#পরিপূর্ণতা
#৪র্থ_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী
মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে আশঙ্কামুক্ত হয় অহনা। তবে এক্সিডেন্টের ফলে তার এক পায়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আপাতত কিছু দিন ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারবে না অহনা। অহনা চোখ মেলার পর সবার আগে মুক্তকে দেখতে পায়। মুক্ত অহনার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অহনা ভয়ে ঢোক গেলে। মুক্ত কোন কথা না বলে চলে যায়। অহিমা বেগম অহনার কাছে এসে বলেন, তুই কিভাবে এটা করতে পারলি অহনা? হ্যাঁ মানছি, অনেক সময় আমি তোর বাবার রাগ তোর উপর মিটাই। তার মানে এই নয় যে, আমি তোকে ভালো বাসি না। মায়ের ভালোবাসা তুই বুঝিস না। তুই কেন এমম একটা কাজ করলি? জানিস না আত্ম*হ*ত্যা মহাপাপ।
অহনা কিছু না বলে চুপ থাকে। মুক্ত আদিলকে নিয়ে টানতে টানতে অহনার সামনে এনে দাঁড় করায়। আদিলকে ইশারায় কিছু বলতে বলে।
আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি অহনা। আমার জন্য আজ তোমার এই অবস্থা। তুমি যা চাও তাই হবে। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমায় খুব ভালোবাসো। আমি ঐ মেয়েটার সাথে ব্রেকআপ করে নেবো। তারপর তোমাকে বিয়ে করব।
অহনা খুব খুশি হয় আদিলের কথা শুনে। সে তো এটাই চেয়েছিল। আদিলকে অনেক ভালোবাসে অহনা। অবশেষে তার ভালোবাসা বুঝতে পারল আদিল।
অন্যদিকে মুক্তর বুক চি*রে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। সেই ছোটবেলা থেকে অহনাকে পছন্দ করে মুক্ত। কিন্তু অহনা কখনো তাকে ভাই ছাড়া অন্য নজরে দেখে নি। ছোটবেলায় একবার তাদের নানু যখন বলেছিল তখন অহনা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল সে তার মতো হ্যাবলা টাইপ ছেলে বিয়ে করবে না। সেই কথা শুনে রেগে গিয়েছিল মুক্ত। তখন থেকে নিজেকে অনেক চেঞ্জ করেছে। এখন একদম স্মার্ট হয়ে গেছে। সবকিছু করেছে শুধুমাত্র অহনার জন্য। কিন্তু এতকিছু করেও অহনার মন পায়নি। সেদিন অহনার শাড়ি মুক্তই ঠিক করে দিয়েছিল এবং ইচ্ছে করেই অন্য একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিয়েছিল যাতে অহনা জেলাস হয়। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি।
সবকিছু ঠিক ছিল। কিন্তু মুক্ত যখন অহনার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে এখানে এলো এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে জানতে পারল একটি ছেলের কথায় অহনা এমন করেছে তখন মুক্ত বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। অহনাকে পাবার আশা একেবারের জন্য ছেড়ে দিল।
অহনার বাড়িতে গিয়ে তার ডায়েরি পড়ে আদিলের ব্যাপারে সব জানতে পারে মুক্ত। আদিলকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসে অহনার কাছে। তাকে অনেক টাকা দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে বলে, তুমি অহনাকে গিয়ে বলবে তুমি ওকে ভালোবাসো এবং ওকে বিয়ে করতে চাও।
আদিল টাকার লোভে ও ভয় পেয়ে রাজি হয়ে যায় মুক্তর কথায়। মুক্ত এসব ভেবেই নিজেকে নিয়ে নিজেই ঠাট্টা করে।
কত বোকা আমি। যাকে ভালোবাসি তাকেই কিনা অন্য একজনের হাতে তুলে দিচ্ছি টাকার বিনিময়ে। কিন্তু কি করব আমি? অহনা যে আমাকে ভালোবাসে না। আমি জোর করে ওর ভালোবাসা চাই না। জোর করে ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা মন থেকে আসে। কিছু প্রিয় জিনিস থাকুক না অন্যকারো হয়ে, তবুও যেন তারা ভালো থাকে।
এই আশা নিয়েই আদিলের সাথে অহনার মিল করার ব্যবস্থা করেছে মুক্ত। তার কাছে অহনার সুখই মূল ব্যাপার। যদি অন্য কারো সাথে অহনা সুখী হতে পারে তাহলে তাতেও খুশি মুক্ত।
এদিকে আদিলের কথা শুনে অহনার খুশির শেষ নেই। সে পারলে এখনই নাচ শুরু করে দেবে। শরীরের সব ব্যাথা ভুলে খুশি গদোগদো হয়ে আদিলকে অহনা বলে, তুমি সত্য বলছ তো? আমাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?
হ্যাঁ। আমি তাই বলছি।
অহিমা বেগম অসহায় চোখে মুক্তর দিকে তাকান। অহনা মুক্তর মনের কথা না বুঝলেও অহিমা বেগম ঠিকই বোঝেন।
অহনা যখন আদিলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল তখন অহিমা বেগম মুক্তকে টেনে নিয়ে যান বাইরে। বলেন,
তুই এসব কি বলছিস মুক্ত? আর কেউ না জানুক আমি তো জানি তুই অহনাকে কতোটা ভালোবাসিস। সেই ছোটকাল থেকে অহনার প্রতি তোর ভালোবাসা। নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারো সাথে মেনে নিতে পারবি তুই?
কেন পারবোনা খালামনি? অহনার সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। প্রয়োজনে নিজের জীবনও আমি অহনার জন্য ত্যাগ করতে পারি। সেখানে এটা তো কিছু নয়।
নিজের জীবন দিয়ে দেওয়া আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়া এক ব্যাপার নয় মুক্ত। তুই ভালো করে ভেবে দেখ।
আর কিছু ভাবার নেই খালামনি। অহনা যখন আদিলের জন্য নিজের জীবন দিতে পারে তারমানে বোঝা যাচ্ছে ও কতোটা ভালোবাসে আদিলকে। তুমি আমার কথা না ভেবে নিজের মেয়ের সুখের কথা ভাবো। এখান থেকে ফিরে বিয়ের প্রস্তুতি করে নাও। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিয়ে দেব।
তুই যে অহনাকে ছাড়া পরিপূর্ণতা পাবি না মুক্ত।
আমি না পাই নাই। অহনা তো তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে পরিপূর্ণতা পাবে। আমি তাতেই খুশি। যাইহোক চলো এখন। বিয়ের আয়োজন করতে হবে। আদিলের পরিবার কাল আসবে তোমার বাড়িতে বিয়ের কথা পাকা করতে। তুমি আর দাদি মিলে সব সামলে নিও।
অহিমা বেগম আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেন না। মুক্তকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে থাকেন। মুক্তর জন্য তার বুক ফে*টে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন মুক্ত কতটা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছে।
খালামনি এভাবে কেঁদোনা। আমি একদম ঠিক আছি। এই দেখ আমি হাসছি আর তুমি কিনা কাঁদছ। চলো তো এখন।
মুক্ত অহিমা বেগমকে নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। বাড়িতে ফিরে অবাক হয়ে যায় অহিমা বেগম। আজ অনেকদিন পর তার স্বামী ফিরে এসেছে বাড়িতে।
অহিমা বেগমকে দেখে ছুটে আসেন তার স্বামী সিরাজুল ইসলাম। দৌড়ে এসে অহিমা বেগমের হাত ধরে বলেন, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও অহি। আমি তোমাকে বুঝতে না পেরে ভুল করে ফেলেছিলাম। তুমি আমার জন্য সবসময় সেরা ছিলে। কিন্তু আমি অন্য একজনের মায়ায় পড়ে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।
এতদিন পর আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কিন্তু এখন যে খুব দেরি হয়ে গেছে। আপনার প্রতি আমার যত অনুভূতি ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। একসময় যে আপনাকে ভালোবেসেছিলাম এটা ভাবতেও আমার এখন নিজের প্রতি রাগ হয়। কারণ আপনি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নন। এখনই চলে যান আমার সামনে থেকে।
সিরাজুল ইসলাম অহিমা বেগমের পায়ের কাছে বসে পড়ে। অহিমা বেগম দূরে সরে গিয়ে বলেন, আমাকে আর পাপের ভাগিদার করবেন না। এমনি আপনার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছি। দয়া করে চলে যান।
অহনার দাদি ছুটে এসে বলেন, আর ছাওয়াল ভুল করছিল। এহন তো মাফ চায়। ওরে মাফ করন যায়না।
যারা ভুল করে তাদের ক্ষমা করা যায় আম্মা। কিন্তু অপরাধীদের ক্ষমা করা যায়না।
এত ডাট ভালা না বৌ।
কথাটা অহনার দাদি নিজের ছেলেকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। অহিমা বেগম নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন।
মুক্ত তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে, এখন আপনারা যাচ্ছেন কোথায়? বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
অহনার দাদি জানতে চায়, কার বিয়া?
অহনার।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, অহনা মানে আমার মেয়ের বিয়ে।
ও আপনার মেয়ে নয়। অহনা শুধু আমার মেয়ে। ওর বিয়ের ব্যবস্থাও আমি একাই করতে পারব।
কথাটা বলে অহিমা বেগম নিজের ঘরে চলে যান।
#চলবে