পদ্মপাতার জল পর্ব -০১

0
1883

#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০১

১.
__’মৃন্ময়ী, হুনছোস?আমাগো অনিরুদ্ধ বাবা আইজ দ্যাশে ফিরতাছে।আমার কি যে খুশি লাগতাছে!’

রেখা খালার কন্ঠ কানে যেতেই দৃষ্টিহীন মৃন্ময়ী চমকে উঠে।রুমে চকচকে আলোর মধ্যেও দুহাত হাতড়ে খালার কাছে আসার চেষ্টা করে।দু-তিন জায়গা হাতড়ে খালাকে পেয়েও যায়। খালার হাত ধরে কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

___’খ-খা-খালা, তু-মি কি বললে?আর একবার বলো!আর একবার বলো তো?অনিরুদ্ধ ভাই দেশে ফিরছে?’

___’হ রে মা।তোরে আগে বলমু কি!আমি নিজেই তো মাত্র হুনলাম।রাঁধা বাড়ার যোগাড়যন্ত্র দেইহা জিগাইতে কইলো অনিরুদ্ধ আসতাছে।’

মৃন্ময়ী হাতড়ে ধপ করে পাশে রাখা চৌকিটার উপর বসে পড়লো।অনিরুদ্ধ ভাই দেশে ফিরছে!এই বাড়িতে ফিরছে!তার যেনো বিশ্বাসই হতে চায় না।দীর্ঘ তেরোটা বছর দুই মাস সতেরো দিন পর আজ অনিরুদ্ধ ভাই তার নিজের বাড়িতে ফিরছে।নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরা শুরু করলো।

রেখা খালা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।থাক,মাইয়াডারে সে আর জ্বালাবে না।এমনি বহুত জ্বালানি সহ্য করতে হয়।আল্লাহও কেন যে অসহায় মানুষরে আরো অসহায় করে তার রেখার বোধগম্য হয় না।এমনিতেই মাইয়াডার কপালে দুঃখ তার উপর আল্লায় তার দৃষ্টিশক্তিও কাইড়া নিল।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে গেল সে।তার অনেক কাম!

নামাজে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত ধরলো মৃন্ময়ী।চোখ বন্ধ করতেই সেই তেরো বছরের ফুটফুটে ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠলো।সে অনিরুদ্ধ ভাইকে সেই তেরো বছর বয়সে দেখেছে।তারপর বিধাতা আর দেখতে দেয়নি।অনিরুদ্ধ ভাইয়ের চৌদ্দতম জন্মদিনের কয়েকদিন আগে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। আর তার কিছুদিন পরেই অনিরুদ্ধ ভাই দক্ষিণ কোরিয়া চলে যায়।

মৃন্ময়ী বিড়বিড় করে বলল,

___’অনিরুদ্ধ ভাই, আমার কথা কি তোমার মনে আছে?বিগত এতগুলো বছরে তো একবারও খোঁজ নাওনি।কথা বলা তো দূরে থাক!আমিও না।কথা কেন বলবে তুমি!আমার মতো অন্ধের জন্য কেন তোমার করুণা হবে,কেনই বা মায়া জন্মাবে? আমি একটু বেশি আশা করে ফেলি সবসময়। বাদ দাও।জানো তো,এই এতগুলো বছরে তোমার চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তাই না?দেখো না আমি সেই ছোট্টটি আর নেই। আমার বয়স একুশ চলছে।এখন আমি পুরোদস্তুর যুবতী।কিন্তু আমি যেমন তোমাকে আর দেখতে পাবো না,তেমনি তুমিও আমাকে আর দেখতে পাবে না।আমি তোমার সামনে যাবো না কোনোদিন।আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক।আমিন।’

জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় বসলো সে।নিজের অন্ধত্বের এতগুলো বছর হয়ে গেল।নিজের সব কাজ হাতড়ে হাতড়ে নিজেই করতে পারে সে।আর তার কাজ বলতে সে সারাদিন রাত এই রুমটাতেই থাকে।গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন খালি পায়ে মাঝে মধ্যে ডাইনিং এ ঘোরাফেরা করে।সিঁড়িতে দুদন্ড বসে থাকে এই যা।তার সিঁড়ির উপরে যাওয়া নিষেধ।

___’মৃন্ময়ী, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।এখনো খাসনি কিছু। এই নে,খাবার দিয়ে গেলাম খেয়ে নে।’

শুভ্রা আপুর কন্ঠ কানে যেতেই মৃন্ময়ী উত্তেজিত হয়ে পড়লো।তার এ উত্তেজনার কারণ শুভ্রা ঠাওর করতে পেরে তাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না।দ্রুত বলল,

___’লক্ষী বোন আমার।এখন কোনো কথা নয়।খেয়ে নে।আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। ‘

এটুকু বলে দ্রুত পা চালাল শুভ্রা।দরজার বাইরে পা রাখতেই কানে এলো,

___’বুবু,অনিরুদ্ধ ভাই নাকি আসছে?’

শুভ্রা পেছন ফিরে একবার তাকালো।কিন্তু উত্তর দিলো না।দিবেও না সে।আবারো বুকের ভেতরের চাপা আর্তনাদের অস্তিত্ব অনুভব করলো।কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে তারা দুবোন,তা অজানা।কই তাদেরো তো একটা সুখী পরিবার ছিল। বাবা, মা আর তারা দুবোন।বাবা রিকশা চালিয়ে যা আয় করতো তাতেই দিব্যি চলে যেতো।নিজের ভাগ্যের উপর তার আজকাল চরম হাসি পায়।মনে হয় সবকিছুর জন্য সে দায়ী।

অতীতের তিক্ত পাতাটি আরো একবার স্মরণ করলো সে।বর্তমানে সে এই খান বাড়ির বড় বউ।মি. অনির্বান খানের একমাত্র ওয়াইফ সে।আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে অনির্বান তাকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করে ফেলে।বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই তার দরিদ্র বাবা একপায়ে রাজি হয়ে যান। মেয়ের সুখ যে তাদের সুখ। কিন্তু মেয়ের সুখই সবকিছুর কাল হলো।তাদের বিয়েটা একটা বিলাসবহুল কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছিল।

তার জন্যই তো, হ্যাঁ তার বিয়ের মধ্যেই তো গাড়িতে করে কমিউনিটি সেন্টারে আসার সময় ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়। তার বাবা, মা,ড্রাইভারসহ আরো তিনজন মারা যায়।আর দুঃখ পোহানোর জন্য বেঁচে ফেরে সে আর তার ছোট বোন টুকটুকি।

এক্সিডেন্টের তিন মাস পর অনির্বান একপ্রকার পরিবারের অমতে গিয়ে তাকে বিয়ে করে।মৃন্ময়ীর সে ছাড়া কেউ ছিল না বলে তাকেও নিয়ে আসে।শুভ্রা অনেক খুশি হয় অনির্বানের কাজে।তার বোনটাকে নিজের কাছে রাখতে পেরে সে অনির্বানের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

কিন্তু পরিবারের দু একজন তাদের ভালোভাবে নেয়নি।তার মধ্যে তার শ্বাশুড়ি মা প্রধান।আজ এতগুলো বছরেও সে তাদের দু বোনকে সহ্য করতে পারে না।

ছোটবেলা থেকে মৃন্ময়ী অনেক দুষ্টু ছিল। এ বাড়িতে আসে যখন তখন ওর বয়স ওর আট বছর বয়স।বাবা মা হারানোর মর্মটা তখনো বুঝে উঠতে পারেনি।সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতো।

অনির্বানরা ছিল দুই ভাই শুধু ।অনির্বান বড়।আর ওর ছোট ভাই অনিরুদ্ধর বয়স তখন তেরো বছরের মতো।এ বাড়িতে টুকটুকির খেলার সাথী কেউ ছিল না বলে সারাদিন অনিরুদ্ধর পিছন পিছন ঘুরতো।অনিরুদ্ধ তাকে দু চক্ষের বিষ মনে করতো।কিন্তু তবুও পিচ্চি মৃন্ময়ী সেসব বুঝত না।তার এই অবুঝতাই কাল হয়ে দাঁড়ালো।নিজের চক্ষু দুটো হারিয়ে ফেললো।

এখন সে নিচতলায় দক্ষিণের দিকে ছোট্ট একটা ঘরে দিনরাত থাকে।একপ্রকার নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে টুকটুকি।তার রুমে রেখা খালাও থাকে।রুমটাতে সিঙ্গেল দুটো চৌকি পাড়া।বোনের কষ্ট শুভ্রার আর সহ্য হয় না।কবে যে এর থেকে মুক্তি মিলবে তা বিধি জানে!

সে চোখের জল মুছে দরজা থেকে সরে আসলো।তার বোনের দৃষ্টি হারানোর জন্য সে অনিরুদ্ধকে দায়ী করে।বিগত এতগুলো বছরে সে একবারও অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলে নি।প্রথমদিকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতো।কিন্তু বোনের এ অবস্থার জন্য যে সে দায়ি!আজ এতগুলো বছর পর বাড়ি ফিরছে ছেলেটা,কিন্তু তার মধ্যে বিন্দুমাত্র আনন্দ বা ভালো লাগা অনুভূত হচ্ছে না।

_________________

কলিং বেলের তীব্র আওয়াজ হতেই রেখা দরজা খুলে দিল।দরজা খুলেই এক চিল্লানি দিল।

___’ওমা!দেহো সবাই! অনিরুদ্ধ বাবা কত বড় হই গেছে। ওমাগো।একদম রাজপুত্রের মতো হইছে দ্যাকতে!’

রেখার চেঁচামেচিতে অনিরুদ্ধর মা মাজেদা বেগম এগিয়ে এলেন।ছেলেকে দেখে একদৌঁড়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।

___’মা, কান্না কাটি থামাও তো।এইতো ফিরে এসেছি।আর তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না।এবার ভেতরে তো প্রবেশ করতে দাও।’

অনিরুদ্ধ বলতে মাজেদা সরে দাঁড়ালো।অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। টনের্ডো গতিতে ভিতরে রক্ত চলাচল করছে যেনো।এ বাড়িতে যে তার প্রাণভোমড়া রয়েছে!কয়েক হাজার ভোল্ট বুক ধুকপুকানি নিয়ে সে ভেতরে পা রাখলো।তার পেছনে পেছনে অনির্বানও প্রবেশ করলো।

সোফায় বসে পড়লো দুভাই।রাত মোটামুটি ঢেড় হয়েছে।অনিরুদ্ধ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১১ টা চব্বিশ বাজে।তার মানে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে?সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মৃন্ময়ীকে খুঁজলো।কিন্তু ডাইনিংএ তারা চারজন ছাড়া আর কেউ নেই।সে মাথা নিচু করে ফেলল।বুকের ভেতর অভিমান জমে জমে দলা পাকিয়ে উঠছে বার বার।

অনির্বান বলল,

___’মা, বাবা কোথায়? ‘

__’ঘুমিয়ে গেছে।জেগে থাকতে চেয়েছিল।আমি নিষেধ করেছি।ডাক্তার বারণ করেছে।অনিরুদ্ধ যা ফ্রেশ হয়ে নে।উপরে তোর রুমটা গোছানো হয়েছে।অনির্বান তুইও যা।’

অনিরুদ্ধ মাথা নেড়ে বলল,

___’আমার খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দাও মা।অনেক টায়ার্ড।কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো।সবার সাথে সকালে কথা হবে।’

অনিরুদ্ধ আর দেরি না করে লাগেজটা হাতে নিয়ে উপরে উঠে গেল।

_________________

মাঝরাতে হলরুমে কারো পায়ের শব্দ হতেই এক লাফে উঠে বসলো মৃন্ময়ী। এত রাতে হলরুমে হাঁটাহাঁটি করে কে?চোখের আলো নেই বলে হয়তো তার কর্ণশক্তি অনেক প্রখর।সামান্য তম শব্দ কান এড়ায় না।কিন্তু এত রাতে ডাইনিং এ হাঁটাহাঁটি করবে কে?চোর টোর নয়তো?

সর্বোচ্চ রাত এগারোটা পর্যন্ত হলরুমে মানুষ থাকে।তারপর যার যার মতো উপরে চলে যায়। রাতে ভুলেও নিচে আসে না।তবে কি অনিরুদ্ধ ভাই দেশে ফিরছে বলে চোর চুরি করতে এসেছে?

চাপা কন্ঠে কয়েকবার রেখা খালাকে ডাকলো।কিন্তু সে সারাদিন খাটুনি করে এখন মরা কাঠের মতো ঘুমাচ্ছে। অগত্যা সে নিজেই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল।হালকা পায়ে হেঁটে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে দরজার ছিটকিনির উপরে হাত রাখলো।

দরজা খুলে…….………………….

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে