ভাইবার চালু হবার পর থেকে শুরু হয়েছে বিরাট মুসিবত। দেশের মানুষ সময়ের পার্থক্য, কাজে থাকার সম্ভাবনা এসব কিছু না ভেবেই যখন তখন ফোন দিয়ে বসে। আমার বাসা এবং আমার স্বামী এ ব্যাপারে আরেক কাঠি সরেস। একবার ফোন দেয়া শুরু করলে ফোন না ধরা পর্যন্ত কিছুতেই বিশ্রাম নেয়না। বারংবার পকেটে মোবাইল ভাইব্রেট করাতে বাধ্য হয়ে সুপারভাইজারকে বলে স্টাফরুমে আসি। মায়ের ফোন।
– হ্যালো, মা; তুমিতো জানো আমি এসময় কাজে থাকি। এতোবার ফোন দিচ্ছো কেন?
তোর বড় বিপদ রে মা। কিভাবে যে তোকে বলি?
– কি হয়েছে মা? আমার সাফিন কেমন আছে?
সাফিন একটু আগে রাগ করে আমাদের বাসায় চলে এসেছে। তোর জামাই নাকি আবার বিয়ে করেছে।
– কি বলছো মা এসব? আশফাক এমন কিছু করতেই পারেনা।
তুই সাফিনের সাথে কথা বল।
– মা, আমি ওর সাথে কাজ শেষে কথা বলবো। এখন রাখছি। তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো।
নিজের ডেস্কে কাজে ফিরেও কিছুতেই মনকে বুঝ দিতে পারছিনা। আমার আশফাক, এমন একটা কাজ করলো? এমন ভাবে আমাদের মা ছেলেকে ঠকাতে পারলো? এমন মানসিকতার একটা মানুষকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশী বিশ্বাস করেছিলাম? গতকাল সকালেও আমি টাকা পাঠিয়েছি। নিজেদের ফ্ল্যাটটার আর দুটো কিস্তি শেষ হলেই দেশে চলে যাবো। কতদিন নিজের ছেলেটাকে সামনাসামনি দেখিনা, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখিনা!
দশ বছর আগে যখন ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন আমারটা হয়ে যায়, আমি আমার দশ বছরের ছেলেটাকে রেখে তখন একদম আসতে চাইনি। নিজেদের কথা ছেলের কথা বলে আশফাকই আমাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কথা ছিল ও চেষ্টা করবে আবার। তারপর আমি যখন টাকা পাঠাতে শুরু করি দিনে দিনে ছেলের স্কুল, ছেলের পড়াশোনা, বাইরে পরিবার নিয়ে থাকা খুব কষ্টের এসব বাঁধায় আমাকে আটকে যেতে হয় এই দূর প্রবাসে। আমিও ভেবেছিলাম এইতো নিজেদের থাকার একটা জায়গা হয়ে গেলে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবো দেশে। তারপর শুধুই আরাম আর আরাম। দিন কি রাত, কাছে কি দূরে, শরীর ভালো কি খারাপ এসবের তোয়াক্কা না করে শুধু কাজ করে গেছি। যাদের সাথে শেয়ার বাসায় থাকতাম সেই বাসার ভাড়া আর নিজের সামান্য খাওয়া খরচ ছাড়া আর সব টাকা পাঠিয়ে দিতাম দেশে। আর একটু বেশী টাকা, আর একটু আগে দেশে যাবার সুযোগের অপেক্ষায় হাতের কড়ে গুণে দিন কাটানো আমার জন্য এই খবর যে অনেকটা হঠাৎ করে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবার সামিল।
ঘরে ফিরে ছেলেকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা জানার পর কেমন একটা গা গোলানো ভাব ছাড়া আর তেমন কোন ভাবান্তর হয়না আমার। যেন আমি জানতামই এমন একটা ব্যাপার কোন একদিন হতে পারে। আসলে গত কয়েক মাস ধরেই লোকের মুখে এটা ওটা শুনলেও বিশ্বাস না করে এড়িয়ে গেছি। ঐ যে, যে কোন খারাপ খবরে লোকে যেমন ভাবে এমনটা হতেই পারেনা আমার সাথে। বিদেশে এর একটা গালভরা নামও আছে, ডিনায়াল। ডিনায়ালের পরবর্তী পর্ব হিসেবে আমি দেশে যাবার সব ইচ্ছে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। মা হিসেবে ছেলের পড়াশোনাটা অন্তত চালিয়ে নিতে হবে ভেবে কাজ করতাম যতটুকু না করলেই নয়। পাকাপাকিভাবে এদেশে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করার সেই শুরু। আশফাকের সাথে শুধু একবারই কথা বলেছিলাম এরপর। না কোন কৈফিয়ত চাইনি শুধু জানতে চেয়েছি কথা কি সত্যি? আশফাক একবারও যদি বলতো এটা মিথ্যে তাহলেও যেন আমি মেনে নিতাম।
দিনের নিয়মে দিন গড়িয়ে আমার এদেশে থাকার কাগজ হলো। ছেলেকে বিপিটিসি কোর্স করাতে নিয়ে এলাম নিজের কাছে। আসলে আশফাকের সাথে সম্পর্ক থাকার দিনে ও যা সিদ্ধান্ত নিতো তাই সঠিক মেনে করে যেতাম বলে নিজের কোন মতামত দেয়ার প্রয়োজন সেভাবে হয়নি। ছেলেটাকে কাছে আনার পর আমি বুঝলাম ওকে দূরে সরিয়ে রেখে আমি শুধু ছেলেটাকেই না মানুষ হিসেবে, একজন মা হিসেবে নিজেকেও কতটা বঞ্চিত করেছি। আমার সাথে একটা লম্বা দূরত্বের জন্য ছেলেটা একটু কম কথাই বলতো আসার পর থেকেই। আজ রাতের খাবার টেবিলে ছেলে যখন নিজ থেকে কথা বলে আমি খুব অবাক হই।
– মা, আপনাকে একটা কথা বলি?
আমি দেশে ফিরে গিয়ে আমার বাবার নামে মামলা করতে চাই।
– এতোদিন পর কি লাভ এসব প্রসঙ্গ তুলে?
আপনার অপমানের একটু শোধ নিতে। আমি যে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছি শুধু এই একটা কারণে।
– যে নক্ষত্র শূন্যে মেলাবে বলে পথ হারায় অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে তার যে আদতে কোন পথই থাকেনা বাবা। আমার মনে হয় আমি শুধু তোমার বাবার ঐ সময়ের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই সময় পার করেছি। এই যে একা একা জীবন পার করে দিচ্ছি এই জীবন নিয়ে আমার এখন দুঃখ নেই। নিজের মতামত স্বাধীনভাবে নিতে পারছি এই ব্যাপারটাই তো জানা হতোনা একটা জীবন যদি তোমার বাবা থেকে যেতো সাথে। যে অন্যায় সে আমার আর তোমার সাথে করেছে তার জবাব দেয়ার একজন তো আছে। সেদিন পর্যন্ত না হয় আমি ধৈর্য্য ধরি।
ছেলে দেশে ফিরে যাবার পরপর আবার আমার সেই একলার জীবন। মনে হলো এবার বোধহয় একবার দেশে ফেরা যায়। ছেলের করা বাসাতেই এবার ওঠা। সবকিছু কত বদলে গেছে। এক সপ্তাহের মাথায় এক বিষন্ন বিকেলে বেজে ওঠে বাসার কলিংবেল। বাসার কাজের ছেলেটা জানায় আমার কাছে কে যেন এসেছে। নিজেকে একটু গুছিয়ে বসার ঘরে এসে দেখি, আশফাক বসা। একটু যেন থমকে যাই। তবু এতোগুলো বছর পরে ক্ষমা চাইতে এসেছে ভেবে একটু ভালো লাগে। মুখোমুখি এসে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বসি।
– তুমি তো আগের মতোই আছে দেখি সুমনা। ভালো করেছো ওখানে রয়ে গেছো। এদেশে কিছু আছে নাকি? সব দুষ্টলোকের আখড়া। দেখোনা আমার পেছনে দুদক লেগেছে। আমার সম্পদের হিসেব চাইছে। আমার চাকুরীর সাথে নাকি আমার গাড়ি বাড়ির পরিমাণ মিলছেনা। তুমি যদি একটু একটা সাপোর্ট লেটার লিখে দিতে তাহলে আমার ঝামেলাটা কমে যেতো।
তেলতেলে চেহারা নিয়ে গা দুলিয়ে হাসতে থাকা আশফাককে আমার মনে হয় যেন এক লোভী ধূর্ত শেয়াল।
‘তোমার ঠিকানা লিখে রেখে যেও।’ এটুকু বলে উঠে চলে আসি। মনে মনে বলি, ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা আমায় আশফাকের কক্ষপথ থেকে পথহারা করে সরিয়ে নিয়েছিল। নয়তো আশফাক নামের এই লোভী লোকটাকে একজীবন শুধু দিয়েই যেতে হতো।
শফিকের সাথে নিজের জীবন নতুন করে শুরু করবো কি না এ নিয়ে বড় দোটানায় ছিলাম। দেশ থেকে ফিরে সেই দোটানা যেন কর্পূরের মতো উবে যায়। আমার নতুন সংসার শুরুর এক বছরের মাথায় আমার নামে একটা চিঠি আসে।
সুমনা,
তোমার সাপোর্ট লেটারটা আমি পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা রইলো। দুদক আমার সাথে আর ঝামেলা করেনি আর। কিন্তু ওপরে যিনি বসে সব খেলা দেখেন তিনি এবেলা আমায় আর ছাড় দেননি। দুদকের সাথে সব ঝামেলা শেষে ফেরার পথে আমার গাড়ি এক্সিডেন্ট করে আমি দুটো পা হারাই। আমার বর্তমান স্ত্রী আমায় একটা বৃদ্ধাশ্রম মতো জায়গায় রেখে গেছে। আমার অসুস্থতার সময়ে ও সুকৌশলে সব সম্পদ সরিয়ে নিয়েছে তার নামে। আমাদের ছেলে সাফিনকে দেয়ার মতো কিছুও অবশিষ্ট নেই আমার কাছে। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার মতো সাহসও আমার নেই। তোমায় কষ্ট দেবার, আর আমার লোভের শাস্তি আমি কড়ায় গন্ডায় বুঝে পেয়েছি।
– আশফাক
চিঠিটা পেয়ে কি আমার খুব আনন্দ হয়েছে? কই না তো? চিঠিটা কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে মনে হলো আমার এক অন্ধকার জীবনের সমাপ্তি হলো আজ। বিছানা লাগোয়া জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকাতেই একটা তারা খসে পড়তে দেখলাম। যেন আমার দুঃসহ অতীতের সমাপ্তি বোঝাতেই ঐ দূরের নক্ষত্রটি পথ হারালো মহাশূন্যে।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস