নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০৫

0
3

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৫]
-তামান্না

–রিফাত :আসল কাহিনি শোনা হয়েছে রিহান?
–রিহান:কি কাহিনি? কি হয়েছে?
–রিফাত :নিরব তার প্ল্যান সম্পর্কে সব কিছু শেয়ার করেছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিমনের সাথে।সে ইচ্ছে করেই সবটা করেছে।তার সাথে পারিবারিক সমস্যা ছিলো নিরুদের।তারপর সব কাহিনি খুলে বলে।
রিহান চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সব কথা শুনে।দুই দিন যাবত এটাই আন্দাজ করছিল।

–রিহান:একদম শান্ত গলায় বলে তারপর কি করা উচিত?
–রিফাত :হ্যালো!হ্যালো!তুই ঠিক আছিস রিহান?
–রিহান :রাখছি।মাথা ঠিক লাগছে না।তারপর কল কেটে ফোন টাকে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।চুল গুলো শক্ত করে হাত দিয়ে মুঠোয় বন্দী করে বসে পড়ে।ভীষণ রাগ লাগছে ভীষণ।নিরুপমার চেহারা অসহায় চাহনি সব কিছু এখন ভাসছে।সব কিছু ক্লিয়ার করা হয়েছে কিন্তু সবটা হাত থেকে দূরে ফসকে যাওয়ার পর।

–রিফা:ভাইয়া!ভাইয়া!দরজা খোল।তারপর কান্না করতে করতে বলে আম্মু কেমন করছে।ভাইয়া দরজা খোল।
–চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে রিহানের।বোনের মুখ থেকে এমনটা শুনে দৌড়ে দরজা খুলে বের হয়।ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে সেন্স নেই মায়ের।
–রিহান:তুই আব্বু কে কল কর।তারপর মা’কে কোলে করে গাড়িতে বসে।পিছনের সিটে মায়ের মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে রিফা আর কান্না করছে।

–বারান্দায় সবাই মিলে অপেক্ষা করছে ডাক্তার আসার।রিফার কান্না কোনো ভাবেই থামছে না।
রিহান মাথা নুয়ে বসে আছে আর ওর আব্বু ও মন খারাপ করে বসে আছেন।আর একটু পর পর চোখের পানি মুছছেন।
ছোট থেকে আজ অব্ধি বাবা মায়ের মধ্যে ভালোবাসা ছাড়া কোনো ঝগড়া দেখে নি।সব সময় একে অপরের পরিপূরক হয়েই পাশে রয়ে গেছে।আজকে প্রথমবার তাদের খানিকটা দূরত্ব চোখ দিয়ে পানি সব মিলিয়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছে রিহানের।সবটাই বোধহয় ওর অন্যায়ের ফল।এর মধ্যে কয়েক বার নিরুকে কল করেছে রিহান।কিন্তু ফোন সুইচড অফ।নিরুর মায়ের ফোন অন থাকলে ও রিসিভ হয় নি।

–ডাক্তার :আসলে রোগী স্ট্রোক করেছেন।জ্ঞান ফিরে আসে নি তবে ফিরে আসবে।কিন্তু…
–রিহান:ককককিন্তু কিহহহহহ?
–ডাক্তার :প্যারালাইসড হয়ে গেছে এক হাত এক পা।তবে বিশ্রাম কিংবা মানসিক ভাবে সুস্থ আর পুরোপুরি যত্ন পেলে ঠিক হয়ে যাবে আশা করি।এতে খানিকটা সময় লাগবে।

–এবার রিহানের আব্বু কান্না করতে করতে বসে পড়েন।রিহান বাবার দিকে তাকিয়ে বড় করে নিশ্বাস নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে শেষ করে নেন।
–রিহান:বাবার কাঁধে হাত রেখে বসে বলে,,তোমার মতো মানুষ ভেঙে পড়ে?শক্ত হতে হবে তো আব্বু।আমরা যে পুরুষ মানুষ।সবাই মিলে আম্মু কে সুস্থ করে ফেলবো।তারপর নিশা এগিয়ে আসতেই বাবা আর বোন কে জড়িয়ে ধরে।
ছোট বেলায় বাবা মা যেমন আদর করে সন্তান কে আগলে রাখেন ঠিক তেমনি বাবা মা বৃদ্ধ হলে সন্তান বড় হলে বাবা মা কে আগলে রাখতে হয়।

********
–নিরুরা বাসায় আসার পর থেকে তিন দিন চলে যায় বাসা গুছাতে।তারপর তিন দিন চলে যায় কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত কাজে।অবশেষে নিরুকে সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি করে তবে আগামী তে এইচএসসি দিতে হবে।আর নিশাকে ও স্কুলে ভর্তি করা হয়।
সব গুছিয়ে এক সপ্তাহ পরে নিরুর আম্মু মেয়েদের কে রেখে চলে আসেন বোনের বাসায়। উপর মহল থেকে কাগজ পত্র ঠিক হলে তারপর ট্রান্সফার এপ্লিকেশন ওকে হবে।আপাতত মিলিয়ে এবং মানিয়ে নিতে হবে সবটা।বোনের বাসা থেকে স্কুল চালিয়ে নিবে,, ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের ওখানে ও যাবে।
–দুই দিন যাবত একটা নাম্বার ফোন করছে।ভয়ে রিসিভ ও করছে না।নিরুর ভয়ে এতো দিন আরও রিসিভ করে নি।তবে আজকে সমস্যা নেই তাই রিসিভ করে।
–মিতা:ওয়ালাইকুম আসসালাম!কে?
–রিহান:আমি রিহান আন্টি।ভালো আছো?কোথায় তোমরা?
–মিতা:চোখের চশমা টা ঠিক করে বলে,, রিহান?
–রিহান:আম্মু অসুস্থ আন্টি।কথাটা বলার সাথে সাথেই দুপাশ থেকে নিরবতা।
–মিতা:কোথায় তোমরা?হসপিটাল নাকি বাড়িতে?আমি স্কুল শেষে আসবো।।
–রিহান :বাসাতেই আজকে আনা হয়েছে।তুমি বরং এসে দেখে যেও।তারপর কথা শেষ করে কল কেটে দেয়।

*************
–আব্বু :ফ্লাইট তো ক্যান্সেল হয়ে গেলো? এখন কি করবা?
–রিহান:এইচএসসি শেষ করে যেতে চাই।তারপর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে এসে মাষ্টার্স শেষ করবো।চাকরি বা ব্যবসা যেকোনো একটা স্থায়ী করে নিবো।
–আব্বু :জোর করবো না।তুমি যা ভালো বুঝো।চাইলে এইচএসসি শেষ করেও আমার ব্যবসায় যোগ দিতে পারো।এমনিতেই আমার শরীরের পক্ষে এতো দখল নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
–রিহান:সময় তো আছে দেখি কি করা যায়। আর আম্মুর দেখাশোনা ও তো করতে হবে। রিফা ছোট মানুষ সবটা সামলাতে পারবে না।

–এদিকে নিরু আর নিশা পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।নিরুর অবশ্য তেমন চাপ নেই তবে নিশার চাপ বেড়েছে।নিরু বাসাটা খুব সুন্দর করে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে।
নিজেদের বাড়ির মতো না হলে ও খুব সুন্দর বাসাটা।তিনটে রুম মস্ত বড় বেলকনি আর রান্না ঘর ড্রয়িং রুম সব আছে।বাসার সামনে ও ছোট একটা বাগান।মামা ও নতুন বাড়ি দেখছেন কিনবে বলে।বাবার পেনশনের টাকা আর বাড়ি বিক্রি করার চাচার দেওয়া টাকা,, মায়ের কিছু জমানো টাকা সব মিলিয়ে নিজেদের একটা বাসস্থানের প্রয়োজন আছে।আর হয়ে ও যাবে সহজেই।

–নিরু:কি করছো আম্মু?ভীষণ ব্যস্ত,,সারাদিন একটা কল ও করো নি?
–মিতা:স্কুল থেকে ফিরে আসি নি মিটিং হচ্ছে।বাসায় গিয়ে কল করবো।তারপর কোনো রকম কল কেটে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেন মিতা।কলিং বেলে চাপ দিতেই রিফা দরজা খুলে দেয়।
তারপর রিফার সাথে ওর আম্মুর রুমে চলে যায়। রিহান ওর আব্বু ওখানেই আছে।
–রিহান :সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে বসতে বলে।
–রিহানের আম্মুর দিকে তাকিয়ে কান্না করে দেয় মিতা।রিহানের আম্মু চুপচাপ মলিন মুখ করে তাকিয়ে আছে।আর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

–রিহানের আব্বু :তুমি এসেছো মিতা?এতো কিছু হয়ে গেলো আমরা একসাথে কথা বলে মিটমাট করতে পারলাম না?
–মিতা:সব কিছু হাতের বাইরে ছিলো ভাইজান। আপনি তো জানেন নিরুর চাচা চাচিরা কেমন।ছোট্ট একটা ঘটনার পর এসব হয়ে গেলো।
–রিহান মাথা নুয়ে ফেলে।ভীষণ খারাপ লাগছে।কোনো রকম একটা অজুহাত দেখিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
–রিহানের আব্বু :আমি জানি রিহান যা করেছে অন্যায়।তবে রিহান বুঝতে পেরেছে ও ভুল করেছে,, আর ভুল পথটা জোর করে বের করে দিয়েছে নিরব।তারপর পুরো ঘটনা খুলে বলে।
–মিতা:যা ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।তবে আমার মেয়ে টা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।সহজ সরল মেয়ে আমার সত্যিই কিন্তু রিহান কে ভালোবেসেছে।আমি সেই শুরু থেকেই খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।তবে খুশিই হয়েছি।যেহেতু আমরা এটাই চাচ্ছিলাম ওদের বিয়ে দিতে।তারপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নিরুর আব্বুর ও ভীষণ শখ ছিলো রিহান তার মেয়ের জামাই হবে।
তারপর এতো জটিল কিছু হয়ে গেলো আমার মেয়ের ক্যারিয়ার ও নষ্ট হওয়ার পথে,, সব মিলিয়ে খানিকটা দখল যাচ্ছে।তাছাড়া সম্মান তো আর কিনতে পাওয়া যায় না।

–রিহানের আম্মু :আস্তে আস্তে অস্পষ্ট স্বরে হাত তুলে মাফ চায়।সাথে রিহানের আব্বু ও।রিফা এগিয়ে এসে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
এরমধ্যে রিহান রুমে প্রবেশ করতেই ওর আব্বু বলে বসো রিহান।তোমার সামনেই সবটা বলতে চাই।
–রিহানের আব্বু :বাসায় একজন মানুষের ভীষণ প্রয়োজন আর রিফার পক্ষে সব কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।তাই আমি আর তোমার বান্ধবী ভাবছি নিরু আর রিহানের বিয়ে টা দিয়ে দিতে।মিতা কিছু বলতে গেলে হাত দিয়ে থামিয়ে বলে,, যেহেতু সেই ছোট বেলায় আমরা ঠিক করে রেখেছি।রিহান অবাক হয়ে কথা গুলো শুনে। ছোট বেলায় ওদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে সত্যি? মনে মনে এসব প্রশ্ন করে রিহান।

–মিতা:মাফ করবেন ভাইজান।এটা কখনোই সম্ভব না,, নিরুর সামনে এই প্রস্তাব আমি কখনোই রাখতে পারবো না।আমি আমার মেয়ের সামনে ছোট হয়ে যাবো প্লিজ!
–রিহান:আমি ওকে রাজি করাতে পারবো আন্টি।গত এক বছরে ওকে মোটামুটি ভালো ভাবে চেনা হয়েছে আমার।
–মিতা:তাও রাজি হবে না।আর তুমি যে অন্যায় টা করেছো….আর কিছু বলতে পারেন নি মিতা।দৌড়ে এসে পায়ের কাছে বসে পড়ে রিহান।মাথা নুয়ে বসে।

–রিহান:তোমার মেয়ে কে সত্যি আমি ও ভালোবাসি।যা করেছি ভুল দেখানোর জন্য করেছি আন্টি।আমি আমার জীবনে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য হলেও ওকে চাই।না হলে এতো অনুশোচনা আর অপরাধ বোধ আমাকে বাঁচতে দিবে না।
সেদিন আমার ও খুব কষ্ট হয়েছে আমিও এরপর আর ভালো থাকছি না।প্লিজ আন্টি আমাকে একটা সুযোগ দাও।মিতা হাত দিয়ে রিহান কে দাঁড় করিয়ে বলে,,আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। সব কিছুর দায়িত্ব শুধু তোমার, দেখো রাজি করাতে পারো কি না!
–তারপর রিহানের মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে আসছি ভালো থাকিস।

**************
–নিশা:এখানে ভালো লাগে না আপু।চলনা আমরা আমাদের শহরে চলে যাই।ওখানে বাসা নিয়ে থাকি।
–নিরু:ঐ শহর নিষিদ্ধ নিশা।ঐ শহরে তোর বোন কলঙ্কিত ছাড়া কিছু নয়।সেখানে তোর সম্মান রাখতে পারে নি তোর বোন।সেজন্য আমি ভীষণ লজ্জিত।কথা গুলো বলে বোনকে জড়িয়ে ধরে নিরু।চুপচাপ কান্না করতে থাকে।
–নিশা:থাকুক। আমরা তো জানি তুমি কেমন।আমরা আমাদের মতো আমাদের রাজ্যে রাজকন্যা হয়ে থাকবো।
–নিরু:বাবা ছাড়া মেয়েরা রাজকন্যা হয় না তার প্রমাণ চাচারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

–এরমধ্যে কল বাজতেই রিসিভ করে নিরু।তারপর কতক্ষণ মায়ের সাথে আড্ডা দেয় দুই বোন মিলে।
–মিতা:একটা কথা বলি নিরু?আগেই বলি রাগ করবি না।
–নিরু:বলো।
–মিতা:আমি অনেক চেষ্টা করছি দুই বছর আগে ট্রান্সফার করা সম্ভব না।তোরা বরং এই শহরে চলে আয়।তোর আঙ্কেল বলছেন পরীক্ষা টা দিয়ে দিতে।অযথা এক বছরের নিচে পড়ার দরকার কি?
–নিরু:ভালো লাগে না ঐখান টাতে।মানুষ গুলো ও খুব বিরক্তিকর।দম বন্ধ হয়ে আসে,, ঐ শহর টাতে তোমার মেয়ে কলঙ্কিত আম্মু!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে