#নোনাজল
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“কেমন আছো, স্বর্না?”
“ভালোই আছি। বাবু কি নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে নাকি সিজার?”
“নরমাল।”
স্বর্নার মুখে যেন কথা আটকে যাচ্ছে। বলার মতো কোনো কথাই সে খুঁজে পাচ্ছে না। সে এসেছিল সুনয়নার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য। কিন্তু, বর্তমানে সেইসব বলার মতো অবস্থা নেই। তাই কথা আগানোর জন্য সে আবার বললো,” বাবু কবে হয়েছে? ”
” কালকে রাত ১২ টার দিকে।”
স্বর্না বুঝতে পারলো এই কারণেই সেইসময় তার শ্বশুরকে এতো খুশি খুশি লাগছিল। নিজের বংশের প্রদীপ এসেছে যে। খুশি তো হবেই।
” তুমি যে আসবে, আমি কিন্তু জানতাম।”
“কিভাবে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে স্বর্না।
” কারণ, আমি জানতাম, তুমিও একসময় আমার প্রবলেম গুলো ফেইস করবে। তখন তোমাকে আমার কাছে আসতেই হতো। কারণ, এই দুনিয়ায় তোমাকে বোঝার মতো আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
স্বর্না মাথা নিচু করে বসে রইলো। তাকে চুপ থাকতে দেখে সুনয়না আবার বললো,” আমি ঠিক বললাম কি?”
“হুমম, আপনিই ঠিক। আমার উচিত ছিল আপনাকে বিশ্বাস করা।” রিনরিনে গলায় বললো স্বর্না।
“বড্ড ভালোবাসো আসিফকে তাইনা?”
“হুমম, ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। বিশ্বাস করুন, আমি ওকে অনেক ভালোবাসি।” একটু জোর গলায়ই যেন বললো স্বর্না।
“আমিও ওকে ভালোবাসি স্বর্না। সে শুধু আমার স্বামীই নয়, বর্তমানে আমার সন্তানের বাবা।”
আচমকাই স্বর্না মুখ ফসকে বলে ফেললো,” আপনার স্বামী? আপনাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে তাইনা?”
” আমি তো সিগনেচার করিনি। গর্ভাবস্থায় তো ডিভোর্স হয় না কোনো মেয়ের। সেই হিসেবে, আমি এখন ও আসিফের স্ত্রী। তার সন্তানের মা। আর সেই অনুযায়ী, আমাদের সম্পর্ক কি এসে দাঁড়ায় বলো তো? আমরা হচ্ছি একে অন্যের সতীন।”বলেই হাসতে লাগলো নয়না।
কেন যেন স্বর্নার ভীষণ ভয় লাগছিল এখন। নয়না সেটা বুঝতে পেরে বললো, ” ভয় পেও না। আমি যাব না তোমার সংসারে। অন্যের জিনিসে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। যদিও সেটা আমার ছিল একসময়। এখন সেটা অনেকেই ব্যবহার করেছে। আমি আবার ভীষণই খুঁতখুঁতে।”
নয়নার ঠান্ডা মাথায় করা অপমান টা ভীষণ আঘাত করলো স্বর্ণলতাকে। কিন্তু, সে কিছু বললো না। কিই বা আর বলবে? সে তো আর মিথ্যে কিছু বলেনি।
” তাহলে আপনি ওকে ডিভোর্স দিবেন কবে?”
” আমার ছেলের যাবতীয় কাগজপত্র রেডি হোক। বৈধ ভাবেই ওকে ওর বাবার পরিচয় পাইয়ে দিই। তারপর ডিভোর্স পেপার এ সাইন করে পাঠিয়ে দিব স্বর্না। তোমাকে আমায় নিয়ে টেনশন করতে হবে না। তুমি বরং আসিফের নতুন বানানো মেয়েটাকে কিভাবে আসিফের লাইফ থেকে সরাবে, সেই চিন্তাই করো।”
” আমি আসলে আপনাকে স্যরি বলতে এসেছিলাম। আমার উচিত হয়নি সবকিছু না জেনে না শুনে আসিফকে ভালোবাসা।”
“এতে তোমার দোষ নেই। ভালোবাসা বা ভালোলাগা কাউকে তো আর বলে কয়ে আসে না। তাইনা? নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো। আচ্ছা, একটা কথা বলতো, তুমি কিভাবে আসিফকে ভালোবাসলে? মানে তোমাদের প্রেমের সূচনা কিভাবে?”
স্বর্না অবাক হয়ে ভাবছে সুনয়নার কথাগুলো। একজন স্ত্রী তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বলছে, তার স্বামীর সাথে কিভাবে তার সতীনের প্রেম হলো। স্বর্না বেশ বিব্রত হলো। সুনয়না বুঝতে পেরে বললো, ” আরেহ, লজ্জা পাচ্ছো কেন? বলোই না। আমি তো তোমার বড় বোনের মতো।”
স্বর্না বলতে শুরু করলো, ” আমি আসলে নতুন এসেছিলাম তখন। নতুন চাকরি আর জীবনের প্রথম চাকরি। আমার বাবা খুব কষ্ট করে আমাদের বড় করেছিল। আমার আর ভাই-বোন এর পড়াশোনার পিছনেই জীবনের বেশিরভাগ উপার্জন ঢেলেছে। চাকরি পাওয়ার পর ভেবেছিলাম এইবার আর কোনো কষ্ট করতে দিব না বাবা-মাকে। প্রথম ২ মাস ভালোই চলছিল। আসিফ মাঝেমধ্যে আমার ডেস্কে এসে গল্প করে যেত। মাঝে মাঝে আমার টিফিন শেয়ার করতো। আএ বলতো, তার স্ত্রী নাকি অনেক খারাপ। অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক আছে। তাছাড়া একদিন টিফিন ও বানিয়ে দিত না। বেশিরভাগ সময়েই সে ক্যানটিনের খাবারই খেতো। জামা-কাপড় অগোছালো থাকতো। বেচারা টাই বাঁধতে জানতো না। ওর স্ত্রী নাকি ওকে সকালে এই টাই বাঁধতেও সাহায্য করে না। কোনোরকমে নিজেই সে রেডি হয়ে আসতো। মাঝে মাঝে তো আপনাকে কল ও দিত আপনি নাকি বিরক্তি দেখিয়ে কল কেটে দিতেন। তাছাড়া শাশুড়ী মাও তো এইসব বলতো। আমার সাথে বিয়ের আগেই উনি কথা বলতেন। তখন তো আমার নামে উনি প্রায় অজ্ঞান ছিল। আমি আমার বাবা-মাকে আসিফের কথা বললে উনারা আমাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেন৷ কিন্তু আমি তো অন্ধ ছিলাম। কিছুই বুঝতে চাইনি। সমাজের বাকি সবার কাছে আমাদের সম্পর্কটা ছিল পরকিয়ার। কিন্তু আমার কাছে ছিল ভালোবাসা। আমি যে ওকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আপনি যেদিন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, আমার আপনার প্রতি অনেক রাগ হয়েছিল। খুব খারাপ লাগছিল আপনাকে। আমি আপনার কোনো অনুরোধও শুনিনি। আমার বাবা-মায়ের কথাও শুনিনি। উনারা আমার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এখন তো, আমার মুখ ও দেখতে চায় না উনারা। সকালেও কল করেছিলাম উনারা অনেক কথা শুনিয়েছেন আমাকে। আমি কিছু মনে করিনি। কারণ, আমি এইসবই ডিজার্ভ করি।” কথা শেষ করার সাথে সাথেই এক ফোঁটা #নোনাজল গড়িয়ে পড়লো তার কপোল বেয়ে। সে তা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিল। সুনয়নার দিকে তাকিয়ে আবার বললো,” কি নাম রাখলেন আপু আপনার ছেলের?”
” এখন ও ঠিক করিনি কিছু। তবে, সাতদিনের দিন আকিকা করে নাম দিয়ে দিব একটা। ”
আবার ও কিছুসময়ের জন্য নীরবতা পালন করলো দুজনেই। সুনয়না আবার বললো,” তোমাকে আরেকটা কাজ দিব আমি। করতে পারবে?”
” কি কাজ?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে স্বর্না।
” তুমি এখন আসিফের অফিসে যাবে। বুঝলে? ”
” তারপর?”
” কিছুই না। তুমি গেলেই বুঝতে পারবে।”
” মানে? বুঝলাম না আপু।”
” আজ তুমি আসিফের অফিসে যাবে। তারপর আমার ছেলের আকিকার দিন তোমাকে দাওয়াত দিলাম৷ তুমি আমাদের বাসায় আসবে। বুঝলে?”
” আচ্ছ, ঠিক আছে আসবো। কিন্তু এখন ঐখানে গিয়ে আমার কি কাজ?”
” তুমি গেলেই বুঝতে পারবে। আর হ্যাঁ, তুমি আজ আসিফ বাসায় আসার সাথে সাথেই ওর ব্যাগ টা চেক করবে। বুঝেছো?”
“সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আপু।আমি এইসব কেন করবো?”
” গেলেই বুঝতে পারবে। ৭ দিন পর তোমাকে আসতেই হবে। কে যানে, আগেও আসা লাগতে পারে। ” বলেই বাঁকা চোখে হাসলো সুনয়না।
হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাটছে স্বর্না। তার ভীষণ ইচ্ছে করছিল, সুনয়নার বাচ্চাটাকে কোলে নিতে। কিন্ত, সে বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। স্বর্না সাধারণ ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, সে দেখতে পেল, সদ্যোজাত এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক বাবা কি সুন্দর করেই না কথা বলছে। আচমকাই এদিক ওদিক তাকিয়ে স্ত্রীর কপালে আলতো করে চুমু দিল। স্বর্নার হঠাৎই মনে হলো, আচ্ছা, সুনয়নার ও কি এইসব পাওয়া দরকার না? মেয়েটা নিজের প্রেগ্ন্যাসির জার্নিটা কত কষ্ট করেই না কাটিয়েছে একা একা।
অফিসের সামনে এসে অটো থেকে নেমে গেইট দিয়ে যখন অফিসের ভিতরে ঢুকতে যাবে, তখনই দারোয়ান সালাম দিয়ে বলে উঠলো, ” ম্যাডাম, আপনার রান্নার হাত কিন্তু বেশ ভালো। আগের ম্যাডামের রান্নার হাত ও ভালোই ছিল। তবে, আপনার রান্না করা খাবার টাই বেশি ভালো।”
” মানে? আমি আপনাকে খাবার কখন দিলাম?”
” কেন? স্যার তো প্রতিদিনই নিজের টিফিন টা আমাকে দিয়ে যায়। আবার যাওয়ার সময় টিফিন বক্স নিয়ে যায়। ”
স্বর্নার মাথা ঘুরে উঠলো। কি বললো লোকটা? তবে কি আসিফ তাকে যা বলতো, সব ভুল?
চলবে…..