পরী পর্ব ২
‘ও হচ্ছে আরিয়ান মেহবুব।’ সাবিলাকে ভাইয়ার সাথে পরিচয় করালাম, ‘সেই ইন্সপেক্টর, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম।’
ভাইয়াও তার সাথে পরিচিত হয়ে বলল, ‘এই জায়গাটা আমাদের বাসা থেকে অনেক দূর। প্রায় দুই ঘণ্টার দূরত্ব। প্রতিদিন এখানে আসা যাওয়া কষ্টসাধ্য এবং অনেক সময়সাপেক্ষও হবে। এখানেই কোনো এক ভাড়াটে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। চল আবির, তাড়াতাড়ি চল। লাঞ্চেরও সময় হয়েছে।’
‘আসছি।’
সাবিলাকে বিদায় দিতে যাব, সে বলে উঠল, ‘আপনারা বোধ হয় এখানে নতুন। আপনারা আজাদ আঙ্কেলের সাথে কথা বলে দেখুন। তিনি হয়তো সাহায্য করতে পারবেন।’
‘সাবিলা ভুল বলেনি।’ ভাইয়া বলল, ‘আমরা এতো তাড়াতাড়ি বাসা কোথায় পাব? আর কালরাত তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। এখনও আকাশে মেঘ। যেকোনো সময় বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। আজাদ সাহেব হয়তো সাহায্য করতে পারবেন। চল আবির।’
আমরা তাঁর কাছেই যাচ্ছি। সাবিলা আমাদের পেছনে ছিল।
‘শুনুন,’ সাবিলা আমাকে বলল, ‘আঙ্কেলের একটি বাসা আছে এখান থেকে কিছু দূরেই। ওখানে কেউ থাকে না। এমনিই পড়ে আছে। আপনি যদি বলেন, আমি তাঁকে ওই বাড়িটির কথা বলে দেখতে পারি।’
‘তাহলে তো আরও ভালো। ঠিক আছে, বলবেন।’
আমরা গিয়ে আজাদ সাহেবের কাছে সাহায্য চাইলাম। সাবিলাও বাড়িটির কথা পেড়ে দেখল।
আজাদ সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই বাড়িটি এমনিই পড়ে আছে। ওটা কাউকেই ভাড়া দিই না। তোমরা চাইলে থাকতে পার। তবে ওটা একটু দেখে আসো। ভালো নাও লাগতে পারে। ভালো না লাগলে আমি তোমাদের জন্য অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করব।’
‘আরে না স্যার।’ ভাইয়া বলল, ‘বিশেষ কিছু লাগছে না। আমরা বাড়িটিই বরং দেখে আসি। পরে যা হয় দেখে নেব।’
‘জায়গাটা একটু নির্জন এবং জঙ্গলের ভেতর।’ আজাদ সাহেব আলমারি খুলে চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, ‘জঙ্গলের বাহির থেকে বাড়িটি একদমই দেখা যায় না। আর বাড়ির ভেতর দুটো তালাবন্ধ রুম আছে। ওগুলো খুলবে না। বাকি রুমগুলো থাকার উপযোগী আছে। একটু এডজাস্ট করতে হবে।’
‘সমস্যা নেই আজাদ সাহেব,’ ভাইয়া বলল, ‘থাকতে পারলেই হচ্ছে।’
‘আমাকে আঙ্কেল ডাকতে পার।’ তিনি মৃদু হাসলেন। তাতে কোনো ঔজ্জ্বল্য নেই।
‘আঙ্কেল,’ আমি বললাম, ‘আপনি ওই জায়গায় কেন বাসা করলেন?’
‘আসলে ওটা আমি বাঁধিনি। ওটা অনেক পুরাতন। যারা বেঁধেছে, তারা হয়তো এখন জীবিত নেই। জঙ্গলটা আকবরের ছিল। একদিন গাছ কাটানোর সময় বাসাটির সন্ধান পেয়েছি।’
‘তাহলে চাবি আপনার কাছে কেন?’ ভাইয়া বলল।
‘ওই বাসার কথা শোনার পর আমি আর আকবর ওখানে গিয়েছিলাম। দরজায় লক ছিল না। এমনিই হালকা বাঁধা ছিল। ওইখানের তালাবন্ধ যে রুমদুটোর কথা বলেছি, সে দুটো আগে থেকেই তালাবন্ধ ছিল। হয়তো আগের লোকের জরুরি কিছু আছে ওই রুমগুলোতে। তাই বেঁধে রেখেছে। আমরাও আর খোলার চেষ্টা করিনি। তবে আকবর সাহসী ছিল বিধায় প্রায় যেত সেই বাড়িতে। সে ওখানে রিয়া, সাবিলা আর ইভাকেও নিয়ে কয়েকবার গিয়েছে। ইভা এখন কোনোদিকে যাওয়ার অবস্থায় নেই। তোমরা এক কাজ কর, সাবিলাকে নিয়ে যাও। ও তোমাদের পথ দেখিয়ে দেবে।’
আজাদ আঙ্কেল চাবি দিলে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাবিলার সাথে বেরুলাম। বাহিরে ইভার সাথে আমার দেখা হয়। সে বলল, ‘আমার আব্বার খুনিকে যেভাবেই হোক খোঁজে বের করুন। তার শাস্তি পেতেই হবে।’
‘আপনি টেনশন করবেন না। আমরা অতি শীঘ্রই খুনিকে খোঁজে বের করব।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আপনার বাবাকে কি কখনও দুশ্চিন্তায় ভুগতে কিংবা কোনোকিছু নিয়ে টেনশন করতে দেখেছেন?’
‘না। তেমন কিছু নিয়ে তিনি টেনশন করতেন না। তবে মাঝে মাঝে হুট করে অদ্ভুত রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসতেন।’
‘যেমন?’
‘সময় সময় বলতেন, লোভ জিনিসটা বড় খারাপ। মাঝে মাঝে এমন বলতেন, ধনী হতে হলে একটি ডায়েরিই যথেষ্ট। এরকম আরও অদ্ভুত কথা বলতেন ও জিজ্ঞেস করতেন। যেমন, একবার আমার কাছে পরীদের অস্তিত্ব আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
‘এরকম অদ্ভুত কথা বলতেন?’
‘হুঁম।’
‘ওহ্,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম, ‘আসি। ধন্যবাদ এসব বলার জন্য।’
তাকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম। এসব আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আকবর সাহেব যতেষ্ট সাহসী ছিলেন। তবে এরকম অদ্ভুত ধরনের কথা কেন বলতেন? ভাবতে ভাবতে বাইকে উঠলাম। সাবিলাকে আমার বাইকে নিয়ে রওনা দিলাম। তার নির্দেশনায় বাড়িটায় এসে পৌঁছোলাম। বেশ পুরনো বাসাটি। কিন্তু দেখতে খারাপ নয়। সাবিলা বলল, ‘আমার না এই জায়গাটি অনেক ভালো লাগে। আমার তো ইচ্ছে হয় এখানেই থেকে যাই।’
ওর কথা শোনে ভাইয়া বলল, ‘তোমার যখনই মন চায় এখানে চলে আসতে পারবে।’
‘অবশ্যই। আমি কিন্তু এখানে আকবর আঙ্কেলের সাথে অনেকবার এসেছি। যেদিন শেষবার এসেছি সেদিন তাঁর কাছে শুনেছিলাম, এখানে অদৃশ্য কিছু একটার উপস্থিতি আছে। হয়তো এখানে কোনো আত্মা আছে। আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন।’
‘ভূত-আত্মা এসব কাল্পনিক।’ আমি বললাম, ‘আঙ্কেলের হয়তো কোনো ভ্রম হয়েছিল।’
‘হ্যাঁ,’ ভাইয়া মত দিল, ‘ওরকম কিছু বাস্তবে থাকে না।’
‘তবু সাবধানে থাকবেন।’ সাবিলা জোর দিলো।
কথা শেষে ভাইয়া দরজা খোলার পর আমরা ভেতরে ঢুকলাম। বারিটি হয়তো আগের মানুষেরা খুব শখ করে বেঁধেছে। চারিদিকে পোর্ট্রেট, সিনারীসহ আরও অনেক কিছু টাঙানো। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম, উপরের দেয়ালের সাথে ঝুলন্ত অনেকগুলো বড় বড় হাতপাখা আছে। হাতপাখাগুলো তো স্বয়ং বাতাস করতে পারবে না, তবে এসব ঝুলিয়েছে কেন? সাবিলা তো আসার সাথে সাথেই ভেতরের চারদিকে ঘুরছে, যেন তার জন্য বাড়িটি অনেক আপন। আগেও সে অনেকবার এসেছে এখানে। হয়তো মিস করেছে। বাড়িটি নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তা করেছিলাম ততটা খারাপ নয়। বেশ কয়েকটা রুম আছে। চারিদিকে ঘুরে দেখলাম আমরা। এরপর ভাইয়া কেনাকাটা করতে চলে গেল।
আমি আর সাবিলা অনেকক্ষণ গল্প করলাম। এতক্ষণে আমাদের সম্পর্ক আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছে। দু’জনই ঘরের চারিদিক পরিষ্কার করলাম। এরপর তাকে তার বাসায় দিয়ে এলাম।
ভাইয়া আসার পর রান্না করতে চলে গেল আর আমি পানির সন্ধান করতে বাইরে গেলাম। বাড়িটির বাইরে একটি নলকূপ আছে। ওটা দিয়ে গোসলের প্রয়োজন মিটবে না। আরো খুঁজে কিছুদূর গিয়ে একটা বড় কুয়ো দেখলাম। কুয়োর আশেপাশের জায়গাগুলো অনেক সুন্দর, মনোমুগ্ধকর। দেখেই মন জুড়িয়ে যায়। যাক, পানির ঝামেলা মিটল। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় বাড়ির সামনে দেখলাম, ভাইয়া বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আর কাঁপছে।
আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম, ‘কী হলো ভাইয়া?’
‘রা-রান্নাঘরে কেউ যেন আছে।’ কাঁপাস্বরে সে বলল, ‘কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আমাকে কে যেন এখান থেকে চলে যেতে বলছে। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।’
‘কী বলছিস এসব? সাবিলার কথা হয়তো তুই বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিস। ওসব কিছু না। চল ভেতরে চল।’
রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম সবই ঠিকঠাক আছে।
‘তোর হয়তো ভ্রম হয়েছে আর কিছু না।’ ওকে বললাম, ‘আসলে তোকে নতুন এই বাড়িতে একা ফেলে যাওয়াটাও উচিত হয়নি। সারাক্ষণ যে ভূত-প্রেতের কাহিনি পড়িস। চল ফ্রেশ হয়ে নে।’
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রুমে চলে এলাম। সকাল থেকে একটুও রেস্ট নিতে পারিনি। আজকে আর কোনোদিকে যাওয়া হবে না। আজাদ সাহেবের বাসায় কাল সকালেই যাব। রাতের খাবার খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমি ঘরের কোণোর একটি রুমে শুয়েছি। ভাইয়া শুয়েছে, ঘরে ঢুকতেই যে তালাবন্ধ রুমটি আছে, তার পাশের রুমটায়। ক্লান্ত থাকায় আমি কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
হঠাৎ ভাইয়ার চিৎকারে অর্ধরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তড়িঘড়ি করে উঠে দৌড় দিলাম। গিয়ে দেখি ভাইয়া ওর রুমে নেই। পাশের তালাবন্ধ রুমটি খোলা। তার ভেতর ভাইয়া ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে তোলার চেষ্টা করলাম। সে তার গলা ধরে আছে। দেখে লাগছে কে যেন ওর গলা চেপে ধরে আছে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম ওকে ছাড়ানোর। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বিপরীতে আমি পেরে উঠছি না। নিরুপায় হয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগলাম, ‘ভাইয়াকে ছেড়ে দাও। ও তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও।’
সাথে সাথে ভাইয়া কাতরানো বন্ধ করে দিয়েছে। উঠে সে কাশতে লাগল এবং জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।
তড়িঘড়ি করে আমি ওকে আমার রুমে এনে বসালাম। পানি খেতে দিলাম ওকে। সে বারবার গলাই ধরছে। ভাইয়াকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।
‘ভাইয়া, তুই আজকের রাতটা আমার সাথেই শুবি।’
সে কিছুই না বলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবছি, আমি তো এই ধরনের কিছু বিশ্বাস করি না। তবে চিৎকার করে ওসব কথা কাকে কেন বলেছি? কী হয়েছিল ওখানে? রুমটিতে তো তালা লাগানো ছিল। এখানে সত্যিই কি কোনো আত্মা আছে? ভাইয়ার যদি কিছু হয়ে যেত? না, আমরা এখানে আর থাকব না। কালকেই ভাইয়াকে নিয়ে চলে যাব। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি।
আমি ঘুম থেকে উঠার পরও ভাইয়া ঘুমোচ্ছিল। ওকে জাগানোর জন্য ওর বাহু ধরে ডাকলাম। একি! ওর যে গা গরম। কপাল চেক করে দেখলাম, ওর গায়ে জ্বর এসেছে।
তড়িঘড়ি করে আমি ডাক্তার এনে ওকে দেখালাম। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে চলে গেল।
ভাইয়াকে বললাম, ‘তোর এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালো, তবে মাথাটা ভারী হয়ে আছে।’
‘তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ভাইয়াকে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে বললাম, ‘এখন রেস্ট কর। তুই সুস্থ হয়ে উঠতেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। আসলে কাল সাবিলার কথাগুলো সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ছিল। আমার মনে হচ্ছে এখানে সত্যিই কোনো আত্মা আছে। আচ্ছা, কাল কী হয়েছিল তোর সাথে?’
‘কাল গভীর রাতে গরমে ছটফট করতে করতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আমার। তখন অদ্ভুত এক গরম বাতাস ছিল রুমের চারিদিকে। জানালা খুলে দিতে গিয়ে দেখলাম তুই আমার রুমের দরজা খুলে বের হচ্ছিস।’
‘আমি?’ থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে বললাম। কারণ কালরাত আমি ঘুমোচ্ছিলাম।
‘হ্যাঁ, তোকে আমি অনেক ডেকেছিলাম। তুই ফিরে তাকাচ্ছিস না দেখে তোর পিছু নিই। দেখলাম তুই পাশের তালা লাগানো রুমটাতে যাচ্ছিস। আর রুমটা তখন আপনা থেকেই খুলে গিয়েছে। আমি তোর পিছু পিছু রুমটায় গেলাম। এরপর তুই হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গিয়েছিস। আশেপাশে আবার সেই গরম বাতাস বইতে শুরু করল। তখন কে যেন বলে উঠল, “আমি তোকে চলে যেতে বলেছিলাম কিন্তু তুই যাসনি। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”
ভয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে ভাবলাম দুপুরের ঘটনাটা অবহেলা করে ভুল করেছি। আমি তখন পালাব ভেবেছি। কিন্তু কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছি। তখনই আমার গায়ের উপর ভারী কিছু একটা বসল আর আমার গলা চেপে ধরল। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু পারিনি। তুই আসার পরই জান ফিরে পেলাম।’
‘সত্যি? তবে আত্মাটা কি চায় না যে, আমরা এখানে থাকি?’
‘হয়তো চায় না।’
একটু পর সাবিলা এলো। ভাইয়াকে দেখে চমকে উঠে বলল, ‘একি! কী হয়েছে তাঁর?’
‘ভাইয়ার গায়ে জ্বর। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন।’ বললাম, ‘সাবিলা, ভাইয়ার জানের রিস্ক নিয়ে আমি এখানে থাকতে পারব না।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘এখানে যে আত্মাটি আছে, সে কালরাত ভাইয়াকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি মাঝরাতে ভাইয়ার চিৎকার শুনি আর রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ভাইয়া সামনের তালাবন্ধ রুমটার ফ্লোরে পড়ে আছে। আমি ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলাম।’
‘আরিয়ান ভাইয়া,’ সাবিলা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি কোন রুমে ঘুমিয়েছিলেন?’
‘আবির যে তালাবন্ধ রুমটির কথা বলছে তার পাশের রুমে।’
‘ওহহো, আপনি ওটাতে কেন থাকতে গেলেন!’
‘কেন?’
‘আপনি তালাবন্ধ রুমটির পাশের রুমে ঘুমিয়েছেন বিধায় এমনটা হয়েছে। আমি কাহিনিটি বলছি, এখানে এখন দুটো তালাবন্ধ রুম আছে। কিন্তু আমি যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন তালা লাগানো রুম কেবল একটাই ছিল। আবির, তুমি যে রুমটির কথা বলছ, সেটি ছাড়া আর কোনো তালাবন্ধ রুম ছিল না। উপরের তালাবন্ধ রুমটিতে আমি এই পর্যন্ত দুইবার থেকেছি। দ্বিতীয়বার থাকার পর, সকালে উঠে রুম থেকে বেরুনোর সময় দরজাটা আপনা আপনিই বেঁধে গিয়েছে। আর তালাটাও আপনা থেকেই লক হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে এসব গিয়ে আকবর আঙ্কেলকে বলেছিলাম। আর এসব কী হচ্ছে তাও জিজ্ঞেস করলাম। অনেক জোরাজুরির পর তিনি ঘটনাটি বললেন, “ওই রুমটি আপনা আপনি কেন বন্ধ হয়েছে তা আমি জানি না। তবে আমি বাড়িটিতে আগেও অলৌকিক কিছু দেখেছি। আমি যেদিন এই বাড়ির সন্ধান পেলাম, সেদিন ভাইয়াকে নিয়ে এখানে থেকেছিলাম। তখন এখানে দুটো তালাবন্ধ রুম ছিল। আমি সামনেরটির পাশের রুমে ঘুমিয়েছিলাম। রাতে হঠাৎ বেশি গরম লাগার কারণে জানালা খোলার জন্য উঠলাম। দেখলাম একটি যুবক রুম থেকে বেরোচ্ছে। আমি একটু আশ্চর্যান্বিত হলাম, এখানে এই ছেলে কোথা থেকে এসেছে তা ভেবে। আমি ছেলেটিকে অনেকবার ডেকেছি। পেছনে ফিরছে না দেখে আমি ওর পিছু নিই। সে একটু পর পাশের রুমটাতে ঢুকে গেল। দরজাটি আপনা থেকেই খুলে গিয়েছিল। আমিও ওখানে ঢুকি। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ চোখের সামনেই গায়েব হয়ে গেল। এরপর আমি কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। আমাকে অদৃশ্য কিছু একটা গলা চেপে ধরেছিল। আমি অনেক লড়াই করলাম ওটার বিরুদ্ধে। তারপর হঠাৎ ফজরের আজান শোনা গেল। অদৃশ্য শক্তিটাও আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি সেখান থেকে প্রাণপণে বের হলাম। পরে দরজাটি আবার লক হয়ে গেছে। অথচ এই ঘরে ভাইয়াও ছিলেন। তাঁর কিছুই হয়নি। আমি কথাটা তাঁর কাছ থেকে গোপনই রাখলাম। ধরে নিলাম, তালাবন্ধ রুমগুলোতে কিছু একটা আছে। এর আশেপাশে থাকা যাবে না। তুমি, ইভা এই বাড়িটিতে ঘুরতে আসতে চেয়েছিলে, তাই আমি তোমাদের এনেছি। ভেতরে ঢুকে দেখি তালাবন্ধ রুমদুটোর উপরটিতে তালা নেই। এটা নিয়ে মাথা আর ঘামাইনি। আর আমি তো তোমাকে বলেছিলাম রুমটিতে না থাকতে। তুমি নিজেই থেকেছ।” এসব শুনে আমি ভাবলাম, যে আত্মাটি আঙ্কেলকে মারতে চেয়েছে সেই হয়তো এসব দরজা খুলে দেয়। আর আমি আপনাদের কালকে বলেছিলাম এখানে একটি আত্মা আছে। আপনারা বিশ্বাস করছেন না দেখে আমি এসব কাহিনি বলিনি।’
‘সরি,’ আমি বললাম, ‘আসলে আমরা এসব আগে কখনও দেখিনি।’
‘আত্মাটা..’ ভাইয়া বলল, ‘আমাকেও আকবর আঙ্কেলের মতো করে মারতে চেয়েছিল।’
‘এখানে আমরা আর থাকব না। ভাইয়া সুস্থ হয়ে উঠতেই চলে যাব।’
সাবিলা বলল, ‘তালাবন্ধ রুমদুটোর আশেপাশে না থাকলেই তো হলো। চলে যেতে হবে কেন?’
‘না, আমি কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারব না।’
‘কিন্তু আমি পারব।’ ভাইয়া বলল, ‘আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। দেখি আত্মাটা আর কী কী করে।’
‘কী বলছিস এসব?’
‘ভাইয়া ঠিকই তো বলছেন।’ সাবিলা বলল, ‘সামান্য একটা আত্মাকে ভয় পেয়ে চলে যাবেন? আমাকে দেখুন, সবকিছু জানার সত্ত্বেও এখানে আমি আসি। খুব ভালো লাগে এই জায়গাটি। যদি আপনারা চলে যান, তবে এখানে আমি আর আসার সুযোগও পাব না।’
‘এখানে থাকলে অনেক এডভেঞ্চার হবে।’ ভাইয়া বলল, ‘আর সাবিলা তো বলছেই, তালাবন্ধ রুমগুলোর আশেপাশে না থাকলেই হলো।’
আমি ভেবে দেখলাম, হ্যাঁ, তাই তো। অনেক এডভেঞ্চার হবে, ‘ঠিক আছে এখানেই থাকব। তবে আত্মাটা যদি আবার কিছু করে?’
‘উফফ’, ভাইয়া আর সাবিলা দু’জনেই একত্রে বলে উঠল।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর কিছু বলছি না।’
(চলবে..!)
লেখা: ফারিয়া কাউছার