নীল নীলিমায় পর্ব-০১

0
113

#নীল_নীলিমায়
সুমাইয়া আমান নিতু

নীরুদের পাশের বাড়িতে মস্ত বড় একটা কুকুর পালা হয়। বড় বড় লোমওয়ালা বিদেশী কুকুরটার খাসা একখানা নামও আছে, জেমি। নীরু রোজ উত্তরের জানালাটা খুলে বসে থাকে জেমির ঘুরতে বের হওয়ার অপেক্ষায়। আসলে জেমিকে দেখতে নয়, জেমির মালিকটি, যিনি তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন, তাকে দেখতে। ছেলেটার বয়স বোধহয় আটাশ-উনত্রিশ হবে। নাম নিয়ন। সে নাকি ঘোষণা করেছে চিরকুমার থাকবে, বিয়ে করার ঝামেলায় কোনো কালে যাবে না। এমন সিদ্ধান্তের কারণও আছে বৈকি! তার বড় দুই বোনেরই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে বিয়ের বছর কয়েকের মধ্যে। এখন সে চায় ছোটবেলার মতোই ভাইবোনেরা একত্রে থাকবে আমৃত্যু! লোকে বলে বউ নেই বলেই নাকি সে কুকুর পালে। কী আজব কথাবার্তা!

নীরুর সাথে নিয়নের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে একে অপরকে। নীরু বয়সে ছোট হলেও নিয়ন ভাইয়ের সাথে কত খেলেছে! একটু বড় হওয়ার পর লজ্জায় ওদের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এখন মাঝেমধ্যে গেলেও নিয়নের সাথে তেমন কথা হয় না, ওর বড় বোন নাজিফা আপা আর নাঈমা আপার সাথে তাদের ঘরে বসে গল্প হয়, ফেরার সময় কখনো সামনে পড়ে যায়। নিয়ন একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে ফাঁকিবাজ, পড়াশোনা কেমন চলে?”

নীরু ফাঁকিবাজ সত্য। এসএসসি, এইচএসসিতে টেনেটুনে পাশ করে মুখরক্ষা হয়েছে। এবার অনার্স পড়ছে বাংলা সাহিত্যে। প্রথম বর্ষে উতরে গেলেও এবার পাশ করবে বলে মনে হয় না। নিয়নের উত্তরে তাই সে হাসার চেষ্টা করে, হাসি আসে না। নিয়ন কিন্তু ভালো ছাত্র। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, পড়া শেষ হতে না হতেই চাকরি পেয়ে গেছে। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের পথ অফিস। তাই সকাল সন্ধ্যা তাকে বাড়িতেই দেখা যায়৷ নীরুও সকালবেলা দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে জানালা খুলে বসে।

এক নজর এই মানুষটাকে দেখতে তার বড় ভালো লাগে। আগে কিন্তু এমন হতো না। বরং উল্টোটা হতো। নিয়ন যখন তাকে ফাঁকিবাজ বলে ডাকত, কিংবা এটা সেটার জন্য বকে দিত, তখন খুব রাগ হতো। কতবার ইচ্ছে হয়েছে নিয়ন ভাইকে মাঠের ধারের বদ্ধ ডোবাটাতে কয়েক দফা চুবিয়ে আনতে! কিন্তু একদিন সব কেমন বদলে গেল।

এমন অপোগণ্ড ঘটনাগুলো বৃষ্টির দিনেই বুঝি ঘটে! তাও আবার ডিসেম্বর মাসে অকালের বৃষ্টি। শীতে জমে যাবার অবস্থা! নীরু কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে, একটা রিকশা নেই, রাস্তা হাঁটুপানিতে সয়লাব। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে নীরু। হঠাৎ রিকশায় নিয়ন ভাইকে দেখা গেল। নীরুর কাছে এসে রিকশা থামিয়ে বলল, “বাড়ি যাবি?”

নীরু যেমন ভরসা পেল, তেমন রাগও হলো। বলতে ইচ্ছে হলো, না বাড়ি যাব না, মরতে যাব। এখানে তো ঢং করতে দাঁড়িয়ে আছি। সে কথা না বলে রিকশায় চড়ে বসল। রিকশা একটু দূরে গিয়ে জ্যামে পড়ল। সামনে নাকি একটা বড় গাড়ির চাকা গর্তে আটকে গেছে। ভারি ঝামেলায় পড়া গেল তো!

নীরুর সোয়েটার ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে এর মধ্যে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে সে। নিয়ন কিছুক্ষণ নীরুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “শীত করছে?”

নীরু এবারও প্রশ্নের জবাব দিল না। মনে মনে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, না গরম লাগছে। রিকশায় একটা এসি ফিট করে দাও না প্লিজ!

নীরুকে অবাক করে দিয়ে নিয়ন ভাই তার পরনের জ্যাকেটটা খুলে নীরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। নীরু হতভম্ব হয়ে গেল। কান্ডটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারল না৷ নিয়ন ভাইয়ের দিকে এক পলক চেয়ে দেখল সে। বৃষ্টিতে আধভেজা চুলগুলো কপালের ওপর পড়ে আছে। বিকেলের মরে আসা আলোয় তার ফরসা গায়ের রঙ বাদামী দেখাচ্ছে। আধভেজা শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে আছে, আর চুলগুলো পড়ে আছে কপালে। একদম হিরোদের মতো দেখাচ্ছে নিয়ন ভাইকে! আগে তাকে কোনোদিন খেয়াল করে দেখেনি নীরু। একেই বলে মাথার ওপর চশমা রেখে সারা বাড়ি খোঁজা! ক্লাসে সবার প্রেমের গল্প শুনে কান ঝালাপালা নীরু নিজে কোনোদিন প্রেমে পড়েনি। যেসব ছেলের থেকে প্রস্তাব পেয়েছে তাদেরও সাড়া দেবার ইচ্ছে জাগেনি। বলা যায় মনের মতো কাউকে পায়নি। এখন পাওয়া গেল! ইশ্ ওর বান্ধবীরা যদি দেখত, নীরুকে ওর হিরো রিকশায় তুলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে, গায়ের জ্যাকেট খুলে পরিয়ে দিচ্ছে, ওদের রিয়েকশান কেমন হতো? হা হয়ে চোয়াল ঝুলে যেত না? রিকশার ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফেরে নীরুর। আর একটু পরেই বাড়ি এসে যাবে। নীরুর ইচ্ছে করে রিকশাওয়ালাকে বলে, একটু ঘুরে যান না মামা। আমি বহুকাল পর তাকে পেয়ে গেছি।

নিয়নের অবশ্য এরকম কোনো অনুভূতি নীরুর জন্য নেই। নীরু কিছু বলতে গেলেই এমন ভাব করে যেন উনি গুরু আর নীরু তার কাছে দীক্ষা নিতে যাওয়া কচি শিষ্যা। অসহ্য! আসলে প্রেম ব্যাপারটাই অসহ্য৷ অথচ নীরু সেদিনের পর থেকে নিয়ন ছাড়া কারো কথা মাথাতেও আনতে পারে না।

একদিন নীরু ঠিক করে ফেলল সে নিয়নকে প্রপোজ করবে। অসভ্য লোকটা সহজে মানবে না, কিন্তু নীরু মানিয়ে নেবে যে করেই হোক। সে একটু একটু করে টাকা জমাতে শুরু করল। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, কখনো একশো। এভাবে জমে জমে সাতশো বিশ টাকা হলো। নীরু দোকানে গিয়ে খুব ভেবেচিন্তে অনেকগুলো রঙিন কাগজ, গ্লিটার, রঙ, আঠা ইত্যাদি কিনল। নীরু হাতের কাজ দারুণ জানে! কিছু একটা বানিয়ে ফেলবে। দুশো টাকা রাখল ফুল কিনতে। আর বাকি টাকা দিয়ে একটা ভালো দেখে লিপজেল কিনল। নিয়নের ঠোঁটদুটো সারাক্ষণ শুকনো খটখটে হয়ে থাকে। কখনো ফেটে একপাশে রক্ত জমে যায়, তবু লিপজেল দেবে না৷ বাজে কোথাকার! এতদিন কিছু বলতে পারেনি নীরু, এখন বলবে।

ঠিক তিনদিন পর নীরুকে দেখা গেল বিশাল একটা বাক্স নিয়ে পাড়ার মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে। নিয়ন ভাইকে খবর দিয়েছে এখানে আসতে। মাঠের একধারে বড় একটা রেইনট্রি গাছ৷ তার নিচেই দাঁড়িয়েছে নীরু। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। নীরুর ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে ভালো লাগত। সে খেলা দেখতে থাকল৷ একটা ছেলে দারুণ খেলছে। গোল হতে হতে হয়নি দু’বার। এবার হয়েই যাবে মনে হচ্ছে। হঠাৎ পাশ থেকে বাজখাঁই গলা শুনে চমকে উঠল নীরু।

“কিরে, তোর কী কথা এখানে এসে বলতে হবে? কোনে ঝামেলা পাকিয়েছিস নাকি?”

নিয়ন ভাইয়ের দারোগাদের মতো দৃষ্টি দেখে নীরুর এতদিনের আত্মবিশ্বাস গলে জল হয়ে গেল। ঘামতে শুরু করল সে। নিয়ন চোখদুটো ছোট করে সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “সত্যি করে বল তো কী হয়েছে? তোর হাতে এগুলো কী?”

সত্যি বলার কথা শুনে নীরু হাপ ছেড়ে বাঁচল। মিথ্যে বলার বুদ্ধি তবে নিয়ন ভাই নিজেই দিল। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “কলেজের প্রোজেক্ট। কাগজ দিয়ে একটা বাড়ি বানাতে হবে। তুমি আমাকে হেল্প করবে?”

নিয়নের চোখে সন্দেহ তীব্র হলো। “তুই নিজেই তো কতকিছু বানাতে পারিস। আমাকে কেন লাগবে? আর লাগলে বাড়িতে না এসে এখানে ডেকেছিস কেন? সত্যি করে বল নীরু।”

নীরু কেঁদে ফেলল। যা যা ভেবেছিল সব গুলিয়ে ফেলল। সে হাতের বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে রেখে এক ছুটে পালিয়ে এলো সেখান থেকে। তারপর দুই মাস সে নিয়ন ভাইয়ের ধারে কাছেও গেল না৷ এমনকি জানালা খুলে লুকিয়ে দেখতেও কী ভীষণ লজ্জা করতে থাকল। আচ্ছা নিয়ন ভাই কী করেছিল বাক্সটা? পানিতে ফেলে দিয়েছে? নাকি রেখে দিয়েছে? নীরু ক’দিন কী যে ভয়ে ছিল! যদি নিয়ন ভাই বাড়িতে এসে বিচার দেয়? কিন্তু দেয়নি আজ পর্যন্ত। আপাদেরও বোধহয় কিছু বলেনি৷ নইলে নাঈমা আপা সেদিন ছাদ থেকে ডেকে হাসিমুখে বাড়িতে যেতে বলত না।

অবশেষে একদিন নিয়ন ভাইয়ের সামনে পড়তেই হলো। নীরুর বড় বোন তরুর বিয়ে। মফস্বলের বিয়েগুলোতে শহরের মতো অতটা জাঁকজমক না হলেও মজা হয় খুব। কিছু লোক এসে প্যান্ডেল খাটিয়ে, মরিচবাতি দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে দিয়ে যায়৷ ডালা সাজানো, গায়ে হলুদের গয়না বানানো, ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো এসব নিজেদের কাজ। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে বিয়ে বাড়িটা কী দারুণ জমে ওঠে! নীরুও বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে যেন সব ভুলে মেতে উঠল একেবারে। হলুদের দিন সকালবেলা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরল। চোখে গাঢ় কাজল, কানে ঝুমকা আর হাতভর্তি রঙিন চুড়ি পরে ঘুরতে লাগল বাড়িময়। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সামনে পড়ে গেল নিয়ন ভাই। তার হাতে একটা ডালা। ছেলের বাড়িতে পাঠানোর জন্য ডালা সাজানো হচ্ছে, নিয়ন ভাইও যে সেখানে আছেন নীরুর জানা ছিল না। সে ভীষণ লজ্জা পেলে লাল টকটকে হয়ে গেল। পালানোর জায়গা খুঁজছে, এমন সময় কোথা থেকে নীরুর মা উদয় হলেন। নিয়নকে দেখে বললেন, “একটা ঝামেলা হয়ে গেছে রে বাবা।”

“কী হয়েছে চাচী?”

“হলুদের স্টেজ সাজানোর জন্য যে ফুলের অর্ডার দিছিল তোমার চাচা, সেই দোকান নাকি ফুল দিতে পারবে না৷ কী হইল তাদের কে জানে! এখন এত ফুল কই পাই? তুমি একটু দেখো না বাবা। আমার ছেলেপেলে নাই, ওর মামাতো ফুপাতো ভাইয়েরা তো এইদিকে থাকেও না, কিছু চেনেও না। তোমার চাচা যাইত, কিন্তু তার এদিকে শতেক কাজ।”

নিয়ন ভাই নীরুর মায়ের হাত ধরে বলল, “আমি আছি তো চাচী। চিন্তা কিসের? আমি ছেলে না? দেখছি কোথায় ফু্ল পাওয়া যায়।”

নীরুর মা যেন একটু স্বস্তি পেলেন। তারপর বললেন, “তুমি নীরুরে সঙ্গে নিয়ে যাও বাবা। ও ফুলটুল ভালো চেনে, তোমার সাহায্যও হবে।”

নিয়ন ভাইয়ের বোধহয় নীরুকে নেবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। মানাই করে দিত, আবার কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। নীরুর লজ্জা করলেও মনে মনে খুব খুশি লাগতে থাকল।

সেদিনকার মতো রিকশায় চড়ে বসল দু’জন। আজ বৃষ্টিবাদল নেই। শরতের আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। রোদ উঠেছে আকাশ ভেঙে। নিয়ন ভাই কথাবার্তা বলছে না একটাও। নীরুও কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু এইযে উঁচুনিচু পথে রিকশার ঝাঁকুনিতে হাতে হাত লেগে যাচ্ছে, কী যে ভালো লাগছে তার!

অবশেষে ঘন্টা তিন ঘুরে একেক জায়গা থেকে ফুল জোগাড় করা হলো। সেসব ফুল রিকশায় নিয়ে দু’জনের আসতে আসতে অবস্থা খারাপ। নীরু যেমনটা ভেবেছিল তেমন রোমান্টিক কোনোকিছু হয়নি। নিয়ন ভাইয়ের দু’চারটে ধমক খেয়েছে ফ্রিতে। তবু অতটা খারাপ লাগত না, যদি না বাড়ি ফিরে আয়না দেখত নীরু। চোখের কাজল ছড়িয়ে গেছে। ফুলের চাপে শাড়ির ভাজ নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে তাকে দেখতে লাগছে ভূতের মতো। নীরু আবার গোসল করল। হালকা মিষ্টি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে নিল। সাজগোজের ইচ্ছে হলো না আর। বিকেলটা কাটল তরু আপার সাথে। তরু নীরুর চেয়ে অনেক সুন্দর। ওর গায়ের রঙ দুধে আলতা। মুখটাও ভীষণ মিষ্টি৷ তরু অনেক আগে বলে রেখেছিল তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি হলে তারপর বিয়ে করবে। চাকরি হওয়ার পর প্রথম যে সম্বন্ধটা এসেছে, তারাই তরু আপাকে পছন্দ করে ফেলেছে। বিয়েটাও সেখানেই হচ্ছে। তরু আপার বরটা বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে। দু’জনকে একসাথে খুব মানাবে। নীরু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, বিয়ের স্টেজে সে আর নিয়ন ভাই পাশাপাশি বসে আছে। চিন্তাটাও যেন লজ্জা দিয়ে যায়, নীরুর মুখের রঙ আপনাআপনি বদলাতে থাকে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে