#পাতা_ঝরা_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী
ইকরা যখন বাবার বাড়িতে পা রাখে তখন প্রায় দুপুর।মানহাকে নিয়ে দুই তলা বাড়িটির সামনে দাঁড়ায় ইকরা।কোথা থেকে সোলেমান চাচা চেচিয়ে ওঠে।
“কে কোথায় আছো দেহো কে আইছে।আমার ইকরা আম্মা আইছে।তুমি আইবা আগে কইবা না আম্মা?
” এভাবে জোরে কথা বলবেন না চাচা মানহা ভয় পাবে তো।কেমন আছেন আপনি?
“ভালো। তয় তোমারে দেইখা আরো ভালো।এতোদিন পর আমাগো কথা মনে পরলো তোমার আম্মা?
” সব সময় মনে পরে চাচা।কিন্তু চাইলেই এতো দূর থেকে আসতে পারি না যে।বাবা কোথায়?
“বড়ো সাহেব তো গেরামে একটা শালিসি ডাকা হইছে সেই হানেই গেছে।আইসা পরবো।চলো বাড়ির ভিতরে।
বাড়ির বিশাল বড়ো উঠনে বসে রেহানা বানু ইরার মাথায় তেল দিচ্ছিলেন আর বকাবকি করছিলেন।হঠাৎ গেটের সামনে আপাইকে দেখে মায়ের কাছ থেকে একপ্রকার ছুটে এলো ইকরার কাছে।হঠাৎ এমন হওয়ায় রেহানা বানু কিছুই বুঝলো না।ইরার দৌড় অনুসরণ করে সামনে ইকরাকে দেখতে পেলো মানহাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা কেমন ছোট হয়ে গেলো।
” আপাই তোমার আমাদের কথা মনে পরলো?
কেন এতোদিন আসোনি।নাকি মেয়ে পেয়ে তোমার পুতুল বোনকে আর ভালোবাসো না।
অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া একটা মেয়ে এমন বাচ্চামো কথা বললে যে কারোরই হাসি পাবে।ইকরার ও তাই হলো।ফিক করে হেসে দিয়ে নিজেই আবার নিজের জিভ কাটলো।
“তুমি হাসছো আপাই।সত্যিই তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না।
” আমার পুতুলকে আমি ভালোবাসবো না তো কাকে বাসবো।মনে পরেছে তো অনেক মনে পরেছে।কিন্তু কি করবো চাইলেই তো আসতে পারি না।
সোলেমান চাচা ততক্ষণে ইকরার দাদিকে তার ঘর থেকে ধরে বের করে এনেছে বাইরে।নাতনিকে দেখে তিনি বেশ খুশিই হয়েছেন।বিয়ের পর এটাই প্রথম ইকরার এই বাড়িতে আসা।সকলকে নিয়ে বাড়ির বসার ঘরে প্রবেশ করে ইকরা।ইমন সেখানেই ছিলো টিভি দেখছিলো বসে।বোনকে দেখে তারাতাড়ি বোনের কাছে এগিয়ে যায়।
“এই তোমার আসার সময় হলো আপাই?
” তুইও এবার ইরার মতো অভিমান করিস না প্লিজ।
রেহানা বানু ইকরার আসাতে যে মোটেও খুশি হয়নি এটা তার চোখমুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছে সবাই।তবে এতে কারোর বিশেষ কিছু যায় আসে না।ইরা মা-কে একটু আকটু ভয় পেলেও ইমন পুরোটাই বিপরীতে। সম্মান করে ঠিকই তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না কখনোই। ইরাকে উদ্দেশ্য করে রেহানা বানু বলেন-
“এই মাইয়া নিজের ঘরে যা।এইহানে কি মেলা বইছে যা কইতাছি।দুই দিন পর পরিক্ষা সেই খবর আছে?
ইরা মায়ের ধমক শুনে নিজের ঘরে চলে গেলো।
” ওকে না বকলেও পারতে ছোট মা।
“আমর মাইয়া আমি যা খুশি কমু তাতে তোর কি?
” মা!
চলো তো আপাই। উপরে চলো।আজ আমি বাজার থেকে তোমার সব পছন্দের খাবার নিয়ে আসবো।দাদি তুমিও চলো।এখানে থাকলে নানান কথা শুনতে হবে।
কতোদিন পর সেই চিরচেনা ঘরে প্রবেশ করেছে ইকরা।এই ঘরে কতো স্মৃতি, বাবার সাথে দেয়া আড্ডা সব কিছু মনে পরে যাচ্ছে।আহ: নিজের বাড়িতে এতো শান্তি এটা এখন অনুভব করছে ইকরা।এরই মধ্যে মানহা ছোট ছোট হাতে ইকরার শাড়ির আঁচল টেনে মুখে আঙুল চাপে।অর্থাৎ তার খিদে পেয়েছে।এই বিষয় টা ইকরার খুব ভালো লাগে। মেয়েটা ছোট তবে তার অসুবিধা গুলো খুব সহজেই ইকরাকে বুঝিয়ে দেয়।এই যেমন বাথরুম পেলে ইকরাকে টয়লেট দেখিয়ে দেয়।গরম লাগলে এসি।পানি তৃষ্ণা পেলে মাম পট।তাই ইকরার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে তার মেয়ের কি লাগবে না লাগবে।এই ক্ষেত্রে মা মেয়ের বন্ডিং দারুণ। এক কথায় অসাধারণ।
দিন গড়িয়ে রাত হলো।এমনিতে আরহান দিনে দু এক বার ফোন দিয়ে মানহার সাথে টুকটাক কথা বলে।ইকরার থেকে খোঁজ খবর নেয় তবে আজ একবারও ফোন করেনি আরহান।ইকরাও না।এমনিতেও লোকটার প্রতি অভিমান অনেক।ইকরা জানে লোকটা নির্দয়।ইকরার মান ভাঙাতে সে আসবে না।তবুও আশা করে।এবার দেখা যাক শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে কি হয়।কথায় তো আছে
“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন “!
হতেই পারে এক্ষেত্রেও তাই হলো।হয়তো সে আসবে।ইকরার জন্য না হোক নিজের মেয়ের জন্য তো আসতেই হবে।
আজ আরহান একটু দেরিতেই বাড়িতে ফিরেছে।ইদানীং কাজের খুব চাপ।ফ্যাক্টরিতে কিছু গড়মিল পাওয়া গেছে সেটা নিয়ে ম্যানেজারের সাথে হিসাব নিকাশ করতেই দেরি হয়ে গেলো।এই ফ্যাক্টরি টা অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত করেছে আরহান।বাবা মারা যাওয়ার পর অন্তরা বেগম স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িটা আকরে ধরে একা হাতে টিউশন করে আরহান কে বড়ো করেছে।আরহান ছোট থেকেই পরিশ্রমী। সেও স্কুল লাইফ থেকে টিউশন করেছে।উচ্চ মাধ্যমিকের পর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলো আরহান।একবার সেখানকার এক উর্ধ কর্মকর্তা কাজে ভুল হওয়ায় অনেক গালাগাল করে।সেটা সে সহ্য করতে পারেনি।সেদিনই চাকরি ছেড়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিজেই কিছু করবে।ছেলের এক কথায় ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলেম অন্তরা বেগম।সেটা দিয়েই আরহান ছোট পরিসরে ছোট্ট একটা ফ্যাশন হাউস শুরু করে।যার নাম দিয়েছিল “স্বপ্নের ফ্যাশন হাউজ”।আজ সেটা অনেক বড়ো হয়েছে।এখন সেখানে শতাধিক বেকার মানুষ কাজ করে নিজেদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।এছাড়াও বড়ো মামা দেশের বাইরে থাকায় তার সহযোগিতায় এখন বিদেশেও আরহানের ফ্যাশন হাউজ এর বেশ নাম হয়েছে।আজ তিল তিল করে গড়ে তোলা সেই ফ্যাক্টরির যখন এই অবস্থা এতে খারাপ লাগারই কথা।
বাড়িতে ফিরে খুব টায়ার্ড হয়ে যায় আরহান।কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে যায়।সেখানে মানহা বা ইকরা কাউকেই দেখতে পায় না আরহান।প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো মায়ের ঘরে আছে।কিন্তু যখন রাত ১০টা বেজে গেলো তখন একটু সন্দেহ হলো।এতো রাত করে তো মানহা ঘুমায় না।ইকরাও একবারও এলো না।বিষয় টা ভাবায় আরহানকে।তাই দেরি না করে বাইরে এসে খুঁজে কিন্তু কাউকেই পায় না।শেষে মায়ের রুমে গিয়ে দেখে মা বসে বসে কাথা সেলাই করছে।
” মা মানহা কোথায় দেখতে পাচ্ছি না যে?
ইকরাকে ও দেখছি না ওরা কি কোথাও গিয়েছে?
“ইকরা বাবার বাড়ি গেছে।
” বাবার বাড়ি!আর মানহা?
“সেও গেছে।তোমার কি মনে হয় ইকরাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে?
” মানে সত্যি সত্যিই ওরা গেছে।আর তুমি আমাকে একবার জানালেও না মা?
“জানালে কি হতো।সে কি আমার কথা শুনে বসে থাকতো।তাছাড়া তুমি যা করেছো কাল।মেয়েটার সাথে তাতে আমারও মনে হলো এবার কিছু একটা করা উচিৎ। সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছি আবেগের বসে আমি কতো বড়ো ভুল করেছি।
” ভুল!কিসের ভুলের কথা বলছো মা?আর তুমি আমাকে তুমি তুমি করেই বা কেন বলছো।
“কারণ তোমাকে আমার কেমন অচেনা লাগছে।আমার ছেলে কখনই কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে পারে না।তাও সে যখন নিজের বিবাহিত স্ত্রী।যাই হোক ছাড়ো সেসব কথা।তুমি যখন কাল মেয়েটাকে ওসব বলছিলে আমি নিজেই সব কিছু বাইরে থেকে শুনেছি।বিশ্বাস করো তখন নিজের ওপর এতো রাগ হচ্ছিলো।তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
” কি!
“খুব তারাতাড়ি তোমাদের বিচ্ছেদ হবে।তারপর আমি নিজ দায়িত্বে একটা ভালো পাত্র দেখে ইকরার আবার বিয়ে দেব।
” তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে মা।কি সব বলছো।বিয়ে দিবে মানে!মানহার কি হবে।ও তো ইকরাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।
“সেই দায় তো ওর একার নয়।ও কেন তোমাদের বাবা মেয়ের সব দায়িত্ব নিতে যাবে যেখানে ওর কোনো মর্যাদাই নেই?
” আমি ওনার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেছি।অসম্মান তো করিনি।তাছাড়া কালকের বিষয় টা আলাদা ছিলো।
“একটা মেয়ে স্বামীর বাড়িতে শুধু ভালো ভালো খাবার,গহনা, ভালো পোশাকের জন্য আসে না।মেয়েদের গহনা হচ্ছে তার স্বামী। স্বামীর ভালোবাসা।অথচ মেয়েটা সেসব তো পায়ই নি উল্টো পদে পদে অপমানিত হয়েছে।তোমাকে এতো কথা কেনই বা বলছি।তোমার তো মন বলতে কিছুই নেই।আমি একজন উকিলের সাথে কথা বলেছি।কাল তুমি যাবে। ওনার সাথে কথা বলে ডিভোর্সের যাবতীয় কাজ শেষ করবে।
” এই ডিভোর্সের কথা উনি নিজে বলেছে?
“না। এটা আমার সিদ্ধান্ত। ও সেটা জানে।তাই আমার কথা মেনে নিয়েছে।
” মানে উনি রাজি!
“না হবার তো কিছুই নেই।
” তোমরা বললেই হবে নাকি।আমার মেয়ের ভবিষ্যতের প্রশ্ন এখানে।দেওয়াচ্ছি ডিভোর্স আমি।
এই বলে আরহান মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।অন্তরা বেগম সময় নষ্ট না করে ইকরাকে ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে।এটা শুনে ইকরা একটু হাসে আবার একটু খারাপ ও লাগে।
“যদি সত্যিই তোমার ছেলে ডিভোর্স দিতে রাজি হয় তখন কি হবে মা?
” আমি থাকতে তুই কেন এতো ভয় পাচ্ছিস।আমার তো মনে হচ্ছে উল্টো টাই হবে।
“কি হবে?
“সেটা পরেই বুঝতে পারবি।তুই শুধু আমি যেটা বলছি সেটা করে যা।ফোনটা বন্ধ করে রাখ।আমি না বলা পর্যন্ত খুলবি না।বাকি কথা আমি তোর বাবার সাথে বলে নিবো।
চলবে