পাতা ঝরা বৃষ্টি পর্ব-০৫

0
8

#পাতা_ঝরা_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মানহার বয়স এখন ১বছর।আজ মানহার জন্মদিন। আরহান আজ কাজে যায়নি।ঠিক করেছে পুরো দিনটা মেয়ের সাথেই থাকবে।মানহা এখন অস্পষ্ট অনেক কথাই বলে।কিন্তু বাবা মা ছোট ছোট কথাগুলো বেশ স্পষ্ট।

মানহার জন্মদিন উপলক্ষে ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আরহান।বিশেষ করে ইকরার জন্য।ওদের বিয়ের ব্যাপারে আত্নীয় স্বজনের অনেকেই জানে না তাই এই আয়োজন।

রান্নার জন্য লোক আনা হয়েছে।রিতা বেগম ও এসেছেন তবে এখানে সে থাকার পারমিশন পায় নি।সেদিনের পর থেকে রিতা বেগমের সাথে কোনো রকমের যোগাযোগ করেনি আরহান।অন্তরা বেগমকে দিয়ে আজ এই বাড়িতে আনিয়েছে তাও কিছু সময়ের জন্য।

বাড়ির সবকিছু গোছগাছ করতে করতে প্রায় দুপুর। আরহান বাজারে গেছে কোনো একটা কাজের জন্য।ইকরা আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে দেখলো এটা পুরোনো তবে রঙ একেবারে নতুনের মতোই।খুব সম্ভবত এটা মহুয়ার শাড়ি।এটা ছাড়াও আরো কিছু শাড়ি আছে যেগুলো আরহান খুব যত্নে রেখে দিয়েছে।যদিও ইকরার শাড়ি আছে অনেক কাল আরহান ও নতুন দুটো শাড়ি এনে দিয়েছে। কিন্তু কেন জানি এই শাড়িটা বেশ পছন্দ হলো ইকরার।তাই ঠিক করলো সে এটাই পরবে।মেরুন রঙের শাড়িটা দেখলে যে কারোর নজর লেগে যাবে।আরহান আসার আগেই ইকরা ফ্রেশ হয়ে শাড়িটি পরে রেডি হয়ে নিলো।মানহা এখনো ঘুমে।ঘুম থেকে উঠলেই কেক কাটা হবে।

রেডি হয়ে ইকরা নিচে নেমে এলো।মানহাও ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে।আরহান বাজার থেকে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই।ইকরাকে নিচে নামতে দেখে অন্তরা বেগম সহ বাকিরাও সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।সকলের একদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরহান ও পিছনের দিকে ঘুরে তাকালো।ইকরাকে সুন্দর লাগছে না এটা নয়।রাগ হচ্ছে ইকরা কেন মহুয়ার শাড়ি পরেছে এটা দেখে।আরহানের কি হলো কে জানে ইকরা নিচে নামার আগেই ওর এক হাত ধরে টেনে আবারও উপরে নিয়ে গেলো।

“আরহান বাবা শোন।

মায়ের ডাকেও আরহান থামলো না।রিতা বেগম জানে এটা মহুয়ার শাড়ি। মহুয়াকে আরহান কতটা ভালোবাসে সেটাও জানে।তাই এখন ইকরার সাথে কি হতে পারে সেটা ভেবেই তার কেমন খুশি খুশি লাগছে।

” আমার হাতে লাগছে।আচ্ছা কি হয়েছে বলুন না।আমি কি কিছু ভুল করেছি?

ইকরার কথা কানে না তুলে আরহান ইকরাকে নিজের ঘরে এনে তবেই থামলো।

“এটা কি পরেছেন আপনি?

” কেন শাড়ি।খারাপ লাগছে দেখতে!

“আপনি এই শাড়ি কেন পরেছেন।বলুন কেন পরেছেন?আপনাকে আমি নতুন শাড়ি এনে দেই নি?

” হ্যাঁ দিয়েছেন কিন্তু।

“কিন্তু কি হ্যাঁ। কিন্তু কি।শাড়ি এনে দেয়ার পরেও কেন এটা পরেছেন।আপনি জানেন না এটা মহুয়ার শাড়ি।মহুয়ার জিনিসে আপনি কেন হাত দিয়েছেন?আপনি কি কোনো ভাবে মহুয়ার যায়গা নিতে চাইছেন।স্ত্রীর অধিকার ফলাতে চাইছেন?

” আপনি এসব কি বলছেন।একটা শাড়িই তো পরেছি।বিশ্বাস করুন আপনার খারাপ লাগবে জানলে আমি পরতাম না।

“চুপ একদম চুপ।এক্ষুনি এটা পালটে অন্য শাড়ি বা আপনার যা ইচ্ছা আপনি পরুন।কিন্তু এটা নয়।

” আচ্ছা ঠিক আছে কেক টা কাটা হয়ে যাক তারপর না হয়।এমনিতেই তো দেরি হয়ে গেছে।

“হোক দেরি।তবুও আপনি এটা চেঞ্জ করবেন।একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন এই বাড়িতে আপনি..।

” শুধুই মানহার দেখাশোনা করার জন্য এসেছি।মায়ের ভুমিকা পালন করতে এসেছি।স্বপ্ন, চাওয়া পাওয়া সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এসেছি শুধু মানহার দেখাশোনা করার জন্য।এটা জানি আমি।বার বার আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না।

“আমি এভাবে বলতে চাই নি।

“থাক না। তাতে কি যায় আসে।আপনি নিচে যান আমি চেঞ্জ করে আসছি।

” ইকরা আমি।

“কিছুই বলতে হবে না।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।

আরহান আর কথা বাড়ালো না।ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ঘরে মহুয়ার একটা বড়ো ছবি আছে। সেটার দিকে ইকরা এক পা দু পা করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রয় কিছুটা সময়।

” তুমি খুব ভাগ্যবতী মহুয়া আপু।দেখো না তুমি নেই তবুও তুমি এখনো কতো ভালোবাসা পাচ্ছো আর আমি!হাহ আমি জন্ম থেকেই কপাল পোরা।আচ্ছা তুমি বলো না আমাকে কি ভালোবাসা যায় না।একটুও না? তোমার যায়গা তো আমি চাইনি।তবে কেন বার বার উনি আমায় ভুল বুঝেন?সত্যি বলছি যদি জানতাম তোমার শাড়ি পরাতে উনি এভাবে রিয়েক্ট করবেন আমি পরতাম না।

আড়াল থেকে সবটাই শুনলো অন্তরা বেগম।কিন্তু এখন এটা নিয়ে কিছুই বলা যাবে না।আগে আত্নীয় স্বজনেরা যাক তারপর আরহানের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবে সে।একটা শাড়ির জন্য মেয়েটাকে এভাবে বলবে আরহান?বুঝিয়েই তো বলা যেত।সেটা না করে মেয়েটাকে আজকের দিনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে হবে?
এবার এর একটা বিহিত না করলেই নয়।

১০ মিনিটে আগের শাড়ি পালটে বিয়েতে বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া শাড়ি থেকে একটা শাড়ি পরে নিচে নামে ইকরা।চোখমুখের ভাব স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি।এটা দেখে চাচি শাশুড়ী জানতে চাইলেন শাড়ি কেন পাল্টেছে।

“আসলে কাকি ওই শাড়িটা অনেক অজন বুঝলে যেটা বহন করা আমার সাধ্যের মধ্যে নেই।তাই এটা পরে এলাম।দেখো না এটা অনেক হালকা কোনো অজন নেই।আমি এটাতেই বেটার ফিল করছি।

” আচ্ছা ঠিক আছে এসো কেক কাটা হবে।

আরহান সবটাই শুনলো কিন্তু কিছুই বললো না।মানহা ইকরাকে দেখে তার কাছে চলে এলো।কেক কাটা হলো।খাওয়া দাওয়া আড্ডা শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেলো।ইকরা মানহাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ওর পাশেই শুয়ে পরলো। তখনকার আরহানের বলা প্রতিটি কথাই আবারও একবার স্বরণে এলো ইকরার।আহ কি কষ্ট দায়ক সেই কথাগুলো সহ্য করা।

“আল্লাহ আপনি তো জানেন আমি কারো জায়গায় নিজের যায়গা করে নিতে চাই না।আমি শুধু নিজের যায়গা টা চাই।আপনি তো জানেন আমি কি চাই।তাহলে কেন বার বার আমাকে কষ্ট দেয়া হয় আল্লাহ।আমি যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি।আপনি আমাকে আরো ধৈর্য দিন।

আরহান এখনো ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অন্তরা বেগম ছেলের কাধে হাত রাখেন।কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আরহান বুঝতে পারে এটা তার মা।

” তুমি এখনো যেগে আছো মা?

“তুই ও তো যেগে আছিস।ঘরে যাসিনি কেন?

” ঘুম আসছে না তাই।

“ঘুম আসছে না নাকি অনুতপ্ত তুই?

” মানে!

“আমি তোর মা আরহান।মায়েরা সব বুঝে।এমন কাজ কেন করিস যার জন্য পরে অনুতপ্ত হতে হয়।অনুসুচনা হয়?যাই হোক ঘুমিয়ে পর এখন ভেবে কোনো লাভ নেই।আর হ্যাঁ ইকরা আমায় কিছুই বলেনি।এটা নিয়ে মেয়েটাকে আবার কথা শোনাস না।

মায়ের কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরে আরহান।তার মা কখনো এভাবে কথা বলেনি তার সাথে।এমনকি মহুয়াকে যখন বিয়ে করে এনেছিলো তাকে না জানিয়ে তখন ও না।বাবা মারা যাওয়ার পরে অনেক কষ্টে একা হাতে মানুষ করেছে আরহানকে।তখনো এতো শক্ত ভাবে নিজের মা-কে আবিষ্কার করেনি আরহান।আজ কি হলো।নিজের মা কে কেন এতো অচেনা লাগছে!

আরহান রুমে এলো রাত তখন প্রায় ১২টা।ইকরা মানহাকে জরিয়ে ঘুমিয়ে আছে।ইকরার গায়ে একটা পাতলা কম্বল। এসির হাওয়া সহ্য করতে পারে না।কিন্তু মানহা এই বয়সেই এসি ছাড়া ঘুমোতে পারে না।আরহান এসির পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে পাশের সোফায় বসলো।ইকিরার দিকে লক্ষ্য করলো মেয়েটার চোখে পানি শুকিয়ে আছে।হয়তো কান্না করেছে।হুট করেই বিছানার একদম কোনায় চলে এলো ইকরা।একটু মোর নিলেই পরে যাবে নিশ্চিত। হলোও তাই।যেই মোর নিলো পরতে যাবে আর আগেই আরহান ধরে নিলো।ইকরার ঘুমও ভেঙে গেলো।আরহানকে নিজের এতো কাছে দেখে একপ্রকার ছিটকে দূরে সরে গেলো।ভয় পেয়েছে।আরহান বিষয় টা বুঝতে পেরে গ্লাসের পানি সামনে দিল।এটাই যেন এই মুহুর্তে খুব প্রয়োজন ছিলো ইকরার।

“সরি আসলে পরে যাচ্ছিলেন তাই।

ইকরা কিছুই বললো না।পানি খেয়ে গ্লাসটা নিজেই টেবিলে রাখতে গেলে আরহান সেটা নিয়ে নিলো।তারপর ইকরা পুনরায় শুয়ে পরলো।

” কথা বলবেন না?

“ঘুমিয়ে পরুন অনেক রাত হয়েছে।

তারপর দুজনের মধ্যে আর কথা হলো না।আরহান বুঝলো অভিমানের পাল্লাটা অনেক ভাড়ি।ওই বা কি করতো।মহুয়াকে চাইলেই ভুলতে পারছে না।চাইলেও ইকরাকে আপন করে নিতে পারছে না।যতবার সবটা মানিয়ে নিতে চাইছে ততবারই মহুয়ার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত চোখের সামনে ভেসে আসছে।ভাবতে ভাবতে এক সময় আরহান ও খাটের এক কোনে ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে উঠে ইকরাকে আর দেখতে পেলো না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো অনেক বেলা হয়ে গেছে।ইকরা আসার পর আরহানের একটা বাজে স্বভাব হয়েছে সকালে রোজ ইকরা ডেকে দেয় বলে এখন নিজে থেকে উঠে না।কিন্তু আজ ইকরা ডাকেনি।ডাকেনি মেয়েও। এমনিতে মানহা সকালে ঘুম থেকে উঠলে বাবার সাথে অনেক দুষ্টুমি করে আজ তাও করে নি।মা মেয়ে মিলে হয়তো জোট পাকিয়েছে।

আরহান একেবারব অফিসের জন্য রেডি হয়ে বের হলো।নিচে নেমেও ইকরাকে পেলো না।তবে মানহাকে পেলো।মেয়েকে কোলে নিয়েই হালকা কিছু খেয়ে বেরিয়ে যায় আরহান।

” তোমার ছেলে কি চলে গেছে মা?

“হ্যাঁ। এবার তুইও তৈরি হয়ে নে।

” মানে আমি কেন তৈরি হবো!

“কারন তুই বাপের বাড়ি যাচ্ছিস।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে পরে থেকে কি করবি?

” তুমি কি মজা করছো?

“না সত্যি সত্যিই বলছি।তুই কি আমার ছেলেকে ভালোবাসিস?সত্যি করে বল।

“বাসি তো।কিন্তু তাতে কি যায় আসে।

” তাহলে আমি যা বলছি সেটা কর।আরহান নিজেই তোকে ফিরিয়ে আনবে।

“তোমার ছেলে! কোনোদিন যাবে না মা।শুধু শুধু আমাকে আশা দেখিও না।তাছাড়া মানহাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

” ছেড়ে থাকতে তো বলছি না।ওকে নিয়েই যাবি। তবেই না বউ মেয়ের টানে আমার ছেলে পাগল হবে।

“তুমি সত্যি বলছো।উনি যাবেন?

” ১০০% শিওর থাক।

“নিজের ছেলের সাথে এমন করতে তোমার খারাপ লাগছে না?তুমি তো জানো মানহাকে না দেখে উনি থাকতেই পারেন না।

” শোন মাঝে মাঝে ছেলে মেয়েদের সঠিক টা বোঝানোর জন্য বাবা মায়ের এমন কিছু করতে হয়।এবার কথা না বলে যা।করিম তোকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে