নীল বেনারশী পর্ব-০৪

0
4009

#নীল_বেনারশী
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৪
আর গিয়ে দেখি দিশা মায়ানকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
তাহলে কি দিশাই মায়ানের ভালবাসার মানুষ?
এই জন্যই তাহলে মায়ান রাতে আমার সাথে এমন করেছে?

_আচ্ছা তোমার কি কোন লজ্জা শরম নেই?এইভাবে একজন পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরে আছো।

মায়ানকে দিশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আমার কথা শুনে দিশা মায়ানকে ছেড়ে দেয়।

আর আমার দিকে ঘুরে মাথা কিছু টা নিচু করে নিচের দিকে তাকায়।

_না মানে আসলে,
_না মানে আসলে কি?
_তুমি জানোনা মায়ান এখন বিবাহিত?
আর তাছাড়া বিবাহিত হোক আর অবিবাহিত হোক,কাজিনকে কেউ এইভাবে জড়িয়ে ধরে?
কিছুটা লজ্জাও তো থাকা দরকার।

_আর আপনি,মিঃ মায়ান রাহমান।
আপনিও কি লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছেন?

মায়ান ধমক দিয়ে আমাকে বলে,
চুপ একদম চুপ।
যাও ঘরে যাও।

_আপনি আর কত আমাকে চুপ করাবেন?
_ধ্যাত,

মায়ান ওখান থেকে চলে যায়।
দিশাও চলে যায় অন্য জায়গায়।
আমি রুমে গিয়ে বসে বসে ভাবি,
আর কত কিছু যে জীবনে সহ্য করতে হবে।

কল্প কখনোই আমার সাথে এইভাবে রেগে কথা বলতোনা।
ও কখনোই আমার সাথে রাগ করতোনা।
আমি রাগ করলে আমার রাগও ভাঙাতো না।
ও আমার অভিমান রাগ কিছুই বুঝতোনা।
ভালবাসার মানুষ রাগ অভিমান করলে তা যে ভাঙাতে হয় সেটা ও কখনোই করতোনা।

অবশ্য আমি আর ও দুজন দুই রকম।
আমাদের মধ্যে মনের মিল টা ছাড়া আর কোন কিছুরই মিল ছিলোনা।

যেমন ওর পছন্দ ছিলো নীল রঙ।
আর নীল আমার একদম পছন্দ না।
আমার পছন্দ হলুদ।
সরিষা ফুল,সূর্যমুখী আমার অসম্ভব ভালো লাগে।
কিন্তু একটা সময় আমার নিজের প্রিয় রঙ হয়ে যায় নীল।
আর ওর হয়ে যায় হলুদ।
ওর পছন্দ টক,আর আমার মিষ্টি।
ও ভীষণ রাগী,এটা ও প্রায়ই কথায় কথায় বলতো।
তবে কখনো আমার সাথে রাগ করতোনা।
আর আমি শান্ত।
ওর পছন্দের দল আর্জেন্টিনা।
আমার ব্রাজিল।
তবে আমরা আমাদের সম্পর্কের পর দুজনই দুই দলকেই সাপোর্ট করতাম।

একটা সময় আমাদের দুজনের ভালো লাগা,পছন্দ গুলো দুজনের ভালো লাগায় পরিণত হয়।

আমি ওকে একদিন বলেছিলাম,কল্প!
তুমি আমায় ”নীল বেনারশী”কিনে দিবে হুম?

ও অবাক হয়ে বলেছিলো,
সবাই লাল বেনারশীর স্বপ্ন দেখে।
আর তুমি নীল নিবা?

আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম,
সবার সাথে আমার তুলনা নাকি হুম?
আমি সবার থেকে আলাদা বুঝেছো?

_হ্যাঁ রে বউ বুঝেছি।

কল্প আমাকে সচরাচর বউ বলে ডাকতোনা।
খুবই কম,হয়তো দুই কি তিন বার ডেকেছে আমাদের রিলেশনের মধ্যে।
তবে ওর মুখে বউ ডাক টা আমার কাছে কি যে ভালো লাগতো।
আমি কি পরিমাণ শান্তি যে পেতাম,তা ও জানতোনা।

ও শুধু আমাকে ভালই বাসতো,আমার অনুভূতি গুলো বুঝতোনা।
আসলে ও ছিলো সবার থেকে আলাদা।কেমন অদ্ভুত যেন।মাঝে মাঝে রাগ হতো ভীষণ।তবে বুঝতে দিতাম না।
ও আমাদের লাভ এ্যানিভার্সারি টাও মনে রাখতে পারতোনা।
আর অন্য সব ছেলেরা সেই দিনে ভালবাসার মানুষকে নাকি উইশ করে,সারপ্রাইজ দেয়।উলটা আমি আমাদের সব স্পেশাল ডেট গুলো মনে রাখতাম।
যেখানে ছেলেরা তাদের ভালবাসার মানুষকে বার্থডে তে সারপ্রাইজ দেয়।
রাত জেগে ১২ টা এক মিনিট কখন হবে অপেক্ষায় থাকে।
সেখানে সে আমাকে উইশ টাও ঠিক মত করেনা।
মানুষ রোজ ডে এই ডে সেই ডে কত সব ডে পালন করে ভালবাসার মানুষ কে রোজ ডে তে গোলাপ দেয়,চকলেট ডে তে চকলেট দেয়।
আর ও আমাকে কখনো গোলাপের একটা পিক ও দেয়নি,আর না প্রপোজ ডে তে একবার আই লাভ ইউ বলেছে।
এই নিয়ে কষ্ট পেলেও ওকে কখনো বুঝতে দেইনি আমি।

কারণ সবাই তো আর এক হয়না।
প্রতিটা মানুষই ভিন্ন।
তাদের মন, চিন্তাধারা ভিন্ন।
তবে এটা শত ভাগ সত্যি মানতাম আমি যে ও আমাকে ভালবাসে।
অসম্ভব ভালবাসে।
যেই ভাল আমাকে আর দুনিয়ায় কেউ বাসতে পারবেনা।
আর আমি তাতেই সব থেকে বেশি খুশি ছিলাম।

কল্পর কথা ভাবছি আমি,আর সেই সময় মায়ান চলে আসে।
_চলো নাস্তা করবে।
_খেতে ইচ্ছে করছেনা আমার।
_শোনো,আমার এত ঠেকা পড়েনি যে আমি তোমাকে ডাকতে আসবো।
আম্মু ডাকতে বলেছেন,তাই তোমাকে ডাকতে এসেছি আমি।

আম্মুর কথা শুনে আমি উঠে আম্মুর কাছে গেলাম।
সবাই নাস্তা করলাম এক সাথে।

_আচ্ছা তোরা হানিমুনে কবে যাবি?
_যাবোনে পরে।
বিয়ে করলেই যে হানিমুনে যেতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি?
_কি যে বলিস,বউমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবিনা তাই বলে।
_তা পরে যাওয়া যাবে।
_তাহলে এক কাজ কর,আজ বউ মাকে মার্কেটে যা,তারপর ওর জন্য আর ওর বাসার সবার জন্য কিছু কেনাকাটা কর।
তারপর কাল বউমা দের বাসায় গিয়ে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আয়।
থেকে আয় দুই দিন।
তাতে বউমারও ভালো লাগবে,আর ওর বাবা মাও একটু শান্তি পাবে ও ভালো আছে দেখে।

_হ্যাঁ আম্মু আমি যেতে চাই।
শপিং করা লাগবেনা।
আপনি উনাকে বলুন,আজই যেন আমাকে নিয়ে যায়।

_না মা,আজ কিছু কেনাকাটা করো।
কাল যেও।
কাল ও নিয়ে যাবেনে তোমাকে।
বিয়ের পর এই প্রথম বাবার বাড়ীতে যাচ্ছো,খালি হাতে যাবে নাকি।
কাল যেওনে।

_আম্মু তুমি গিয়ে ওকে দিয়ে আসো।
ও বেড়িয়ে আসুক যত দিন মন চায়।
_এই ছেলে কি বলে দেখো,
আমি পরে যাবো আমার বউমাকে নিয়ে।
তুই যাবি কাল।
আর কাল সকালেই যাবি।
আমি আমার বউমার মন খারাপ দেখতে চাইনা।

এই কথা বলে আম্মু উঠে যান।

_আহারে বউ মা রে।
_আপনার কেন জ্বলে হুম?
_আমার কেন জ্বলবে?
_মনে তো হচ্ছে আগুন জ্বলছে,হিংসার আগুন।
_আমার ওসব হিংসে টিংসে নেই মেয়েদের মত।
যাও রেডি হও।
মার্কেটে যাবো।

আমি রেডি হয়ে আসি।
মায়ান আমাকে নিয়ে শপিং করতে যায়।
এক এক করে আমাদের বাসার সবার জন্য গিফট কিনে।
আমি এ বাসার সবার জন্যও কিনতে বলি।
সবার জন্য কেনাকাটা শেষ হলে মায়ান আমাকে একটা শাড়ীর দোকানে নিয়ে যায়।
যেখানে শুধু শাড়ীই পাওয়া যায়।

_নাও পছন্দ করো কোন গুলা নিবে।
_আমি শাড়ী কিনে কি করবো,শাড়ীতো আমি পরতে পারিনা।
_আমি আছি না আপনার গোলাম,পরিয়ে দিবোনে।
কিনেন।
_এই ভাবে কেন বলছেন?
_হয়েছে এবার পছন্দ করো।

আমি তিন টা শাড়ী পছন্দ করলাম।
আর তিন টাই নীলের মধ্যে।

_এখানে আর কোন কি কালার নেই?
_হুম আছেতো কত।
_তাহলে সব নীল কেন?
বাবার বাসায় গিয়ে প্রতিদিন নীল শাড়ী পরবে?
কেমন দেখাবে?
নীল তোমার পছন্দের রঙ বুঝি?

আমি চুপ হয়ে যাই।

মায়ান আমাকে একটা কাঁচা হলুদ রঙের,একটা লাল,আর একটা সাদা রঙের শাড়ী পছন্দ করে দিলো।
বল্লো ওই তিন টার সাথে এই তিন টাও নাও।
এই তিন টা পরার ফাকেফাকে তোমার নীল তিন টা পরো।
_আমি এত শাড়ী দিয়ে কি করবো?
বাসায় না তিন টা আছে?
_বার বার আমি তোমাকে নিয়ে মার্কেটে আসতে পারবোনা বুঝলে?আমার অত সময় নেই।
একবারে নিয়ে নাও।

তারপর মায়ান দোকানদারকে ৬ টা শাড়ীর টাকা দিয়ে শাড়ী গুলো প্যাক করিয়ে নেয়।

তারপর একটা থ্রি পিচ এর দোকানে গিয়ে কয়েকটা থ্রি পিচ কিনে দেয়।

কসমেটিকস এর দোকানে গিয়ে কিছু নীল চুড়ি কিনে আমার হাতে আচমকা ই পরিয়ে দেয়।

আমি অবাক হয়ে মায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকি।

একদিন কল্পকেও আমি বলেছিলাম,
কল্প!
আমাকে একদিন চুড়ি কিনে নিজ হাতে পরিয়ে দিবা হুম?

_এই মেয়ে!কি ভাবছো?
_না কিছুনা।

_হয়েছে কেনাকাটা?
_হুম হয়েছে।

চলো এবার,

মায়ান মার্কেট থেকে রাস্তায় বেড়িয়েই বলে,
_মেঘা!
_হুম।
_আইসক্রিম খাবে?

আমি আবার অবাক হয়ে যাই।
_আমার যে আইসক্রিম পছন্দ,আপনি কি করে জানলেন?
_আমার খেতে ইচ্ছে করছে তাই জিজ্ঞেস করেছি খাবে কিনা।
পছন্দ অপছন্দের কথা আসছে কেন?
_ওহ তাইতো,আপনি আমার পছন্দ অপছন্দ জানবেন কি করে,আর জেনেই বা কি করবেন।

আমি প্রায়ই কল্পকে বলতাম,তুমি আমাকে আইসক্রিম কিনে খাওয়াবে হুম?
আমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরবে।
আমার খুব ইচ্ছে তোমার সাথে রিক্সায় ঘুরার।

মায়ান আমার জন্য আর ওর জন্য দুইটা আইসক্রিম কিনে।
আমরা আইসক্রিম খেয়ে বাসায় চলে আসি।

বাসায় আসার পর হঠাৎ মেসেঞ্জারে মেসেজের আওয়াজ।
ফোন টা হাতে নিয়ে দেখি,
_মেঘা প্লিজ।
একটু তো কথা বলো আমার সাথে।
বলেছিনা তোমার সাথে আমার কথা আছে।

আমি বিরক্ত হয়ে কল্পর মেসেজের রিপ্লাই দিলাম,
_বাট আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।
প্লিজ দয়া করে আর কোন দিন আপনি আমাকে মেসেজ দিবেন না।
_মেঘা আমার কথা তো শোনো,
_আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাইনা।
_আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
_দেখা?
_হুম আমি দেশে এসেছি।
_সেই তো এলেন,আগে এলে কি এমন ক্ষতি হতো আপনার?
_সব বলবো, দেখা করো আমার সাথে একটা বার প্লিজ।
_আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
_আমি এ বিয়ে মানিনা।
_আপনার মানা না মানাতে আমার কিছুই যায় আসেনা।
_তুমি আমার সাথে দেখা করবে কি না?
শেষ বারের মত জিজ্ঞেস করছি।
_না করলে কি করবেন?
_আমি কি যে করতে পারি তা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই।
_কি বলতে চান আপনি?
_তোমার কি মনে হয় তোমার বিয়েটা এমনি এমনি ভেঙেছে?
_মানে?
_ওই যে ছেলে পক্ষ যে না করে দিলো, তোমার কি মনে হয় তারা এমনি এমনি না করে দিয়েছে?
জ্বী না।
তাদের আমি না করিয়েছি।
ইয়েস আমি।
_ছিঃ তুমি এত খারাপ।
_হ্যাঁ তুমিই বাধ্য করেছো খারাপ হতে।
এখন আসল কথায় আসি,
তুমি আমার সাথে দেখা করছো কি না?
_না বলেছি না।
_ওকে তাহলে অপেক্ষায় থাকো।
কাল সকালেই আমি তোমার কাছে আসছি।
_আমি কই আপনি জানেন?
_মায়ানের বাসায় ই তো নাকি?
_মানে?তুমি মায়ানের বাসা চেনো নাকি?আর আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার নাম যে মায়ান তা তুমি কিভাবে জানলে।

_কলিজা,
ভালবাসিতো, জানতে তো হয়ই বলো।
তাহলে কাল সকালে দেখা হচ্ছে আমাদের ওকে?

আমি ডাটা অফ করে ফোন টা রেখে দেই।
রুম থেকে দৌড়ে গিয়ে মায়ানকে খুঁজি।
ওকে দেখেই আমি এক দমে বলতে থাকি,

_শো শো শোনেন,
আমি না কাল বাসায় যেতে চাইনা।
বাসায় পরে যাবো।
প্লিজ আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে চলুন।
_দূরে কোথাও মানে?

আমি এক নিঃশ্বাসে চোখ বন্ধ করে বলে ফেলি,
আ আ আমি হানিমুনে যাবো।
প্লিজ দূরে কোথাও আমাকে নিয়ে চলুন।
আর আজ রাতের মধ্যে।
প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

এ কথা বলেই আমি দৌড়ে রুমে চলে যাই।
আর মায়ান আমাকে পিছু ডাকতে থাকে,মেঘা এই মেঘা!
হঠাৎ কি হলো তোমার?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে