নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১৬+১৭

0
476

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

আরুর শরীরের তাপমাত্রা যেন সাধারণ তাপমাত্রাকে অতিক্রম করতে পারে অনায়াসেই। সম্পূর্ণ রাতে একটিবারের জন্যও চেতনা ফিরল না আরুর। জ্বরের মাঝে সে কেবল কাঁপছিল। পারুল লোহা গরম করে পানি পান‌ করাল আরুকে। তা গলা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলো, অতঃপর গাল বেয়ে নেমে গেল। সকাল হতে না-হতেই কবিরাজ ডেকে আনা হলো। আহসান বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে ভাগ্নেকে দেখতে। একটা হোগলা বিছিয়ে উঠানে নামানো হলো আরুকে। কবিরাজ আরুর হাতে তেল দিয়ে মালিশ করে দিতে বললে পারুল, অনিতা, জাহানারা ও মনি গেল ব্যস্ত হয়ে উঠল। তখনও ফিরল না আরুর গেল। অবশেষে অবসন্ন হয়ে কবিরাজ বলে, “খুঁজে দেখুন তো, কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কি-না?”

হাত-পা খুঁজে চুলের নিচে ঘাড় পর্যন্ত যেতেই সন্ধান পেল তিনটি নখের দাগের। কবিরাজ ক্ষত তিনটি দাগ গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে, “ওকে ধরে কেউ ঘরের ভেতরে নিয়ে যাও দ্রুত।”

“কেন?” চম্পা বলে।

“তা বলছি, দ্রুত করো। বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ক্ষতিকর।” কবিরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে। অপূর্ব কষ্টেসৃষ্টে পাঁজাকোলা করে আরুকে নিয়ে ঘরে গেল। আরুর চেয়ে দ্বিগুণ একটা মেয়েকে চকিতে বহন করার ক্ষমতা রাখে অপূর্ব, সেখানে আজ আরুকে বহন করতেই তার ঘাম ঝরছে।
কবিরাজ চারটা লোহা পারুলের হাতে দিয়ে বলে, “এই লোহা চারটা ঘরের চার কোনায় রাখবি। তিনদিন আরুকে ঘর থেকে বের হতে দিবি না। চোখে চোখে রাখবি। এক চল্লিশ দিন সতর্ক রাখবি। সন্ধ্যার আর দুপুরে পশ্চিম দিকে যেতে দিবি না, ঘরে রাখবি। আমাকে একটু তপস্যা করতে হবে। তিনদিন পরে এসে যা করার করব। খবরদার ঘর থেকে বের হতে দিবি না। ওঁরা ওকে নিয়ে যাবে।”

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কবিরাজ পানি পড়া ও ধূপ দিলেন সকাল সন্ধ্যা ব্যবহার করতে। ইমদাদ কবিরাজকে বললেন, “কী হবে আমার মেয়েটার?”

“তোর মেয়ের মতো রূপবতী গুণবতী মেয়ে এই তল্লাটে তো দূর আট গ্ৰামেও পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে হারাস না, অন্তত তিনদিন ওর পাশাপাশি থাক। ঘর থেকে বের হলে কোথায় নিয়ে যাবে, ঠিক নেই। অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে বলেই জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছে।” বলে কবিরাজ ঘরমুখো হতেই মোতাহার আহসান থামালেন। কিছু টাকা মুঠোবন্দী করে এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোর হাদিয়া।”

“না চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার থেকে কিছু নিবো না। আপনি আমাদের গ্ৰামের জন্য যা করেছেন, এটা নিয়ে নিজেকে ছোট করতে পারব না। তবে একটা অনুরোধ, এইবার টিউবল এলে আমাদের পাড়ায় একটা দিয়েন। বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয় গিন্নিকে। আমি তো আবার সব জায়গা যেতে পারি না।” কবিরাজের কথায় মোতাহার আহসান টাকাটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “তোদের ঐ পাড়ার দুইটা কলের জন্য আপিল করেছি উপর মহলের কাছে। আসলে কল বসানোর যাবতীয় খরচ আমি দিয়ে আমার ভাগ্নের ঋণ শোধ করব।”

কবিরাজ প্রস্থান করার পরপরই পারুল সম্পূর্ণ ঘরে পানি ছিটালেন। মেয়েটাকেও পান করালেন কিছু। অপূর্ব স্থির দৃষ্টি আরুর ঈষৎ কৃষ্ণাভ মুখশ্রীর দিকে। শীর্ণ হয়ে আছে যে। বামহাতের কনিষ্ঠা আঙুল নড়তে দেখে এগিয়ে যেতে আরুর গালে হাত রাখল অপূর্ব, “আরুপাখি উঠ।”

আরু অবলোকন করল তার ঘন পাপড়িযুক্ত ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে। কিছু বলল না। পারুলকে আদেশ করে মোতাহার আহসান, “আরুকে কিছু খাওয়া। কাল দুপুরে দুমুঠো খেয়ে এসেছে।”

“তোমরাও তো কালরাতে খবর পেয়েই ছুটে এসেছ, কিচ্ছু দাঁতে কা/টো নি। সবাই খেতে এসো।” বলেই পারুল রান্নাঘরে গেল। কালরাতে রান্না করা ভাত তেমনই পড়ে আছে। ইলিশ মাছটা পড়ে আছে হাঁড়িতে। অনিতা গেল সাহায্য করতে। মাছ টুকরোগুলো উনুনে দিয়ে একটু সেকে নিল।

ইলিশ মাছে ডিম হয়েছে বড়োবড়ো দুই খণ্ড। পারুল একটা ডিম সাত টুকরো করেছে ও অন্যটা আস্তো অপূর্ব-র জন্য রেখেছে। সবাইকে খেতে দিয়ে আরুর জন্য আলাদা বাটিতে পান্তা ভাত, একটু পেঁয়াজ, এক টুকরো ডিম, শুকনো পোড়া মরিচ নিয়ে এসেছে পারুল‌। আরু নাকোচ করে, “মা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“না মা, খেয়ে নে। খেয়ে শুয়ে থাক। একা খেতে পারবি? নাহলে একটু অপেক্ষা কর মা, এখান তো সবাইকে খেতে দিয়েছি।” রেখেই খাওয়ার ঘরে চলে গেল পারুল। পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভাতের বাটিটা নিয়ে বসল আরু। জ্বর ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে শরীর ছেড়ে। উষ্ণ শরীরে পান্তা ভাত বেশ লাগল আরুর। অপূর্ব খাওয়া শেষে আরুর পাশে গিয়ে বসল। অতঃপর অনিতা উঠে গেল। সবসময় একজন নয় একজন আরুর পাশে থাকা উচিত।
পাতে তুলে দেওয়া বড়ো খণ্ডের ডিমটা দাঁতে কাটেনি অপূর্ব। অগোচরে নিয়ে এসেছে। আরুর আড়ালে পাতে দিয়ে হাত মুখে ফেলল রুমালে।
আচমকা ডিমটা দেখে বাকরুদ্ধ হলো আরু। খাওয়ায় অনশন করে বলে, “আমার স্পষ্ট মনে আছে, মা আমাকে এক টুকরো দিয়েছিল তাও ছোট। এখন দেখছি দুই টুকরো।”

“আমিও তো দেখলাম দুই টুকরো। হয়তো ভাতের ভেতরে ছিল, তুই দেখিস নি। বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস কর।”

“তাই হবে বোধহয়।” বলেই ডিম ভেঙে টুকরো করে মুখে তুলে স্বাদ গ্ৰহণ করে ডিমের। আরু জানতেও পারল না, কেউ একজনকে তার প্রিয় মাছের প্রিয় ডিমখানা না-খেয়ে তারজন্য লুকিয়ে এনেছে।
__
অপরাহ্ন পেরিয়েছে। গভীর নিদ্রায় মগ্ন আরু। বাইরে প্রবেশ নিষেধ বিধায় পোশাক ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছিল আরু। অপূর্বরা রয়েছে মধ্যবয়স্করা সবাই চলে গেছে। উঠানে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছে। উত্তর পাশ দিয়ে একটা কালো কুচকুচে বিড়াল এসে বসল সবার মাঝে। পারুল কয়েকটা মুড়ি মাটিতে রাখতেই বিড়াল ছানাটা মুখে নিল। খাওয়া শেষে আহসান বাড়ির দিকে মুখ করে পা চাটে। তুর মজার ছলে‌ বলে, “গতকাল পা চাটলে বুঝতাম, আমরা আসব বলে আগমন বার্তা দিচ্ছিস। কিন্তু এখন কেন চাটছিস?”

ভেজা মুড়িগুলো চামচ দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলে অয়ন, “কালকেও এসেছিস ও‌। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। কালকে চাটতে পারেনি তাই আজকে এসেছে।”

অপূর্ব প্রশ্ন করে, “বিড়াল পা চাটলে অতিথি আসে?”

“হম। সবাই বলে।” পারুল বলে। বিড়াল ছানাটা ঘরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তিনবার ম্যাও আওড়াল। অতঃপর ছুটে চলে গেল। পারুল দৃষ্টি অনুসরণ করে অয়নকে আদেশ দেয়, “দেখতো আরু ঘরে আছে কি-না?”

অপ্রসন্ন হলো অয়ন। রোষে গজগজ করতে করতে ঘরে যেয়ে ফিরে এসে স্পষ্ট স্বরে বলে, “বুবু ঘরে নেই মা।”

কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অপূর্ব কাপ ফেলে ছুটে গেল ঘরে। উপস্থিত সবাই গেল পেছন পেছন। আরু-কে ডানপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে অপূর্ব হৃৎপিণ্ডে শীতল স্রোত খেয়ে গেল। পারুল চ/ড় বসালেন অয়নের গালে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “ইচ্ছে করছে এক চ/ড়ে সব দাঁতগুলো ফেলে দেই। মিথ্যা বলা শিখে গেছে। গুরুতর একটা বিষয় নিয়ে মজা করছে।”

চোখে পানির আগমন হতে না হতে হেঁচকি উঠে গেল অয়নের। এতে কড়া গলায় শাসায় পারুল, “আরুর ঘুম ভাঙলে ঐ কলা বাগানে বেঁধে রাখব তোকে। যা এখান থেকে।” অয়ন ছুটে গেল বাইরে। আরুদের ঘরে দুইটা দরজা। পেছনের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে উঠানে গিয়ে বসল পারুল। পুনরায় খোশগল্পে মেতে উঠল।

পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। অয়ন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “মা বুবু কোথায় জানি যাচ্ছে।”

“মা/র না খেতে চাইলে সামনে থেকে সর।” অয়নের কথাকে ফাঁকা আওয়াজে উড়িয়ে দিলেন পারুল। অপূর্ব অস্থির হৃদয় নিয়ে তিন মিনিট ক্ষান্ত থাকতে পারেনা। ‘দেখে আসি’ ভেবে অগ্রসর হলো ঘরের দিকে। বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে, আরু নেই। বিছানা ফাঁকা এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় গেল মেয়েটা? ‘পেছন দিকের দরজাটা দমকা হাওয়াতে একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে’ -কে খুলল?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

কবিরাজ সকাল সকাল খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। রাতে তিনি আসতে পারতেন, তবে কবিরাজরা চাইলেই সবসময় সব স্থানে যেতে পারেন না। তাদের অনেক বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন পারুল, “কবিরাজ সাহেব আমার আরুকে ওরা নিয়ে গেছে, আপনি আমার আরুকে ফিরিয়ে এনে দিন।”

“গতকাল বারবার বারণ করেছি মেয়েকে হাত ছাড়া করবি না। আমার কথা তোরা কেউ শুনলি না।” কবিরাজ অধৈর্য হয়ে বলে। পারুল অনুশোচনা বোধ করলেন। ভুল স্বীকার করে, “এমন হয়ে যাবে আমি বুঝিনি। আরু ঘুমাচ্ছিল, আমরা উঠানে বসে চা খাচ্ছিলাম। আপনি বলেছিলেন বাড়ি থেকে বের হলে তবেই আরু-কে নিয়ে যাবে, কিন্তু ওরা যে ঘর থেকে ঘুমন্ত আরুকে নিয়ে গেছে।”

কবিরাজ রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে পানি ছিটালেন বাড়িতে, যা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বে পড়ে নিয়ে এসেছেন। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “দরজা বাইরে থেকে খোলার সাধ্য ওদের নেই, তোরাই কেউ খুলেছিস। ওরা দূর থেকে শুধু আকর্ষণ করেছে।”

পারুলের স্মৃতিশক্তি যতদূর ভেসে উঠে সে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়ার পূর্বে তেজস্রী অয়ন রাগ দেখিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। আরুর চলে যাওয়ার সংবাদ অয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ অয়নকে সমুখের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখেনি কেউ। এক্ষেত্রে সে পেছনের দরজা ব্যবহার করেছে। পারুল রোষে গজগজ করতে করতে অয়নকে খোঁজার প্রচেষ্টা করল। দৃষ্টিগোচর হলে আজ বোধহয় তার সেদিন দিন থাকত।
_
আরুর নীল রঙের শাড়িটা উঠানে দড়ির সাথে দুলছে। কাল দুপুরে মেলে দেওয়া হয়েছে, এখন বোধহয় আরুর অপেক্ষায় অপেক্ষারত সে। তাকে ঘরে নিয়ে ভাঁজ কথার তীব্র বাসনা।

মৃধা বাড়িতে ক্রন্দনরোলে মুখরিত। উঠানে হোগলা বিছিয়ে এলোপাতাড়ি বসে আছে সকলে। নির্ঘুম পেরিয়েছে গোটা এক কালরাত্রি। পারুলকে শান্তনা দিচ্ছে অনিতা, জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। মোতাহার আহসান তার চেয়ারম্যান-ই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আশপাশ গ্ৰামে আরুর খবর ছড়িয়েছে, অথচ এখনো আরুর সন্ধান নেই। চার ভাই, স্বামী ও বাবা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পারুল অশান্ত হয়ে ছুটে গেল সেদিকে। গ্ৰামীণ শাড়ির এক প্যাঁচ খুলে মাটিতে গড়াগড়ি করে মাখিয়েছে আর্দ্র ও শুষ্ক উভয় মাটি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাজান, তুমি আমার আরুকে এনে দাও। কাল থেকে আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই।”

বংশের একমাত্র মেয়ে/বোন। সাত ভাইয়ের এক বোন বলেই তো ভালোবেসে তার নাম রেখেছিল পারুল। আজ বোনের কান্নায় বুকে ফেটে যাচ্ছেন তাদের। মোতাহার আহসান বলেন, “কাঁদিস না, কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা আরুকে পেয়ে যাবো। একজন মানুষ উধাও তো হয়ে যেতে পারে না।”

“কীসের চেয়ারম্যান আপনারা? নিজের বোনের সমস্যাই সমাধান করতে পারছেন না, গ্ৰামের সমস্যা কী সমাধান করবেন?” পারুল কাঁদতে থাকে অনবরত। চেপে রাখা হাতটা আলগা হয়ে ঝুলে গেল নিচে। হেলে পড়ার পূর্বেই ধরে ফেলল ভাইয়েরা। এতগুলো মুখ যখন হাহাকারে জর্জরিত তখন একটি মুখে ভেসে আছে প্রফুল্ল হাসি। বেশ হয়েছে আরু চলে গেছে, এবার তাকে সবাই ভালোবাসবে। উপস্থিত সবার মাঝখান থেকে বেরিয়ে গেল খেলতে। আরুর জন্য কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। বহু কষ্টে ধরে হোগলা পর্যন্ত নিয়ে যেতেই সবাই দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল পারুলকে রাখার। অনিতা চাপা গলায় অন্য ঝা-দের বলে, “জাগানো দরকার নেই, বিশ্রাম করুক একটু।
সত্যি কি মেয়েটার কোনো খবর‌ আপনারা পাননি?”

“না, বউমা। কোথায় কীভাবে নিয়ে গেছে, কে জানে? এক সেকেন্ডে তাঁরা অনেক পথ পাড়ি দিতে পারে।” দাদাজানের দিকে চেয়ে ফোঁস করে‌ নিঃশ্বাস ছাড়ল অপূর্ব। উড়তে থাকা আরুর নীল রঙের শাড়িটা দড়ি থেকে নামিয়ে বুকে চেয়ে রাখল। পায়ের নুপূরের শব্দটা এখনো যেন বাজছে। চোখের তারা ভিজে আনমনে বলে উঠে, পদ্মাবতী, ক্ষমা করে দিও তোমার ব্যর্থ প্রেমিক-কে। অপূর্ব-র বুকে ফুটে উঠা পদ্মফুলটা কেউ কেড়ে নিয়ে গেল অজানায়। ফিরে এসে আগলে রাখার শেষ একটা সুযোগ দাও আমায়।”
__

অপূর্ব দিঘির জলে পা ভিজিয়ে শাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। তখন সেই ব্যথার উপশম হিসেবে আগমন ঘটল আরুর। অপূর্ব-র কাঁধে হাত রাখতে হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। চকিতে পাশ ফিরতেই আরুর আবেদনময়ী মুখশ্রী নজরে এলো তার। হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে স্থির থাকতে না পেরে অবিলম্বে আবদ্ধ করে নিল আরুকে। দুরন্ত কণ্ঠে বলে, “কোথায় ছিলে পদ্মাবতী?”

“এই তো কাছে। কে আমাকে কতটা ভালোবাসে পরখ করতে।” আরুর শান্ত কণ্ঠ। অপূর্ব দূরত্ব বজায় রাখল না। বড্ড উন্মাদ হয়ে উঠল। আরু নিজেকে যথা সম্ভব দূরে‌ নিল। দিঘির পাড়ে বেড়ে উঠা কচু পাতা নিয়ে রঙ্গ করে বলে, “আপনার মন খারাপ না? আমি আপনার মন ভালো করে দিবো দাঁড়ান।”

অপূর্ব-র বাহু আঁকড়ে ঢালবিশিষ্ট দিঘিতে পানি ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অপূর্ব অন্যহাতে কোমর জড়িয়ে আরুকে আগলে রাখে। বেশ খানেকক্ষণ পানিতে চুবিয়ে তুলে একই রঙ্গ করে বলে, “দেখেছেন ভিজে নি। এটা আরুর ম্যাজিক।”

“খুব সুন্দর ম্যাজিক, এজন্য তোমার একটা পুরস্কার প্রাপ্য।” দুগালে হাত রেখে দূরত্ব শূন্যতায় এনে আরুর কপালে ছুঁয়ে দিল ওষ্ঠ। নিরবচ্ছিন্ন দৃষ্টি চেয়ে রইল আরু। অতঃপর পুনরায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “আমি জেনে গেছি আমার মনে কথা। যেই বয়সের দোহায় দিয়ে তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম, সেই বয়স তোমাকে অধিক কামনা করছে।”

ফোনের রিংটোনে অপূর্ব-র ভাবনার সমাপ্তি ঘটে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। নতুন যোগদান করে একদিন গিয়েছিল, আরুর চিন্তা আর যায়নি। তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে আরু নিখোঁজের। সূর্যটাও আগের মতো উঠে না অপূর্ব-র আকাশে, মেঘলা থাকে সর্বক্ষণ।
বিষণ্নতায় মাখা মন নিয়ে রিসিভ করে কল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না। অপূর্ব শান্ত গলায় বলে, “আমি কয়েকটা দিন যেতে পারব না। একটু অশান্তিতে আছি।”

অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় চোখের পাতা বুঝে আরুকে আহ্বান করল। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকাল অপূর্ব। তিনদিন পর তার চোখের পাতা লেগে এসেছিল। একটু ঘুম পেয়েছিল। সে স্বপ্নেও আবির্ভাব ঘটেছিল আরুর। অনিতা বসতেই অপূর্ব মায়ের কোলে মাথা রাখে। জড়িয়ে ধরে বলে, “মা আমার পদ্মাবতীকে কি আমি ফিরে পাবো না?”

“তুই তো বললি, ‘ওকে তুই বিয়ে করবি না।’ তাহলে ওর জন্য উতলা হচ্ছিস কেন?” ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জরানো গলায় বলে অনিতা।

“তুমিই তো আরুর ভালোবাসার বীজ আমার বুকে বপন করেছিলে। বীজ থেকে চারা হয়ে উঠেছে। সেই চারা অন্য কারো বুকে রোপন করতে দিবো না। এখানে বড় হবে।” প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে অপূর্ব।

অনিতা নিরবে অপূর্ব-র চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। অপূর্ব-র বন্ধ করা চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু অনিতার শাড়িতে পড়ে। স্বযত্নে ছেলের চোখ মুছে দিয়ে বলে, “পশ্চিম দিকের লোকজন তোর বাবাকে ফোন দিয়েছিল। সেদিকে একটা মেয়েকে কড়ই গাছের মগডালে হাঁটতে দেখা গেছে। সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে। বর্ণনা অনেকটা আরুর সাথে মিলে গেছে। তোর বাবা সেদিকে গেছে।”

চকিতে অপূর্ব উঠে বসে। প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে অপূর্ব। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ব্যক্ত করে বর্ণ, “আমি জানি ওটা আরু মা। ঐটাই আমার পদ্মাবতী। কীভাবে যেতে হবে, আমায় একটু বলো। আমি যাই।”

অনিতা প্রহরী ডেকে তাদের হাতে অপূর্ব-কে তুলে দিয়ে আরুর কাছে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্ব-শরীরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। অপূর্ব সে-তো আগে আগেই ছুটে গেল।

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে..!

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে