#নোনাজল
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
আজ বহুদিন বাদে বাবার বাড়িতে এসেছে স্বর্না। কিছুক্ষণ আগেই সে আসার সুবাদে বাড়িতে প্রলয় ঘটে গেছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যবহার করেছে তার নিজের জন্মদাত্রী মা। বাবা তাকে দেখেই দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে আছে। বর্তমানে অবশ্য তার মা কাঁদছে। ভাঙাচোরা সোফায় বসে অবনত মস্তকে বসে আছে স্বর্না। মা রান্নাঘরের সামনে বসে অঝোরে কেঁদেই চলেছে। বোনটাও নিজের রুমের সামনে দাড়িয়ে ছলোছলো নয়নে তাকিয়ে আছে। স্বর্না বুঝতে পারছে, সবার তার উপর রাগ থাকলেও মায়ার কাছে সবাই হার মেনে গেছে। তাইতো, রাগ ভুলে সবাই এখন নিরবতা পালন করছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলে বর্ণা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা ঠেলে ভিতরে আসে তার একমাত্র ভাই। স্বর্নাকে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। কোনো ভাবেই সে এখন এইখানে স্বর্নাকে আশা করেনি। নিজের থেকে ৩ বছরের বড় স্বর্না। কিন্তু, পিঠাপিঠি হওয়ায় কখনোই বড় বোনকে আপনি বা তুমি সম্বোধন করেনি। সবসময়ই তুই/তুকারিই করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানের স্বর্না তার সেই আদুরে বোনের জায়গায় নেই। সে ভ্রু কুঁচকে বর্ণাকে জিজ্ঞেস করে, ” উনি আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন? কি চাই আবার উনার? মানসম্মান তো সব শেষই করে দিয়েছে। বের হলেই মানুষের নানান গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাদের। ২ টাকা ইনকাম করেই তো সাপের পাঁচ পা দেখেছিলেন উনি। অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে পারলো না আর। তাইতো এক মেয়ের সংসার ভেঙে সেই খানে নিজের সংসার গড়ে তুললো৷ আমরা যে সমাজে থাকি, সেটাও ভুলে গেল। তা, উনি আবার আমাদের গরীবখানায় কেন এসেছেন?”
স্বর্না কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই তার বাবা দরজা খুলে বের হয়ে আসে। এসেই সোফার উপরে ধপ করে বসে পড়ে। নিজের ছেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাদেরকে বসতে বলে। এরপর নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,” কড়া করে এককাপ চা বানাও তো। তারপর তুমিও এসে বসো।”
সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সে এমন ভাবে কথাগুলো বলছিল যেন কিছুই হয়নি। নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার বলে,”কি হলো,যাও। চা বানিয়ে আনো।” এরপর সরাসরি নিজের তিন ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” আজ তোমাদের আমি দারুণ একটা গল্প শোনাবো। এই গল্পে অনেক গুলো চরিত্র থাকবে। গল্প শেষে তোমরাই রিভিউ দিবে, গল্পে কে নায়িকা আর কে খলনায়িকা। বুঝলে? আর হ্যাঁ, আমি গল্প শেষ না করা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলবে না। কোনো প্রশ্নও করবে না৷ বুঝলে?”
তিন ভাই-বোন একসাথেই মাথা ঝাঁকালো। ততক্ষণে ওদের মা চা নিয়ে এসেছে। সেও বসে পড়ে তাদের সাথে। স্বর্নার বাবা গল্প শুরু করে,” একজায়গায় থাকতো এক বাবা। সে তার স্ত্রী সন্তান আর নিজের বৃদ্ধ মা কে নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল। সংসারে অতো স্বচ্ছলতা না থাকলেও অভাব ছিল না। বাচ্চাদের মা ও নিজের জীবন নিয়ে খুশি ছিল। সে ছিল স্বামী ভক্ত। তার স্বামীর হ্যাঁ তেই তার হ্যাঁ আর না তেই তার না। সবাই বেশ সুখেই ছিল। ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু, সবসময় তো ভালো সময় থাকে না। একদিন রাত ৩ টার দিকে বাবাটা বাসায় ফিরলো। সেই প্রথম এতো রাতে ফিরেছিল। বাসায় তার মা,স্ত্রী,ছেলে জেগে ছিল। ছোট মেয়েটা কখন ঘুমিয়ে গেছে। তবে, সেই রাতে বাবাটা একা ফিরে নি। ফিরেছে একটা মেয়েকে সাথে করে। মেয়েটার পরণের শাড়িটি দেখে যে কেউই বলে দিতে পারবে, সদ্য বিয়ে করা বউ সে। বাবাটা তার স্ত্রীর সামনে দিয়ে নতুন বউকে নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। তার মা, বউ, ছেলে কাউকেই তোয়াক্কা না করে। তারপরের ঘটনা খুব সাধারণ। কিছুমাস তার প্রথম স্ত্রী তাদের সাথে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পেরেছিল, তার স্বামীর কাছে তার কোনো মূল্য নেই। তবুও সন্তানদের কথা চিন্তা করে সে ছিল সেই সংসারে। তবে, ২ বছর যেতেই নতুন বউয়ের একটা ছেলে হলে, তার পাওনা উপহার হিসেবে বাবাটা তার প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিল। বড় বউটা চেয়েছিল তার সন্তানদের নিয়ে যেতে। কিন্তু, বাবাটা তার সন্তানদের ভালোবাসতো। তাই তাদের কাউকেইদেয়নি। সতীনের সন্তানদের কিন্তু প্রথম প্রথম ভালোই আদর করতো নতুন বউ। কিন্তু, ধীরে ধীরে অবহেলা বাড়তে থাকলো। তার নিজের সন্তানকে নিয়েই সে ব্যস্ত। তাদের আর কি খেয়াল রাখবে? একরাতে ছোট্ট বোনটার প্রচন্ড জ্বর আসলো। সারারাত ভাইটি বোনের মাথার কাছে গিয়ে জলপট্টি দিতে থাকলো। পরবর্তী কয়েকদিন সে বাবার কাছে অনেক অনুরোধ করেছিল যেন একজন ডাক্তার দেখায় তার বোনকে। কিন্তু, মা হীন সন্তানদের কে আর কয়দিন দেখতে পারে? সে আমলে নেয়নি। ভেবেছিল সাধারণ জ্বর। কিন্তু, যেইদিন মেয়েটি নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, সেইদিন সে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। ডাক্তাররা সেই অবস্থায় রোগীকে দেখেই বাবাটাকে ধমক দিয়ে বলেছিল মেয়েকে মেরে ফেলে কেন নিয়ে এসেছেন? বোনটা মারা গেল। মাও নেই। সৎ মাও ভালোবাসে না। সৎ ভাইবোনেরাও কাছে আসে না। বাবাও সময় দিতে পারে না। বৃদ্ধ দাদী শুধু তার শেষ আশ্রয়স্থল। এরপর সে যখন একটু একটু করে বড় হলো, তাকে একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দিল। সে সেইখানে মন দিয়ে পড়তে থাকলো। বাড়িতে অবহেলা আর অমানুষিক কাজের চাপের মধ্যে দিয়েও সে পড়ে যাচ্ছিল৷ সেইখানে সে খুঁজে পেল তারই মতো আরো একজন কে। একটা মেয়েকে৷ ওর জীবনের কাহিনিও প্রায় একরকম। ওর মা তার পুরোনো প্রেমিক এর সাথে চলে গেছে। বাপ টা রেগে সেইদিনই আরেকটা কুমারী মেয়ে বিয়ে করেছে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। মেয়েটাও অনাদরে বড় হতে লাগলো। ওদিকে ছেলেটার আসল মাও বাবার বাড়িতে ভাইয়ের বউদের দাসীবৃত্তি করে কিভাবে যেন কঠিন অসুখ করে মারা গেল। তার দুবছরের মাথায় তার দাদীও মারা গেল। তখন তার আপন বলতে শুধু সেই মেয়েটি। ধীরে ধীরে তারা স্কুল পেরিয়ে হাই স্কুল, তারপর কলেজ, ছেলেটি একটা ন্যাশনালে ভর্তি হয়েই কাজ খুঁজলো। মেয়েটিকে কিন্তু আর পড়াশোনা করায় নি তার বাবা মা। বিয়েও দেয়নি। কারণ, কাজের লোকের বড্ড অভাব ছিল যে। একদিন হুট করেই ছেলেটি মেয়েটিকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরলো। মেয়েটির বাবা আর সৎ মা এলো৷ মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে ত্যাজ্য করলো। ছেলেটির বাবাও তার ছোট বউয়ের কথায় সবার সামনেই ছেলেটিকে ত্যাজ্য করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। ছাত্রাবস্থায় মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাবে ছেলেটি? তবুও ভালোবাসতো বলেই কোনোরকমে টিকে ছিল তারা। মেয়েটি টুকটাক সেলাই মেশিনে জামা সেলাই করতো অন্যদের। আশেপাশের বাচ্চাদের পড়াতো। ছেলেটিও ছোটোখাটো একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। একসময় তাদের একটি মেয়ে হলো। আনন্দে কেঁদে দিয়েছিল দুজনে যখন জেনেছিল তারা বাবা-মা হবে। মেয়েটিকে যতোটা আনন্দে বড় করা যায় করেছে৷ এরপর একটা ছেলে তারপর আবার একটা মেয়ে। ” এইটুকু বলেই থামলো স্বর্নার বাবা। নিজের ৩ সন্তানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” জানো, সেই ছোট্ট ছেলে মেয়ে দুটি কে?”
তারা ৩ জনেই না বললো। স্বর্নার বাবা একটু হেসে বললো,” ছেলেটা হচ্ছি আমি, আর মেয়েটা তোমাদের মা।”
৩ ভাইবোনের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। তারা এইসবের কিছুই জানতো না। স্বর্না থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তার বাবা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” এই গল্পে তুমি কোন চরিত্রটার মতো আচরণ করেছো বলোতো?”
স্বর্না চুপ করে রইলো। ” আমার সৎ মায়ের তাইনা?” ঘরটা কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে গেল। স্বর্নার বাবা তাকে আবার বললো,” কি করে পারলে মা? কি করে? একটা নারী হয়ে আরেক নারীর ঘর ভাঙতে? জন্মের আগেই একটা সন্তানকে তার বাবার থেকে আলাদা করতে? এই বাচ্চাটা কি একটা স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারবে? বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকলে সন্তান রা কি রকম ভাবে বড় হয় জানো তুমি?”
স্বর্নার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চায়ের কাপে হাত দিয়ে দেখলো, সেটা শরবত এ পরিনত হয়ে গেছে৷ তবুও সেটা মুখে তুললো সে। কেউ লক্ষ্য করলো না চায়ের কাপে তার চোখ থেকে এক ফোঁটা #নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।
“তোমার কি লজ্জা করে না আসিফ? ৭ মাস আগে যে মেয়েকে ভালোবেসে ঘরে তুলেছো, তাকে এখন ডিভোর্স দিতে চাইছো? ওর কি হবে তোমার কোনো ধারণা আছে?” প্রবল আক্রোশে আসিফকে কথাগুলো বলে সুনয়না।
” আমি এখন ওকে নিয়ে ভাবছি না নয়না। আমাদের ছেলেটার কথা চিন্তা করো। অন্যের কথা কেন ভাবছো? আমাদের ছেলে আমার আদর ছাড়া বড় হবে, এটা আমি চাই না। আর তুমি তো একটা বেসরকারি স্কুলের টিচার। তুমি কি ওর প্রোপার কেয়ার রাখতে পারবে? আমি চাই না আমার ছেলে আর্থিক সংকটের মধ্যে বড় হোক। এর জন্য হলেও আমাদের আবার এক হওয়া উচিত।”
নয়নার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে আসিফের কথা শুনে। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে সে আসিফকে বলে,” আর নীহারিকা? ওর কি হবে?”
সুনয়নার এই প্রশ্নে যেন একটু হোঁচট খায় আসিফ।কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,” সব বাদ। আমি শুধু আমার ছেলের কথা ভাবতে চাই। ব্যস। আর কিছুই না। তুমি আমার সাথে আবার আমার বাড়িতে যাবে, আমি তাই চাই। না হলে, আমি কোর্টে যাব। বলে দিচ্ছি।”
” তোমার যেখানে খুশি সেইখানে যাও। আমি আমার ছেলেকে তোমার মতো অমানুষের হাতে তুলে দিব না। বের হও এইখানে থেকে না হলে আমি কিন্তু এখন চিৎকার করে ডাক্তার নার্স সবাইকে ডাকবো।”
আসিফ চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার আগে সুনয়নাকে আবার শাসিয়ে যায়। সুনয়না বেডে বসে ছেলেকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে৷ একটু পর আসিফের বাবা রুমে ঢুকলে সে তাকে কিছু না বলতে দিয়েই জিজ্ঞেস করে,” আপনার ছেলে এমন কেন করে বাবা? ও এমন কেন? কেন ও আর দশটা ছেলের মতো না?”
আসিফের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” ওর এই ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ওর মা। আর দ্বিতীয় হচ্ছি আমি। আমাদের ভুলের কারণেই ও এমন করে।”
” মানে কি বাবা? কি বলছেন এইসব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সুনয়না।
চলবে….???