে কেন পাঠালো! এই যুক্তি দিতিয়ার আছে। তবুও প্রশ্ন একটা থেকে যায়, বাই এনি চান্স ও যদি পারফিউম ব্যবহার করতো!
দিতিয়া আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো। ওর একটা স্পেশাল লিস্ট আছে। ধ্বংস লিস্ট। সেই লিস্টের লাস্ট নামটা মায়ের। একে একে সবাইকে পানিশমেন্ট পেতে হবে। মা’কে ছাড় দেয়া যাবে না কারণ ও জানেনা মায়ের উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিলো! পারফিউম সেট টা তো ও’কেই পাঠানো হয়েছিল।
….সমাপ্ত….
বাপ রে বাপ,,,,,,,,কি গল্প রে বাবা,,,,,,🙄🙄🙄🙄🙄