পাতা ঝরা বৃষ্টি পর্ব-০৩

0
11

#পাতা_ঝরা_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী

শশুর বাড়িতে এসে ইকরা প্রথমে ইতস্তত বোধ করছিলো।কারণ বাবার বাড়ি থেকে আসার পথে আরহান একবারের জন্যও কথা বলেনি ইকরার সাথে।কিন্তু ছোট খাটো বিষয় গুলোতে নজর রেখেছে।একবার ইকরার মনে হলো তবে কি বিয়েটা করে সে ভুল করেছে?আবার ভাবলো হয়তো সে সময় নিচ্ছে।

যে কোনো মেয়ের জীবনে শশুর বাড়িতে অন্যতম ভুমিকা পালন করে তার শাশুড়ী। শাশুড়ী যদি মনের মতো হয় তাহলে সেই মেয়ের জন্য সুখকর অন্য কিছুতে নেই।ইকরার ভাগ্য টা বলতে গেলে সেদিক থেকে ভালোই।বাকি রইলো স্বামী সেও একদিন ঠিক আপন করে নেবে এটা ইকরার বিশ্বাস।

অন্তরা বেগম এসেছে থেকে এই সেই করেই যাচ্ছেন।ইকরার কি ভালো লাগবে কি খাবে সবকিছু তিনি নিজের হাতে করছেন।এদিকে ইকরা আরহানের থেকে একটু বেটে বলে প্রতিবেশী কিছু মহিলারা সেটা নিয়ে কথাও শুনিয়ে দিয়েছে।যদিও অন্তরা বেগম জবাব ও দিয়েছেন যথাযথ।

“আপনি যাই বলেন ভাবি আমার মহুয়া কিন্তু লাখে একটা ছিলো।আর জামাই হিসেবে তো ১ নম্বর।

” কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো মহুয়া বেঁচে থাকতে আপনি আমাদের মেনেই নেন নি আম্মা।আর রইলো বাকি ইকরার কথা?তবে আমি বলবো আমি শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য কোনো পুতুল নিয়ে আসিনি।যা দেখতে একেবারে নিখুঁত হবে।ওকে আমি বিয়ে করে এই বাড়িতে এনেছি। কাজেই ও দেখতে কেমন সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই।ওনারা না হয় বাইরের মানুষ কিন্তু আপনি তো নন।এটা আপনার মেয়ের শশুর বাড়ি আম্মা।হ্যাঁ সে হয়তো বেঁচে নেই কিন্তু তার রেখে যাওয়া একটা সম্বল তো আছে।এই বিয়েটা কেন হয়েছে সেটা আমরা সবাই জানি।কিন্তু তার মানে তো এই না যে সে শুধু আমার মেয়ের দেখভাল করবে অন্য সব কিছু ত্যাগ করে।
আর আপনাদের বলছি বউ দেখা শেষ। নিশ্চিত আপনারা আপনাদের প্রশংসা করে নিয়েছেন।এবার আপনারা আসতে পারেন।

“অন্তরা ভাবি আপনার সামনে আরহান এমন কথা বলছে আর আপনি চুপ করে আছেন?আমরা কি ওর খারাপ চাই?

” কি বলবো বলুন তো ভাবি।আমি বলতাম যদি ওর দোষ থাকতো। কিন্তু ওর তো কোন দোষ নেই।তাই কিছু বলতেও পারছি না।আর একটা কথা তো ঠিক।মানুষ দেখতে যেমনই হোক মন যদি পবিত্র থাকে তার সব কিছুই পবিত্র। তাছাড়া আমরা ওকে দেখেশুনেই বাড়ির বউ করেছি।সুতরাং ও কেমন নিশ্চয়ই সেটা জেনেই এনেছি।মহুয়াকে আমি কিন্তু পছন্দ করে আনি নি।তাই বলে কি আমি ওকে ভালোবাসতাম না?অবশ্যই বাসতাম।কিন্তু পরিস্থিতি আজ ভিন্ন।মহুয়া থাকলে এমন কিছু হতোই না।আমরা এখনো মহুয়াকে ভালোবাসি।তার মানে এই নয় যে ইকরা তার প্রাপ্যটা পাবে না।

“হয়েছে ভাবি।আমাদের ঘাট হয়েছে তোমাদের বাড়িতে এসে।এই চল সবাই এখান থেকে।বউ দেখতে এসেছি নাকি অপমানিত হতে।

” আরে ওনারা চলে যাচ্ছেন তো।মা আপনি আটকান ওনাদের।

“যেতে দিন ওদের।অদ্ভুত তো।এতোক্ষণ যারা আপনাকে এতোকিছু বললো তাদেরকেই যাওয়া থেকে আটকাতে চাইছেন?মা ওনাকে বলে দাও এতো নরম হয়ে চললে হবে না।আমার স্ত্রী থাকবে শক্ত। যার আত্ন সম্মানবোধ আছে।তোমাদের কি কি রিচুয়াল আছে শেষ করো আমি ঘরে গেলাম।

এই বলে আরহান আর একমুহূর্তের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।বাড়িটা ইকরাদের বাড়ির মতোই। তবে বেশ বড়ো।আরহানের যাওয়ার দিকে চোখ বড়ো করে চেয়ে আছে ইকরা।যেই লোকটা আসার পথে একটা কথাও বললো না।এমনকি বাড়িতে এসেও না।সেই লোকটা তার হয়ে প্রতিবাদ করলো এটা অবিশ্বাসী লাগছে ইকরার কাছে।ইকরার আশ্চর্য যেন কাটছেই না।তখনই কাটলো যখন অন্তরা বেগম ইকরাকে টেনে সোফায় বসালো।

” এখনই এতো অবাক হলে হবে?তোকে বলেছিলাম না আমার ছেলে লাখে একটা। একটু সময় দে দখবি তোকে মাথায় করে রাখবে।শুধু আমার নাতনীটাকে একটু মায়ের ভালোবাসা দিস এতেই হবে।আবার ভাবিস না আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি।তোকে তো আবার চোখে হারায় সে।বোস এখানে। ওসব রিচুয়াল টিচুয়ালের দরকার নেই।আমি হচ্ছি তোর স্মার্ট শাশুড়ী। এসব দিক দিয়ে তোর কোনো চাপ নেই।আর শোন আমাকে আপমি আজ্ঞে করতে হবে না।তুমি করে বলবি।এখন ফ্রেশ হয়ে নে।আমি তোদের খাবার দিচ্ছি।
আর আপা আপনিও এবার ঘরে চলে যান।অনেক রাত হলো।মানহা না হয় আমার সাথেই থাকুক।মেয়েটা আমার রুমে ঘুমিয়েছে।

“কেন মা ও আমার কাছে থাকবে না?

” থাকবে তো।তবে আজ না, কাল থেকে।আজ তোমাদের একটা বিশেষ রাত।আজ না হয় আমিই সামলে নেব।

ঘড়িরর কাটায় যখন ১১টা বাজে।ঠিক তখন ইকরাকে আরহাবের ঘরে দিয়ে গেলো ওর কিছু কাজিনরা।আরহান সে সময় তার অফিসের কিছু ফাইল দেখছিল।
ইকরা পরনের বেনারসি পালটে শাশুড়ীর দেয়া একটা মেজেন্ডা রঙের সুতি শাড়ি পরেছে।
ইকরাকে দেখে আরহান একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
ইকরাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আরহান বললো-

“ঘুমিয়ে পরুন আমার ঘুমোতে অনেক রাত হবে।

ইকরা শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ শুয়ে পরলো।ভাবছে আরহান কি তার পাশে ঘুমোবে নাকি আলাদা।খাটের পাশে বেশ বড়সড় একটা জোড়া সোফা রাখা যে কেউ চাইলে আরাম করে ঘুমোতে পারবে।

” লাইট কি নিভিয়ে দিব?

“কি!

” আপনার কি আলোতে ঘুমোতে অসুবিধা হচ্ছে তাই বললাম।

“ওহ(আমি ভাবলাম কি না কি।কিন্তু এ তো আস্ত একটা বেরসিক লোক।)

” আমি কিছু জিগ্যেস করেছি।আপনি কি ভাবতে বসেছেন বলুন তো?

“ক..কিছু না।নিভিয়ে দিন। আমি ঘুমোচ্ছি।

” দেখুন ইকরা।বিয়েটা কেন হয়েছে আমরা দুজনেই।জানি।আমি অন্য ছেলেদের মতো বলবো না যে আপনাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না বা দায়িত্ব ছাড়া কিছুই পালন করতে পারবো না।কিন্তু হ্যাঁ আমার একটু সময় লাগবে।আর তখনকার জন্য সরি।

“সরি!

” নিচে যা হলো।আমি উপস্থিত থাকলে এসব কিছুই শুনতে হতো না।

“আমি কিছু মনে করিনি।কিছু মানুষের স্বভাব টাই এমন।আপনি যাকে আম্মা বলছিলেন উনি তো আপনার শাশুড়ী মা তাই না।

” হ্যাঁ। আসলে মহুয়া বেঁচে থাকতে উনি আমাদের বিয়েটা মেনে নেন নি। আর এখন মেয়ে মেই অথচ মেয়ের জামাই নাতির জন্য দরদের যেন কমতি নেই।আমি শুধু কিছু বলি না মহুয়ার মা বলে।সে যাই হোক আপনি ঘুমিয়ে পরুন আমি সোফায় ঘুমাবো।

কথার পিঠে বেশি কিছু বললো না ইকরা।সে নিজেও খুব ক্লান্ত। ঘুমের প্রয়োজন। তাই কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরলো।কাল সকালটা হবে তার জীবনের নতুন সকাল।কারো বউ হওয়ার লড়াই,কারো মা হয়ে ওঠার লড়াই, কারো বউমা হয়ে ওঠার লড়াই।যেই লড়ায়ে হেরে যাওয়ার কোনো অপশন রাখতে চাইলো না ইকরা।সমাজকে দেখিয়ে দিবে জন্ম না দিয়েও মা হয়ে ওঠা যায়।যেই ভালোবাসা, যেই আদর স্নেহ ও নিজে পায়নি।সে সবকিছু মানহাকে দিবে ইকরা।এটা নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা।বাবাকে কথা দিয়েছে কথা তো রাখতেই হবে।

সকালে ঘুম ভাঙলো মিষ্টি রোদের ঝলকানিতে। জানালা ভেদ করে একফালি রোদ ইকরার চোখে মুখে খেলা করে যাচ্ছে।এদিকে রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় বাইরের প্রকৃতিও সেজেছে নতুন রুপে।ইকরা ওঠে।সোফায় দিকে চোখ পরে।আরহান এখনো ঘুমে।এক কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।ইকিরা সেদিক পানে কিছু সময় চেয়ে রয়।ছেলেদের ঘুমোলেও কি এতো সুন্দর লাগে?হয়তো জীবন সঙ্গী বলেই এতো সুন্দর লাগছে।

“আল্লাহ আমি তো একটা কালো স্বামী চাইতাম।তুমি আমার স্বামীকে এতো ফর্সা কেন বানালে বলতো।তবে যাই বলো দেখতে কিন্তু খারাপ নয়।

এর মধ্যেই বাইরে থেকে শাশুড়ী মায়ের ডাক শুনতে পেলো।ইকরা ঘড়ির দিকে সময় দেখে চটজলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।৯ টা বাজে।

” এতো বেলা হয়ে গেছে। আর আমি কিনা নতুন বউ হয়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছিলাম।বাড়ির সবাই কি বলবে?

রান্না ঘরে ছোট যা মরিয়ম অন্তরা বেগমের সাথে সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল।এখানে নিয়মিত থাকে না ওরা।কোনো কিছুর উপলক্ষে আসা হয়।এমনিতে এক ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে পুরান ঢাকার নিজ বাড়ি করে থাকেন।আরহানের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল।

“বুঝলেন বড় ভাবি এবার মানহাটার একটা হিল্লে হবে বলুন।মেয়েটার জন্য যা খারাপ লাগতো।

” হ্যাঁ। আমি না অনেক ভেবেই এই বিয়ের সিদ্ধান্ত টা নিয়েছিলাম।মানহার প্রতি ওর যে অগাধ ভালোবাসা সেটা দেখে আমার মনে হয়েছিল পারলে ওই পারবে আমার মানহাকে মায়ের ভালোবাসা দিতে।

“মা!

” আরে উঠে গেছো।টেবিলে চা আছে একটু খেয়ে নাও মা।

“আমার আসলে সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস নেই।ভাতেই শান্তি পাই।আমার উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেলো তাই না।বলুন কি কাজ করতে হবে আমি করে দিচ্ছি।

” কেন তোমাকে কি এবাড়িতে বাড়ির কাজের জন্য আনা হয়েছে?হ্যাঁ কাজ তো একটু আকটু করতেই হয় কিন্তু এবাড়িতে সবে এসেছো।যাক কিছুদিন তারপর।আপাতত আমি আর বড় ভাবিই সবটা সামলে নেবো বুঝলে।

“ইশ এই বাড়ির মানুষ গুলো এতো ভালো কেন।সবাই কত সহজে আপন করে নিয়েছে আমায়।
আচ্ছা বেশ আমি তবে ফ্রেশ হয়ে মানহার কাছে যাই কাল থেকে দেখতে পারছি না।

” ঠিক আছে যাও তবে।আমার রুমেই আছে ঘুম থেকে ওঠেনি এখনো। ভাত রান্না হলেই আমি তোমায় ডাকবো।

ইকরা যতক্ষণে মানহার কাছে গেলো তার আগেই আরহান সেখানে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হচ্ছিলো।

“মাত্রই তো দেখলাম ঘুমাতে এর মধ্যে উঠলো কখন আজব তো।

” আপনি এখানে কেন। নিচের সব কাজ শেষ?

“হ্যাঁ। আমি এসেছিলাম মানহাকে নিতে।

” এখন না নিলেও হবে।আমি ওকে নিয়ে একটু বাজারে যাবো।ওর খাবার আর প্যাম্পাস কিনতে হবে।আপনার কিছু লাগলে বলুন আমি নিয়ে আসবো।

“না কিছু লাগবে না।

” শিওর তো!

“একদম।

” ঠিক আছে।

আরহান একা আসতে গেলে অন্তরা বেগম ইকরাকেও জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। এতে অবশ্য আরহান কিছুই বলেনি।নিজেই একবার ভেবেছিলো বলবে কিন্তু কেন জানি বলতে পারেনি।যেহেতু ইকরা সাথে যাচ্ছে তাই করিমকে আর সাথে নিলো না আরহান।নিজেই ড্রাইভ করলো।একটা শপিংমলে গিয়ে আনহা সহ ইকরার জন্যও কিছু রেগুলার থ্রিপিস নিলো। বিয়ে উপলক্ষে শুধু শাড়িই দেয়া হয়েছিলো।তারপর একটা রেস্টুরেন্টে সকালের খাবারটাও খেয়ে নিলো দুজনে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে