পরিচয় কলমে:সুমাইয়া মীম

0
645

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগীতা_আগষ্ট_২০২০
শিরোনাম :পরিচয়
কলমে:সুমাইয়া মীম
ক্যাটাগরী:কষ্টের গল্প

জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক টা কম থাকে।যা হাড়ে হাড়ে টের পায় শীতের সকালের কর্মব্যস্ত মানুষগুলো।মাঝে মাঝে ২ একটা গাড়ির আওয়াজ রাস্তায়।প্রায় জনমানব শূন্য।শাল,জ্যাকেট,সোয়েটার এর আড়ালেও মানুষ কে কাঁপিয়ে তুলছে হিম শীতল অবাধ্য বায়ু।

এই মানুষগুলোর মধ্যে মীম একজন।যাকে এই শীতের সকাল কে তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে প্রাইভেট এর পথে।একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি চেঞ্জ করতে হয়।এক গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে অপেক্ষা করতে হয় অন্য গাড়ির।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মীম একটা গাড়ি ও তার বন্ধু খুশির।কুয়াশা ঢাকা প্রকৃতি আর জনমানবহীন রাস্তা-পথ কেমন যেন লাগছে তার।
বারবার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে চাইছে।আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।যেতে গাড়িতে লাগবে তো ৫ মিনিট।গাড়ি পেলে তবেই তো রওনা দিবে।

অপেক্ষা শব্দটা বিরক্তিকর একটা অভিজ্ঞতা।যা সবারই তিতা লাগে।অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে একটা অটো গাড়ির হর্ণ শোনার জন্য।
হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখে আর মিটমিট হাসে কারণ ঘড়িটা তার প্রিয় ছোট মামুর কিনে দেওয়া।এই ঘড়িটা নিয়েও গল্প আছে,
যেদিন সে এক্সিডেন্ট করেছিল।হাসপাতাল এর বেডে অজ্ঞান অবস্থায় যখন খবর পেয়ে ছোট মামা ছুটে যান, দেখেন হাতে,পায়ে,মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো মেয়েটা অচেতন।প্রায় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দেহটার হাত ঘড়িটা থেমে যায়নি টিকটিক চলছিলো সেটা তার নিজের নিয়মে।
এক্সিডেন্ট! উফ্ আর মনে করতে চায় না মীম।কেমন ছিল এক্সিডেন্ট এর পরের দিনগুলো।X-ray,ঔষধ,ডাক্তার,ফিজিওথেরাপি,ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি কি দূর্বিষহ ছিল।ফুটন্ত মোমের মতো “ওয়াজবার” এর কি যে জ্বালা!

ঘড়ির দিকে বারবার চাওয়া শুধু সময় দেখাই নয়।মামার ভালোবাসা দেখা।নওগাঁ শহরে কোন এক কাজ থেকে আসার সময় ঘড়িটা এনেছিলেন মামা।ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। ঘুম থেকে টেনে তুলে হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,”পিচ্চু তোর পিংক কালার ঘড়ি।”কি সব পাগলামি।
কারোর গলার আওয়াজে চমকে সামনে তাকায় মীম।রাস্তার অপরপাশে ঠিক তার সামনেই দাড়িয়ে আছে একটা লোক।লোকটার বয়স অনুমান করে অবাক হয় মীম।তার বাবার থেকেও বেশি বয়সী একটা লোকের দৃষ্টিতে এতটা নোংরামি থাকতে পারে কি করে।আর কেনই বা পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে?

অটোগাড়ির হর্ণ এর শব্দে স্বস্তি ফিরে পায় মীম।কিন্তু সমস্যা হলো গাড়ি আসছে দুইটা। কোন গাড়িতে যাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।ভাবতে ভাবতেই গাড়িগুলো কাছাকাছি এসে যায়।
কোথায় যাবেন আপু?
জি, কোর্ট মসজিদ থেকে একটু সামনে যাবো।
আসেন।
সিদ্ধান্ত নিলো অটোভ্যান এ যাবে না অটোগাড়িতেই যাবে।
কিন্তু পেছনের ভ্যানগাড়িতে একটাই লোক ছিলেন।ওনিই বললেন “এটাতে আসো মা”।
মীম থমকে গেলো।এত সুন্দর ডাক উপেক্ষা করে সে কিছুতেই যেতে পারবে না।
ভ্যানগাড়িতেই উঠে বসল সে।

মা ডাকটার বড় সংকট হয়ে গেছে।মানুষ রা ভয়ানক রকমের সভ্য হয়ে গেছে।যেখানে মেয়ের বয়সীদের মা ডাকা উচিৎ সেখানে তারাই নোংরা চোখে তাকায়।

গাড়িতে বসতেই লোকটা নিজের ছালা-বস্তা সরিয়ে জায়গা করে দেয়।
তুমি কি কলেজত পড়েন মা?
জি,আমি কলেজে পড়ি।
হেসে হেসে বললেন,আমার বেটি থাকলে তোমার মতোই কলেজত পড়তো।

হঠাৎ দূর্গন্ধে মীম কিছুটা চমকে। কারণ গন্ধ টা আসছে কোথা থেকে।এত বাজে একটা গন্ধ!
খেয়াল করে দেখে গন্ধ আসছে লোকটার শরীর হতে।
গায়ে ময়লা পুরোনো একটা পাতলা সোয়েটার আর উপরে সেরকমই একটা শাল জড়ানো।
এরকম পোশাক লোকটা গায়ে জড়িয়ে আছে কি করে বুঝে আসেনা মীমের।

আমার বউ নাই মইরা গেছে অনেক দিন হলো।আমার একটা বেটা আর বউমা আছে ওরা ভাত দেয় না আমাক।তুমি আমার বেটি হবে,আমাকে আব্বা বলে ডাকপে?

বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে মীম।এ কেমন খেলা খেলছে বিধাতা তার সাথে।যেখানে সে নিজের পরিচয় ফিরে পাবার জন্য চাতকিনীর ন্যায় চেয়ে থাকে,
সেখানে অপরিচিত একটা লোক তাকে এভাবে আপন চোখে দেখছে!

ডাকপে না আমাকে আব্বা,আমার বাড়িত যাবে?একদিন যাইও।এবার কাম করে টেকা পাইছি মেলা। ল্যাপ বানাই নিছি।ভাবো না শীতের দিন বইলা যাওয়া যাবে না।
তুমি যেদিন যাবে মাছ,গোস্ত সব লিয়া যামু।তুমি রান্না কইরা খিলাবে আমাক,কি পারবে না?

হাতের দিকে চেয়ে বলে, তুমি রাঁনতে পারেন না তাই না?
অবাক হয় মীম।বাহ্ লোকটা জাদুকর নাকি হাত দেখেই অপদার্থ কে চিনে ফেলে!মনে মনে হাসে সে।

আচ্ছা চিন্তা কইরো না আমি শিগিয়ে দিলে পারবে তো।
জি পারবো।
হয়তো যাবে না মীম লোকটার বাসায়।আর কোনদিন দেখাও হবে কিনা তাও জানে না সে।কিন্তু ভুলতে পারবে কি কখনো এই দিন টা,এই পরিচয়?

হয়তোবা পরিচয় এর সঠিক মানে অনেকের ই অজানা। কিন্তু খুব কঠিনভাবে অনুভব করতে পারে পরিচয় এর গুরুত্ব কতটা।জীবনে পরিচয়হীন ভাবে বেড়ে উঠা আর সামনে এগোনোটা বড়ই যন্ত্রণার।যখন সীমিতভাবেও কাওকে পরিচয় দিতে হয় কারোর ক্ষেত্রে সেটা বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার মতোই।যখন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় মানুষের স্বভাবের কাছে তখন মনে হয় আদৌও কি মূল্য আছে এই কাটাছেঁড়া জীবনের?

লোকটার সাথে অনেক গল্প হয় মীমের। গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে শুধু তার একটাই চিন্তা পদার্থবিজ্ঞান প্রাইভেট আছে তার।দেরি হলেই তো স্যার শোনাবে,”মঙ্গল গ্রহ থেকে আসলে বুঝি মীম বুড়ি?”পদার্থবিজ্ঞানের মতো খসখসে একটা সাবজেক্ট এর মতোই এই স্যার টা ও।বুঝেও না যে শীতের সময় গাড়ি পেতে সমস্যা।

গাড়ি থেকে নেমেই ভাড়া দিয়ে দৌড় লাগায় সে।লোকটা বলে দেখেশুনে যাও,দেখে শুনে যাও।যেন সে তার ছোট্ট মেয়েকে রাস্তা পার হওয়ার কথা বলছে।পেছনে তাকানোর আর সময় পায়নি মীম।রুমে প্রবেশ করার পর সবাই তার দিকে চেয়ে আছে যেন এলিয়েন দেখছে।
হঠাৎ মনে হলো লোকটা কে তো বলে আসা হলোনা কিছু।এমনকি লোকটার ভ্যানভাড়া ও তো সে ই দিতে পারতো।কেন মনে ছিল না?ব্যাগ রেখেই স্যার আসছি বলে আবার ছুট লাগালো বাইরে।
বাইরে গিয়ে দেখে গাড়ি অনেক টা দূরে এগিয়ে গেছে আর লোকটা পিছু ফিরে চেয়েই আছে।তাকে দেখে লোকটার মুখে আবারো হাসি ফুটলো।হাত নাড়িয়ে কি যেন বুঝাতে চাইছেন।হয়তো ফিরে যেতে বলছেন।

পিছন থেকে শিক্ষক হাবিবুর রহমান বললেন লোকটা কে মীম?
হয়তো স্টুডেন্ট এর পাগলের মতো ছুটা দেখে তিনি রুমে থাকতে পারেন নি।তিনিও ছুটে বেরিয়ে এসেছেন।

আমার বাবা।
তুমি কি মরিচীকা দেখছ বুড়ি?
শীতল চোখে তাকাল মীম শিক্ষকের মুখ পানে।
মাথায় হাত রেখে বললেন,”চলো তুমি ক্লাস অনেক টা মিস্ করে ফেলেছো,কিন্তু আমারা তোমার জন্য অপেক্ষা করে এতক্ষন গল্প করেছি হাসি মুখে বললেন স্যার।”
মৃদু হাসি ফুটল মীমের ঠোঁট জুড়ে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে