#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৩
মৃন্ময়ী কেঁদে দিল।কয়েক মিনিট টানা হেঁচড়া করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।হঠাৎ একদম শান্ত হয়ে গেল।অস্ফুটস্বরে বলল,
___’অনিরুদ্ধ ভাই! ‘
অনিরুদ্ধ বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। কতগুলো দিন পর আজ তার মায়াপরীর মুখে এই ডাক শুনছে।পরমুহূর্তে বন্ধ চোখ জোড়া আপনাআপনি খুলে গেল।দ্রুত মৃন্ময়ীকে ছেড়ে একটু পিছিয়ে আসলো।একপলক কান্নাসজল চোখে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই একপ্রকার দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার শব্দ কানে আসলেও মৃন্ময়ী সামনে বার বার হাত দিয়ে অনিরুদ্ধকে খুঁজলো।নাম ধরে মৃদুস্বরে ডাকও দিল কয়েকবার।কিন্তু কোনো প্রতিত্তর আসলো না।
অনিরুদ্ধ কিছু না বলেই চলে গেল!এটা যেনো তার কিছুতেই হজম হচ্ছে না।একে তো দুদিন ধরে বাড়ি আসার পরো একটিবার তার সাথে দেখা করেনি।তার উপর আজ ভাগ্যের ফেরে দেখা হলো অথচ সামান্য কুশল বিনিময় করলো না।পাহাড় পরিমাণ অভিমান এসে ভিড় জমালো তার ছোট্ট মনে।
তবে এটা অনিরুদ্ধ ছিল তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ অনিরুদ্ধর প্রতিটা স্পর্শ তার চিরচেনা।এতকাল পরেও তার সেই স্পর্শের কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি!আলতো পায়ে রুমের দিকে পা বাড়াল মৃন্ময়ী।
ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলো অনিরুদ্ধ। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে।টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে সামান্য খেলো।তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
মৃন্ময়ীর নিষ্প্রাণ চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে।অনিরুদ্ধ নিজের শরীরে একবার হাত বুলালো।মৃন্ময়ীর স্পর্শ এখনো লেগে আছে যেনো।তার এলোকেশের সেই গন্ধ এখনো নাকে লাগছে।সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
আজও মৃন্ময়ীর সামনে মুখ খুলতে পারলো না সে।বহু বছর আগে নিজের করা একটা ভুলের জন্য সে মৃন্ময়ীর কাছে অপরাধী। এমনকি অপরাধী নিজের কাছেও।সেই অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির জন্য এতগুলো বছর বিদেশের মাটিতে একাকী কাটিয়ে দিল।মৃন্ময়ীর থেকে একপ্রকার পালিয়ে বেড়ালো।
কিন্তু নিজের অনুভূতির সাথে লড়তে পারেনি সে।পারেনি নিজের ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বেড়াতে।সে হার মেনেছে।হার মেনেই আবার মৃন্ময়ীর কাছে ফিরে এসেছে।
একটা সময় যে ছিল তার অদমিত কিশোর মনের প্রথম ভালোবাসা,প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভূতি,তার ভালোবাসার সব কথার প্রথম অংশীদার; যার নাছোড় মনোভাব আর ছেলেমানুষী কথাবার্তা বাঁচার খোরাক জুগিয়ে যেতো,সেই মেয়ে কিনা এখন নিঃসঙ্গ।তার প্রথম ভালোবাসার মানুষটি তারই বাড়িতে অন্ধকারের ভেতর অতীতের এক অপচ্ছায়া মাত্র।
অনিরুদ্ধর চোখের সামনে ভাসছে মৃন্ময়ীর হাড়ের অনুপ্রভা যা চামড়া ভেদ করে বাইরে বের হবে যেনো।মৃন্ময়ী ঘুরে বেড়াচ্ছে আলেয়ার আধো আলোতে,বদ্ধ বাতাসে,থাকছে বদ্ধ বারুদের লুকানো গন্ধের মধ্যে।অনিরুদ্ধর অন্তর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে যেনো!
নাহ!সে মৃন্ময়ীকে মুক্ত পৃথিবীর স্বাদ দিবে,মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ নিতে দিবে।তাকে স্বাভাবিক করে তুলবে।সেই পিচ্চি কালের ছোট্ট মৃন্ময়ীকে জাগিয়ে তুলবে যে অনিরুদ্ধর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
.
.
.
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে,
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি
দেখিতে না পাও ছায়ার মতোন আছি না আছি__
তবু মনে রেখো।।
_____(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সকালবেলা বিরামহীন সকরুণ সঙ্গীতের মাতাল করা ছন্দে ঘুম ভাঙে মৃন্ময়ীর।ভোরবেলা নামায পড়ে ঘুমিয়েছে সে।
বিছানায় উঠে বসলো।কানে এখনো গানের লাইনগুলো ভেসে আসছে।তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আজ শুক্রবার। কারণ প্রতি শুক্রবারে অনিরুদ্ধ ভাইয়ের বাবা সকালবেলা রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত শুনে।ড্রয়িং রুমে বাজায় বলে সম্পূর্ণটা তার কানে আসে।এতগুলো বছরে একবারও এ নিয়মের হেরফের হয়নি।
এজন্য রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত সম্পর্কে মোটামুটি ভালো একটা ধারণা হয়েছে তার।মুচকি হেসে গুনগুনিয়ে গাইলো____”তবু মনে রেখো।’
ইশ!কি সুন্দর লাইন।
_______________
খাবার টেবিলে অনিরুদ্ধ রেখাকে উদ্দেশ্য করে ফ্লুয়েন্টলি বলল,
___’খালা, মৃন্ময়ীকে ডাক দাও তো!সবাই একসাথে খাই।’
উপস্থিত সবাই খানিকটা ভড়কে গেল। অনিরুদ্ধর বাবা আজাদ খান বলল,
___’অনি,তুই গিয়ে ডাক দে না হয়।মেয়েটা কারো কথা শুনতে চায় না।মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে তাকে ডেকে ড্রয়িং রুমে কিছুটা সময় কথা বলি আমি।কিন্তু যতক্ষণ কথা বলে নিজেকে অপ্রস্তুত রাখে।হাজার বার বলার পরো আমার সাথেই সহজ হতে পারে না।এভাবে চললে তো মানসিক রোগী হয়ে যাবে!’
অনিরুদ্ধ চুপ করে রইলো।রেখা খালা দৌঁড়ে গিয়ে দরজার বাইরে থেকে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলো।কিন্তু কোনো প্রতিত্তর করলো না।
এবার অনির্বান শুভ্রাকে বলল,
___’শুভ্রা,তুমি গিয়ে একবার চেষ্টা করো।।এই মেয়ে এতটা একগুঁয়ে হয়েছে না!কারো কথা শুনে না।আমি কতদিন বলেছি একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।বা আমাদের সাথে একত্রে বসে খাবে।সে কোনোটাই করবে না।দিনরাত ঘরের মধ্যে থাকে।(একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)অনি,তুই বাড়িতে এসেছিস,মৃন্ময়ীকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা কর ভাই।’
অনিরুদ্ধ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।মাজেদা বেগম অনেক্ক্ষণ ধরে শুকনো রুটি চিবুচ্ছে। এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজের রুমে গেল।
শুভ্রা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
___’আমি রুম থেকে আসছি।অন্তিক ঘুম থেকে উঠেছে কি না দেখে আসি।’
বলেই তাড়াতাড়ি করে উপরে চলে গেল।
অন্তিক অনির্বাণ আর শুভ্রার ভালোবাসার প্রথম উপহার।অন্তিকের বয়স নয় চলছে।এই বয়সে সে অনেক দুষ্ট হয়েছে।আলাদা রুমে ঘুমায়।আবার মাঝে মাঝে বাবা মায়ের সাথে ঘুমায়।তার মতিগতির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। শুভ্রা তার রুমে গিয়ে তাকে একপ্রকার টেনে তুলল।জোর করে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে রুম গোছানো শুরু করলো।
তার মনের ভেতর খচখচ করছে।সে চায় না তার বোনের জীবনে অনিরুদ্ধর কোনো হস্তক্ষেপ পরুক।তার চঞ্চল বোনটা শামুকের মতো বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে যার কারণ অনিরুদ্ধ!
.
.
.
___’মৃন্ময়ী,বাইরে বের হও।আজ আমাদের সাথে একত্রে খাবে।চলো!’
দরজার বাইরে থেকে টোকা দিয়ে অনিরুদ্ধ বলল।মৃন্ময়ী জড়ানো গলায় ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলো,
___’কে,কে? ‘
__’আমি!আমি অনিরুদ্ধ।বাইরে আসো।কুইক।’
মৃন্ময়ীর গলা ধরে আসছে। সে অনেক কষ্টে বলল,
__’ওহ।আমি পরে খাবো।আপনারা খান।’
__’দেখো,লাস্টবারের মতো বলছি বাইরে আসো।নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। ‘
মৃন্ময়ী কোনো জবাব দিল না।চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো।সেতো সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। তার অন্ধত্বের বোঝা অন্য কারো কাঁধে দিতে চায় না।না চাইতেও অনেক করেছে এ বাড়ির মানুষ।তিনবেলা খাচ্ছে, থাকার জায়গা দিয়েছে।আর কত!
হুড়মুড় করে দরজা খোলার শব্দে মৃন্ময়ী চমকে উঠলো।পরক্ষণে নিজের হাতে হ্যাচকা টান অনুভব করলো।তাকে ধরে রাখা হাতটা ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে।সে চাপা কন্ঠে বলল,
___’অনিরুদ্ধ ভাই! ‘
অনিরুদ্ধর হাত নরম হয়ে আসলো।এক নজর সারা রুমে নজর বুলিয়ে আলতো করে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো।তার পাশের চেয়ারে বসে বলল,
__’চেহারার কি হাল করেছিস তুই?দিন দিন তো শুকিয়ে পোড়া কাঠ হয়ে গেছিস।নে,এই প্লেটের সব শেষ করবি।’
একটা প্লেট এগিয়ে দিল অনিরুদ্ধ।রেখার চোখ ভিজে উঠেছে।মেয়েটার ঘরবন্দী দশা সে মেনে নিতে পারে না।
অনির্বান একটু তাকিয়ে বলল,
__’মৃন্ময়ী, খেয়ে নাও।আমাদের তো খাওয়া শেষের দিকে।নাও,নাও শুরু করো ‘
___’ভাইয়া,আমর খিদে নেই। ‘
আজাদ খান এবার কঠিন গলায় বললো,
___’মা,খেয়ে নাও।কোনো কথা বলবে না।রেখা ওর প্লেটে দেখো কিছু লাগবে কিনা।’
মৃন্ময়ী এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছে। তার ভীষণ রকম অস্বস্তি হচ্ছে। সে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না,কিন্তু সবাই তাকে দেখতে পাচ্ছে এটা ভেবে অস্বস্তির পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
___’তুই এক সেকেন্ডের মধ্যে খাওয়া শুরু করবি নাকি আমি জোর করে তুলে খাওয়াবো?’
অনিরুদ্ধর ঝাঁঝালো কণ্ঠ কানে যেতেই মৃন্ময়ী দ্রুত হাতড়ে সামনে রাখা প্লেট থেকে শুকনো রুটি ছিড়ে মুখে দিল।উপস্থিত সবাই মুচকি হাসলো।
আজাদ খান আর অনির্বানের খাওয়া শেষ হতেই রুমে চলে গেল।রেখা মুচকি হেসে কিচেনে দুপুরের ভাত বসালো।
সবাই চলে যেতে অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর হাত ধুইয়ে দিল।মৃন্ময়ী ঠোঁট উল্টে দ্রুত বলল,
__’আল্লাহ, আমার তো এখনো পেট ভরে নি।মাত্র খাওয়া শুরু করলাম।হাত ধুইয়ে দিলেন কেন অনিরুদ্ধ ভাই? ‘
মৃন্ময়ীর আপনি বলে কথা বলাটা অনিরুদ্ধর গায়ে লাগলেও এখন পাত্তা দিল না।পরে এর শোধ নেয়া যাবে।আপাতত রুটির ভাঁজে গরুর মাংসের এক টুকরো পেঁচিয়ে বলল,
__’হা করো!’
__’কি?হা করবো কেন?’
__’হা করো।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
__’এ মা,ছি!একদম না।আমিই খেয়ে নিতে পারবো।দিন,আমার কাছে প্লে……’
বাকিটুকু বলার আগেই অনিরুদ্ধ মুখে রুটির টুকরো ঢুকিয়ে দিল।মৃন্ময়ী আর কথা না বাড়িয়ে চিবানো শুরু করলো।
খাওয়া শেষে অতি সাবধানে টেবিল ছেড়ে সরে আসলো মৃন্ময়ী।নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হাতে টান পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে হার্টবিট লাফানো শুরু করলো। সে টেনে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে অনিরুদ্ধ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
__’আমার সাথে আমার রুমে যাবে এখন।কথা আছে।’
__’আমি যাবো না।ঘুমাবো এখন।আর হাত ছাড়ুন।কথায় কথায় গায়ে হাত দিবেন না।ইয়ে মানে হাত ধরবেন না!’
__’ভালোয় ভালোয় যাবে, নাকি কোলে তুলে নিবো?’
__’আজব,জোর করছেন কেন?বলছি তো ঘুমাবো আমি এখন।তাছাড়া আমি উপরে যাই না।হাত ছাড়ুন।এসব আমার একদম পছন্দ না।’
অনিরুদ্ধ আশপাশে এক নজর তাকিয়ে এক ঝটকায় মৃন্ময়ীকে কোলে তুলে নিল।তারপর ধুপ ধাপ পা ফেলে উপরে চলে গেল।
(চলবে)