#নোনাজল
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
স্বর্নার মাথা ঘুরে উঠলো। কি বললো লোকটা? তবে কি আসিফ তাকে যা বলতো, সব ভুল?”
আজকে নিজের কাছে নিজেকে বেশ ছোট মনে হচ্ছে স্বর্নার৷ আসিফ তার অফিসে নতুন আসা কলিগকে নিয়ে বিজি। সুনয়না তার ছেলেকে নিয়ে বিজি। সবারই নিজেদের বলে কেউ একজন আছে। শুধু, তারই নেই। কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার মতো কেউ নেই তার। আজ বহুদিন বাদে ফুটপাত দিয়ে হাটছে সে। আগে প্রচুর হাটতে হতো ফুটপাত দিয়ে। না চাইতেও। ৫ টা টাকা বাঁচানোর জন্য পায়ে হেটে স্কুল কোচিং এ যেতো। মাঝে মাঝে বাবা টাকা দিত অটোতে কিংবা রিকশায় করে যাওয়ার জন্য। সে সেইটা জমিয়ে রাখতো। মাঝে মাঝে ২/১ টা শখের জিনিস কিনতো। কত অল্পতেই না তুষ্ট ছিল তখন। আর এখন? তার স্বামীর কত টাকা। দামী গাড়িতে করে ঘুরতে পারে সে। কিন্তু, সুখ কই তার জীবনের?
হাটতে হাটতে স্বর্না একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাড়ালো। তার মনে পড়লো, বিয়ের আগে সে আর আসিফ এইখানেই আসতো। কোণার দিকের একটা টেবিল এ দুজনে বসতো। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা একসাথে কাটাতো। আসিফ তখন তার কতই না খেয়াল রাখতো। তার ভীষণ ইচ্ছে করলো, সেই টেবিল টায় গিয়ে একটু বসতে। সেই ভাবনাতেই যখনই সে পা বাড়ালো, সে বুঝতে পারলো, এইখানে আসা তার উচিত হয় নি। তার পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে এলো। সে বুঝতে পারছিল না সে কি করবে। তার মনে পড়ে গেল অতীতের কথা। এমনি একদিন সে আর আসিফ এইভাবে বসে ছিল। কোথা থেকে যেন ঝড়ের বেগে সুনয়না এসে আসিফকে তার সাথে যেতে বলছিল। সেদিন ভরা রেস্টুরেন্টে কতটা অপমানিতই না হয়েছিল তারা৷ সবাই তার দিকে আঙুল তুলছিল। কিন্তু, এরপরও তারা এইখানে এসেছিল। স্বর্না অবাক হয়ে দেখলো, আসিফ সকালে যে শার্টটা পড়ে বের হয়েছিল বাড়ি থেকে, তার পরণে এখন সেটি নেই। সে আর কিছু না ভেবে চলে আসলো ঐখানে থেকে। এই মুহূর্তে সে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ ভাবছে। সবারই কেউ না কেউ আছে। শুধু তারই নেই।
” আজকাল বড্ড কাজের প্রেশার যাচ্ছে বুঝি?”
” হুমম, আর বলো না। নতুন কিছু মেম্বার এসেছে। এদের কাজ বুঝাতে অনেক সময় লাগে।”
“দেখো, তাদের কাজ বোঝাতে গিয়ে যেন আবার আমার মতো প্রেমে পড়ে যেও না। আমার প্রেমেই যেন শেষ প্রেম হয়।” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে স্বর্না।
আসিফের বুকটা ধ্বক করে উঠে। স্বর্না কি তবে কিছু টের পেয়ে গেল? না,না এখন যদি এইসব বাইরে জানাজানি হয়ে যায়,তাহলে তার চাকরি টা আর থাকবে না। সুনয়নার সাথে ডিভোর্স এর সময় অনেক ঝামেলা হয়েছিল। তাকে আরো সতর্ক থাকতে হবে এখন থেকে। দুই দিকই সামলাতে হবে। সে স্বর্নার দিকে তাকিয়ে রাগী চোখে বলে,” তোমার তাই মনে হয়? আমাকে এমন ভাবো?তোমাকে ভালোবেসে কি না করেছি বলো? এখন তুমিই আমার কাছে সবকিছু, বুঝলে?”
স্বর্নার চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে। সে কিছু বলতেই যাবে, তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। রাত ১১ টার পরে তাদের রুমে কে আসবে? আসিফ দরজা খুলে দেখে তার বাবা। সুনয়নার সাথে ডিভোর্স এর পর বাবার সাথে খুব কমই কথা হয় আসিফের। হঠাৎ এতো রাতে এইভাবে দরজার সামনে তাকে দেখে সে খানিকটা হকচকিয়ে উঠে। আমতা আমতা করে বলে,” বাবা..বাবা..তুমি এইখানে? কিছু বলবে?”
“হুমম, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। পসিবল হলে একটু বারান্দায় এসো।” বলেই বারান্দার দিকে পা বাড়ায় বাবা।
আসিফও কাঠের পুতুলের মতোই তার পিছু নেয়।
“কি বলবে বাবা?”
” আমার নয়না মায়ের ব্যাপারে। ”
” বাবা, ওর সাথে তো আমার সব সম্পর্ক শেষই হয়ে গিয়েছে। এখন আর কি বলবে ওর ব্যাপারে? আর ও তো বলেছে আমার থেকে কোনো টাকাপয়সাও নেবে না। ”
“আমাকে বলতে দিবে একটু? আগ বাড়িয়ে কথা বলছো কেন?”
“ওকে বাবা। বলো। যাই বলো না কেন, আমাকে শুধু আবার ওর দায়িত্ব নিতে বলো না। আমি সেটা পারবো না।”
আসিফের কথা শুনে ওর বাবা বাঁকা চোখে হেসে বলে, ” সব শেষ মানে? ও কি তোমাকে ডিভোর্স পেপার ফেরত পাঠিয়েছে? যাতে তুমি বুঝতে পারবে যে ও সিগনেচার করেছে?”
” বুঝলাম না বাবা। ও এখন ও সিগনেচার করেনি? কেন করেনি? ও তো বলেছিল যে আমাকে আর ওর জীবনে দরকার নেই। তাহলে করে নি কেন? আমি এখন আমার বর্তমান নিয়ে ভালো আছি। ও কি আবার আসতে চাইছে আমার জীবনে?”
” নাহ বাবা, ও তোমার জীবনে আসবে না আর। তুমি চাইলেও আর আসবে না। কিন্তু ওর জীবনের সাথে আরো একটি জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল, যার কারণে ও তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারে নি। তবে, এখন সে পারবে। ”
” কি এমন হয়েছিল বাবা, যে ও তখন ডিভোর্স পেপার এ সাইন করেনি?”
“কারণ, তখন ও গর্ভবতী ছিল। আর, আশা করি, তুমি ভালোভাবেই জানো যে, গর্ভাবস্থায় কোনো মেয়ের ডিভোর্স হয় না? আর গতকাল তার ছেলে হয়েছে। এখন ছেলের যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক করেই সে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তুমি টেনশন করো না। দূর্ভাগ্যবশত সুনয়নার স্বামী আর তার ছেলের বাবা তুমি। না হলে, তোমাকে সে এইসবে জড়াতো না অবশ্যই। এখন বলো, তোমার কি ৬ দিন পর সময় হবে, ছেলের আকিকা করবো, নাম ঠিক করবো। আরও অনেক কাজ আছে। জন্ম সনদ ও বের করতে হবে। তারপরেই সুনয়না তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারবে।”
” আমি বুঝলাম না বাবা, তুমি বলতে চাইছো, আমার একটা ছেলে হয়েছে গতকাল?”
“হুমম। ”
” মানে কি এইসবের? সুনয়নার একটা ছেলে হয়েছে, যার বাবা আমি? আর আমি জানতাম ই না যে আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট? ও আমাকে কেন বলেনি? বলো?”
” কেন বলেনি, সেটা আমি জানিনা। সেটা তার থেকেই জেনে নিও। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাতে গেলাম।”
আসিফ স্থানুর মতো বসে রইলো বারান্দায়। একজন মানুষ যতোই খারাপ হোক না কেন, সে সবসময়ই একজন ভালো বাবা। আসিফ ভেবেই পাচ্ছে না, কেন নয়না তাকে সবকিছু জানায়নি৷ না জানালে হয়তো সবকিছু আজ অন্যরকম হতো। স্বর্নার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। কি বলবে গিয়ে সে? সে বাবা হয়েছে যেটা তার জন্য সবচেয়ে খুশির খবর। কিন্তু, সেই সন্তানের মা স্বর্না নয়। মেয়েটার কেমন লাগবে? যদি সে শুনে, সুনয়নার প্রতি আবার তার ভালোবাসা জেগে উঠছে? কিন্তু হঠাৎই তার মস্তিষ্ক সচল হতে শুরু করে। সে রুমে তার ফোনটা রেখে এসেছে৷ নীহারিকা যেকোনো সময়ে কল করতে পারে। স্বর্না দেখলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। সে দ্রুতগতিতে পা বাড়ায় রুমের দিকে।
এদিকে স্বর্না আসিফ যাওয়ার পরই আসিফের অফিসের ব্যাগটা চেক করেছে সুনয়নার কথা মতো। সে অবাক হয়ে দেখে, ব্যাগের ভেতর আরেকটা ছোট ব্যাগ যার ভিতর আসিফের আরেক জোড়া শার্ট-প্যান্ট রয়েছে। যেটা সে রেস্টুরেন্টে দেখেছে। সে যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে। তারমানে আসিফ তাকে আগে যেসব বলতো, তার সবকিছুই মিথ্যে। সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য সে এইরকম করেছে। স্বর্না হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। সে যে কতোটা বোকা সে এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে তার।
আসিফ ঘরে ঢুকেই আগে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপর স্বর্নাকে বললো,” অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো।” বলেই সে কোনো জবাবের তোয়াক্কা না করে নিজেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। অগত্যা, স্বর্নাও লাইট অফ করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। কারও চোখে ঘুম নেই। দুজনেই জেগে আছে। একজন নিজের খারাপ কাজের কৃতকর্মের কথা চিন্তা করে চোখের পানি ফেলছে। আরেকজন নিজের সন্তানের চেহারা নিজের চেহারায় মিলাতে ব্যস্ত। শুয়ে শুয়েই আকাশ কুসুম কল্পনা করছে সে৷ স্বর্নাকে সে বুঝিয়ে ডিভোর্স দিবে। তারপর সুনয়নার কাছে মাফ চেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনবে। নীহারিকাকেও কোনোভাবে দূর করবে নিজের লাইফ থেকে। স্বর্না আর সুনয়না যদি না মানে, তবে ছেলেকে আর স্বর্নাকে নিয়ে সে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। অনেকদিন বাদে একটা প্রশান্তির ঘুম হলো তার। কিন্তু, সে যদি জানতো, কালকে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে, তাহলে কি সে এইভাবে ঘুমাতে পারতো?
চলবে…