নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২

0
3419

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২

লেখিকা: সুলতানা তমা

দূর থেকে ফজরের আযানের সূর ভেসে আসছে শুনে চোখের পানি মুছে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম, মেঘ’কে সামনে দেখে একটু অবাকই হলাম। মেঘ থাপ্পড় দেওয়ার পর কোনো কথা না বলে তোহাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় চলে এসেছিলাম। এতোটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদেই কাটিয়ে দিয়েছি।
আমি: আপনি ঘুমাননি?
মেঘ: ঘুম আসেনি।
আমি: ওহ!
মেঘ: তখনের এমন ব্যবহারের জন্য সরি, বুঝতেই পারছেন মাথা ঠিক নেই। বিয়েটা করার ইচ্ছে তো আমার ছিল না তা…
আমি: হুম বুঝতে পেরেছি।
মেঘ: একটা অনুরোধ করবো রাখবেন প্লিজ।
আমি: বলুন।
মেঘ: আপনি গোসল করে নিন নাহলে…(মেঘ মাথা নিচু করে থেমে গেলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, এই কথা ও বলতে পারলো)
মেঘ: ভুল বুঝবেন না প্লিজ! আসলে আমি দাদিকে খুব ভয় পাই আর দাদির জন্যই বিয়েতে রাজি হয়েছি, এখন দাদি যদি জানতে পারে আমি আপনাকে মেনে নেইনি তাহলে…
আমি: সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বউরা যেমন ভোরবেলা গোসল করে আমাকেও তাই করতে বলছেন তো?
মেঘ: প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না আমি নিরুপায় হয়েই এমন জঘন্য কথা বলেছি। জানি আপনি এই কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছে…
আমি: হুম রাতের থাপ্পড়ের চেয়ে এই কথাটায় বেশি কষ্ট পেয়েছি। আমার স্বামী যে কিনা আমাকে ছুঁয়েও দেখলো না উল্টো বাসর রাতে থাপ্পড় গিফট করলো, আর আমাকে কিনা সেই স্বামীর জন্য লোক দেখানোর জন্য… ছিঃ!
মেঘ: ভুল বুঝবেন না প্লিজ দাদি বুঝতে পারলে রেগে যাবে দাদি অসুস্থ উত্তেজিত হলে সমস্যা… (মেঘের পুরো কথা শেষ হবার আগেই ওকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে আসলাম)

চুপচাপ খাটের এক কোণে বসে আছি, মেঘ আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে বাতরুমে চলে গেলো হয়তো লোক দেখানোর জন্য এখন গোসল করবে। ছিঃ ভাবতেই আমার রাগ হচ্ছে মানুষ এমনো হয়?

মেঘ: যান গোসল করে আসুন। (মেঘের কন্ঠ শুনে পাশে তাকালাম, মাত্র গোসল করে আসাতে মেঘ’কে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যেন ঘিরে রেখেছে। সব ছেলেদের কি এমন সুন্দর লাগে নাকি মেঘ খুব বেশি ফর্সা বলে এতোটা সুন্দর লাগছে)
মেঘ: কি হলো?
আমি: হু!
মেঘ: গোসল করে আসুন।
আমি: পারবো না আমি লোক দেখানোর জন্য আপনার কথামতো চলতে।
মেঘ: তাহলে সূর্য উঠার আগেই বাবার বাড়ি চলে যান তোহার কাছে থাকতে হবে না। (ঘুমন্ত তোহার দিকে তাকাতেই চোখ দুটু ভিজে উঠলো, বিয়েই তো করেছি নিষ্পাপ এই শিশুর জন্য এখন নাহয় ওর জন্যই সব মেনে নিবো)

গোসল সেরে রুমে এসে মেঘ’কে কোথাও দেখতে পেলাম না, হয়তো বেরিয়ে গেছে। একটু সাজুগুজু করে তোহার পাশে এসে বসলাম, সাথে সাথে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দুহাত দিয়ে আমার গলা জরিয়ে ধরে আধোআধো কন্ঠে বলে উঠলো…
তোহা: আমার আম্মুটা। (মা হওয়ার সুখ বুঝি এরকমই, তোহার কন্ঠে আম্মু ডাক শুনে আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো)
তোহা: ও নতুন আম্মু কাঁদছ কেন তুমি?
আমি: কোথায় নাতো মামুনি, চলো ফ্রেশ হবে তুমি।

তোহাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম, সবাই ডাইনিং এ বসা। মেঘ’কে বসা দেখে আর ওদিকে গেলাম না সোফায় এসে বসলাম। সাথে সাথে দাদি উঠে এসে আমার পাশে বসলেন।
দাদি: তোহা যাও তো আব্বুর হাতে খেয়ে নাও।
তোহা: কেন? আমার তো এখন আম্মু আছে আমি আম্মুর হাতে খাবো। (তোহা কথাটা বেশ জোরেই বলে ফেলেছে, মেঘ মন খারাপ করে খাবার না খেয়ে বসে আছে। মেঘ হয়তো ভাবছে আমি ওর থেকে ওর মেয়েকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি)
আমি: মামুনি আমি তোমাকে দুপুরে খাইয়ে দিবো এখন বাবার হাতে খেয়ে নাও। (তোহা আর কোনো কথা বললো না মেঘের কাছে চলে গেলো)
দাদি: কিরে রাতে ঘুম কেমন হলো? (দাদির এমন প্রশ্ন শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো)
দাদি: তুই হয়তো রেগে আছিস হুট করে এমন কিছু হয়ে যাওয়াতে, তোরও হয়তো কোনো স্বপ্ন ছিল যা আমাদের জন্য বিসর্জন দিতে হলো।
আমি: না দাদি আমি রেগে নেই তাছাড়া তোহাকে আমি মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েছি বলেই তো বিয়েটা করেছি।
দাদি: তুই রাজি হবি আমি ভাবতেই পারিনি, রায়হান চৌধুরীর মেয়ে আমাদের মতো গরীব ঘরে বউ হয়ে আসতে রাজি হবে তা…
আমি: আব্বুর হয়তো অনেক কিছু আছে কিন্তু আপনাদেরও তো কম নেই তাছাড়া আপনাদের ঘরে তো সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস আছে, আমার মেয়ে “তোহা”
দাদি: ভাগ্যিস তুই মেঘ এর স্ত্রী হয়ে এসেছিস, শায়লার মতো কেউ হলে তো তোহার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো।
আমি: শায়লা…
মেঘ: কণা একটু রুমে আসবে! (বাব্বাহ্ রাগি বোম এর মুখ থেকে এতো সুন্দর কথাও বের হয়)
আমি: আসছি।
দাদি: আমার দাদুভাইটা একটু রাগি কিন্তু অনেক রোমান্টিক, যা যা রুমে যা।
আমি: দাদি আপনি না!

রুমে এসে দেখি মেঘ রেডি হচ্ছে অফিস যাবে বোধহয়। বিয়ের পরদিন বোধহয় ওর মতো রাগি বোম গুলার দ্বারাই অফিস যাওয়া সম্ভব।
মেঘ: ওহ আপনি এসেছেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: এভাবে তাকিয়ে আছেন যে, আরে আগে তো দাদি ছিল তাই তুমি করে বলেছিলাম। (ভেবেছিলাম ভালোবাসা দিয়ে সব ঠিক করে দিবো কিন্তু মনে হচ্ছে সম্ভব না)
মেঘ: যেহেতু বিয়েটা হয়েই গেছে তাই তোহার দায়িত্ব এখন থেকে আপনার। দেখে রাখবেন ওকে আমি অফিস যাচ্ছি।
আমি: আজ অফিসে না গেলে হয় না? (কথাটা বলে জিহ্বায় কামর দিলাম নিজের অজান্তেই কি বলে ফেললাম)
মেঘ: কেন আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে? হানিমোনে যাবেন? ভুলে গেছেন রাতের থাপ্পড়ের কথা? একদম অধিকার ফলাতে আসবেন না আসলে আবারো থাপ্পড়…
আমি: এই আপনি কি মানুষ নাকি রাগি বোম? (মেঘকে কথা শেষ করতে না দিয়ে এই কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। রাতে থাপ্পড় দিয়ে সকালে সরি বলেছে এখন আবার থাপ্পড় এর ভয় দেখাচ্ছে, অদ্ভুত মানুষ একটা)

আমি: হ্যালো আব্বু।
আব্বু: হ্যাঁ মা কেমন আছিস?
আমি: এইতো ভালো তোমরা কেমন আছ?
আব্বু: আর বলিস না তোর মা তো কাঁদতে কাঁদতেই শেষ, আমি নাকি তোর জীবন নষ্ট করে ফেলেছি।
আমি: না আব্বু আমি অনেক ভালো আছি এখানে সবাই খুব ভালো আম্মুকে বুঝিয়ে বলো।
আব্বুর সাথে আরো কিছুক্ষণ ফোনে কথা বললাম, ফোন রেখে পিছন ফিরতেই মেঘ’কে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম!
মেঘ: কি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? (মেঘ আস্তে আস্তে আমার দিকে এগুচ্ছে, ওর এমন অদ্ভুত চাহনি আর এগুনো দেখে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বারান্দার রেলিং এ এসে আটকে গেলাম। মেঘ একদম আমার গাঁ ঘেসে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো তারপর আমার দুদিকে দুহাত দিয়ে রেলিং ধরে আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো)
আমি: আআআপনি এমমন করছেন কেন?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কি হলো কথা বলছেন না কেন?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: সরুন আমি রুমে যাবো।
মেঘ: এই মেয়ে পেয়েছটা কি আমাকে যখন যাকে দিয়ে খুশি বকা শুনাচ্ছ। বিয়ে করে কি এমন করেছি যে আমি এখন অফিসেও যেতে পারবো না? একবার তুমি না করছ তো একবার দাদি না করছে পেয়েছ কি আমাকে হ্যাঁ? আমি অফিসে না গেলে কি তোমার বাবা আমাকে চাকরিতে রেখে দিবে নাকি মাস শেষে বেতনটা পাঠিয়ে দিবে? যত্তোসব। (মেঘ কথাগুলো বলে চলে যাচ্ছিল আমি আস্তে করে পিছন থেকে বললাম…)
আমি: মনে হচ্ছে রাগি বোম ফেটে গেছে। (মেঘ আমার কথা শুনে আবার ফিরে আসলো। আমার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো)
মেঘ: এই তোমরা মেয়ে জাত এমন কেন?
আমি: সব মেয়ে এক না, সবাইকে নিজের বউয়ের সাথে তুলনা করবেন না বলে দিলাম।
মেঘ: হুহ আসছে সব মেয়ে এক না! সব মেয়ে এক সব নষ্ট, সবাইকে আমি ঘৃণা করি।
মেঘ: আপনার ঘৃণা করাতে কোনো মেয়ের কিছু যায় আসে না।
মেঘ: দ্যাত।
মেঘ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে হেটে চলে গেলো। এই রাগি বোম এর ভালোবাসা পাওয়া কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব?

সন্ধ্যায় তোহাকে নিয়ে বসে গল্প করছি হুট করে মেঘ কোথা থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে রুমে ঢুকলো।
মেঘ: কণা আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আমি: বলুন।
মেঘ: যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো আর ডিভোর্স সম্ভব না তাই আমাদের মধ্যে কিছু…
আমি: আমাকে মেনে নিতে আপনার সমস্যা কোথায়?
মেঘ: আমার মনে হয় সব মেয়ে এক আমি এখন আর কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারিনা।
আমি: আপনার প্রথম স্ত্রী কি এমন করেছিল যে দুনিয়ার সব মেয়ের উপর আপনার ঘৃণা জন্মে গেছে।
মেঘ: বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও আমি শায়লাকে অনেক ভালোবাসতাম কিন্তু শায়লা সবসময় ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি করতো। তোহা জন্ম নেওয়ার ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন শায়লা আমাকে বললো ওর পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব না, ও ডিভোর্স চায়। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো ও আগে কাউকে ভালোবাসতো এখন তার কাছে ফিরে যেতে চায়। অনেক বুঝিয়েছিলাম শায়লাকে কিন্তু ওর এক কথা, ও ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরে যেতে চায়। ছোট্ট তোহাকে ফেলে রেখে যেতে ওর এতটুকু কষ্ট হয়নি। আমার তো রাগ একটাই অন্য কাউকে যখন ভালোবাসতো তাহলে আমার সাথে বিয়ে নামক নাটক করার কি প্রয়োজন ছিল।
আমি: শায়লা এমন ছিল বলে যে সব মেয়ে এক তাতো নয়। আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসি না তাহলে আমাকে মেনে নিতে পারবেন না কেন?
মেঘ: এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আজ থেকে আপনি সোফায় ঘুমাবেন, আমার সামনে বেশি আসবেন না, আমার কোনো কিছুতে অধিকার খাটাবেন না আ…
আমি: সব পারবো কিন্তু সোফায় ঘুমাতে পারবো না, আপনার ইচ্ছা হয় আপনি গিয়ে ঘুমান। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এখানেই এই বিছানায় ঘুমাবো।
মেঘ: আমি আমার মেয়েকে রেখে ঘুমাবো না।
আমি: আমিও আমার মেয়েকে রেখে ঘুমাবো না।
মেঘ: আল্লাহ্‌ এই ঝগড়াটে মেয়ে কোথা থেকে আমার কপালে জুটিয়ে দিলে।
দাদি: মেঘ কণা নিচে আয় তোরা দেখ কারা এসেছে। (দাদির ডাক শুনে তোহাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, পিছু পিছু মেঘও আসছে)

ড্রয়িংরুমে রুহানকে বসে থাকতে দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো, ও এখানে কি করছে? আমার কোলে তোহা আর পাশে মেঘ’কে দেখে রুহান বেশ অবাক হয়েই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
রুহান: কণা তুমি?
দাদি: তুই ছিনিস ওকে? ও তো মেঘ এর স্ত্রী।
রুহান: অসম্ভব এইটা হতে পারে না।
দাদি: কেন কালই তো ওদের বিয়ে হলো ফোনে তো তোদের বললামই।
রুহান: আরে দাদি তোমরা কেন বুঝতে পারছ না ওকে আমি ভালোবাসি, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ও বিয়ে করতে পারেনা। কণা শুধু আমার বউ হবে তিনবছর ধরে আমি এই স্বপ্ন দেখে আসছি।
রুহানের চিৎকারে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মেঘ এর দিকে তাকালাম, ওর চোখে শুধু রাগ আর ঘৃণা।
মেঘ: ছিঃ শেষপর্যন্ত আপনিও…
মেঘ চলে গেলো তোহাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে