পরী পর্ব ৬

0
1149

পরী পর্ব ৬
..
পরদিন সকাল। জঙ্গলের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। সাবিলার জন্য অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে। এখনও সে আসছে না। প্রতিদিন তো এই সময়ে চলে আসে মেয়েটি!
ভাবতে ভাবতেই ওকে দেখলাম। সে কালকের কেনে দেওয়া একটি সাদা ফ্রক পরেছে। গলার ওড়না হাত অবধি ছড়ানো। দুইহাত দিয়ে সে ওড়নার এক কোণা ঘুরাচ্ছে। পুরনো একটা হিন্দি গান গেয়ে হেলেদুলে হেঁটে আসছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। বোধ হয়, আমি দাঁড়িয়ে আছি তা সে খেয়াল করেনি। সে কাছে এলে আমাকে দেখে গান বন্ধ করে দেয়। বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তুমি এখানে?’
‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজ এতো দেরিতে কেন এসেছ?’
‘বাসায় কিছু মেহমান এসেছিল তাই দেরি হয়ে গেছে আসতে। এখন চল।’
‘চল।’ হাঁটতে হাঁটতে সাবিলাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছলাম। হালকা নাস্তা সেরে আমরা কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। পর্বটা শেষে ওর চোখ ধরলাম আমি।
‘আরে,’ সাবিলা বলল, ‘আরে কী করছ?’
‘বাহিরে চল।’
‘তুমি এভাবে চোখ ধরে রাখলে আমি দেখব কীভাবে?’
‘তোমার দেখতে হবে না। চল, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।’
সাবিলার চোখ ধরে ওকে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা জায়গায় এনে ওর চোখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সারপ্রাইজ।’ চোখ খুলতেই সে অবাক বনে গেল।
‘এই সাইকেলটা,’ সাবিলা বলল, ‘এই সাইকেলটা এখানে কীভাবে এসেছে?’
‘কেন? আমি কেনে এনেছি তোমার জন্য। কালকে মার্কেটে তোমাকে দেখছিলাম, এই সাইকেলটা তুমি একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলে। তোমার পছন্দ হয়েছে ভেবে আনলাম।’
‘কী?’, সাবিলার চোখে মুখে বিস্ময়, ‘আমার জন্য?’
‘হ্যাঁ, তোমার জন্য। তখন কিছু বলিনি সারপ্রাইজ দেব ভেবে। কেমন লাগল সারপ্রাইজটা?’
‘ও..য়া..ও। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমাকে কেউ এমন গিফটও দিতে পারে। আমি একটু দেখতে পারি ওটা?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। এটা তোমারই। আর এখন থেকে এখানে তোমার পায়ে হেঁটে আসতে হবে না। এটা করেই আসতে পারবে।’
‘সত্যিই এটি একটি অসাধারণ গিফট।’ সাবিলা সাইকেলটা চারিদিক থেকে দেখতে লাগল। ‘কিন্তু আবির, আমি তো সাইকেল চালাতে জানি না।’
‘সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দেব।’
‘সত্যি?’
‘হু সত্যি। দেখি এখন সাইকেলে ওঠো।’
সাবিলা সাইকেলে উঠলে আমি তাকে সাইকেল চালানো শেখাতে লাগলাম। চালাতে চালাতে আমরা জঙ্গলের অন্যদিকে চলে যাই। এদিকটায় ঝোপঝাড় কম। গাছ বেশি। জায়গাটি বাড়ির পেছন দিকে। সাবিলা অনেক কম সময়ে সাইকেল চালানো মোটামুটি শেখে গেছে। জঙ্গলের ওই জায়গায় গাছ আর গাছ থাকায় সাইকেল চালাতে কষ্ট হচ্ছে। চলে আসতে যাব, সাবিলা বলে উঠল, ‘আচ্ছা, আরিয়ান ভাইয়া কোথায়? তাঁকে বাসায় দেখিনি কেন?’
‘ও একটা ছেলের অ্যাড্রেস নিতে গেছে। একটু পর চলে আসবে।’
‘আমার কেন যেন লাগছে এখানে কেউ একজন চিৎকার করছে।’
‘কোথায়? আমি তো শুনছি না!’
‘তুমি কি কারও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ না?’
‘না, এই জঙ্গলে কে বা আসবে বল?’
‘আবির, আমাদের আরেকটু সামনে যাওয়া উচিত।’
‘ঠিক আছে। তুমি এখানে থাকো। আমিই দেখে আসি।’
আমি জঙ্গলের আরও কিছুদূর গেলাম। হঠাৎ কোনো এক ছেলে কণ্ঠের চিৎকার কানে ভেসে এলো। সত্যিই তো, কেউ যেন চিৎকার করছে। আমি সাথে সাথেই দৌড় লাগালাম ওই আওয়াজের সন্ধানে। একটি জায়গায় গিয়ে বড় একটি গর্ত দেখতে পেলাম। লাগছে আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে। দৌড়ে আমি ওখানে যাই। এ কি! গর্তে তো ভাইয়া পড়ে আছে, চিৎকার করছে। আর ওর নিচ থেকে একটি জীবন্ত কঙ্কাল ওর গলা চেপে ধরেছে। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম। ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। ভাইয়া বলছে, ‘আবির, হা করে কী দেখছিস? বাঁচা আমাকে এই কঙ্কালটির কাছ থেকে।’
দিশাহারা হয়ে কিছু না ভেবে আমি সর্বপ্রথম গর্তে লাফ দিই। ভাইয়াকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কঙ্কালটি কোনোভাবেই তাকে ছাড়ছে না।
‘আবির,’ ভাইয়া বলল, ‘তুই পারবি না এটির সাথে। আমার রিভলভারটা বের কর।’
ভাইয়া রিভলভারটা সবসময় পিঠের দিকে শার্টের ভেতরে করে পেন্টের বেল্টের সাথে আটকিয়ে রাখে। ওর শার্টের ভেতর হাত ঢোকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কঙ্কালটি ওকে নিচ থেকে এভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যে, আমার হাত ওখানে পৌঁছাচ্ছেই না।
‘ভাইয়া, আমি তো হাত ঢোকাতে পারছি না।’
‘কিছু একটা কর আবির। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি আর বাঁচব না।’

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

‘আচ্ছা, তুই পিঠটা একটু তোলার চেষ্টা কর।’
‘আমি নড়তেও পারছি না।’
আমি চারিদিকে তাকাতে লাগলাম। কোনোদিকে কিছুই দেখছি না। চোখে পড়ল, ভাইয়া পা-গুলো ভালো করে টানতে পারছে না। গর্তটি আকারে ওর চেয়ে ছোট।
‘ভাইয়া, একটি কাজ কর। পায়ের মাধ্যমে মাটিতে ভর দিয়ে উপরের দিকে হাঁটার চেষ্টা কর।’
‘কী বলছিস এসব?’
‘যাই বলছি তাই তাড়াতাড়ি কর।’
ভাইয়া অনেক কষ্টে হাঁটার চেষ্টা করছে। ওর পায়ের দিকের অংশ একটু উপরে উঠার পর ওর পিঠের নিচে জায়গা হয়েছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি হাত ঢোকালাম। ভাইয়া নিজের ভার দুয়েক কদম পর্যন্ত বয়ে পা নামিয়ে ফেলেছে। ততক্ষণে আমি রিভলভার নিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে ওই কঙ্কালটির কপালে গুলি করলাম। গর্ত হয়ে কপালে গুলিটি ঢুকে গেছে। ভাইয়াকে ছেড়ে দেয় কঙ্কালটি। আমি তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে টেনে উপরে উঠে পড়লাম। গর্তের উপরে উঠার পর আমরা পালাতে যাওয়ার আগে কঙ্কালটি আমাকে পেছন থেকে গলা চেপে ধরল। সজোরে আমি চিৎকার করতে লাগলাম। ভাইয়া দৌড়ে এসে আমাকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। রিভলভারের গুলি কঙ্কালটির কোনো ক্ষতি করতে পারছে না। এমন সময় দেখলাম সাবিলা আমার চিৎকার শোনে ইতোমধ্যে এখানে এসে পড়েছে। সে ভয় পাবে ভেবে চিৎকার করে ওকে চলে যেতে নির্দেশ দিলাম। কিন্তু ও যাচ্ছে না। বরং ও দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কঙ্কালটিকে একটি ধাক্কা দেয়। সাথে সাথেই কঙ্কালটি দূরে ছিটকে পড়ল। এই ধাক্কায় আমি গর্তে পড়ে যাওয়ার সময় হা করে দৃশ্যটা চেয়ে রইলাম। সাবিলা আমাকে গর্তে পড়ার আগে ধরে ফেলল। আমি নিজেকে সামলানোর আগে কঙ্কালটি আবার এগিয়ে এলো। কিন্তু এখন সেটি আমার আর সাবিলার কাছে আসতে পারছে না। ভাইয়ার দিকেই এগিয়ে গেল। সাবিলা গিয়ে কঙ্কালটির সামনে হাত দুটো তুলে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়াল ভাইয়ার সামনে। কঙ্কালটা ওকে ভেদ করে ভাইয়ার কাছে যেতে পারছে না। আশ্চর্য! ওটা সাবিলাকে কেন কিছু করছে না?
সাবিলা বলল, ‘আবির, তোমরা এখান থেকে চলে যাও। আমি একটু পর আসছি। কঙ্কালটি আমাকে কিছুই করতে পারবে না।’
‘আর ইউ শিওর?’ দৃশ্যটা দেখে ভাইয়া ওর বিশ্বাসে বিশ্বাস করেছে।
‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আমাকে এটা কিছুই করতে পারছে না দেখছেনই তো। আপনারা যান। আমার কিছুই হবে না।’
ওর কথামতো চলে যাওয়ার জন্য ভাইয়া আমাকে টানতে লাগল। সাবিলাকে একা ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছে মোটেও হচ্ছে না। সে কোনোভাবে কঙ্কালটিকে আটকিয়ে রেখেছে। জোরাজুরি করে ভাইয়া বাইক নিয়ে আমাকে জঙ্গলের বাইরের রাস্তায় নিয়ে এলো। আমার তবু মন মানছে না। সাবিলাকে ঐ কঙ্কালের কাছে রেখে এসেছি যেটি একটু আগে আমাদের দুই পুরুষের উপর আক্রমণ করেছিল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অগত্যা ভাইয়াকে ছাড়িয়ে জঙ্গলে যেতে উদ্যত হই। এমন সময় সাবিলা জঙ্গল থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমি তাকে দেখে আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। কাঁপাকণ্ঠে বলতে লাগলাম, ‘সাবিলা, তোমার কিছু হয়নি তো?’
ও হয়তো আমার এই কাণ্ডে লজ্জা পেল। ‘না, আমার কিছুই হয়নি।’ সে মুচকি হাসল।
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। সাবিলাকে বাহু থেকে ছেড়ে দেয়ার পর ভাইয়া আমাদের কাছে এলো।
‘সাবিলা,’ ভাইয়া বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।’
আমি এখনও তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছি। এতক্ষণ যা হয়েছে সবই কি বাস্তব ছিল? বিস্ময় কাটছে না।
‘কী দেখে আছ এভাবে?’, সাবিলা বলল।
‘ইয়ে মানে…’
‘সাবিলা’, আমাকে বলতে না দিয়ে ভাইয়া বলে উঠল, ‘কঙ্কালটা তোমার কিছু করতে পারেনি কেন?’
‘আমিও তাই বুঝতে পারছি না।’ ভাইয়ার সাথে মত দিলাম।
‘পরে বলব। আরিয়ান ভাইয়া, আপনি জঙ্গলের এইদিক দিয়ে কেন ঢুকেছেন?’
‘আসলে রোড দিয়ে যেতে দেরি হয় বিধায় জঙ্গলের এদিক দিয়ে বাড়ি কাছে হবে ভেবে ঢুকে পড়লাম।’
‘এদিক দিয়ে আর যাবেন না। আমিও প্রথম দিন আপনাদের সাথে দেখা করতে এদিক দিয়েই গিয়েছিলাম। কঙ্কালটি আমাকেও আক্রমণ করেছিল। কিন্তু আমার ক্ষতি করতে পারেনি। আমি এসব কথা পরে বলব। এখন চলুন সবাই বাসায় যাই।’
ভাইয়া নিজের বাইকে উঠে পড়ল।
‘তুমি চাইলে আমার সাইকেলের পেছনের সিটে বসতে পারবে।’ মুচকি হাসি হাসছে সাবিলা, ‘আমি সাইকেল চালানো শিখে গেছি।’
আমি ওর সাইকেলের পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম। আমার লম্বা পাগুলোর কারণে তার আবার সাইকেল চালাতে অসুবিধা হবে। তাই পেছনে মুখ করে বসলাম।
ভাইয়া হেলমেট পরতে পরতে বলল, ‘আমার বাইকের পেছনে বসলে কী হতো?’
‘না থাক,’ মুচকি হেসে বললাম, ‘আমি এখানেই অনেক সুখে আছি।’
ভাইয়াও হাসতে হাসতে বাইক স্টার্ট দেয়। মুহূর্তেই সে চোখের আড়াল হয়ে গেল। সাবিলাও সাইকেল চালাতে শুরু করেছে। এখনও তেমন দক্ষ হয়নি। আস্তে আস্তেই সাইকেল চালাচ্ছে। আর আমার হৃদয়পাড়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে কেউ জানেই না। এই মুহূর্তে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। সাবিলার লম্বা লম্বা চুলগুলো একটু পর পর বাতাসে উড়ে এসে আমার ঘাড়কে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে লাগলাম। কেননা এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাইকেল রাইড। স্কুল জীবনে বন্ধুদের সাথে, ভাইয়াদের সাথে এভাবে কতবারই না বসলাম! কিন্তু এইবারেরটা ভিন্ন। এইবার… থাক, বাকিটা নাই বলি।
কখন যে ওর পিঠে হেলান দিয়ে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। একটু পর সামনে থেকে সাবিলা বলে উঠল, ‘আবির উঠো, বাসায় চলে এসেছি।’
চোখ খুলে চারিদিকে তাকালাম। হ্যাঁ, চলে এসেছি বাসার সামনে। ধুর ছাই, পথটি আরেকটু লম্বা হলে কী ক্ষতি হতো? বিশিষ্ট মুহূর্তগুলো এতো তাড়াতাড়ি কেন ফুরিয়ে যায়? উদাস হয়ে সাইকেল থেকে নামলাম।
‘কী মিস্টার?’, সাবিলা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?’
‘তুমি যেভাবে সাইকেল চালাচ্ছিলে ঘুমানোরই কথা!’ রসিকতা করে বললাম।
‘হাহাহা.. আমি তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। আসলেই এই সাইকেলটা আমার জীবনের সেরা একটি গিফট। থ্যাংকস অ্যা লট।’
‘কিসের থ্যাংকস? বরং আমি নিজেকে অনেক ধন্য মনে করি তোমাকে কোনো কিছু উপহার স্বরূপ দিতে পেরে।’
কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকলাম। ভাইয়া রান্না করতে গেছে। সাবিলার উদ্দেশ্যে ভাইয়া বলল, ‘সাবিলা, তুমি আজ দেরি করে যেয়ো। আজ তোমার এখানেই খাবার খেতে হবে।’
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’
আমরা দু’জনও রান্নাঘরে গেলাম। রান্নায় ভাইয়ার সাহায্য করলাম। সাথে সাবিলার সাথে ঠাট্টা- তামাশা তো আছেই। আসলে ওকে জ্বালাতে আমার খুব ভালো লাগে। রাগলে ওর নাকটা লাল টকটকে হয়ে যায়। এটি দেখার জন্যই জ্বালাই। সাবিলা আজ এখানে প্রথমবাবের মতো লাঞ্চ করবে ভেবে আমি ওর জন্য একটা স্পেশাল আইটেম করলাম।
রান্নাবান্না শেষে আমরা খেতে বসি। সাবিলা ওই খাবারটা খেতে যাওয়ার সময় মনে পড়ল, আমি তো প্রতিবারের মতোই এই খাবারেও লবণ দিইনি। তাড়াতাড়ি সাবিলাকে থামিয়ে দিয়ে ওটা খেতে নিষেধ করলাম।
ভাইয়া বলল, ‘তোর লবণবিহীন খাবার খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। এদিকে দে, ওটা আমি খাই।’
আমি উদাস হয়ে রইলাম। কোনোবারই ভালোভাবে রান্না করতে পারি না। ভাইয়া খাবারটা চেকে দেখে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল।
বললাম, ‘মজা হয়নি, তাই না?’
‘আবির, তুই তো লবণ পরিমাণ মতো দিয়েছিস। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে, তুই আজ এতো মজা করে কীভাবে রান্না করতে পেরেছিস।’
সাবিলা ভাইয়ার কথা শোনে বলে উঠল, ‘তাই নাকি? এতো মজা হয়েছে? আমাকে দিন। আমিও খাব।’
‘আরে’, বললাম, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি খাবারে লবণ দিইনি।’
‘লবণ তুই না দিলে কি ঐ আত্মাটি দিয়েছে? হা হা হা..’ ভাইয়া বিদ্রূপ করে হাসতে লাগল। এই ধরনের কথা বলে সাবিলা আর ভাইয়া দু’জনই হাসাহাসি করছে। ভাইয়া তো সুযোগ পেয়ে আমার ছোটখাটো সব দোষ উগলে দিচ্ছে। যাক, খাবারে লবণ যেই দিক না কেন, খাবারটা খাওয়ার যোগ্য তো হয়েছে।
ভাইয়া বলে উঠল, ‘এই জঙ্গলে কী সব অদ্ভুদ জিনিস, বাবারে। শেষ পর্যায়ে একটি জীবন্ত কঙ্কাল দেখতে হলো!’ পরক্ষণে সাবিলাকে বলল, ‘সাবিলা, তুমি তো এখনও বললে না কঙ্কালটা তোমাকে কেন কিছু করেনি।’ আমিও আগ্রহ দেখালাম।
সাবিলা বামহাতের কালো সুতার ব্যান্ডগুলো দেখিয়ে বলল, ‘আমার বামহাতের এই যে তাবিজগুলো দেখছেন? এই তাবিজগুলোর কারণেই কিছু করতে পারেনি কঙ্কালটি।’
‘এইগুলো তাবিজ?, বিস্মিত হয়ে বললাম।
‘হ্যাঁ, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে একটা দরবেশ বাবা এগুলো দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, এগুলো আমাকে প্রতিটা খারাপ আত্মা থেকে দূরে রাখবে। তাঁর সাথে থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ভয় জিনিসটা থেকেও পরিত্রাণ পেয়েছি। তাইতো আমি কঙ্কালটাকে মোটেও ভয় পাইনি। সেদিন আমাকে যখন কঙ্কালটি আঘাত করতে গিয়েছিল, তখন ওটা আমাকে ধরতেই দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছিল এই তাবিজগুলো আমার হাতে থাকার কারণে। আর আজও তাই হয়েছে।’
‘তাই নাকি?’, ওর কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস না হওয়ায় আমি বললাম, ‘তুমি তোমার দরবেশ বাবাকে কোথায় পেয়েছিলে?’
সাবিলা এই ঠাট্টায় কিঞ্চিত রেগে গেছে।
‘আচ্ছা’, আমি বললাম, ‘সরি। আমি দুষ্টুমি করছিলাম। কষ্ট পেও না।’
সাবিলা স্বর পাল্টিয়ে গম্ভীরভাবে বলতে লাগল, ‘আমি আট বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে পথে পথে ঘুরতাম। ভালো-মন্দ, সাদা-কালো কিছুই বুঝতাম না। অনেক ভিক্ষুকদের পাশে গিয়ে ওদের সাথে বন্ধুত্ব করতাম। অন্যরা আমাকে ভিক্ষুকের বাচ্চা ভেবে দুয়েক পয়সা দিয়ে যেত। একদিন এক মাজারের পাশে বসেছিলাম ভিক্ষুকদের সাথে। এমন সময় একটি বৃদ্ধ লোক এসে আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাঁকে আমার নাম ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারলাম না। তাঁর হয়তো আমার প্রতি মায়া হয়েছিল। তিনি আমাকে নিজের সাথে করে নিয়ে গেলেন। তিনি সেই দরবেশ। অনেক ভালো স্বভাবের লোক ছিলেন। মানুষের উপকার করতেন, আমার অনেক খেয়াল রাখতেন। আমি ছাড়া এই দুনিয়ায় তাঁর আর কেউ ছিল না। তাই আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। একসময় তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। বুঝে ফেলতে পারেন, যেকোনো সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে। তিনি বহু কষ্টে আমার বর্তমান বাবার কাছে আমাকে সপে দেন। এরপর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতি হিসেবে এই দুটো তাবিজই রয়ে যায় আমার কাছে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, “মা, এখানের একটি তাবিজ তোমার জীবনসঙ্গীকে দিয়ে দেবে। আমি চাই, যে তোমার অসহায় মুখ দেখে তোমাকে আপন করে নেবে তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”‘ সাবিলার চোখে পানি দেখলাম।
‘দুঃখিত, আমার কারণেই তোমার কাছে তোমার অতীতের কথা মনে পড়ে গেছে।’
সাবিলার দিকে তাকালাম। এখনও মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে মেয়েটির। ‘আচ্ছা, এসব বাদ দাও। খাবার কেমন হয়েছে বলো?’
‘দারুণ হয়েছে।’
ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘ভাইয়া, তোর তো খালেকের ছবি আনার কথা ছিল। এনেছিস?’
‘এনেছি। সাথে ওর গ্রামের অ্যাড্রেসও দিয়েছে সজীব। আমাদের কালই ওর গ্রামে যাওয়ার জন্য বেরুতে হবে।’
‘কোন গ্রামে?’, সাবিলা বলল, ‘আর কেন?’
‘আমরা আকবর সাহেবের মৃত্যু সম্বন্ধিত কিছু তথ্য পেয়েছি।’, প্রতিউত্তরে বললাম, ‘খালেক নামের একটি ছেলে আকবর সাহেবের মৃত্যুতে কোনো না কোনোভাবে জড়িত আছে। কিন্তু কীভাবে তা ফাইন্ড আউট করার জন্য ওর গ্রামে যেতে হবে।’
‘কয়দিন লাগবে তোমাদের ফিরতে?’
‘ঠিক বলা যাবে না। ওকে পেতে কতদিন লাগবে ধারণা নেই। ওকে ওর গ্রামে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু গিয়ে দেখায় ক্ষতি নেই।’
আলাপ আলোচনা করে খাওয়াদাওয়া শেষ হলো আমাদের। সাবিলার যাওয়ার সময় হয়েছে। ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসতে চাইলাম। ওর এখন সাইকেল আছে। না গেলেও চলবে। ওকে বাসার বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। সাবিলা তখনও উদাসীন।
‘সাবিলা,’ বললাম, ‘আমি তখন যে মজা করেছিলাম তোমার দরবেশ বাবার বিষয়ে, সেটা নিয়ে এখনও মন খারাপ করে আছ তুমি?’
‘আরে না। তোমরা কাল হতে এখানে থাকবে না। তোমরা চলে গেলে আমার এখানে আর আসাও হবে না। তাই একটু খারাপ লাগছে।’
‘এই কথা? সত্যি বলতে আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে খুনির কাছে পৌঁছার জন্য যেতে তো হবেই।’
আমাদের এখনও কথাবার্তা বলতে দেখে পেছন থেকে ভাইয়া এসে বলল, ‘সাবিলা, তুমি চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারবে। তোমার পরিবারকে বলে কাল এখানে চলে এসো। আমরা একসাথেই বেরুব। আর তোমার মনও ভালো থাকবে।’
সাবিলার মুখের উজ্জ্বলতা তৎক্ষণাৎ ফিরে এলো, ‘ঠিক আছে। মায়েরা যদি রাজি হয়, তবে আমিও আপনাদের সাথে যাব।’
ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে সাবিলাও থাকবে। মনের ভেতর অন্য ধরনের প্রশান্তি কাজ করছে। একটু পর সাবিলা বিদায় জানিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। আর আমি ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। ভ্রম কাটিয়ে ভাইয়া বলে উঠল, ‘আবির মশাই, সামথিং সামথিং?’
‘নো নাথিং’, মৃদুহাসি হাসলাম।
‘তাই নাকি? দেখছিলাম, যখন থেকে খালেকের গ্রামে যাওয়ার কথা উঠেছে তখন হতে সাবিলার সাথে সাথে আপনারও মুড অফ। এখন তো সাবিলাও যাবে। মুড এখন ঠিক হয়েছে তো?’
‘কী যে বলছিস! এমন কিছু না।’
‘তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকাতে চাইলেও পারবি না। আমি তোর বড় ভাই। সব বুঝি। সাবিলাকে হয়তো তুই পছন্দ করিস। তাইতো এই সাইকেল..’
‘ইয়ে মানে,’ ইতস্ততভাবে বললাম, ‘ও মেয়ে হিসেবে ভালো। ওর সাথে থাকতে আমার ভালো লাগে। তাই কখন যে ওকে পছন্দ করে বসেছি বুঝতেই পারিনি।’
‘ওকে বলে দে তোর মনের কথা?’
‘সাবিলার মনে আমাকে নিয়ে কিছু আছে কিনা তা আমি আদৌ জানি না।’
‘টেনশন করিস না। সাবিলার কাছে তোকে পছন্দ না হওয়ার কথাই আসে না। তোকে পেলে সাবিলা সৌভাগ্যবতী একজনই হবে।’
‘এসব বাদ দে। খালেকের ছবিটা দেখা তো। আমি একটু দেখতে চাই।’
‘ভেতরে চল।’
ঘরে এসে খালেকের ছবি দেখলাম। অনেক পুরনো ছবি। তার স্কুল জীবনের। এতদিনে অবশ্য অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবু তাকে চেনা কঠিন হবে না। কারণ খালেকের একটি চোখ সামান্য ট্যারা। কপালের বাম কোণায় কালো একটি জন্মের দাগ আছে। ব্যাস, এই দুটো চিহ্নই যথেষ্ট। তাকে দেখলেই চেনে ফেলতে পারব।
(চলবে…!)
লেখা: ফারিয়া কাউছার