পাতা ঝরা বৃষ্টি পর্ব-০৪

0
87

#পাতা_ঝরা_বৃষ্টি
#পর্ব_৪
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী

দেখতে দেখতে মানহার বয়স এখন ৭ মাস।রোজ নতুন নতুন কথা শিখছে।সাধারণত বাচ্চারা প্রথম ডাকটা হয় দাদি নয়তো বাবা দিয় শুরু করে।কিন্তু মানহার প্রথম ডাক ছিলো মা।স্পষ্ট ডাক।যেটা শুনে সেদিন ইকরার চোখমুখ চিক চিক করছিল খুশিতে।এইতো তার মা হওয়া সার্থক হলো।

প্রতিদিনের মতই রাতের বেলা ইকরা মানহাকে সুজি খাইয়ে থাকে।আজও তাই করছিলো। সুজি রান্না করে খাটের পাশে ছোট টি টেবিলে রেখে মানহাকে কোলে নেয় ইকরা।এদিকে মানহার এতোটাই খিদে পেয়েছিলো যে কান্নার বেগ থামার নাম নেই।তাই সব কিছু ছেড়ে ইমরা আগে মানহাকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।আরহান তখন সবে নিজের ফ্যাক্টরি থেকে ফিরেছে।এমন সময় ঘটলো আরেক ঘটনা। টেবিলে রাখা গরম সুজি মানহার পায়ের ওপর গিয়ে পরলো।যদিও তেমন গরম নয় তবে বাচ্চাদের শরীরের জন্য এই গরমই যথেষ্ট। ইকরার থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো ইকরার নানি মা।কিন্তু ইকিরা সেটা বুঝতেই পারেনি। ও তো মানহার এই অবস্থা দেখে অনেকটাই ঘাবড়ে গেছে।
ঘরে ঢুকে মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আরহানের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। মানুষ কিভাবে এতোটা অসচেতন হতে পারে?

এদিকে আরহান ঘরে ঢোকার আগেই মানহার নানি মা (রিতা বেগম)বেরিয়ে যান।যার ফলে আরহান তাকে দেখতে পায়নি।

হুট করে মানহাকে কেউ একটানে ইকরার থেকে ছিনিয়ে নেয় আরহান।ইকরা পিছনে ফিরে দেখতে পায় আরহানের লাল চোখে ভয়ংকর চেহারা।

“আপনি এটা কি করলেন?

” বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে করিনি।

“কি বিশ্বাস করবো?সব তো নিজের চোখেই দেখলাম।যখন দায়িত্ব নিয়ে সেটা পালন করতে জানেন না তখন দায়িত্ব নিয়েছেন কেন।আপনি ভুলে গেছেন আমাদের বিয়েটা কেন হয়েছে?শুনুন আমার মেয়ের শরীরে যদি একটা ফোস্কা ও পরেছে না আপনাকে আমি দেখে নেব।

ছেলের চেচামেচি শুনে অন্তরা বেগম ছুটে এলেন আরহানের রুমে।কি হয়েছে সেটা মানহা আর পাশে পরে থাকা সুজি দেখেই বুঝতে পেরেছে।

আরহান নিজের মা-কে দেখে চুপ হয়ে যায়।যত যাই হোক মায়ের সামনে উচু গলায় কথা বলতে পারে না আরহান।মানহাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে একটা ফার্মেসীতে নিয়ে গেলে ডক্টর একটা মলম দেন।তেমন কিছু হয়নি সামান্য লালচে ভাব হয়েছে।সুজিটা এতোটাও গরম ছিলো না।তখন মাহনার কান্না দেখে সহ্য করতে পারেনি আরহান।মানহাও বাবা চিৎকারে ভয় পেয়ে বেশি কেদেছে। আরহান ভুলেই গিয়েছিল উচ্চস্বরে কথা মানহার সহ্য হয় না ভয় পেয়ে যায়।এটা তো সত্যি তখন ইকরার কোলেও কান্না করেনি মানহা।আরহানের কথা শোনার পরই কান্না করেছে।আরহানের এবার খারাপ লাগছে ইকরার সাথে ওই ব্যবহার করার জন্য।ইশ বেচারি হয়তো কষ্ট পেয়েছে?

বাড়িতে এসে আরহান ইকরারে ঘরে পেলো না।মানহা কোলেই ঘুমিয়ে গেছে বিধায় বিছানায় সুন্দর করে শুইয়ে দিলো।রাত তখন ৮টা বাজে।ইকরা এখনো রুমে আসছে না।
“তার মানে উনি আসবেন না?মায়ের কাছেই থাকবেন।তাহলে রাতে মানহাকে কি করে ম্যানেজ করবো!ও তো ইকরাকে ছাড়া কিছু বুনঝেই না।নিজের মেয়েও আজকাল কেমন পর হয়ে যাচ্ছে।

আরহান মায়ের ঘরের দিকে গেলো।বাইরে থেকে ইকরার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

“এবার কান্না থামা না।তুই তো আরহানকে চিনিস ও কি এমন বল?জানিসই তো মেয়েকে বড্ড ভালোবাসে তাই রাগে এভাবে বলে ফেলেছে।

” তাই বলে আমাকে অবিশ্বাস করবেন উনি!এতোদিনে আমি কি ওনার একটু বিশ্বাস ও অর্জন করতে পারিনি মা?উনি তো জানেন আমি মানহাকে ভালোবাসি কি না।কি করে ভাবলেন যে আমি ওই গরম সুজি ওর গায়ে ফেলে দিবো?হ্যাঁ আমি ওর আসল মা নই কিন্তু মা তো।
এটাও সত্যি উনি আমার সাথে কখনো এমন ব্যবহার করেন নি।কিন্তু।

“কিন্তু কি?আচ্ছা তুই আমাকে বল তো টেবিল তো তোদের থেকে একটু দূরেই ছিলো তাহলে বাটিটা কি করে মানহার গায়ে পরলো?

” এটা আমিও ভেবেছি মা।আমার মনে হলো আমাকে কেউ পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে।আর এতো দ্রুত ঘটনা টা ঘটলো যে পিছনে ফিরে আমি কাউকে দেখতে পাই নি।তবে দরজার বাইরে আমি শাড়ির আঁচল দেখেছি।

“শাড়ির আঁচল!

” হ্যাঁ কিন্তু তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে মা?

“কি কথা বল?

” আমার মনে হয় ওটা আর কেউ না মহুয়া আপুর মা ছিলেন।

“কি বলছিস।আগে কেন বলিস নি!

” আমি ভেবেছিলাম আমি ভুল দেখেছি।তখন মাথাও ঠিক ছিলো না আমার।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যা দেখেছি সত্যিই দেখেছি।

“অনেক হয়েছে। আর না।এবার এর একটা বিহিত করতেই হবে।

” প্লিজ মা আপনি আপনার ছেলেকে কিছুই বলবেন না।

“বলবো না মানে?অবশ্যই বলবো।

” না বলবেল না।

“কেন আটকাচ্ছিস বল তো?

” কারণ আপনার ছেলে জানতে পারলে উনি এই বাড়িতে আর আসতে পারবেন না মা।আমি চাই না মানহা ওর নানির আদর ভালোবাসা থেকে দূরে থাকুক।

“কিন্তু।

” কোনো কিন্তু নয় মা প্লিজ।

“ঠিক আছে বলবো না।

শাশুড়ী ইকরার কথা শুনলেও একজন আছে যে শুনে নি।ইকরার বলা প্রতিটি কথাই আরহান শুনেছে।আর তখনই রিতা বেগমের ঘরের দিকে চলে যায়।সেই সময় রিতা বেগম ফোনে নিজের বোনের সাথে কথা বলছিলেন।ইকরার বলা প্রতিটি কথাই সত্যি এটা ওনার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে আরহান।

ইকরার সাথে অন্তরা বেগম তখনও নিজের ঘরেই কথা বলছিলেন।এমন সময় রিতা বেগমের গলার আওয়াজ শুনে বাইরে এলো দুজনেই।

” কি হয়েছে এভাবে চিৎকার করছেন কেন আপা?

“দেখুন না আপা।জামাই বলছে এই রাতের বেলা আমাকে এখান থেকে চলে যেতে।আপনিই বলুন আমার নাতনিকে রেখে গেলে আমার খারাপ লাগবে না?আমার মা মরা মেয়েটা।

” যদি এতোই আমার মেয়ের কথা ভাবতেন তবে আজ যেটা করেছেন সেটা করতেন না আম্মা।কথা বাড়াতে চাই না।আমি যখন বলেছি আপনি এখন এই বাড়ি থেকে যাবেন মানে এখনই।আর মা যদি বাধা দেয় আমি সেটাও শুনবো না।করিম ভাই গাড়ি বের করেছে আপনি আর দেরি করবেন না প্লিজ।

“বলছি আরহান থাক না বাবা।উনি তোর শাশুড়ী হন।

” মা প্লিজ উনি যেটা করেছেন সেটা অন্যায়।আমার ওইটুকু মেয়ের সাথে উনি এমন একটা কাজ করেছেন।তুমি ভাবো তো যদি ওটা বেশি গরম হতো তাহলে কি হতো?আমি শুধু শুধু তখন ইকরার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি।আর যাই হোক উনি এখানে থাকলে আমরা কেউই ভালো থাকতে পারবো না মা।বিশেষ করে ইকরা।আর আমি চাই না কোনো বদ সঙ্গে আমার মেয়েও বদ হোক।

“জামাই!

” বলতে বাধ্য হচ্ছি আম্মা।আর হ্যাঁ মানহা যতদিন বড়ো না হচ্ছে আপনি এবাড়িতে আসবেন না।এবার আপনি যেতে পারেন।করিম ভাই ওনাকে একেবারে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই আসবেন।

এতোকিছুর মধ্যে ইকরা একটা কথাও বলেনি।চুপচাপ আবারও শাশুড়ীর ঘরে চলে গেলো।

“যাক বাবা ভালো হয়েছে উনি গেছেন।এবার সবাই একটু ভালো থাকতে পারবো।

” মা!

“হ্যাঁ বল।

” উনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?

“এই উনি টা কে?

” ইকরার কথা বলছি।

“আসলে কি বলতো আমরা রাগের মাথায় অনেক সময় অনেক কিছু বলে ফেললেও পরে কিন্তু ভুল বুঝতে পারি।কিন্তু পরে ভুল বুঝলে আগের দেয়া আঘাত সেরে যায়?তুই ভুল করেছিস আরহান।তোর যায়গায় হয়তো যে কেউ এটাই করতো।কিন্তু আমি তোর থেকে এটা আশা করিনি।আমি তো জানতাম আমার ছেলে বুঝদার, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান মানুষ হুট করে রেগে গিয়ে কাউকে কষ্ট দেয়ার ছেলে তো তুই নস তাহলে?

” আমি সত্যি বুঝতে পারিনি মা।তখন কি যে হলো।তোমার ছেলে হয়তো ওই সরল মেয়েটার যোগ্য নয়।

“কে কার যোগ্য সেটা তো সময় বলবে।তবে তোকে একটা কথা বলতে পারি।

“কি?

” তোর উনি রেগে নেই।একটু কষ্ট পেয়েছে।সে কিন্তু কিছু খায় ও নি।

“খায় নি কেন?

” তুই কি কিছুই বুঝিস না।মহুয়াও তো এমন করতো।

“তুমি কি এখন ওনার রাগ ভাঙতে বলছ আমায়!

” বলিনি তো।তুই কি করবি তুই ভালো জানিস।আমার শুধু ভেবে খারাপ লাগছে মেয়েটা সারারাত না খেয়ে কষ্ট করবে।

“তুমিও না মা।ঠিক আছে খাবার বেরে দাও আমি দেখছি কি করা যায়।

” ঠিক আছে।(আল্লাহ যেভাবেই হোক এই দুটোকে মিলিয়ে দাও। আর কিছুই চাই না)

ইকরা অন্তরা বেগের ঘরে শুয়ে আছে।উল্টো দিকে ঘুরে শোয়ায় দেখতে পেলো না কে এসেছে।দেখার ইচ্ছেও নেই।ঘরের আলো এখন অসহ্য লাগছে।

“লাইট টা অফ করে দাও না মা।

এমনিতে অন্তরা বেগম আশেপাশে থাকলে কথা বলে।তবে এখন না বলায় ইকরার মনে সন্দেহ হয় তাই ঘুরে তাকায় শোয়া অবস্থাতেই।আরহানকে দেখে চটজলদি উঠে বসে।

” আপনি এখানে কেন মা কোথায়?

“কেন আমার কি এই ঘরে আসা বারন!

” সেটা আমি কখন বললাম।তাছাড়া আপনার বাড়ি আপনার ঘর আপনি আসতেই পারেন।সেখানে আমার বারনে তো কিছু যায় আসে না।

“ঠিক ধরেছেন। আর এই বাড়িতে আমার কথাই হবে শেষ কথা।

” কি বলতে চাইছেন সেটা বলুন।

“রাতে খান নি কেন?

” খিদে নেই।

“কেন নেই?আমার বাড়ির খাবার কি এতোটাই বাজে যে খাওয়া যায় না?

” আমি কি সেটা বলেছি?

“কোনো কথা শুনতে চাই না।এই নিন খাবার। আমার সামনেই খেয়ে শেষ করুন।

” বললেই হলো নাকি।আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই?

“অবশ্যই আছে তবে সেটা অন্য কোনো ইচ্ছে হলে ঠিক ছিলো।আপনার কোনো ধারণা আছে এই এক মুঠো খাবারে জন্য মানুষ দিন রাত কত পরিশ্রম করে।আর আপনি সেটা পেয়েও অবহেলা করছেন।এটা তো আমি মেনে নিবো না।

” কি হলো বসে আছেন কেন?দেখুন খাবারে হেরফের আমার একদম পছন্দ নয়।খেয়ে নিন বলছি।

অবশেষে বাধ্য হয়ে ইকরা খাবারটা খেয়েই নিলো।এমনিতেও খিদে পেয়েছিলো। আরহানের ওপররাগ করেই খায়নি।দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখছিলেন অন্তরা বেগম।তিনি জানতেন আরহান এমন কিছু করবে।এসেছে রাগ ভাঙাতে ঠিক আছে তাই বলে এভাবে?এভাবে বকে কে বউ এর রাগ ভাঙায়?তাও ভালো বেশি বকেনি। তা না হলে দেখা যেত মেয়েটা সত্যি সত্যি খেত না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে