#নৈশতৃষ্ণা
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
-“আমিই কেন?”
-“কারণ এটা তুমি।”
-“তবে হোক বিয়ে।”
-“তুমি কি খুশি নও?”
-“যদি বলি—না?”
-“আচ্ছা।”
-“কী?”
-“জীবনে যা যা চেয়েছি, সব পেয়েছি। উপোষে হোক কিংবা আপোষে, যা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল, তা-ও আমি নিজের করে নিয়েছি। আর তুমি তো বড়োই আকাঙ্খিত! পাব না বলছ?”
বিস্মিত কণ্ঠে নৈশী ফের বলে উঠল,
-“হ্যাঁ?”
-“তবে আর কী! বিয়ের অ্যালবামে আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিজের মায়ের মুখ গোমড়া দেখে যখন শুধাবে—বাবাই, মা মুখটা ওমন করে রেখেছে কেন? তখন আমি তাদের তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো। উত্তর রেডি করে রাখো এখনই।”
এখানটায় নৈশী থতমত খেয়ে গেল। খানিকক্ষণ পর শুধাল,
-“আপনি কি জানেন—আমার এর আগেও আরও তিনটা রিলেশন ছিল?”
-“জানতাম না। কেন?”
-“এখন তো জানলেন!”
-“হ্যাঁ, তাই কী হয়েছে?”
-“একটু রিয়্যাক্ট করলে কি আপনার জাত যাবে?”
ফুঁসতে ফুঁসতে বলল তা। তৃষ্ণা হেসে ফেলল। তারপর জানাল,
-“প্রেম বুঝতে গেলে, এরকম দু-একটা এক্সপেরিয়েন্সের দরকার আছে।”
-“আপনার এক্সপেরিয়েন্স আছে?”
-“আমি সময় পাইনি।”
-“পেলে করতেন?”
-“কেন নয়?”
-“হবু বউয়ের সামনে এত খোলাখুলি এসব বলতে লজ্জা লাগছে না?”
-“লজ্জা-শরম আগে থেকেই একটু কম আমার, কী করব বলো?”
-“আপনি কি আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না?”
-“জানি।”
-“কী জানেন?”
-“এ-ই, যে—তুমি পাঁচ বছর বয়সে একবার হারিয়ে গিয়েছিলে। তোমাকে অনেক খুঁজেও কেউ পাচ্ছিল না। তুমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেও কাঁদোনি। কোনো এক দোকানী মহিলার ফোন থেকে তোমার মাকে কল দিয়েছিলে। যেই বয়সে বাচ্চারা নিজের নামটা ছাড়া কিছুই বলতে পারে না, সেই বয়সে তুমি পুরো ফ্যামিলি ডিটেইলস জানিয়েছিলে। তোমার কাকাতো বোন প্রেম করে বাজে ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার সময় তুমি বিরোধীতা করেছিলে, ফ্যামিলির হাতে তাদের ধরিয়ে দিয়েছিলে। স্কুল লাইফে একটা ছেলে তোমাকে টিজ করায় তুমি তাকে হসপিটালে এডমিট করিয়েছিলে, যে জন্য ভারি চকচকে একটা টিসিও পেয়েছিলে।”
-“আব্.. এসব জানলেন কী করে?”
-“বললাম না, জানি জানি!”
-“আর কী জানেন?”
-“সব।”
-“তবে বললেন কেন—আমার রিলেশনের ব্যাপারে জানতেন না?”
-“এমনিই।”
-“এমনিই কী?”
-“বলতে ইচ্ছে করেছে, তাই।”
-“আচ্ছা! আমার বয়ফ্রেন্ডরা আমাকে ছুঁয়েছে—এটা জানতেন?”
-“বাঙালি হয়েও বাংলা বাক্যে ভুল করো জেন, নৈশ? ছুঁতে গিয়েছিল, ছোঁয়নি। ইয়্যু সেইভড ইওয়োর সেলফ্।”
-“যদি ছুঁয়ে দিত, তবে কি বিয়ে করতেন না?”
এ-পর্যায়ে এসে তৃষ্ণা থামল। ফোনের ওপাশে বসে বসে সে সিগারেট ফুঁকছে। ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে আবার বলতে লাগল,
-“করতাম না।”
নৈশী ভড়কাল, থমকাল। কিছুটা নিন্দিত বোধও করল। তৃষ্ণা থেমে থেমে বলে উঠল,
-“আমি সেসব মেয়েদের দিকে তাকিয়েও দেখি না—যাদের আত্মসম্মানবোধ তলানিতে, যারা পুরুষদের কথায় ওঠ-বস করে, শুতে বললে শুয়ে পড়ে। আমার তুমি তেমন নও। আমার নৈশ রাতের মতো গহীন, উঁকি দিতে গেলে আঁধার ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যায় না; সে-রাতকে ছোঁয়াও যায় না। যদি বাতাস হয়ে যাই, পারলেও মিশে যেতে পারি। কে জানে কী!”
তৃষ্ণার মুখে নিজের নামের একটা আলাদা ধরন ‘নৈশ’ শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল সে। নিশ্চুপতাতে ছেয়ে গেল একটাই কথা—ছেলেটা কথা জানে বটে!
নৈশী প্রসঙ্গক্রমে শুধাল,
-“কাল যেই গানের কিছু লিরিক্স বলেছিলেন, কেন বলেছিলেন?”
-“গানটা আগেরদিন শুনেছিলাম। ভালো লেগেছিল। সারারাত কানে বাজছিল। তোমাকে চোখ-মুখ কুঁচকে বসে থাকতে দেখে গানটা মনে পড়ল, গাইলাম। সুন্দর ছিল না?”
-“এটুকুই?”
-“হ্যাঁ, এটুকুই। বাই এনি চান্স, তুমি কি অন্য কিছু মনে করেছ?”
বিব্রত হয়ে নৈশী শুধাল,
-“অন্যরকম কী মনে করব?”
-“মনে করতেই পারো। উডবিকে নিয়ে মেয়েরা কত কী মনে করে!”
-“কী মনে করে?”
-“খুলে বলতে হবে? ওয়েট, তোমার এজ তো ২০+ তাই-না? বলাই যায়, শোনো।”
তৃষ্ণার এরপরের বলা বাক্যটাতে নৈশীর গাল গরম হয়ে এলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল,
-“আপনি কি জানেন—আপনি ভারি নির্লজ্জ, বেশরম এবং অতি মাত্রিক অসভ্য পুরুষ?”
-“জানি। নিজস্বতার বেলায় আমি ভীষণ রকমের অসভ্য পুরুষ। তুমি নতুন কিছু বলো।”
-“আশ্চর্য তো!”
-“ঘুমোবে না?”
-“হ্যাঁ, ফোন রাখুন। ঘুমোব।”
-“তার আগে একটা গান শোনাই। শোনো।”
-“আমি শুনতে বাধ্য?”
-“অবশ্যই।”
-“কীসের বাধ্যবাধকতা?”
-“আমি বলেছি বলে।”
নৈশী চুপ থাকল। তৃষ্ণা সে-ক্ষণে গুনগুন করে গান ধরল,
-“যদি আকাশের গানে কান না পাতি,
তোমার কথা শুনতে পাব না।
যদি বাতাসকে আমি, ছুঁয়ে না দেখি;
তোমার শরীর স্পর্শ পাব না…”
-“ছি, অশ্লীল!”
নৈশী তৎক্ষনাৎ কল কেটে দিলো। ঘুমোনোর আগে তার ওষ্ঠকোনে দেখা গেল সুবিশাল এক হাসি। বিয়েটা হয়ে গেলে মন্দ অবশ্য হয় না।
_____
ঘটা করে তৃষ্ণা আর তার নৈশর বিয়ে হয়ে গেল। রাতে নৈশী তৃষ্ণাকে এভাবে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেল। শুধিয়ে উঠল,
-“পাগলের মতো ওমন করে হাসছেন কেন?”
তৃষ্ণা জবাবে তা-ও হাসে। নৈশী বিরক্ত হয়। রাগ দেখায়,
-“আমার চেহারায় লেখা আছে—দেখা মাত্রই হাসুন, না হাসলে জরিমানা? কী? হাসছেন কেন এত?”
হাসি কমিয়ে তৃষ্ণা বলল,
-“তোমাকে বউ সেজে খুব অড লাগছে। আমি ভেবেছিলাম খুবই কিউট-সুইট লাগবে। বাট লাগছে হট!”
এ বলে তৃষ্ণা আবারও হাসতে লাগল। নৈশী গাল ফুলিয়ে বিছানার ওপর বসল। তৃষ্ণা আবার বলল,
-“গাল ফোলাচ্ছ কেন, নৈশসোনা? আদর লাগবে? আচ্ছা, কাছে আসো।”
-“আপনি কিন্তু আমাকে টিজ করছেন!”
-“হ্যাঁ, করছি তো। এতক্ষণে বুঝলে?”
তৃষ্ণা হাসছে। নৈশী মুগ্ধ হয়ে সে-হাসি দেখেছে। যে পুরুষের হাসি সবসময় দেখা যায় না, সে পুরুষের হাসি দেখা মানেই জীবন ধন্য। নৈশীকে নিজের দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তৃষ্ণা এগিয়ে গেল। ঝুঁকে নৈশীর গালের একপাশে হাত রেখে কপালে চুমু খেল অনেকটা সময় নিয়ে। নৈশী আবেশে চোখ বুজে ফেলল।
তৃষ্ণা ওর চোখে চোখ রেখে তাকাল। আস্তে ধীরে বড্ড ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
-“তুমি আমার।”
নৈশী মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ায়, একই ভঙ্গিমায় সে-ও বলে,
-“নৈশ তোমার।”
তৃষ্ণা মুচকি হাসে, তার চোখ হাসে। নৈশীর মনে হচ্ছে, তার গোটা জীবদ্দশায় এর চেয়ে শান্তির কিছু সে দেখেনি, এর চেয়ে সুখময় কোনো মুহূর্ত আসেনি। মরনসুখ লাগছে তার! তৃষ্ণার নীলাভ চোখে নৈশীর আঁধার কালো মনি স্থির রয়েছে অনেকক্ষণ, অকস্মাৎ তৃষ্ণা বলে ওঠে,
-“তুমি আমার প্রেমিকা নও, ছুঁলেই নুইয়ে পড়া লাজুকলতা নও; তুমি বিনাশিনী, তুমি প্রলয়, তুমি বিধ্বংসী। তোমার চোখে আমি আমার ভয়ঙ্কর সুন্দর মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি! বড়ো আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, বড়োই নিদারুণ মৃত্যু! আর আমি স্বেচ্ছায় তা নিজের করে নিচ্ছি। স্বাগত জানাবে না, নৈশ?”
~সমাপ্ত~