#পথ_হারা_প্রজাপতি(৭)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)
অফিস শেষ করে সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে রাযীন। বাসায় ফিরেই দেখে আফরোজা বেগম কান্না করেছেন। পাশে করিম সাহেব থমথমে মুখ করে বসে আছেন। কাছে গিয়ে আফরোজা বেগম কে জিজ্ঞাসা করলো,
–” কি হয়েছে? কান্না করতেছো কেন?
–” সাফিরা আজকে বাসায় ফিরে নাই! তোকে কতোবার কল করলাম কল রিসিভ করলি না কেন? আল্লাহ না করুন মেয়েটার কোন ক্ষতি হলো না তো?
বলতে বলতে আফরোজা বেগম আবার চোখের পানি ফেলছেন। করিম সাহেব বললেন তিনি সাফিরার কলেজ পর্যন্ত খুঁজে এসেছেন কিন্তু কোথাও খুঁজে পাননি। তখন রাযীন বলল,
–” আব্বা পুলিশে ডায়রী করলে না কেন?
করিম সাহেব বললেন,
–” টেনশনে কিছু মাথায় আসে নাই।
রাযীন আর কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বের হবে বলে বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হতে নিবে তখন সাফিরা কে আসতে দেখে! একজন মহিলা তাকে ধরে নিয়ে আসতেছে আরেকজন পুরুষ সাথে। রাযীন এগিয়ে গিয়ে বলল,
–” কোথায় ছিলি সারাদিন?
পাশের ভদ্রলোক বললেন,
–” উনি অসুস্থ! আগে বাসায় যেতে দিন।
রাযীন বিচলিত হয়ে বলল,
–” কি হয়েছে?
ভদ্রলোক আবারো বললেন,
–” আগে বাসায় যেতে দিন?
তারপর রাযীন বলল,
–” আসুন।
.
কলেজ থেকে ফেরার পথে ছিনতাই/কারী সাফিরার ফোন ছিন/তাই করে দৌড় দেয়। তখন সাফিরা ফোনের জন্য পিছুপিছু দৌড়ে যায়। মেয়ে মানুষ হয়ে তো আর ছিনতাই/কারীর সাথে দৌড়ে পারা যায় না। উল্টো বেখেয়ালে রাস্তায় দৌড়ে সিএনজির সাথে এক্সি/ডেন্ট করে! কপাল কে/টে যায়! যার জন্য পাঁচটা সেলাই লাগে। তাছাড়া হাতের কিছু অংশ ছি/লে গেছে এবং হিজাবের অংশ ছিঁড়ে গেছে।
যারা তাকে ধরে নিয়ে এসেছে বাসায় তারা সাফিরা কে হসপিটালে নিয়ে যায়।
সাফিরার যখন জ্ঞান ফিরে তখন ঠিকানা বললে তারা বাসায় নিয়ে আসে।
সম্পদ আত্মসাৎকারী বা ছিনতাই/কারী নিঃসন্দেহে কবীরা গোনাহগার ও মহাপাপী এবং তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শা/স্তি[১]
আদালতে বিচারক তাদের অপরাধের মাত্রা অনুপাতে শাস্তি নির্ধারণ করবেন। সেটি জে/ল বা জরিমানা বা উভয়টি হ’তে পারে। কিন্তু সকল বিদ্বানদের ঐক্যমতে তার হাত কা/টা যাবে না [২]
কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘লুণ্ঠনকারী, ছিনতাই/কারী ও আত্মসাৎকারীর হাত কর্তন করা হবে না [৩]
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের মাল ছিন/তাই করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় [৪]
হাসান বাছরী ও ইয়াস বিন মু‘আবিয়ার মধ্যে ছিনতাইকারীর হাত কাটা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে তারা খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তিনি উত্তরে লিখেন ছিনতাই/কারীর হাত কা/টা যাবে না। বরং তার পিঠে চাবুক মার এবং তাকে ব/ন্দী কর। [৫]
মানুষ যদি সবসময় মৃ/ত্যুর কথা স্মরণে রাখতো তাহলে অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকতো।
.
.
আফরোজা বেগম সাফিরাকে উপকারী ব্যাক্তিদের নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। নাস্তা খাওয়া শেষে তারা
চলে যেতে উদ্যত হলে রাযীন বলল,
–” হসপিটালে নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ হয়েছে? যদি বলতেন তাহলে আমি টাকা দিয়ে দিতে চাই।
তারা বলতে না চাইলে করিম সাহেব বিনয়ের সাথে বললেন,
–” আপনাদের জাযাকুমুল্লাহু খাইরান। আপনাদের মতো কিছু ভালো মানুষ আছে বলেই আজো পৃথিবীটা সুন্দর। না হয় যেভাবে প্রতিদিন দূর্ঘট/না ঘটে চলেছে, তাতে ভালো মানুষরা ঘর থেকে বের হতে পারতো না, কখন কি হয়ে যায় এই ভয়ে। তাই আজকে আপনারা টাকাটা রাখুন আবার কারো বিপদে উপকার করতে পারবেন ইনশা আল্লাহ।
অতঃপর তাদের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দেয় রাযীন। তারপর রাত বেরে যাচ্ছে বলে চলে যায় তারা।
.
সাফিরাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেছে ডাক্তার। আফরোজা বেগম সাফিরাকে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেও ক্ষ/ত স্থান দেখে বুকটা যেন ফে/টে যাচ্ছে। এতিম মেয়েটার কপালে কি সুখ নেই? এই ভেবে ভয় তার।
সাফিরা নিরবে শুয়ে আছে, মাথা যন্ত্রনা করছে খুব। পাশে হাত বুলিয়ে সূরা কালাম পড়ে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে আফরোজা বেগম। তামান্না একবার এসে দেখে গেছে সাফিরাকে।
তারপর রাযীন এসে বকাঝকা করে গেছে! এই জন্য যে একটা ফোনের জন্য পিছুপিছু দৌড়াতে গেল কেন সাফিরা? ফোন তো পেলই না উল্টো নিজের ক্ষ/তি করে আসলো। জবাবে নিরব রইলো সাফিরা।
ফোনটা আফরোজা বেগম কিনে দিয়েছিল সাফিরাকে। অবসর সময়ে ইসলামিক বই বা বিভিন্ন হাদীস সম্পর্কে জানতে পারে এই ফোনের মাধ্যমে। তাই ফোনটা অনেক প্রিয় ছিল সাফিরার।
রাতের খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল সাফিরা। সাথে ঘুমের ঔষধ থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। আফরোজা বেগম সাথে ঘুমাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সাফিরা না করে। কারণ সাফিরা জানে করিম সাহেব কখনো স্ত্রীকে ছাড়া থাকেন না। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন কিনা।
সাফিরার সাথে না পেরে আফরোজা বেগম বললেন,
–” তাহলে দরজা ভেজিয়ে ঘুমাস। আমি রাতের বেলা এসে দেখে যাব তোকে। আল্লাহ না করুন ব্যাথার জন্য যদি জ্বর আসে।
–” ঠিক আছে তুমি ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
আফরোজা বেগম তাই করলেন।
.
.
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে তখন, রাযীন পা টিপে টিপে সাফিরার রুমে আসে!
সাফিরা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাযীন ধীরে ধীরে সাফিরা পাশে গিয়ে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। তাকিয়ে রইল অপলক। কপালের ক্ষ/ত স্থানে চুম্বন এঁকে দিল!
সকালে অফিস আছে ভেবে পাশে শুয়ে পড়ল! রাতে ঘুম না হলে অফিস করতে কষ্ট হবে তাই ঘুমানো প্রয়োজন।
আফরোজা বেগম আর করিম সাহেব তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার জন্য রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবীজি (সা.)-এর উদ্দেশে কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জত কায়েম করো, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে—মাকামে মাহমুদে। [৬]
রাতের ইবাদত প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে আরও রয়েছে, ‘হে কম্বলাবৃত! রাতে দণ্ডায়মান হও কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তার চেয়ে কিছু কম অথবা তার চেয়ে বেশি এবং কোরআন তিলাওয়াত করো সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয়ই ইবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয়ই দিবাভাগে রয়েছে তোমার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। তুমি নিজ পালনকর্তার নাম স্মরণ করো এবং একাগ্রচিত্তে তাতে নিমগ্ন হও। [৭]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত! ওঠো, সতর্ক করো, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করো, স্বীয় পোশাক পবিত্র করো এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। অন্যকে কিছু দান করে অধিক প্রতিদান আশা করবে না। আর তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে ধৈর্য ধারণ করো। [৮]
আফরোজা বেগম অযু করে এসে সাফিরাকে দেখতে এসে দেখেন দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা! বন্ধ দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। সাফিরাকে তো বলেছিলেন দরজা বন্ধ করতে না। কেন করলো তাহলে? তিনি আর এই মুহূর্তে মাথা ঘামালেন না। সাফিরাকে ডাকলেন ও না। এমনিতেই অসুস্থ ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙ্গালে মাথায় আঘাত পেতে
পারে তাই তিনি চলে গেলেন।
ফজরের আযানের ধ্বনি শুনে দ্রুত উঠে বসে রাযীন। সাফিরা ঘুমে থাকতে থাকতে রুম ত্যাগ করে।
সকালে অফিসে চলে গেল। আফিস থেকে ফিরে নিজের রুমেই থাকলো। সাফিরাকে একবার গিয়ে জিজ্ঞাসা ও করলো না শরীরের কি অবস্থা? সাফিরা আসা করছিল তাকে অন্তত জিজ্ঞাসা করবে রাযীন কিন্তু করে নাই দেখে সামান্য মন খারাপ হলো।
দ্বিতীয় দিন আবারো সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন রাযীন সাফিরার রুমে আসে! দেখে ঘুমিয়ে আছে সাফিরা। দ্বিতীয় দিন ও একই কাজ করলো। সাফিরার পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে রইলো।
আজকে সাফিরা ঘুমের ঔষধ খায়নি, ঘুমের ঔষধ খাওয়া ভালো না বলে। তাই মাঝ রাতে ওয়াশরুমে যাবে বলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসে, পাশে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় পাশে রাযীনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর হতে চলল কিন্তু রাযীনকে তার পাশে কখনো দেখেনি! আজকে এভাবে দেখে কপালে নাকের ডগায় চিকন ঘাম বের হতে শুরু হলো!.…
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।
রেফারেন্স:
[১] (শূরা ৪২/৪২; মুত্বাফ্ফেফীন ৮৩/১-৬)
[২] (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ১২/৪১৬)
[৩] (দারেমী হা/২৩৭৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪০২)
[৪] (আহমাদ হা/১৫১১২; মিশকাত হা/৩৫৯৬; ইরওয়া হা/২৪০৩)
[৫] (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৮৬৬৫)।
[৬] (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৭৯)
[৭] (সুরা-৭৩ মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ১-৮)
[৮] (সুরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)