#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৪
নিজের রুমে এনে মৃন্ময়ীকে বিছানায় বসালো অনিরুদ্ধ।মৃন্ময়ী নির্বিকারভাবে বসে আছে। কোনো নড়চড় নেই।অনিরুদ্ধ সামান্য ভয় পেয়ে গেল।
তার ভাষ্যমতে, মৃন্ময়ীকে কোলে তোলার সাথে সাথে লাফালাফি, দাপাদাপি করার কথা।কিন্তু সে কিছুই করেনি।ইভেন এখনো মূর্তির মতো ঠায় বসে আছে।
অনিরুদ্ধ টেবিলের উপর থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে মৃন্ময়ীর মুখের সামনে ধরলো।আস্তে করে বলল,
__’পানিটুকু খেয়ে ফেলো।’
মৃন্ময়ী ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করলো।
অনিরুদ্ধ এবার না হেসে পারলো না।আসলে মৃন্ময়ী তার কাজে প্রচুর শকড হয়েছে।রিয়েক্ট করার ফুরসত পাচ্ছে না।আশ্চর্য! সে তো কিছুই করেনি।
মৃন্ময়ীর সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো সে।
মৃন্ময়ীর বাম হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে নিল।বাম পকেট থেকে ছোট্ট একটা বক্স বের করে তার থেকে একটা হোয়াইট রিং বের করলো।
কোনোরকম দ্বিধা না করে মৃন্ময়ীর অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিল।মুখের সামনে এনে হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো।নরম গলায় বললো,
___’উইল ইউ ম্যারি মি মৃন?
উদ্ধৃত বাক্যটা কানে যেতেই মৃন্ময়ীর ধ্যান ভাঙলো।এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
___’কি?’
__’বলছি যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।তুমি রাজি কি?’
__’কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন?অনিরুদ্ধ ভাই,আপনার মাথা ঠিক নেই।এই মুহূর্তে আপনি একটা সম্মোহনের মধ্যে আছেন।বহুদিন পর আমাকে এরকম অসহায় অবস্থায় দেখে আপনার খারাপ লাগছে।আমার প্রতি করুণা হচ্ছে।অসহায়ের প্রতি দয়া দেখানো,করুনা করা ভালো মনের পরিচয়। কিন্তু যাই করুন সেটা নিজের ভালোটা বজায় রেখে করতে হবে।এমন কিছু করা যাবে না যাতে নিজের জীবন অন্ধকারে পতিত হয়।আমি রুমে যাবো এখন।’
অনিরুদ্ধর প্রচুর রাগ উঠছে।সে মেয়েটাকে কি বলতে চায় আর সে বুঝে কি!বড় করে দম নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
__’দেখো,আমি কি বলছি তা সম্পর্কে খুব ভালো ভাবে ওয়াকিবহাল।তোমার বোঝাতে হবে না।তোমাকে যেটা বলছি সেটা হলো আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।এবং সেটা যতদ্রুত সম্ভব।’
___’আজব,বলছি তো এটা আপনার একপ্রকার সম্মোহন।একটা ঘোরের মধ্যে আছেন আপনি।আর ঘোর কেটে গেলেই সব ভুলে যাই।তাছাড়া আমি কারো করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।’
অনিরুদ্ধর ইচ্ছে হচ্ছে ঠাস করে এক চড় দিতে।এই মেয়ে তো এক লাইন বেশি বোঝে না,পুরোদস্তুর আস্ত মোটাসোটা এক বই বেশি বোঝে!
__’দেখো,মৃন আমার রাগ উঠাবে না একদম।আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি শুনতে পাচ্ছো,আই লাভ ইউ।আমি তোমাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।তোমার শর্ট মাথায় সেটা কোনোদিন ঢুকবে না মনে হয়।এতগুলো বছরে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি।
যদিও এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না।তোমাকে যথেষ্ট সময় দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু বাড়িতে এসে তোমার কষ্ট দেখে আমি আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছি না।তোমার কষ্ট,ঘরবন্দী দশা আমি জাস্ট নিতে পারছি না।সেজন্য তোমাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখবো।একদম আমার অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে।’
মৃন্ময়ীর মাথায় যেনো জ্বলজ্যান্ত আকাশ ভেঙে পড়েছে।সে কি করবে না করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।নিজের অনুভূতির রেশও ধরতে পারছে না।সে অনিরুদ্ধর এই প্রস্তাবে খুশি না বেজার সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না।শুধু এটুকু জানে যে অনিরুদ্ধ তাকে ভালোবাসে এটা শুনে তার হাজারগুণ খুশি হওয়া উচিত। কারণ এই এতগুলো বছরে প্রতিটা সেকেন্ড মানুষটার অভাববোধ করেছে।মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করেছে।
একটু বড় হওয়ার পরে যখন ভালোবাসা শব্দটা বুঝতে শিখেছে,তখনি সবার আগে গোমড়ামুখো অনিরুদ্ধ ভাইয়ের রাগী ফেসটা কল্পনায় ভেসে উঠতো।কত রাত তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে কাটিয়ে দিয়েছে!
সেই মানুষটা তাকে ভালোবাসি বলছে,তাকে বিয়ে করতে চাইছে কিন্তু সে কেন খুশি হতে পারছে না?কোথায় সে বাধা পড়ছে?তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক খোলাসা হওয়া শুরু করলো।নিজের অন্ধকার জীবনের সাথে কাউকে জড়াত৷ চায় না সে।সেখানে অনিরুদ্ধর তো আরো নয়।সে চায় না অনিরুদ্ধর জীবনটা নষ্ট করতে।তার কাঁধে বোঝা হয়ে সারাজীবন থাকতে!
সে তো সামান্য লেখাপড়াটাও জানে না।আর সেখানে অনিরুদ্ধ ভাই বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে।
না,একদম সম্ভব নয়।সে আর অনিরুদ্ধ ভাই,কোনোদিনও সম্ভব না।ছি!এসব মাথায় আনাও যে পাপ।মৃন্ময়ী এক লাফে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত সামনে পা রাখতে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেল।পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নিল।
অনিরুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
__’এতক্ষণ সময় দিলাম ভেবে দেখার জন্য। অথচ তুমি কি করলে?কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যাচ্ছো।যদিও তোমার হ্যাঁ,না এর কোনো পরোয়া করি না আমি!তোমাকে ভালোবাসি মানে তোমাকেই বিয়ে করবো।’
__’অনিরুদ্ধ ভাই!একদম জিদ করবেন না।আমি নিচে যাবো এখন।দয়া করে আমাকে যেতে দিন।আর আপনার রিং আপনার কাছে রাখুন।আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি না।’
মৃন্ময়ী রিংটা খুলতে নিতেই অনিরুদ্ধ হাত চেপে ধরলো।কঠিন গলায় বললো,
___’খবরদার,ওটা হাত থেকে খোলার দুঃসাহস দেখাবে না মৃন।ওটা হাত থেকে খুললে আমি নিজেও জানি না তোমার সাথে কি কি করবো!’
মৃন্ময়ী বুকটা কেঁপে উঠলো ভয়ে।তবুও কন্ঠে যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বলল,
___’অনিরুদ্ধ ভাই,আপনি আমার কেউ না।তাই আমার উপর কোনো ধরনের অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবেন না।শুধুমাত্র আপনাদের বাড়ির আশ্রিতা আমি।সেটা যদি আপনার চক্ষুশূল হয়ে থাকে তাহলে চলে যাবো আমি এ বাড়ি ছেড়ে।’
অনিরুদ্ধ হাত উঠিয়ে মারতে নিতেও শেষ মুহূর্তে নামিয়ে নিল।কিছুক্ষণ মাথা চেপে রাগটাকে কন্ট্রোলে আনলো।তারপর শান্ত গলায় বললো,
___’হ্যাঁ,তুমি ঠিকই বলেছো।তোমার উপর আমার কোনো অধিকার নেই।কি আর করা!তাহলে যখন তোমার প্রতি অধিকার থাকবে তখন তোমার সাথে যা করার ইচ্ছে করবো।চলো, তোমায় রুমে দিয়ে আসি।’
__’আমি একা যেতে পারবো!’
মৃন্ময়ীর কথাকে অগ্রাহ্য করে অনিরুদ্ধ আবারো তাকে কোলে তুলে নিল।মৃন্ময়ী যথাসম্ভব বাঁধা দিয়ে শক্ত গলায় বললো,
__’কি করছেনটা কি?কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?নিচে নামান বলছি!’
__’একা একা আস্তে আস্তে যাবে।সেটাতে কারো নজরে পড়ার সম্ভাবনা আরো বেশি।তার চেয়ে আমি দ্রুতপায়ে রুমে দিয়ে আসি।কারো নজরে পরবে না।(একটু ভেবে) আচ্ছা, তুমি আমাকে আপনি করে বলা শুরু করলে কেন?’
মৃন্ময়ী কোনো উত্তর দিল না।অনিরুদ্ধ সাবধানে দরজার বাইরে উঁকি দিল।ড্রয়িং রুমে নজর বুলালো। নাহ!কেউ নেই।সবাই যার যার রুমে।তারপর সন্তর্পনে সিঁড়িতে পা রাখলো।
অতি সাবধানে ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হলো অনিরুদ্ধ।তাকে অধিকার শিখানো?এই মাহতিম খান অনিরুদ্ধকে অধিকার শেখানো?আজ লিগ্যাল অধিকার আদায় করেই ছাড়বে সে।
পার্কিং লটে গিয়ে গাড়িতে ফ্রন্টসিটে বসাতেই চমকে উঠলো মৃন্ময়ী।ভয়ার্ত গলায় বললো,
__’একি!কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে?’
অনিরুদ্ধ চুপ করে মুচকি একটা হাসি দিল।মৃন্ময়ী এক হাত দিয়ে চারপাশের হাত বুলিয়ে বলল,
___’আমাকে গাড়িতে উঠিয়েছেন কেন?তার মানে আমাকে বাইরে বের করেছেন?কেন?এক্ষুনি নামিয়ে দিন বলছি।আমি কিন্তু চিল্লিয়ে লোক জড়ো করবো।’
__’করো।আই ডোন্ট কেয়ার।যা মন চায় তাই করো। ‘
মৃন্ময়ীর প্রচুর রাগ উঠছে এবার।মানুষ টা যে এতটা পাল্টে গেছে তা বিশ্বাস হতে চায় না।সে টানা হেঁচড়া করলো গাড়ি থেকে নামার জন্য।কিন্তু পারলো না।
অনিরুদ্ধ সিটবেল্ট লাগিয়ে দিল জোর করে।মৃন্ময়ীর গায়ের ওড়নাটা টেনে নিতেই সে ভয়ে জমে গেল।দুচোখ বন্ধ করে জড়ানো গলায় বললো,
__’ও-ও-ওড়না সরাচ্ছেন কেন?দে-দেখুন ভালো হবে না কিন্তু।খবরদার আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।সরে যান,দূরে যান।’
অনিরুদ্ধ শব্দ করেই হেসে উঠলো।মৃন্ময়ীর দিকে একটু ঝুঁকে হাতদুটো ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেললো।জানালা লাগিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।তারপর গাড়ির জানালা লক করে মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো।
মৃন্ময়ীর মুখটা ভয়ে চুপসে গেছে।তাকে সহজ করার জন্য তার গালে হাত রাখলো।
বলল,
__’হুশ।এত ভয় পাচ্ছো কেন মায়াপরী?তোমার সব ভয়, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা যা আছে সব দূর করে দিবো।এক পৃথিবী সুখ এনে তোমার পায়ের নিচে ফেলবো।কোনো ধরনের কষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।খুব শীঘ্রই আমরা নতুন জীবন শুরু করবো।’
মৃন্ময়ী আমতা আমতা করে বলল,
__’মানে?কি বলতে চাইছেন?’
অনিরুদ্ধ মৃদু হাসলো।কিছু না বলে মৃন্ময়ীর বাম গালে একটা চুমু দিল।তারপর দ্রুত সরে এসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো সে।মৃন্ময়ী আবারো মূর্তির মতো বসে আছে।অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
একঘন্টা দশ মিনিটের মাথায় অনিরুদ্ধ গাড়ি থামাল।গাড়ির কাচ নামিয়ে মুখ বের করলো।
আপাতত তার গাড়ি পাঁচতলক বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখ বরাবর দ্বিতীয় তলায় একটা বিশালকার সাইনবোর্ড। তাতে বড় বড় করে লেখা,” কাজী অফিস”।অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো।
(চলবে)