#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৩]
-তামান্না
–রিফাত :গলা পরিষ্কার করে বলে নিরুপমা? তারপর এগিয়ে যায়।রিহান বাইক রেখে চুপচাপ গাছের আড়ালে চলে যায়।
–নিরু:ভালো থাকুন ভাইয়া।কলেজে একটা সময় আপনাকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে হয়েছে।কথাটা বলতেই ছলছল করে উঠে চোখ।
–রিফাত:ক্লাস করলে না,,চলে যাচ্ছো যে?
–নিরু:চলে যাচ্ছি।টিসি টা দেখিয়ে বলে এটার জন্যই আসা।হয়তো আর দেখা হবে না তবে ভালো থাকবেন।কথাটা বলেই সামনে এগিয়ে যেতে নিলে,,
–রিফাত:কই চলে যাবা নিরুপমা?
–নিরু:জোর পূর্বক হেসে পিছনে তাকিয়ে বলে,, অচিন পুরে।অচেনা মানুষ আর বিশ্বস্ত পরিবেশে।এখন আমি আমার ইচ্ছে মাফিক জায়গায় বসত করবো,,আজকেই ছুটি নিয়ে নিবো এই জন্মের শহর।মানুষ মায়া অবসর ভালো লাগা আর ভালবাসা থেকে।দোয়া করবেন এই ছুটি যেন আজন্ম কালের হয়।
তবে আমার শহরের মায়া জমানো কিছু মানুষ ধুলোবালি প্রিয় শৈশব কে ভীষণ মিস করবো। আফসোস নিয়ে কাটিয়ে দিবো জীবনের শুরুর দিকের এই ভুলের জন্য।দোয়া করবেন সামনের জীবনে ভুল কে যেন পায়ের তলায় পিষে সামনের গন্তব্যে চলতে পারি।আসি বলে একটা রিকশায় উঠে বসে।
–আর এদিকে রিফাত এখনো তাকিয়ে আছে নিরুপমা আর ওর চলে যাওয়া রিকশার দিকে।
–রিহান:চলে যাচ্ছে?
–রিফাত :হুম!কেন খুশি হস নি?
–রিহান:সামনেই তো পরীক্ষা এখন কোন কলেজে যাবে?ফরম ফিলাপ সবই অলরেডি করা হয়ে গেছে।
–রিফাত:যা ইচ্ছে তা করুক তোর কি?তুই তো এটাই চেয়েছিলি?
–রিহান:আমি চেয়েছি খানিকটা শিক্ষা পাক তবে জীবন নষ্ট হয়ে যাক এটা চাই নি।তাছাড়া সে কি কম নাকি?আমাদের পরিবারের সাথে সখ্যতা থাকার পরে ও আমার নামে বদনাম করতো নিরবের সাথে।তাছাড়া আমি না হয় মন থেকে সম্পর্কে যাই নি,, সে কি কম নাকি?গোপনে আরও সম্পর্কে আছে।
–রিফাত:আমার মনে হয় নিরব কে প্রয়োজনের থেকে ও বেশি বিশ্বাস করে ফেলছিস।তাছাড়া নিরব ওর চাচাতো ভাই হয়ে ও কিভাবে ওর খারাপ চায়??
–রিহান:নিশ্চয়ই নিরু ভালো না দেখেই ভাই হয়ে ও খারাপ চায়।
–রিফাত :একদিন ভীষণ ভাবে পস্তাবি, নিরুপমার অভাবে দুঃখে থাকবি।কথাটা বলেই ওকে ফেলে রিফাত একা একাই চলে যায়।
*******
–নিরুর আম্মু :এটা কিন্তু ঠিক করছেন না ভাইজান?ন্যায্য দাম না দিন অর্ধেক তো দিবেন? তাছাড়া আমার তো মেয়েদের নিয়ে চলতে হবে। স্কুলে ও দৌড়াদৌড়ি করে ম্যানেজ করতে হবে সবটা।
–বড় চাচা:এক পয়সা ও বেশি দিবো না। তোমার তো ভাগ্য ভালো মেয়ের মা হয়ে ও সম্পত্তির ভাগের টাকা পাচ্ছো।চুপচাপ যা দেই নিয়ে নাও।
–নিরুর আম্মু :কান্না করতে করতে টাকা গুলো হাতে নিয়ে নেয়।তারপর বলে,, সবাই মিলে আমাদের বড্ড ঠকালেন।তবুও উপর ওয়ালার প্রতি কোনো আক্ষেপ নেই,, কারণ ভাগ্যে রেখেছে বলে।আর আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী।আর এটাও বিশ্বাস করি খারাপ সময় কেটে গিয়ে ভালো সময় আসবে।টাকা গুলো হাতে নিয়ে বের হয়ে যায়।
*********
–কয়েক দিন লাগবে আরও ট্রান্সফার হতে চাকরি।তবে এখান থেকে ও চলে যেতে হবে তাই আগে থেকেই নিরুর মামাকে দিয়ে ভাড়া বাসার ব্যবস্থা করে।
আর আজকেই সেখানের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় রওয়ানা দিবে।দুই দিন ঢাকা থেকে মেয়েদের কে রেখে আবার এখানে চলে আসবেন,, স্কুলে বোনের বাসা থেকেই কয়েক দিন ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত যাতায়াত করবেন।
–নিশা (নিরুর ছোট বোন)সকাল থেকে শুধু কান্না করে যাচ্ছে।বয়স অল্প আবেগ কম বোধ বুদ্ধি ও কম।শব্দ করে করে কান্না করছে।সে বাবার বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না।নিরুর প্রচুর খারাপ লাগছে নিশার আর্তনাদ শুনে।সে তো বলতে পারছে না তারও অনেক কষ্ট হচ্ছে।বাবার স্মৃতি ছেড়ে থাকা যে ভীষণ কষ্টের।এহ বাড়িতে আজও ওরা নিজের বাবার গন্ধ পায়।অনুভব করতে পারে ছেলেবেলা ভালো সময় বাবা দাদা দাদু একত্রে কাটানো মূহুর্ত গুলো।
–নিজের বাড়ির আঙিনা ছাঁদ রুম বাগান প্রকৃতি এলাকা বিদ্যাপিঠ সব কিছু মিস করবে।এই কষ্ট যেন মরে যাওয়ার থেকে কম না।তবে কষ্ট হলেও ভীষণ ভাবে চেষ্টা করছে দমিয়ে রাখার।আজকে ওর ভুলের জন্যই তো এমন পরিস্থিতি।নয়তো চাচারা সহজে এতো দূর করতে পারতো না।পিছন থেকে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে একদম কষ্ট পাবি না।নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তো,,মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে না?
–নিরু:মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে ভীষণ ভালোবাসি মা।তোমায় আব্বু আর নিশাকে আমার নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসি।প্লিজ তোমরা আমার জীবনে গত হয়ে যেওনা আব্বুর মতো।তোমাদের ছাড়া আমি অচল।এবার নিশা ও এসে আম্মু আর বোনকে জড়িয়ে ধরে।
–আম্মু :তোর মিতা আন্টি ফোন করেছিল।
–নিরু:খানিকটা দূরে সরে অপ্রস্তুত সুরে বলে কককি বললো?
–আম্মু :তোর টিসির ব্যাপারে।ভেবেছে তুই কষ্টে এক বছর বাসায় বসে গ্যাপ দিবি।রিহানের কান্ডে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে,, ছেলেকে বকেছে অনেক।তোকে নিয়ে যেতে বললো।
–নিরু:সমাপ্তি ঘটুক আম্মু কিছু শখের সুখের মানুষের সাথে থাকা সম্পর্কের।আমি সত্যি তোমাদের সবার কাছে লজ্জিত।প্লিজ আমার দুঃখ আর বাড়িয়ে দিও না।
–আম্মু :ছোট বেলায় তোমার আব্বু আর আঙ্কেল কথা দিয়েছিল তোমাকে রিহানের সাথে বিয়ে দিবে।
–নিরু ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকাতেই মা বলে,, তোমাকে তো এখন আমই রিহানের সাথে বিয়ে দিবো না।তবে প্লিজ মিতার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার কথা বলো না।কতক্ষণ নিরবতা পালন করার পর নিরু বড় করে নিশ্বাস নিয়ে কাপড় ভাজ করতে করতে বলে,, তবে আমাকে সঙ্গী করো না ওদের সামনে।আমি ছুটি নিয়ে নিজের মতো বেঁচে স্বপ্ন পূরন করতে চাই।
★★★★★
–এদিকে রিহানের আব্বু দৌড়াদৌড়ি করে ব্যবস্থা করে দেশের বাইরে যাওয়ার।আর ওখানে গিয়ে বাকি পড়াশোনা টা করবে।যদিও এইচএসসি দিতে হবে না নতুন করে গিয়ে ডিপ্লোমা করে ইন্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করবে। আর যদি সিস্টেম টা হয়ে যায় তবে এইচএসসি ও ওখানে দিয়ে দিবে।
–রিহান:এতো তাড়া কেন আম্মু?এইচএসসি শেষ করে যাই!
–আম্মু :এসব আমি জানি না।তোমার বাবা সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে।তুমি ও বখাটে খাতায় চলে যাচ্ছো।
–রিহান:হাসালে আমায়।তোমরা কিন্তু একটা ঘটনা নিয়ে ভুল বুঝছো।আমি কিন্তু দোষী না।শুধু যার যেটা প্রাপ্য সেটাই ফিরিয়ে দিয়েছি।
–আম্মু :তোমার এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। তাছাড়া হিরে না হারালে কেউ হিরের কদর বুঝে না,, আশা করি খুব শীগ্রই বুঝতে পারবে। এই কয়দিনে বন্ধুদের সঙ্গ থেকে দূরে থেকো।
–রিহান:আমার বন্ধুদের পছন্দ নয়?
–আম্মু :নিরব কে আমার ভালো লাগে না।কেমন জানি অন্য স্বভাবের মনে হয়।
ওদের পরিবারের সাথে নিরুপমাদের সব সময় দ্বন্দ লেগেই থাকে।
–রিহান:কিহ?কি নিয়ে দ্বন্দ?কই নিরব তো আমায় বলে নি।আর সব সময় বলে এসেছে খুব ভালো সম্পর্ক ওদের সাথে।নিশা নিরুপমা ওর সাথেই সময় কাঁটায়।
–আম্মু :দারুণ হাসির কথা তো!আজ অব্ধি কখনো এমনটা দেখি নি।তোমার আঙ্কেল বেঁচে থাকতে ও তো এমনটাই শুনতাম।নিরুদের কোনো ভাই না থাকায় ওঁরা সব সময় চাইতো বাবার বাড়ি টা দখলে নিতে।কিন্তু নিরুর দাদা মৃত্যুর আগে ছোট ছেলে মানে নিরুর বাবা কে লিখে দিয়ে যায়।তবে ঝামেলা শুরু হয় নিরুর দাদা মা-রা যাওয়ার পর থেকে।
–রিহান:চিন্তিত সুরে বলে বাদ দাও।ওঁদের ঝামেলা ওঁরা বুঝবে।আর আন্টি কি কিছু বলেছে?
–আম্মু :কষ্ট পেয়েছে বোধহয় ভীষণ।তবে মুখ ফুটে বলে নি।তোমার আব্বু বাসায় এলে ওদের বাসায় যাবো।একটা দরকার আছে।
–রিহান:তুমি কি জানো,,নিজের সন্তানের থেকে ও বান্ধবীর মেয়ে কে মাঝে মধ্যে প্রায়োরিটি দাও বেশি।
–আম্মু :ভালোবাসা সম্মান মূল্য প্রাধান্য এগুলো মনের ব্যাপার।আর তোমরা আমার সন্তান অবশ্যই অন্যের থেকে ও ভীষণ প্রিয় তবে অন্যায়ের ক্ষেত্রে নয়।
–রিহান:এই শহর এখন আর আমার ও ভালো লাগে না।আমি ও মুক্তি চাই কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে।মনে মনে এই কথা গুলো বলে রুমে চলে যায়।
মনে পড়ে সেই এক বছর আগের কথা।যদিও হিংসা এবং প্রতিশোধের তাড়নায় নিরুপমার পিছনে ঘুরে।কারণ নিরব সব সময় উষ্কে দিতো।রিহানের নামে এটা ওটা নাকি নিরু বলতো।আর এসব ও নাকি বলতো যে রিহানকে পাত্তা দেয় না নিরু।আরও নানা ঘটনা আর জেদ থেকেই পিছনে পড়া নিরুর।
প্রথম এক সপ্তাহ ভীষণ বিরক্ত লাগতো তারপর আস্তে আস্তে নিজের ও উৎসাহ বাড়ে অভ্যস্ততা বাড়ে।আগে অবশ্য নিরু মায়ের সাথে ওদের বাসায় প্রায়ই যেতো।তবে যেদিন থেকে নিরুকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় রিহান এরপর আর যায় নি।নিরব ফোন করে এখানে ওখানে ডাকতো এলাকায় যেতো,,নিরবদের বাড়ির পাশে ক্রিকেট খেলতো।
আর সেখানেই নিরুপমার সাথে দেখা হয়ে যেতো।অবশ্য একটা সময় ভালো ও লাগতো রিহানের।আর নিরুপমা ও আস্তে আস্তে দূর্বল হতে শুরু করে।
–এভাবে চলতে চলতে প্রায় ছয় মাস পেড়িয়ে যায়।একদিন নিজ থেকে এসে নিরুপমা ই জানায় সে সম্পর্কে যেতে ইচ্ছুক।তারপর হালকা পাতলা অনুভূতি গুলো ও প্রকাশ করে।
আর এই খবর নিরব পেয়ে আরও নানা ভাবে রিহান কে উষ্কে দেয়।রিহান কন্টিনিউ করে।নিরু কোথাও ঘুরতে যেতো না কোনো আবদার ফাঁকি বাজী কিছুই করতো না।শুধু বলতো বড় হতে হবে একটা কিছু করবে আমি আর তুমি অল্প দিয়েই সুখী হবো।
আমিও করবো রোজগার আমাদের সুখের সংসার হবে।তবে হুটহাট বায়না করতো রিহান কে এক পলক দেখার।নোট কালেক্ট করে এক্সট্রা সব রিহান কে ও দিতো।সম্পর্কের পাঁচ মাস চলে যায়। আস্তে আস্তে নিজেকেও খানিকটা দূর্বল মনে হতে থাকে।অভিনয় কখনো মনে হতোই না মন থেকেই সবটা হতো।ভালো লাগতো নিরুপমার সব কিছু।শ্যামলা গায়ের মেয়ে টাকে ও তার কাছে পরী মনে হতো।এবং অনুভূতি গুলো ও প্রকাশ করে ফেলতো নিরুর সামনে।নিরুও ভীষণ খুশি হতো।অল্প চাহিদার মানুষ হলো নিরু।রিহানের পাগলামি তে মাঝে মধ্যে কান্না ও করে দিতো।বয়স টা ও তো অল্প,, এই বয়সে সব কিছু ই রঙিন লাগে নিরুর ও তা লাগতো।
–তারপর মিথ্যে হিংসা প্রতিশোধ সব ভুলে যায় রিহান।বাবা মায়ের মুখে ও শুনতো নিরুর প্রশংসা।সবাই উৎসাহ দেখালে ও নিরবের ভালো লাগতো না।
#চলবে