#পাওয়া_না_পাওয়া_সুখ
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭
[১১]
নিগূঢ় নিস্তব্ধ রজনী। বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে অন্তঃকরণে বয়ে চলেছে হু হু দমকা হাওয়া। দু’হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে প্রেমা। অশ্রুকণা চিবুক গড়িয়ে ভিজিয়ে দিলো বক্ষঃস্থল। নীরব কান্নার মতো ক্ষতগুলো ও নিরব। যার আর্তনাদ কারো না দৃষ্টিগোচর হয় আর না কর্ণগোচর। অনেকদিন পর আজ নীহার সাথে কথা হলো। একবুক বিষাদময় যন্ত্রণার পাশাপাশি স্বস্তি মিলছে। তার বোন অন্তত ভালো আছে। নাফিজের মতো মানুষটি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে নীহার সাথে। সে ভালো না থেকে খা’রা’প থাকতে পারে? দু’বোনের কথোপকথনের মাঝেই সুশ্রী বুলিতে অন্তর আ’ঘা’ত প্রাপ্ত হলো। নাফিজ দুর্বল কন্ঠে একগ্লাস পানি চাইলো। এক অদ্ভুত মাদকতা মিশ্রিত ছিলো সামান্য এই বুলি টুকুতে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সবকিছুই অসাধারণ লাগে।
মানুষটা কেনো তার হলো না? রা’গে, দুঃখে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে প্রেমা। আজ আর খাওয়া হলোনা তার।
আজকাল সংসারের কাজ নিয়েই সময় কে’টে যায় নীহার। যেটুকু সময় হাতে থাকে সে সময়টুকু হয়তো ঘুমিয়ে নয়তো সুফিয়ার সাথে গল্পগুজবে কাঁটিয়ে দেয়। রাতের সময়টুকু ও দূরত্ব মেনে চলে দুটি দেহের, দুটি হৃদয়ের। নীহা পারছেনা সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কোনো এক অভিমানের দেয়াল তাকে বাঁধা দিচ্ছে।
নাফিজ চোখের উপর হাত দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা জানা নেই নীহার। সে দূরে জানালার দ্বার ঘেঁষে প্রকৃতির খেলা দেখতে ব্যস্ত।
চোখ থেকে হাত সরিয়ে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নাফিজ। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী একই ঘরে থাকলে কিছু ঘটা অনুচিত নয়। সেখানে তারা দুজনেই স্বামী-স্ত্রী। সম্পর্কটি হালাল, বৈধ। যেখানে রয়েছে পাহাড় সম অনুভূতি। নাফিজের দিক থেকে সে একেবারেই এগিয়ে আছে। কিন্তু নীহার থেকে আশানুরূপ কিছু না পেয়ে বারবার হতাশ হচ্ছে নাফিজ। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে নীহার দিকেই তাকিয়ে আছে নাফিজ। খোঁপা করা চুলের নিম্ন অংশ বিনা আঁচলে উন্মুক্ত থাকায় না চাইতেও বারবার বেহায়া চোখদুটো সেদিকেই চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লো সুফিয়া।
-“ভাইয়া, ভাবি খেতে আসো।”
সম্বিত ফেরে নীহার। এতক্ষণ যাবত তার উন্মুক কটিদেশে একজোড়া দুষ্ট চোখের বিচরণ ঘটেছে তার অগোচরেই। নাফিজকে খেতে ডাকার আগেই নীহা দেখতে পেলো নাফিজ আগেই উঠে বসে গেছে। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রান্নাঘরে বাকি কাজ গোছাতেই রয়ে গেলো নীহা।
আজকাল গরম যেনো ট্রাকে ভর্তি করে হানা দেয়। শাড়ির আঁচলে ঘাড়, গলা মুছে ঘরে রওনা দিলো। নাফিজ মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে। হাতমুখে পানি দিয়ে নাফিজের উল্টো পাশে শুয়ে পড়লো। মিনিট দশেক গড়াতেই হাতের উপর একটা শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ হাতের চাপ অনুভব করে।
মুহূর্তেই আবদ্ধ চোখজোড়া সজাগ হয়ে ওঠে নীহার। ঝট করে নেত্রপল্লব খুলে তাকায়।
পাশ ফিরে তাকাতেই নাফিজের আবিষ্ট চোখজোড়া দৃষ্টিগোচর হয়। তার দৃষ্টিতে রয়েছে হাজার ও আকুতি, কিছু পাওয়ার ব্যাকুলতা, তৃষ্ণা।
এরকম একটা দৃষ্টি বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে নীহার। পরিপক্ব বয়সেই বিবাহ জীবনে পা রেখেছে। নাফিজের দৃষ্টির অর্থ ধরতে পেরে চট করেই অপর পাশে ফিরে গেলো। নাফিজ আরেকটু শক্ত হাতে চেপে ধরলো নীহার হাত। চোখ খিঁচে দম নিলো নীহা। শক্ত জবাবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
নাফিজ নিচুস্বরে নম্রগলায় বলল,
-“এবার মনে হয় আমাদের সম্পর্কে এগোনো উচিত। বিস্তর একটা ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে দিনদিন।”
নীহা নাফিজের দিকে ফিরলো। চোখে চোখ রেখে কঠিন কন্ঠে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলো।
-“শরীরের টান অনুভব করছেন বুঝি? ভাবছেন নিজের বিয়ে করা বউ, আমিতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। তাকে এমন ধোয়া তুলসীপাতার মতো কেনো সাজিয়ে রাখবো?”
বক্ষঃস্থলে হাত রেখে একটানে আঁচল সরিয়ে নিলো নীহা। আবারও বলতে লাগলো,
-“নিন ভো’গ করুন। এটাই তো চাইছেন। আমি তো বাঁধা দিচ্ছি না। আপনি চাইলে আরও আগেই যা করার করতে পারতেন। আমিতো এখন বৈধ পন্য।”
নাফিজ স্তব্ধ, হতবাক। বিষ্মিত চাহনি খেলে যাচ্ছে তার নেত্রে। একটা সম্পর্কে পা বাড়ানো কি অন্যায়? মুহুর্তেই তার অভিব্যক্তি বদলে গেলে। চোখেমুখে দেখা দিলো ভীষণ ক্রো’ধ। মানুষের ভাবনা কতটা নিকৃষ্ট হলে স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে জেনেও তার দিকে বা’জে আঙ্গুল তাক করে। অনেক তো হয়েছে। এতটা অহং’কার, তেজ থাকলে সংসার জীবন সুখের হয়না। দু’দিক থেকেই সমান প্রচেষ্টা থাকতে হয়। সবাইকেই স্যাক্রিফাইস করতে হয়। একজনের দ্বারা সংসারে উন্নতি সম্ভব নয়। চোয়ালে হিং’স্র ভাব। নাফিজ মানুষটা ঠান্ডা মেজাজের। কিন্তু একবার যদি রে’গে যায় তবে সেই রাগ খুবই ভয়’ঙ্কর হয়। সে সর্বদাই রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।
শক্ত হাতে নীহার দুবাহু চেপে ধরে তার দিকে ঝুঁকে য়ায় নাফিজ। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আর একটা বা’জে কথা মুখ দিয়ে বের করলে হাত পা বেঁ’ধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসবো। বড় বড় ভাষণ দিচ্ছেন। আমি তো আপনাকে বলিনি এই বিয়েতে মত দিন। আপনি না করলে নিশ্চয়ই বিয়ে হতোনা। ভাবার জন্য বিয়ের আগে আপনাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে। বিয়ের পরও আমি আমাদের সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে আপনাকে প্রচুর সময় দিয়েছি। আর দশটা সম্পর্কের মতো আমাদের সম্পর্ক হলে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব বহু আগেই ঘুচে যেতো। সেটা হোক মানসিক আর হোক শারিরীক। বিয়ে করে এখন সম্পর্কে আগাতে চান না। কেনো? তা’লাক নিবেন? তাহলে শুনুন, এটা কোনো ছেলেখেলা নয়। কোনো সিনেমা নয়। এটা বাস্তবতা। শুধুমাত্র আপনার জন্য দুটো পরিবারে ভাঙ্গন ধরবে, আমার মা ধুঁকে ধুঁকে ম’রবে এটা আমি হতে দেবোনা। এতই যখন আমার প্রতি অনীহা আগেই না করে দিতে পারলেননা। আজ আমার চ’রিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। দ্বিতীয়বার যেনো এমন কিছু না শুনি।”
প্রথম ধা’ক্কায় নীহা বেশ ভ’য় পেলেও এবার যেনো ফুঁসে উঠলো।
-“আচ্ছা চরিত্র নিয়ে কথা বললে খুব গায়ে লাগে, না? যখন নিজের সামনে পরপুরুষ এসে নিজের স্ত্রীকে অ’সম্মান করে। ক’টু বাক্য করে, কই তখন তো আপনার সুপুরুষ গিরি দেখিনি। এখন কাপুরুষের মতো শরীরে হাত দিতে এসে নিজেকে সুপুরুষ দাবী করছেন। নারীর শরীরের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারলেই তাকে সুপুরুষ বলেনা। পারলে মনে ও রাজত্ব করে দেখান। লুজার কোথাকার।”
মাথায় র’ক্ত চড়ে গেলো নাফিজের। ভিত্তিহীন ভাবে তাকে ক্রমশই ছোট করে যাচ্ছে মেয়েটা। একটা ঠুনকো ব্যাপারে রাগ ধরে রেখেই তার এমন দু’র্ব্যবহার। নীহার বাহুতে হাতের ছাপ বসিয়ে ফেলবে যেনো নাফিজ। কপালের রগগুলো দপদপ করে ফুলে উঠেছে। নাকের পাটা ক্রমাগত ফুলে ফুলে উঠছে। রা’গের বসে নীহার গলায় কা’মড়ে ধরে।
নীহা ব্যথা পেয়ে অস্পষ্ট স্বরে ‘উহ্! অস’ভ্য’ বলে উঠতেই নাফিজ ছেড়ে দেয়। ওভাবে নীহাকে দুহাতে চেপে ধরে রেখেই বলল,
-” অ’সভ্য, কাপুরুষদের মনের দরকার হয়না। কি দরকার শুধু শুধু শরীর ছেড়ে মন নিয়ে কা’ড়া’কা’ড়ি করা। আমিতো কাপুরুষ। আপনার আমার কাছে সেরকম আচরণই কাম্য। কোনো বিষয় অজানা হলে, কোনো ক্ষো’ভ থাকলে বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। যে জানতে চায়না তাকে কোনো কিছু এক্সপ্লেইন করার ও প্রয়োজন মনে করিনা।”
সরে গেলো নাফিজ।
বিষ্মিত হয়ে চেয়ে রইলো নীহা। সভ্য পুরুষের আড়ালে সত্যিই সে এক অস’ভ্য পুরুষকে আবিষ্কার করলো। তাছাড়া লোকটা করেছে টা কি? যে তার কাছে এক্সপ্লেইন করবে?
-“আজকাল আমার রূপ বরফের মতো গলে গলে পড়ছে নাকি? ঘুমের ঘোরেও মানুষ তাকিয়ে থাকে।”
কটমট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নীহা। উনি নাকি ঘুমিয়ে আছে। তাহলে অস’ভ্যতামি করলো কে? উনার আত্মা?
মনে মনে বেশ আনন্দ পেলো নাফিজ। নীহাকে জব্দ করতে পেরে তার অধর কোনো সূক্ষ্ম বক্র হাসি উঁকি দিলো। ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিলে হবেনা। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। বিয়ে কোনো পুতুল খেলা নয়।
[১২]
দিনটি শুক্রবার। সরকারি ছুটির দিন। নাফিজ আজ বাড়িতেই রইলো। সুফিয়া নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। নীহা শাশুড়ীর সাথে টুকটাক কাজে সময় ব্যয় করে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ী রান্না করে আবার মাঝেমধ্যে নীহা রান্না করে। এ নিয়ে ভেদাভেদ নেই। যে আগে রান্নাঘরে ঢুকে, রান্নাটা সেই করে নেয় নিজ দায়িত্বে। আজ শাশুড়ী সাহায্য করছে, বউ রান্না করছে। ভাতের মাড় ফেলতে গিয়ে সিটকে অনেকখানি ভাত পড়ে যায়, সাথে নিহার হাতে ও মাড় পড়ে। নাফিজের মা কিছুক্ষণ ব’কা’ঝকা করেন এত অসাবধানে কাজ করার জন্য। পরক্ষণে নিজেই ট্যাপের নিচে নীহার হাত ভিজিয়ে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দেন। হাত প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছে। শাশুড়ী মা নীহাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন।
-“যাও কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে গিয়ে বসো।”
ঘরে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসলো নীহা। চোখ বন্ধ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে রইলো। হাত জ্বালাপোড়া করায় ডান হাত আলগা করে রাখলো। নাফিজ ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“হাতে কি হয়েছে? দেখি!”
নীহা মুখ ঘুরিয়ে সরে বসলো।
নাফিজ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল,
-“মেয়ে মানুষের ঢং দেখলে বাঁচিনা। ঢং বিষয়ক কোনো পরীক্ষা থাকলে সব মেয়ে নিশ্চিত একশতে একশ পেয়ে যেতো।”
নীহার হাতের কব্জি চেপে ধরে চেক করে হাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই নাফিজ জিজ্ঞেস করলো,
-“কিভাবে হাত পুড়লেন?”
নীহা চরম রা’গ দেখিয়ে হাত ঝাড়ি মেরে সরতে গিয়ে উল্টো খাটের সাথেই হাতে লেগে আরও ব্যথা পেলো। ব্যথায় দাঁতে দাঁত লেগে গেলো। চোখ খিঁচিয়ে বসে রইলো।
শান্তভাবে নীহার হাত টে’নে নিয়ে ফুঁ দিয়ে দিলো নাফিজ। স্বগোতক্তি করে বলল,
-“কি লাভ হলো দূরে গিয়ে? জানেনতো, আমরা কিছু মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাই ব্যথা পাবো বলে। কিন্তু মানুষটি থেকে দূরে সরে গেলে অজান্তেই ব্যথা পেয়ে বসি। ব্যথাটা সেরে ওঠা হয়না। আরেকটু তীব্র হয়।”
#চলবে………