পাতা ঝরা বৃষ্টি পর্ব-০২

0
116

#পাতা_ঝরা_বৃষ্টি
#পর্ব_২
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী

“ইকরাকে আমার আলাদা করে দেখার কিছু নেই।কিন্তু আরহান তুই চাইলে দেখতে পারিস।সেই সাথে কিছু বলার থাকলে সেটাও বলতে পারিস।

“হ্যাঁ আপা সেটাই ভালো হবে।মা ইরা আপাইকে নিয়ে আসতে বলো।

” তার কোনো দরকার নেই।এভাবে পুতুল সাজিয়ে মেয়ে দেখার কোনো মানে হয় না ভাই।ওরা আলাদা করে কথা বলুক ।ইরা আম্মু তুমি বরং আমার ছেলেকে তোমার আপাইয়ের রুমে নিয়ে যাও ওরা ওখানেই কথা বলুক।

“ঠিক আছে আন্টি।

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে আরহান ইরার সাথে উপরে উঠছিলো।আরহান আশেপাশে দেখছিল। ইরা নিজের মনেই কথা বলছে। সেগুলোর একটাও আরহান শুনেছে কি না সন্দেহ। আরহান শুধু ভাবছে কখন এখান থেকে যেতে পারবে।ঠিক সে সময় ইকরা কোনো একটা কাজের জন্য নিজের ঘর থেকে ইরার ঘরে গিয়েছিল। হন্তদন্ত পায়ে ফেরার পথে শাড়ীর সাথে পা লেগে ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায় ।সেই সময় আরহান তার সামনে।দুটো পুরুষালী পা দেখে থমকে যায় ইকরা।থমকায় আরহান, ইরাও।আরহানকে ইকরা চেনে।অন্তরা বেগম ছবি দিয়েছিলেন ইকরাকে।কিন্তু আরহান ইকরাকে চেনে না।প্রথম দেখা যে এভাবে হবে সেটাও ছিলো কল্পনার বাইরে।ইকরা বেশ লজ্জা পায় এমন পরিস্থিতিতে।

” আপাই এভাবে ছুটছিলে কেন!ইসস লাগেনি তো তোমার?

ইরাকে খুব বড়ো একটা ধমক দিতে চেয়েও আপাতত সেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিলো ইকরা।একে তো পরে যাওয়ার ফলে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে।তারওপর আবার আরহানের সামনে মান সম্মান যা ছিলো সবটার ফেলুদা হয়ে গেছে।এর মধ্যে এই মেয়ের প্রশ্ন।এতো প্রশ্ন করার কি আছে বাপু।দেখাই তো যাচ্ছে পরে গেছি প্রশ্ন না করে উঠতে সাহায্য করলেই তো হয়।এতো লজ্জায় বোধহয় এর আগে কখনো পরতে হয়নি ইকরাকে।

“এই আপাই কোথায় হারিয়ে গেলে?

” তোর অহেতুক প্রশ্ন করা শেষ? সব উত্তর পরে দিবো। তার আগে আমাকে এখান থেকে তোল আহাম্মক।

ইকরাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে ইরা চলে যায় সেখান থেকে।যদিও কোমড়ে ব্যাথা আছে তবুও আরহানের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ইকরা।

“সরি।আসলে তারাহুরো করতে গিয়ে এমন একটা উদ্ভট ঘটনা ঘটলো। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

“এখনো নিজেই চলতে পারেন না ঠিক করে আমার মেয়েকে কি করে দেখে রাখবেন আপনি?

অপমান। চরম অপমান করলো লোকটা। প্রথম সাক্ষাৎ, প্রথম কথাই যদি এতো তেতো হয় তাহলে ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাই ভাবছে ইকরা।নিজেকে ধাতস্থ করলো কোনো রকম।হজম করে নিলো সবটা।

“দেখুন এটা একটা এক্সিডেন্ট মাত্র।ইচ্ছে করে তো পরিনি।

” তবুও দেখেশুনে চলা উচিৎ ছিল আপনার।এবার বলুন আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ কি?আপনি জানেন তো আমি বিবাহিত। মেয়েও আছে।আপনি আমার থেকেও ভালো একজনকে বিয়ে করতে পারতেন।তাহলে আমিই কেন?মায়ের মুখে শুনেছি আপনি বিনা বাক্যেই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন।

“সবটাই জানি আমি।আপনি বিবাহিত। আপনার মেয়ে আছে।বিয়েটাও করতে চাননি।আপনার মায়ের যেমন আপনি আছেন,আপনার ও আপনার মেয়ে আছে।কিন্তু মেয়েটার কি আছে বলুন তো।হ্যাঁ ওর বাবা আছে, দাদি আছে কিন্তু আসল মানুষ টাই নেই।আর আমি সেই মানুষ টাই হতে চাই।ওর একজন মা প্রয়োজন। আমি ওর মা হতে চাই।

“কিন্তু আপনি তো ওর নিজের মা নন।তাছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে করলেও তো আপনার বেবি হবে।সেটা ছেড়ে কেন আমার মেয়েকেই বেছে নিলেন?

“হ্যাঁ এটা ঠিক যে অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার নিজের বাচ্চা হবে।স্বামী পাবো।সংসার পাবো।কিন্তু মানহাকে তো পাবো না।তাছাড়া আরো একটা বড়ো কারণ আমি নিজেও মা হতে পারবো না।

এই কথা শুনে আরহান কি বলবে ভেবে পেলো না।একটা মেয়ে যখন মা হওয়ার ক্ষমতা হারায় বা বিয়ের আগেই জানতে পারে সে কোনদিন মা হতে পারবে না।তার মনের অবস্থা কেমন হয় তা আরহান জানে।ওর নিজের ফুপুর ও এমন হয়েছিল। শেষে বেচারি সবার কথা সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

” আমাকে বিয়ে করলে কিন্তু আপনার অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে।মানে টা বুঝতে পারছেন তো?

“আপনি চিন্তা করবেন না।আমি রাজি আছি।

আরহানরা চলে গেছে। আরহান বিয়ের জন্য রাজি এটা নিজের মা-কে জানিয়েছে।অন্তরা বেগম যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন অবস্থা। যাওয়ার আগে অন্তরা বেগম নিজের গলায় একটা চিকন চেন ছিল সেটা ইকরাকে পরিয়ে দিয়ে যায়।দুই পক্ষের কথা অনুযায়ী ঠিক হয় সামনের সপ্তাহেই বিয়ে হবে।সেই মোতাবেক হাতে সময় খুব কম।প্রস্তুতির ও একটা ব্যাপার আছে।একেবারে দেরি করতে চাইছে না অন্তরা বেগম।ছেলের এখন মত আছে পরে নাও থাকতে পারে এই ভেবেই এতো তাড়া তার।



রাতে ইকরা নিজের ঘরে বসে কবিতা আবৃত্তি করছিল।এটা ও মাঝে মাঝেই করে থাকে।জীবনে ভালোকিছু বা খুব খারাপ কিছু হলেই একা একা আবৃত্তি করতে ভালোবাসে ইকরা।এতে নাকি ওর মন ভালো হয়।

” তুই কি এই বিয়েটা সত্যিই করতে চাস মা? দেখ আমি কিন্ত রাজি হয়েছি শুধু তোর জন্য।তুই রাজি বলে।আরেকবার কি ভেবে দেখবি?

“বাবা কখন এলে তুমি?

” কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস।

“আচ্ছা বাবা তোমার মায়ের কথা মনে পরে?

” হঠাৎ এই কথা কেন।

“বলই না।

” সত্যি বলবো?তুই তো কখনো তোর মায়ের ছবি দেখতে চাস না।তাহলে বুঝতি মনে পরে কি না।কারণ তুই তোর মায়ের কপি। তাই চাইলেও তাকে ভুলতে পারি না।তুই মানহাকে খুব ভালোবাসিস তাই না?

“সত্যি বলতে ওকে দেখলে আমার নিজের ছোট বেলাটা ভেসে ওঠে বাবা।আমিও নিশ্চয়ই ছোট বেলায় মায়ের জন্য কান্না করতাম আর তুমি আমাকে সামলে উঠতে পারতে না।তাই না? আমি যতবার ওই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখি আমার মনে হয় ওটা আমিই।ওকে কোলে নিলে বুকে জরিয়ে নিলে আমার অন্যরকম একটা তৃপ্তি লাগে বাবা।তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না।আমি ওর মা হতে চাই বাবা খুব ভালো মা।আমি ছোট মাকে দেখিয়ে দিতে চাই জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়।নিজের মা না হলেও মা হয়ে ওঠা যায়।আচ্ছা তুমিই বলো না বাবা মায়েদের কি কোনো ভেদাভেদ হয়।আপন পর বলে শব্দ টা কি মায়েদের সাথে যায়?আমি এই ধারণা টা পালটে দিতে চাই।মানহাকে নিজের মেয়ের পরিচয় দিতে চাই।মাকে দেখিয়ে দিতে চাই, সমাজকে দেখিয়ে দিতে চাই সৎ বলতে কিছু নেই।জন্ম না দিয়েও মা হয়ে ওঠা যায়।

” তোর ওপর আমার আস্থা আছে।আমি জানি তুই পারবি।তবে মা তুই যেটা করতে চাইছিস তা কিন্তু এতোটা সহজ নয়।তুই সবটা সহজ ভাবে নিলেও বাকিরা কিন্তু নিবে না।তাই তোকে শক্ত থাকতে হবে।

“আমি পারবো বাবা।আমাকে পারতেই হবে।তাছাড়া আমি তো মা হতে পারবো না। তাই তো মামি দিদান ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক টা মেনে নিলো না।ভাবো তো একটা মেয়ে পাচ্ছি এটাই বা কম কিসে?

” আচ্ছা বেশ এবার ঘুমিয়ে পর।অনেক রাত হলো।

“তুমিও ঘুমিয়ে পরো।

খুব সাদামাটা ভাবেই ইকরা আরহানের বিয়েটা সম্পন্ন করা হয়।বৃদ্ধা দাদি ও বাবাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো ইকরার সাথে ছোট ভাই বোন দুজনকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়েছে।ছোট মায়ের সাথে সম্পর্ক যেমন হোক ভাই বোন একে অপরকে খুব ভালোবাসে তারা।বিশেষ করে ভাই ইমন। বড় আপাই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বয়সে ইকরার চেয়ে দুই বছরের ছোট ইমন।কিন্তু বোনকে যথেষ্ট ভালোবাসে।মায়ের নানান ছলা-কলায় ও কোনো কাজ হয়নি।ইমন ছোট বেলা থেকেই খুব বুঝদার ও বুদ্ধিমান । তাই কারো কথায় তাকে কিছুতেই কাবু করতে পারে না।বিশেষ করে বড় বোনের ব্যাপারে।

” শোনো আপাই বিয়ে করে চলে যাচ্ছো বলে ভাববে না আমাদের তুমি পর করে দিলে।আমি কিন্তু যখন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে চলে যাবো।তুমিও আসবে মনে থাকবে তো?

“থাকবে।আমার অবর্তমানে কিন্তু এই বাড়ির বড় সন্তান তুই ভাই।বড়দের কিন্তু অনেক দায়িত্ব থাকে। তুই সব পালন করবি।আর ইরাকে একটু কম বকিস।ছোট তো ঠিক ভুল বুঝতে পারে না।আমার পুতুলটাকে অযথা বকিস না।বাবা, মা আর দাদিকে দেখে রাখবি।নিজের যত্ন নিবি।

” তুমি চিন্তা করো না।সব দেখে রাখবো।

“অনেক হয়েছে।এবার তোরা এগো মা।রাস্তা তো অনেক।ঠিক সময় যেতে হবে তো।

” তুমি এখনই আমাকে পর করে দিচ্ছো বাবা?

“বোকা ছেলেমেয়েরা কখনো বাবা মায়ের কাছে পর হয় না।আর তুই তো আমার মা রে।

” তাই! আপাই তোমার মা আর আমি বুঝি কেউ না।আমি তোমার মা হই না বাবা?

“আরে তুমিও তো আমার মা।আমার ছোট মা।রাগ করে না।

” হ অহন তো তোর দুই মা আছেই আমি তাইলে কি হই তোর?

কথাটা ইকরার দাদি মোর্শেদা বললেন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে।বয়স ৭০ এর উপরে অথচ ছেলের সাথে বাচ্চাদের মতো এখনো অভিমান করেন তিনি।
সবাই এবার তার কথায় হেসেই দিলো।

“আচ্ছা মা আপনার যায়গা কি আমি কাউকে দিতে পারি?আপনিও দেখছি দিন দিন বাচ্চা হচ্ছেন।এসেছি মেয়েটাকে এগিয়ে দিতে আর এখানেও মান অভিমান চলছে।

” আচ্ছা ঠিক আছে বেয়াই সাহেব আমরা তবে এবার আসি।এখন না গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে