পরী পর্ব ৮

0
1116

পরী পর্ব ৮

সকালে আমরা সবাই একত্রীভূত হলাম খালেককে খোঁজার জন্য। নাঈমা আমাদের সাথে যেতে চাওয়ায় তাকেও সাথে নিয়ে বেরুলাম। পথে সে আমার সাথে কথা বলার একটি সুযোগও ছাড়েনি। অপরদিকে সাবিলাকে একা দেখে সজীব ওর সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে। আমি নাঈমার কাছ থেকে বিরতি নিতে পারছি না। আবার সাবিলার সাথেও কথা বলতে পারছি না। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। সেই সাথে খালেকেরও কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। কয়েকটি বাড়ি বিচরণ শেষে আমরা একটি চায়ের দোকানে গেলাম। একটি ছেলেকে দেখতে পেয়ে আমি তড়িঘড়ি করে সজীবকে লুকিয়ে ফেলি। অন্যরা কারণ জানতে চাইলে বললাম, ‘সেই ট্যারা চোখ, কপালে সেই জন্মের দাগ। সে আর কে হতে পারে?’
ভাইয়া বুঝতে পেরে ছেলেটিকে সে খালেক বলে ডাক দেয়। ছেলেটি অচেনা মানুষ দেখে থতমত খেয়ে গেছে। আমাদের সামনে এসে সে আমরা কারা জিজ্ঞেস করল। ভাইয়া কোনোকিছু না বুঝিয়ে সরাসরি রিভলভার বের করে খালেকের কপালে তাক করে। খালেক থতমত খেয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল।
‘আকবর সাহেবকে তো চিনিস,’ আমি এগিয়ে গিয়ে শুরুতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার নির্দেশে তুই তাঁর খুন করেছিলি?’
খালেকের ভঙ্গিমা দেখে বুঝা সহজ, সে কিছুই লুকাতে জানে না। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। ‘স্যার,’ খালেক বলল, ‘বন্দুকটা নামান। আমি সব বলতেছি। আমি ওইসব আমার মালিকের কথায় করছিলাম।’
ভাইয়া রিভলভার নামিয়ে ফেলে। খালেক গ্রামীণ একটি ছেলে। কথাবার্তায় তার আঞ্চলিক টান। দেখতেও সে বেশ সরল। তার কথা আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে বসলাম।
‘মালিক আমাকে বলছিল এসব করতে।’, খালেক বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না আকবর সাহেবকে মালিক খুন করবার জন্য এইসব করাইছিলেন।’
ভাইয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার মালিকের নাম কী?’
‘আবু লতিফ। আমি উনার বাড়িতে কাজ করতাম আর গাড়ি চালাইতাম।’
‘আকবর সাহেবের সাথে তোমার মালিকের কী নিয়ে শত্রুতা ছিল? সবকিছু বল।’
‘বলতেছি,’ সে এখনও ঘামছে। তবে সবকিছু স্বীকার করছে, ‘আকবর সাহেব মালিকের বাসায় দুই কী তিনবার গেছিলেন। যখন মালিক আমাকে চাকর করে নেন, তখন একবার উনাকে আমার মাধ্যমে আনাইছিলেন। উনাদের মাঝে কোন একটা বাড়ি লইয়া বহুত কথাবার্তা হয়ছিল।’
‘কেমন কথাবার্তা?’
‘আকবর সাহেব নাকি একটা জঙ্গলের মালিক ছিলেন। তার ভেতরে একটি বাড়ি আছে। বাড়িখানা উনার নামে। তয় মালিক বহুত জোর করছিলেন বাড়িখানা উনারে বিক্রি করে দিবার জন্য। মালিক তো দ্বিগুন টাকা দিতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু আকবর সাহেব কোনোভাবে রাজি হইলেন না বেচবার জন্য। এরপর মালিক আকবর সাহেবের ভাইকেও আসতে বলছিলেন। ভাই আসার পর, মালিক উনাকে অনেক বুঝাইছিলেন। আকবর সাহেবের ভাই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু উনি তবু হন নাই। আমি একবার মালিককে জিজ্ঞাইলাম, ওই বাড়িখানা উনি কেন কিনতে চান। মালিক কইলেন, ওই বাড়িখানা আগে তাঁর ছিল। তবে দলিলের কাগজপত্র নাই। এতবছর বিদেশ থাকবার কারণে জঙ্গলের ভিটাসহ আকবর সাহেব নিজের নামে করে ফেলছেন।
আকবর সাহেব আরেকবার যখন আইছিলেন, তিনি বলিলেন, ওই বাড়িতে কোনো খারাপ কিছুর ছায়া আছে। ওখানে যে থাকবে, সে বাঁচব না। তাই বাড়িটি তিনি বেচতে চান না। কিন্তু মালিক উঠে-পড়ে লাগছিলেন বাড়িটির জন্য। মালিক অবশেষে উনাকে কইলেন, “ওইখানে আমার একটি ডায়েরি আছে। ওটা আমি পেয়ে গেলে আর কিছুই লাগব না।”
বহুত করে বুঝাইলেন আকবর সাহেবকে যে, ঘরখানাতে থাকা ডায়েরিটা পাইলে উনি অনেক ধনী হতে পাইরব। আমি উনাদের নাস্তা দিতে গিয়া শুনছিলাম। আকবর সাহেবকে উনি চুপিচুপি কইতেছিলেন, “ডায়েরিতে একটি পরীর কাহিনি আছে। পরীটি এখন আমার বন্ধুর দখলে। কিন্তু কেউ আদৌ জানে না ওই পরীর শক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যাবে। আমার বন্ধুর দাবী ডায়রিতে পরীর শক্তির রহস্য আছে। শুনুন আকবর সাহেব, পরীর শক্তি একবার পেয়ে গেলে অনেক লাভবান হব। আমি যদি আমার বন্ধুকে ডায়েরি দিতে পারি, তবে ওখান থেকে ভাগ আমারও থাকব। আমার ভাগ থেকে তোমাকেও দিমু। ঘরখানা লাগব না আমার। তুমি শুধু ডায়েরিটা খুঁজে এনে দিবা আমাকে।” আকবর সাহেব সেদিনও অমত দিয়ে চলে যান। এরপর মালিক আমাকে কইলেন, “আকবর সাহেবকে বেহুঁশি অবস্থায় এখানে এনে দলিলে সাইন করাতে পারলে কাজ হয়ে যাবে। আকবর মতলবি লোক। আমি বাড়িটির সম্বন্ধে একটি গোপন তথ্য দিয়েছি তাকে। সে যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে।”
আমাকে জোর করানোতে রাজি হইলাম কাজটি করতে। মালিক জানতো না আমি উনাদের কথা শুনে ফেলছিলাম। এরপর বন্ধু সজীবের সঙ্গে মোর দেখা হয়। আমি ওকে মালিকের কথানুযায়ী কাজ করতে কইলাম। যেদিন আকবর সাহেবের ঘরে সজীবের দাওয়াত পড়ল, সেদিন মালিকের কথায় আমি আমার কাজ করতে গেলাম। উনি কেমন একটা তরলের শিশি দিছেন, আর বলছেন তা রুমালে লাগাইয়া আকবর সাহেবের নাকে ধরলে উনি বেহুঁশ হইয়া যাইব। তাই হইছে। সেই রাতে আকবর সাহেবকে বেহুঁশ কইরা মালিকের বাসায় নিলাম। শেষবারের মতো মালিক তাঁকে অনেক বুঝাইলেন। তবু কাজ হইল না। এরপর মালিক আমাকে শরবত বানাতে কইলেন। বানানোর সময় মালিক নিজে আইসা শরবতে কী জানি মিশাইয়া দিলেন। আর আকবর সাহেবকে খাইয়া দিতে কইলেন। আমি তাই করলাম। কিন্তু কে জানতো, ওইখানে বিষ মিশাইয়া দিছিলেন মালিক! আকবর সাহেবের মুখ দিয়া ফেনা বেরুনোর পর তা বুঝলাম। এসব কথা কাউকে না বলতে মালিক আমাকে হুমকি দিলেন। নইলে মালিক ফাঁসলে আমাকেও ফাঁসাইয়া দিব। আকবর সাহেব বাড়িটির আসল সত্য জেনে গেছিলেন বলে উনাকে মারা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কইলেন মালিক।
মালিকের কথামতো বাধ্য হইয়া আমি আকবর সাহেবকে গাড়ি করে লইয়া খালি রাস্তায় লইয়া গেলাম। তাঁর কথামতো বিষের বোতল টিস্যু দিয়া মুছে আকবর সাহেবের আঙুলের চাপ দিয়া গাড়িতে রাইখা চলে আসি। সেদিনই বুঝলাম, মালিক আমাকে আকবর সাহেবের খেলাপ কান ভরিয়া ষড়যন্ত্র কইরা উনাকে মারাইলেন। আর আমি অজান্তেই উনার সাথে দিলাম। নিজের ওপরই ঘৃণিত হইয়া আমি রাতারাতি সেই বাড়ি থেকে বের হইয়া সকালের বাসে করে মোর গেরামে চলে আসি। এখন এখানে চায়ের দোকানে ব্যবসা কইরা কোনোরকম খরচ চালাইতাছি। আমি আর কিচ্ছু করি নাই। আমি জানতাম না, মালিকের কু-মতলবের সম্বন্ধে। আমাকে ছাড়ি দেন।’ প্রায় কেঁদে ফেলল খালেক। ভাইয়া তাকে সান্ত্বনা দেয়। সে কান্না বন্ধ করল।
‘আই সি’, চিন্তিত হয়ে বললাম, ‘এজন্যই আকবর সাহেব মাঝে মাঝে অদ্ভুত ধরনের কথাগুলো বলতেন।’
‘কেমন অদ্ভুত কথা?’, ভাইয়া বলে উঠল।
‘ইভার কাছে শুনেছিলাম, পরী এবং ডায়েরি নিয়ে অদ্ভুত সব কথা বলতেন।’
‘শোন,’ হঠাৎ সাবিলা মহাক্রোশে বলে উঠল, ‘ তোমরা এই লতিফকে ছাড়বে না। ওর কাছে শাস্তি পেতেই হবে। সে প্রথমত আঙ্কেলকে খুন করেছে। তারপর একটি পরীর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজে লাভবান হতে চেয়েছে। ছিঃ ছিঃ!’
সাবিলাকে শান্ত হতে বললাম। ওর বাবা সমতুল্য আঙ্কেলকে লতিফ এইভাবে খুন করেছে জেনে তার এমন প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
‘আপনারা কারা এখনও কইলেন না যে?’
খালেককে আমাদের পরিচয় দিই। সজীবকে তার সাথে দেখা করালাম। খালেক টাকা না দিয়ে পালানোর এবং সজীব আমাদের কাছে খালেককে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয় নিয়ে তারা একে অপরের কাছে ক্ষমা চাইছে। খালেক নির্দোষ। ভাইয়া ওর বিরুদ্ধে কিছু করল না। যাক, খুনির সম্বন্ধে জানতে পেলাম। এখন আজাদ সাহেবই আমাদের লতিফের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করবেন।
আমরা খালেককে বিদায় দিয়ে নাঈমার বাসায় চলে আসি। আসার পর নাঈমা আমাকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘আবির, আমি তোমাকে…’
ওর মুখের কথা যেন নিমিষেই বুঝে গেলাম। ওকে বাকিটা বলতে বাধা দিই, ‘নাঈমা, তুমি একটি ভালো মেয়ে। তুমি আমার চেয়েও একটি ভালো ছেলে পাবে জীবনসঙ্গী হিসেবে। তাছাড়া আমি আগে থেকেই অন্য কাউকে…’
‘কাকে?’, নাঈমা বিস্মিত হয়ে বলে উঠল।
সাবিলা বারান্দায় ছিল। আমি তার দিকে ইশারা করে আমার পছন্দের মানুষটিকে নাঈমাকে দেখালাম।
‘সরি, আমি জানতাম না।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

‘তোমার দোষ নেই।’
নাঈমার সাথে সব মিটমাট করে সাবিলার কাছে যেতে উদ্যত হব, তখন সজীবকে দেখতে পেলাম, সে সাবিলার দিকে চেয়ে আছে। আমি যেতেই সে থতমত খেয়ে দাঁড়াল। ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ওর মনে সাবিলাকে নিয়ে কিছু আছে কিনা। সে কোনোকিছুই বলল না। আমি আমার পথে কাঁটা দেখে কষ্ট পাই। মুখেও হয়তো তা স্পষ্ট ফুটে উঠছে।
‘সজীব, আমার বন্ধু। সাবিলার সাথে তোমার সবেমাত্র দেখা হয়েছে। তোমার মনে ওকে নিয়ে কিছু থাকলে তা কেবল ভাল লাগা। আর কিছু নয়। আর আমি, আমি সাবিলার সাথে অনেক মুহূর্ত কাটিয়েছি। ওকে…. আমি ভালবেসে ফেলেছি। আমি হয়তো ওর মতো মেয়ে আর কাউকে পাবই না।’
‘এভাবে বলো না।’ সে ইতস্তত করল, ‘ওকে আমার সামান্য ভালো লেগেছিল, এর বেশি কিছু নয়। আমি জানতাম না তুমি ওকে.. আসলে সাবিলার জন্য তুমিই পারফেক্ট। তোমাদের জন্য শুভ কামনা রইল।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খেয়াল করলাম, পেছনে নাঈমা দাঁড়িয়ে আছে। সবকথা হয়তো শুনছিল। আমি আর কিছু না বলে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম, সজীব এবং নাঈমা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় নাঈমা পিছলা খেয়ে সজীবের ঘাড়ে পড়ল। সজীব তাকে ধরে ফেলেছে। ওরা একে অপরকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইল। এই চাহনি অন্য কিছু ইঙ্গিত করে। তারা একে অপরের কাছে দুঃখ বিনিময় করছে বা অন্যকিছু। নাঈমার স্লিপ খাওয়ানোতে ওকে মেডেল দেওয়া উচিত। তবে যাইহোক, আমার কারণে কেউ নিরাশ হলো না। দুজনা ভালোবাসার নীড় খুঁজে পেল। ভাবতে ভাবতে সাবিলার কাছে গেলাম। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিয়ে পুকুরপাড়ে গেলাম, যেখানে নাঈমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমরা কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সাবিলার পা ধোয়ার ইচ্ছা জাগল। সে তখনই সিঁড়িতে পা রাখে। কিন্তু সিঁড়িটায় শেওলা পড়েছে। সে যখন তাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়তে যাবে, তখনই ওকে ধরে ফেললাম। সাবিলা নিজেকে সামলিয়ে নেয়। সে না পড়ার জন্য আমি তাকে ধরে রইলাম। এবার মনের আনন্দে সে পানিতে পা নেড়ে নেড়ে ধুতে লাগল। তার বাল্যকালটা হয়তো অন্যদের মতো সুখকর হয়নি। বাচ্চাপনা তার মাঝে এখনও ভরে আছে। সে আমাকেও সিঁড়িতে নামতে জোর করল। তার খুলে রাখা জুতোর পাশে আমার জুতোগুলো খুলে রেখে, তার সাথে ওই শেষের তাকে নামি। যেই নামলাম, একজনকে অন্যজন ধরে রাখতে পারছি না। দু’জনই একসাথে পানিতে ঝোপ করে পড়ে গেলাম।
দু’জনই আচমকা পড়ায় কাশতে লাগলাম। এরপর সাঁতার কেটে ওই তাকের ওপরের তাকে উঠে আসি। তখন আমরা একে অপরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলাম। এরূপ মুহূর্ত আমার জীবনে এই প্রথমবাবের মতোই এসেছে। সাবিলা উঠে গেলে বিরশ মুখে আমি ধীরে ধীরে উঠলাম। সাবিলার কাপড়টা তার গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আমি ওইদিক থেকে তৎক্ষণাৎ চোখ সরাই। আমার জুতোগুলো হাতে নিয়ে পেছনে না তাকিয়ে ঘাটের ওপর উঠে আসি। সাবিলাও হয়তো জুতো হাতে নিয়ে পিছু পিছু আসছে। আমরা নাঈমার বাসায় যাওয়ার পর ভাইয়াকে ডাক দিই। সেসময় সাবিলা হয়তো আমার পেছনেই লুকিয়েছিল। ভাইয়া দু’জনকে তোয়ালে দেয়। এই ফাঁকে দেখলাম, বাড়ির সকলে কেমন এক খুশিতে মেতে উঠেছে। ভাইয়ার কাছে এর কারণ জানতে পাই। এসব সজীব আর নাঈমার বিয়ের আয়োজন চলছে। হয়তো নাঈমা তার বাবাকে বলে দিয়েছে সজীবের কথা। বাহ্! সবকিছু তাড়াতাড়িই হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া বলল, আমরা কালকে চলে গেলে ওদের বিয়ে দেখা হবে না। তাই নাঈমার কথায় আজই ওদের বিয়ে হবে। চারিদিকে হৈ হুল্লোড় আর বাজনার মাধ্যমে ওদের বিবাহ কাজ সমাপ্ত হয়। সজীবের ঘরজামাই হয়ে থাকার ইচ্ছা নেই। কাল দু’জনকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাব।
পরদিন আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। তিনটি দিন কাটিয়ে শেষ বিকেলে এসে বাসায় পৌঁছলাম। রাতের খাবার খেয়ে সজীব এবং নাঈমাকে একটি রুমে থাকতে দিই। আমি এবং ভাইয়া একটি রুমে থাকলাম। সাবিলাকে আমার রুমে থাকতে দিই। ক্লান্ত থাকায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আর ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাত। বজ্রপাত রাতকেও দিনের রূপ দিচ্ছে। আমার বউ আর মেয়েকে নিয়ে আমি ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ দরজায় টোকা লাগার মতো টকটক শব্দ পেলাম। এই সময় এখানে কে হতে পারে? ঘুমন্ত অধরা দুটোকে রেখে আমি নিচে গিয়ে দরজা খুলি। একজন মুখোশ পরিহিত লোক, তার পেছনে আরও দুটো অচেনা ছেলেকে নিয়ে ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি দু’জন কাপড়ের মুখোশ পরেনি। ভ্যাবাচ্যাকা থেকে উঠে আমি কিছু বলতে যাব, এমন সময় ওরা আমার মুখ চেপে ধরল। সবাই একত্রে আমাকে ধরে ঘরে ঢুকতেই যে রুমটি আছে, তাতে নিয়ে দরজা বেঁধে দেয়। তারা আমার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো। মুখোশ পরিহিত লোকটি আমার পাশে গর্ত করতে শুরু করেছে। একটু পর আমার বউয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে আমার নাম ধরে আমাকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে দোয়ারে গেল। জানালা খোলা থাকায় ওকে ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে। আমি চেষ্টা করেও কিছুই বলতে পারছি না। আমার পাশে মুখোশ পরিহিত আগন্তুক গর্ত করে চলেছে। ওর সঙ্গী দু’জন রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আমার বউ একজন পরী। আমাকে না পেয়ে সে তার দুটো বড় বড় ঝকঝকে ডানা মেলে উড়তে যাবে, এমন সময় বাকি দুটো লোক গিয়ে খঞ্জর বের করে ওর ডানার অগ্রভাগে পোঁচ দেয়, যেখানে ওর ডানা পিঠের সাথে সন্ধিবদ্ধ হয়ে থাকে। পরী সাথে সাথেই জোরে এক আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। তার সারা পিঠ বৃষ্টির পানি মিশ্রিত রক্তে লাল হয়ে গেছে। তার পাশে ডানাগুলো ছিটকে পড়ে মাটিতে কিছুক্ষণ ঝাপটিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। তবু পরী আমার নাম ধরে চিৎকার করে যাচ্ছে। আমি অবিরাম কেঁদেই চলেছি। কিছুই করতে পারছি না আমার হাত-মুখ সব বাঁধা থাকায়। অন্য দু’জন রুমে এলে একজনের কাছ থেকে খঞ্জর নিয়ে মুখোশ পরিহিত ব্যক্তি এখন তা আমার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তাও একবার নয়, বারংবার, যেন আমি তার পুরনো কোনো শত্রু। একসময় আমিও নিস্তেজ হয়ে পড়ি। মুখোশ পরা আগন্তুকের দুই সঙ্গির একজন ডানাগুলো এবং অপরজন পরীকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। জানালা দিয়ে অস্পষ্ট চোখে এসব চেয়ে রইলাম। আমি কেঁদেই চলেছি, তবে আওয়াজ বেরুয় না। মুখোশ পরিহিত ব্যক্তি গর্ত করে আমাকে তাতে ফেলে দিয়েছে। আমি ধস্তাধস্তি করায় তার হাতের ঘড়িটি খুলে গর্তে পড়ে গেছে। আর কিছুই করতে পারলাম না। মনে হচ্ছে, একটু পরই আমার প্রাণপাখি দেহ ছেড়ে উড়াল দেবে। প্রাণ যায় যায় অবস্থায় হঠাৎ এক ধমকা হাওয়া বইতে শুরু করল। লাগছে জঙ্গলের গাছগুলো একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে তুফানের সৃষ্টি করেছে। বাতাসে মুখোশধারী ব্যক্তির মুখের কাপড়টা সরে গেল। বিস্ফারিত চোখে আমি তাকে চেয়ে রইলাম। এই যে আমার মেজ ভাই, আরিয়ান! সে কাপড়টা যখন মুখে দিতে গেল, তখন সে একটি বয়স্কলোকের চেহারা ধারণ করেছে। আমার পেটে খঞ্জরটি এখনও গেঁথে আছে। ভাইয়া আমার উপর মাটি দিয়ে চলেছে। আমার শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময় আমার হাতে থাকা কালো তাবিজটি হাওয়ায় ভেসে জানালার বাহিরে বেরিয়ে গেল। মুখোশধারী মাটি দিয়েই চলেছে। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগে আমি সজোরে একটি চিৎকার দিয়ে দেহ ত্যাগ করলাম।
চিৎকার দিয়ে আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ি। পেট হাতরিয়ে দেখলাম, কোনো খঞ্জর নেই। তার মানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিলাম?
(চলবে..!)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[‘খঞ্জর’ একটি ছুরি বিশেষ। তবে সাধারণ ছুরির মতো নয়। খঞ্জরের দুইপাশই ধারালো হয়।]