#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০
গল্পের নাম : পরিতৃপ্তি
লেখকের নাম : মুজিবা সামিহাত
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক
সময়টা ছিলো বর্ষার একটি ম্রিয়মান বিকেল। এ সময় আকাশে মেঘ জমে ছিল। মনে হচ্ছিল সারা আকাশে মেঘের রাজ সমারোহ। পৃথিবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বৃষ্টি। সারাদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েছিল। তবে, বিকেলে থেমে গেল বৃষ্টি। তা আমার জন্য খুব ভালোই হয়েছে। আজ সারাদিনই দোলনায় বসে পা দোলানো হয়নি। আমি ঝটপট রান্নাঘরে গিয়ে এক মগ চা বানিয়ে নিলাম। চা আমার এককাপ হলে চলে না। একমগ চা না খেলে চায়ের তৃপ্তি পাইও না। তার উপর আজ আরো দগ্ধ বৃষ্টি। এই সময়টাতে তো চায়ের মজা আরো জমবে।
আমি বারান্দার পাশে রাখা দোলনায় গিয়ে বসলাম। একহাতে একটি বই অপর হাতে চায়ের মগ। এই সময় আকাশ দেখা খুবই আনন্দের। আকাশের মেঘগুলো একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দৌড়ে বেড়ায়। কিছুটা অন্ধকার হয় আবার কিছুটা আলোয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইয়ে মনোযোগ দিলাম। কখন যে আমার পাশে রুসাইফ ভাই এসে দাঁড়িয়েছে নিজেও জানি না। চা যখন শেষ হলো, মগটা রাখতে গিয়েই দেখলাম। দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবেই চলেছে। আমি সচরাচর সব বড় ভাইদের ভয় করি। তাদের সামনে যাই না। তেমন কথা বলি না। আমি তাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে চলে যাচ্ছিলাম।
“শুন মাইরা! কাল মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিবি। কেমন?”
আমার চলে যাওয়া দেখেই রুসাইফ ভাই বলে উঠলেন।
“কেন? আপনি কি আমাদের মাদ্রাসায় জয়েন হবেন নাকি?”
“তোকে এত কথা বলতে হবে কেন? ডেকে নিতে বলেছি নিবি। ব্যাস।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” রুসাইফ ভাইয়ের কটমট উত্তর দেখে বিরক্তি নিয়ে আমি বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।
ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশটা কালচে রং ধারণ করে আছে। রুসাইফ হাঁটছে আপন মনে। বৃষ্টির পানিতে ভিজেও যাচ্ছে। তবুও, এসবে তার কোনো খেয়াল নেই। সে ভাবছে আগামী দিনের পথচলার কথা। তখন আর এভাবে এলোমেলো হয়ে একা একা হাঁটা যাবে না। পাশে থাকবে তার মনের অপরূপা। নীল শাড়িতে তাকে বেশ লাগবে। খোলা চুলে থাকবে না। খোলা চুল রুসাইফের পছন্দ না। সে থাকবে হিজাব পরিহিতা। মুখটা একদম গোলগাল লাগবে। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হবে। ইশ! ভাবতেই কেমন যেন অনুভুতি হয়। ভাবতে ভাবতে রুসাইফ বাসায় এসে পৌঁছালো। কলিং বেল বাজাতেই রুমা দরজা খোলে দিল। রুমা হচ্ছে রুসাইফের ছোট বোন। রুসাইফের ভাষায় সে একটা দাজ্জাল রাণী। রুমা রুসাইফের অবস্থা দেখে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠে—
“বাহ্ বাহ্ বাহ্! রাজপুত্তুর কী সুন্দর করে ভিজে এসেছে। সকাল সকাল তো একগাদা কাপড় পরিস্কার করলাম। তা এখনের গুলো কে করবে শুনি? কাজের মেয়ে পেয়েছেন আমাকে? হ্যাঁ!
চুপ করে আছেন কেন? উত্তর দেন।”
“আরে আজব তো! বাহির থেকে আসলাম। ভাইটা ক্লান্ত হয়ে আসল। আর তারে বসতে দিবি, রেস্ট করতে বলবি, ফ্রেশ হতে বলবি, তা না করেই উল্টো বকছিস?”
“বয়ে গেছে আমার। মা পুত্রের যা যা ইচ্ছা কর। আমি এর মধ্যে নাই বাবা।”
“করবই তো আপু।”
“একদম আপু বলবি না, যা ভেতরে যা।”
“আমার মিষ্টি আপুটা।” রুসাইফ আদরের সুরে কথাটি বলে দৌড় দিল।
আর রুমা বড় ভাইয়ের আচরণ দেখে হেসেই যাচ্ছে।
রুসাইফের পরিবারে বাবা নেই। মা, রুসাইফ আর রুমা মিলে তাদের ছোট্ট একটি সুখী পরিবার।
সকালের রোদ্দুর চোখে পড়তেই হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। উফ্ আজ নামাজটাও বাদ গেল। কী যে শয়তানের পাল্লায় পড়লাম কে জানে! রাতে ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে রোদের ঝলকানি উপচে পড়ছে। ধানের শিষ গুলো কতই না মুগ্ধকর দেখাচ্ছে। সবুজ সবুজ রূপে সজ্জিত যেন এক সবুজে ঘেরা রূপমহল। তাতে যে বৃষ্টি বিন্দু জড়িয়ে আছে, তা যেন এক একেকটি মুক্তার পাথর।
প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে গেলে মাথার মগজগুলোই পানি হয়ে যাবে আমার। সবকিছুর ভাবনা একপাশে রেখে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। দেখছি আম্মু নাস্তা রেডি করছে। তাই চুপচাপ গিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। দেরি করা চলবে না আজ। রুসাইফ ভাইকেও ডাকতে যেতে হবে। আরেক ঝামেলা।
“কী রে কী ভাবিস এত?”
“মা তাড়াতাড়ি দাও। আমি খেতে খেতে টিফিন বক্সটাও রেডি করে দাও। আজ সকাল সকাল যেতে হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি রেডি করছি।
আমি আম্মুর গাল টেনে দিয়ে বললাম-
” ভালো আম্মুটা আমার।”
“হুম আর ঢং করতে হবে না আপনার।”
এই বলে আম্মু টিফিন রেডি করতে চলে গেল।
আর আমি খাচ্ছি আর ভাবছি, আমার মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা। অবশ্য পৃথিবীর সব মা’ই ভালো হয়। আমার মা সবার থেকে আলাদা। ভালোবাসে অনেক বেশিই। পৃথিবীতে মা নামক প্রাণীটা না থাকলে বুঝাই যেত না নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কাকে বলে!
ভালোবাসার চাদরে সবসময় আগলে থাকুক পৃথিবীর সকল মা’ই। মা-রাই সবসময় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে তাদের সন্তানদের। কিন্তু আজকাল বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রম নামে এক কীটনাশক সংস্থার প্রচলন আছে। যেখানে বৃদ্ধ বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তান রেখে আসে। আহ! তাদের বেদনাহত চেহারা দেখলেই চোখ জ্বলে পানি আসে। জ্বলতে থাকে চোখগুলো। ভাবতে থাকে মন, কীভাবে বাবা-মাকে আলাদা করে রাখতে পারে সন্তান। এখানে সবাই প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু সন্তানই এসব কর্মকাণ্ড করে। যাদে নূন্যতম মায়াবোধ আর দয়া নেই। তারা এককথায় আমার ভাষায় বিবেকহীন, অভদ্র সম্প্রদায়। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে পানি এসে গেছে টেরও পাইনি।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল-
” কীরে কান্না করছিস কেন?”
আমি মাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে বললাম-
“মা আমি কোনোদিনও তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। ভাইয়া যদিও তোমাকে ছেড়ে দেয়, তাহলে তুমি আমার সাথে থাকবা। কেমন?”
” আরে পাগলী মেয়ে আমার। আচ্ছা থাকবো সারাজীবন তোর সাথে। এবার কান্নাকাটি থামিয়ে ড্রেস পড়ে আয়। তোর না আবার রুসাইফকে ডাকতে যাওয়ার কথা?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ভুলেই গেছিলাম। ”
এই বলে রুমে এসে তাড়াতাড়ি ড্রেসটা পড়ে উপরে কালো বোরকাটা জড়িয়ে নিলাম। ছোট স্কার্ফটা মাথায় ঘুরিয়ে পেচিয়ে বেঁধে নিকাবটা পড়ে নিলাম। ব্যাস রেডি!
টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে।
দিগন্ত মাঠ পেরিয়ে বাতাসের হাওয়া খেতে খেতে আপন মনে এসে দাঁড়ালাম রুসাইফ ভাইয়ের বাসার সামনে।
” রুমা আপু, ও রুমা আপু শুনছ?
ভাইয়াকে একটু ডেকে দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পিছন থেকে রুমা আপু এসেই কান টেনে দিল। আর বলল-
“ফাজিল, এতক্ষণ পরে তোর আসার সময় হলো? ওই যে আসতেছে। তুই হাঁটা ধর। যাহ।”
“বুঝনা কেন তুমি? একটু আরাম করে করে আসি আরকি। হিহিহিহি। ” বলেই দৌড় দিলাম। না হলে আবারো কানটানা খেতে হতো।
” দুষ্টু একটা।” রুমা আপু এই বলে চলে গেল বাসার ভেতরে।
দিঘির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি আর রুসাইফ ভাই। দিঘির স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে। এ দৃশ্য মুগ্ধকর।
কবিরা বলে না, হে মেঘ! কাছে এসে ছুঁয়ে দাও আমায়। কিন্তু আমি তা বলব না। আমি বলবো, হে দিঘির স্বচ্ছ জল! কাছে এসে ছুঁয়ে দাও আমায়। আমি তোমার জলে আমার শরীর মিশাবো। মিতালি গড়বো তোমার সাথে।
” মাইরা! দেখেছ দিঘিটা কত সুন্দর লাগছে। সারা গায়ে যেন নীলের ছোঁয়া। অপরূপে ভরা। ”
রুসাইফ ভাইয়ের আচমকা দিঘির বর্ণনা দেখে আমি থেমে গেলাম।
“কি হলো? থেমে গেলে যে?”
আমি আবার চলতে চলতে বললাম-
“দিঘির গায়ে যদি সবুজের বিচরণ থাকতো তবে তার সৌন্দর্য আরো বাড়তো।”
” মাইরা তুমি সত্যিই অন্যরকম। যেখানে সব মানুষের নীল পছন্দ। সেখানে তুমি সবুজ রঙের সৌরভ খোঁজে বেড়াও!”
হঠাৎ করে রুসাইফ ভাইয়ের তুমি করে বলাটা কেমন যেন লাগলো আমার। কেমন জানি লজ্জাও পাচ্ছিলাম এভাবে পাশাপাশি হেঁটে যেতে। হঠাৎ রুসাইফ ভাই আমার বাম হাতটা ধরলেন। আমি মুহুর্তের জন্য কেঁপে উঠলাম। অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। আমি কিছু বলার আগেই রুসাইফ ভাই বলতে শুরু করলেন-
“জীবন আমাদের অদ্ভুত মাইরা। আমরা একান্ত ভাবে যা চাই তা পাই। জানো, তার জন্য অনেক ধৈর্য লাগে। তুমি যখন বড় হয়েছ তখন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগে। তোমার প্রতিটি কর্মকাণ্ড দেখে আমি প্রতিনিয়তই অবাক হয়। আম্মুকে তোমার কথা বলি। পরে আম্মু তোমার আম্মু আর ভাইয়াকে বলে। আমাদের বিয়েটা আগামী শুক্রবারেই হবে। তোমাকে কিছুই জানানো হয়নি। কারণ তুমি এখনো অবুঝ। বিভিন্ন ধারণা তোমার মাথায় এখন। তাই আমিই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার। মাইরা! আমাকে কি তোমার পছন্দ নয়?”
আমি এতক্ষণ শুনছিলাম রুসাইফ ভাইয়ের কথাগুলো। মনে হচ্ছিল এখনো স্বপ্নের মাঝে আছি। এ স্বপ্ন যেন যেই সেই স্বপ্ন নয়। এখানে আছে একটা রূপদেশ। যেখানে দাড়িয়ে রাজকুমার তার প্রেয়সীকে অনুভব করেই তার মায়াভরা কন্ঠে বলে যাচ্ছে ভালোলাগার পরশ।
এখানে হৃদয়ের ঝরা পালকগুলো শিহরিত হচ্ছে বারবার।
” এই মাইরা! কোথায় হারালে?”
” না না। ঠিক আছি। আমার কেমন কেমন যেন লাগছে রুসাইফ ভাই।”
“ভাই ডাকা লাগবে না আর। ভালোবাসবা খুব। সকল অনুভূতি শেয়ার করবা। ভালোবেসেই একটা নাম দিবা। কেমন?”
” দেরি হয়ে গেছে। হয়তো ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে আমার।”
“কিছুই হবে না। চলো আজ ঘুরে আসি!”
“হুম। ”
আমরা দু’জনে মুঠোবন্দী হাতে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছি ঘাসপাতার উপর পা ফেলে। হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। কৃষ্ণচূড়ার সৌরভ ভেসে আসছে রহিম চাচার পুকুর পাড় থেকে।
একজোড়া কোকিল পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কুহু কুহু আওয়াজে গানের সুর তোলে।
আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন রুসাইফ।
আমিও একদম আষ্টেপৃষ্ঠে ঝড়িয়ে নিলাম হাতটাকে। কাঁধের উপর মাথা রাখলাম। এ যেন অপরিসীম এক পরিতৃপ্তি।
জীবনের আলো এসেছে। মনের পরিতৃপ্তি জমা হয়েছে। প্রজাপতির ডানার সৌন্দর্য অবলোকন করে আমরা হাঁটছি। দু’জনের চোখে চোখ রেখে হাসছি মাঝেমাঝে। আকাশটাও আজ লজ্জা পাচ্ছে আমার আর রুসাইফের পরিতৃপ্তি অনুভব করে।
আমি গুনগুনিয়ে বলে উঠলাম-
হে আকাশ! আমি তোমার মত করে আমার রুসাইফের ভালোবাসা পেতে চাই।
” হে আকাশ! তুমি জানিয়ে দাও, আমার প্রিয়তমাকে ভালোবাসার জন্য আমি তোমার চেয়ে প্রচেষ্টায় আছি। তুমি নিশ্চিন্তে তাকে আমার বাহুডোরে আসতে বল।”
নিঃশব্দে দু’জনের কপাল এক করলাম।
চোখ বুঝলাম। হারিয়ে গেলাম আবার সেই পঙ্কিলতার দেশে। উড়ন্ত শালিকের বেসে উড়ে বেড়াচ্ছি। দেখছি দু’জনে পরস্পরের মনের আকাশ। পরিতৃপ্তির আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো দেহমনে। আলোকময় হয়ে উঠছে আঁখিযোগল। ঠোঁটে অস্ফুট হাসি।
মৃদুস্বরে রুসাইফ গেয়ে উঠলো-
ভালোবাসা নয় তোমার জন্যে
শুধু আজকের দিনে,
ভালোবাসায় তুমি মিশে আছ
মিশে রবে প্রতিক্ষণে।
আমার মাঝে অন্য রঙে
মন বলছে তাই তোমাকে…..
তুমি ভালোবাসার এক অন্য জগৎ
প্রতিটা বেলায় ভালোবাসার দিবস,
হাসিতে কত সুর বাজে মনে
এতটুকুই বুঝি ভালোবাসার মানে…।