পরী পর্ব ১

0
3033

পরী পর্ব ১

সকাল ছয়টা বাজে। বাইক নিয়ে ক্রাইম স্পটে যাচ্ছি। পাশের চলন্ত বাইকে ভাইয়াও আছে। দু’জন পাশাপাশি বাইক চালাচ্ছি। আমাদের সামনে একটি পুলিশের গাড়ি চলছে। ভাইয়া তাড়াহুড়োয় থাকায় তেমন কিছু জিজ্ঞেস করিনি। সম্ভবত কারো মৃত্যু হয়েছে। না, সুইসাইড করেছে। ওখানেই যাওয়া হচ্ছে। তবে জানতাম না, এখান থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরবে।
‘তুই বিয়ে করিস না।’ ভাইয়া বলে উঠল, ‘তুই বিয়ে করলে আমার কী হবে বল?’
‘আমি সারাজীবন এইভাবেই তোর সাথে বাইক চালিয়ে ক্রাইম স্পটে যেতে থাকব নাকি?’
‘তুই তো জানিস, বিয়ের পর ছেলেরা বউয়ের ঘ্যানঘ্যানের কারণে পাগল হয়ে যায়। আমার মতো অবস্থা যদি তোরও হয়, তবে আমার শখের চাকুরী থেকে রিজাইন করতে হবে। হিহিহি।’
আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। আমিই আগ্রহ পোষণ করি। আর কথা হলো, এসব কাজে ওর কাছে আমার সঙ্গ খুব ভালো লাগে।
‘এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ আমি বললাম, ‘কার মৃত্যু হয়েছে? কীভাবে হয়েছে?’
‘জাকির স্যারের এক বন্ধুর। তাঁর নাম আকবর। স্যারের কাছে রাত দুইটার দিকে আকবর সাহেবের কল এসেছিল। তিনি মৃদুসুরে কেবল জাকির বলে ডেকে আর কিছুই বলেননি। এরপর জাকির স্যার আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তাঁর মোবাইল ট্রেস করলেন। ট্রেস করার পর মোবাইলের অবস্থান তাঁর বাড়ি থেকে কিছু দূরের একটি নির্জন রাস্তায় পান। ওখানে গিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে তিনি মাথা কাঁত করে পড়ে আছেন। ততক্ষণে তাঁর মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল। স্টিয়ারিং-এর সামনে বিষের বোতল রাখা ছিল। তাঁর ফেমিলিকে এই মৃত্যুর কথা জানানোর পর লাশকে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এসবের পর জাকির স্যার আমাদের পুলিশ ফোর্সকে ইনফর্ম করেন। তিনি আমাদেরকে একেবারে আকবর সাহেবের বাসায় দেখা করতে বলেছেন। ততক্ষণে হয়তো লাশও নিয়ে আসা হবে।’
‘আকবর সাহেব কেমন স্বভাবের লোক ছিলেন?’
‘বেশিকিছু জানি না। কেবল এটা জানি, লোকটির বড়ভাই অনেক ধনী। আর তাঁর নাকি তেমন সম্পদও নেই।’
‘হয়তো এইদিক থেকেই কোনো এক কারণে সুইসাইড করেছেন।’
‘জাকির স্যার এটিকে মার্ডার কেস বলেছেন। তাইতো যাচ্ছি। ওখানে গিয়েই বাকিটা বুঝতে পারব।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা পর জায়গাটিতে পৌঁছালাম। অনেক বড় তাঁদের বাড়ি। দুই ভাই এই বাড়িতে একই সাথে থাকতেন। হয়তো এটি আকবর সাহেবের ভাই নির্মাণ করেছেন। আমিও পুলিশদের সাথে ভেতরে গেলাম। ভেতরের মানুষগুলো কান্নাকাটি করছে। সম্ভবত লাশ নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশদের সাথে আমিও ডেডবডি দেখতে গেলাম। অনেক বড় একটা রুমে লাশকে শোয়ানো হয়েছে। দেখে লাগছে, তিনি মাঝ বয়সের পুরুষ হবেন। লাশের পাশে বসে লাশকে জড়িয়ে ধরে এক বয়স্ক লোক কাঁদছেন, তাঁর পাশে অল্পবয়সী সুন্দর এক মেয়েও।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। পুলিশরা ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখছে। আমি ওদের ন্যায় পুলিশ নই বিধায় চলে এসেছি।
কিছুক্ষণ পর লাশকে বের করিয়ে জানাযা পড়িয়ে কবর দেওয়া হলো। আমি ভেতরে চলে এলাম। পুলিশ বাইরে তদন্ত শুরু করেছে।
খানিক বসে থাকার পর হঠাৎ আমার ডান কাঁধে মৃদুভাবে কারো কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি, এই অপূর্ব ফর্সা হাতটায় মেয়েটি একজোড়া কালো সুতার মোটা ব্যান্ড পরে আছে। আমি দাঁড়িয়ে ফিরতেই অবাক বনে গেলাম। এটা যেন কোনো মেয়ে নয়, এ যেন আকাশ থেকে সদ্য নেমে আসা কোনো এক পরী! আর তার চোখগুলো কী বলবো! ভাষাই হারিয়েছি। তার চুলগুলো ইয়া লম্বা। পরেছেও সাদা ড্রেস। আমি আবার এই ভূত-পরীতে বিশ্বাস করি না। তবু যাই বলি না কেন, এই অল্পবয়সী মেয়েটি অপূর্ব সুন্দর আই মিন সুন্দরী। তাকে দেখলে কল্পনার পরীরাও হার মানবে। মেয়েটি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি কি নাস্তা করেছেন, আপনার জন্য কি চা আনব?’
আমি এখনও তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি। সে আস্তে করে গলা খাঁকার দিলো। হয়তো আমার হুঁশ ফেরানোর জন্য।
‘জ্বি?’ ভ্রূ কুঞ্চিত করলাম, ‘কিছু বলছিলেন?’
‘আমি এতক্ষণ কি নিজের সাথে কথা বলছিলাম?’, মেয়েটির বিরস মুখে হাসি ফুটল।
‘ইয়ে.. না মানে, সরি খেয়াল করিনি।’
‘আপনাকে পুলিশদের সাথে দেখেছিলাম। সবাইকে অনেক আগেই নাস্তা দেওয়া হয়েছে কিন্তু আপনাকে দেখিনি। আপনি বোধ হয় কিছু খাননি। তাই নাস্তা আনব কিনা জিজ্ঞেস করতে এলাম।’
‘আমি পুলিশ নই। তাই তখন বাইরে এসে বসেছিলাম। আর যে ইন্সপেক্টরকে এই কেস হেন্ডেল করতে দেওয়া হয়েছে সে আমার ভাই। ওর সাথেই কাজ করতে এসেছি।’
‘ওহ, আচ্ছা। বসুন। আমি আপনার জন্য চা আনছি।’
‘আরে না থাক। এতো কষ্ট করতে হবে না। আপনি যে কে এখনও বললেন না?’
‘কয়েকদিন পর আকবর আঙ্কেলের ভাই আজাদ আঙ্কেলের সাথে আপুর বিয়ে।’
‘ওহ্, আপনি এঁদের আঙ্কেল কেন বলছেন?’
মেয়েটি হাসল, ‘ওঁদের বয়স হয়েছে তাই।’
‘ওহ্, তা আপনার নামটা যেন কী?’
‘সাবিলা।’
‘নাইস।’ আমি মূল কথায় এলাম, ‘আচ্ছা, আকবর সাহেব কেন সুইসাইড করেছেন এই ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন?’
কথাটি বলার পর নীলশার্ট পরা পাশে থাকা একটি ছেলে ভ্রূ কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকালো। তার বয়স আনুমানিক আমার আন্দাজেরই হবে। আমার সামনে এসে সে জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার, কে আপনি?’
আমি উত্তর দিতে যাব, আরেকটি ছেলে এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। উত্তর আর দিতে হলো না।
সাবিলা হেসে আমার প্রশ্নটির উত্তর দিলো, ‘আমি তো সবকিছুই জানি।’
কেমন এক রহস্যময় হাসি হাসছে সে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’
‘আরে না। আমি তো মজা করছিলাম। দেখছিলাম আপনাকে, কেমন প্রতিক্রিয়া দেন। আর তিনি কেন সুইসাইড করেছেন, তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, তাঁর মৃত্যুর আগে কী কী হয়েছিল তা আপনাকে বলে কিছুটা হেল্প করতে পারি।’
‘তাহলে বলুন।’
‘এখানের পরিবেশ ঠিক নেই। চলুন, বাইরে চলুন।’
‘ওকে, চলুন।’
আমরা আকবর সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের বাগানের দিকে হাঁটতে লাগলাম। শুরুতেই পুলিশদের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা শোভা পায় না। তাই গড়গড় করে তাকে বলতে লাগলাম, ‘আমি আবির মেহবুব। এইমাত্র পড়াশুনা শেষ করে গ্রামের বাড়ি বেড়িয়ে এলাম। মেজ ভাইয়ের সাথে এতদিন শহরে থেকে পড়াশুনা চালিয়েছি। সে আরিয়ান, দেশে পুলিশের চাকরি করে। ভাবী আর আমাকে নিয়েই থাকে। আর আমি বেকার। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করি। মেজ আমার চেয়ে স্রেফ দুই বছরের বড়। কাজেই আমরা অনেক বন্ধুশুলভ। ভাইয়ারা বিয়ে করে ফেলেছে। এখন আমাকেও জোর করা হচ্ছে। তবে আমি এখন কাউকে বিয়ে করব না। আমার কাছে ভ্রমণ অনেক প্রিয়। আমি আমার পুরো যৌবনকাল এই অভ্যাস নিয়েই লিপ্ত থাকতে চাই। ভাইয়ার কারণেই গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছে। ও বলল, ওদের সিনিয়র অফিসার মি.জাকির এখানে চলে এসেছেন। এখন থেকে তাঁর আন্ডারে তাকে কাজ করতে হবে। তিনি যেহেতু এসেছেন, সেহেতু কাজের চাপও বেড়ে যাবে। যেকোনো সময় তার কাঁধে কেস এসে পড়বে। তিনি ভাইয়াকে অনেক বিশ্বাস করেন। বলল, আমি যাতে তাড়াতাড়ি চলে আসি। তাই চলে আসা। আসলে আমারও ভালো লাগে ওর সাথে ইনভেস্টিগেশন করতে। যতবারই কোনো বড় কেস এসে পড়ে ভাইয়া আমাকেও সঙ্গী করে নেয়। এইবারও বিপরীত হয়নি। কেস পড়তেই আমি ওর সাথে বেরিয়েছি। আমার কথা তো অনেক বললাম। তো কাল কী কী হয়েছিল?’
‘আমরা কাল সকালে এখানে একটা ফাংশনে এসেছিলাম।’
ওকে থামালাম, ‘কিসের ফাংশন?’
‘কাল রাত বারোটায় এখানে একটা বার্থডে পার্টি হয়েছিল। আকবর আঙ্কেলের মেয়ের।’
‘মেয়ে? তিনি কি আজাদ সাহেবের আগে বিয়ে করে ফেলেছিলেন?’
‘না, সে তাঁর পালিত মেয়ে, ইভা। লাশের পাশে এতক্ষণ বসে ছিল সে।’
‘একটা প্রশ্ন করি? তাঁদের এতো বয়স হয়েছে। তাঁরা বিয়ে করেননি কেন?’
‘আমি আপুর কাছে শুনেছি, তাঁরা কাজের চাপে সময় পাননি।’
‘ওহ্, লাশকে জড়িয়ে ধরে যিনি কাঁদছিলেন, তিনি কে?’
‘তিনিই আজাদ আঙ্কেল।’
‘ওহ্, তারপর বলুন।’
‘আমি ইভাকে দেখছিলাম, কাকে যেন খুঁজছিল। সম্ভবত আকবর আঙ্কেলকে। শুরুতে আমি তাঁকে একটু করে দেখেছিলাম। খেয়াল করেছিলাম, এরপর থেকে পার্টিতে আকবর আঙ্কেলকে একটুও দেখা যায়নি। এমনকি এরপর থেকে নিয়ে আর দেখিওনি। এরপর..সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনলাম।’
‘দুঃখিত, তো আপনারা রাত কয়টা পর্যন্ত জেগে ছিলেন?’
‘এইতো, বারোটা থেকে নিয়ে একটা পর্যন্ত বার্থডে সেলিব্রেট করে শুয়ে পড়েছিলাম।’
‘তাহলে আপনি বারোটায় আকবর সাহেবকে দেখেছেন। এরপর তাঁকে আর দেখেননি। রাত দুইটায় তাঁকে রাস্তায় পাওয়া যায়। তাহলে শেষবার কি আপনি তাঁকে কারো সাথে দেখেছিলেন?’
‘খেয়াল করিনি।’
‘একটার দিকে কি সবাই শুয়ে পড়েছিল? কেউ কি বাসা থেকে বের হয়নি?’
‘কেউই বের হয়নি।’
হতাশ হলাম আমি।
‘তবে একজন ঢুকেছিল।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কে?’
‘এই যে, একটু আগে একটা ছেলে আপনার সামনে এসেছিলেন, নীলশার্ট গায়ে। তাকেই দেখেছিলাম।’
‘আগে দেখেননি তাকে?’
‘না। হয়তো কারো রিলেটিভ। পার্টিতে এসেছেন।’
‘কয়টায় দেখেছেন তাকে?’
‘রাত ১:২০ কী ১:২৫ হবে।’
‘রাত একটায় সবাই শুয়ে পড়েছিল বললেন। তাহলে রাত ১:২০ -এ আপনি কেন জাগছিলেন?’
‘আসলে আমার কাছে এখানে সহজেই ঘুম আসে না। আমি জানালার পাশে এসে বসছিলাম। তখনই তাঁকে এদিক দিয়ে বাসায় ঢুকতে দেখেছিলাম।’
‘আপনার রুম কোথায়?’
আকবর সাহেবের বাসার উপরের তলার একটা জানালার দিকে আঙ্গুল তাক করল সাবিলা, ‘কালরাত আমি আর আমার আপু ঐ রুমটায় শুয়েছিলাম।’
রুমটার জানালা এখান থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। ঐ জানালা দিয়ে এই বাগানটাও স্পষ্ট দেখা যাবে। ও হয়তো মিথ্যা বলছে না।
‘ওহ্, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এসব বলার জন্য।’
কথা শেষ না হতেই গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো। পুলিশরা গাড়ি করে আসছে। ওদের আগে কোনোদিকে যেতে দেখিনি। হয়তো এতক্ষণ তারা ছিল না। ভাইয়া এসে বলল, ‘তোকে আমি সেই কখন থেকে খুঁজছি। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
সাবিলার দিকে ইশারা করলাম, ‘ওর সাথে কথা বলছিলাম।’
(চলবে..!)
লেখা: ফারিয়া কাউছার