নীড়ের খোজে পর্ব-১০

0
919

#নীড়ের_খোজে
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_১০

বেশ অনেক দিন হয়ে গেছে মাশরিনা এ বাড়িতে এসেছে। মাশরিনা যে ভয়টা পাচ্ছিল তার কোনটাই লক্ষ্য করা যায় না রুবির মধ্যে। তিনি মাশরিনাকে নিজের মেয়ের মতোই যত্ন করেন। সাজিদ অবশ্য এর পর দুবার মাত্র এসেছিল। একবার তো এসেছে একদম হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে। মাশরিনা তো প্রথমে বুজতেই পারেনি এত কিছু কি নিয়ে এসেছে সেই সাজিদ। পরে রুবি যখন প্যাকেট গুলো খুলল তা দেখে তো মাশরিনা, রুবি দুজনের চোখ ছানাবড়া। ভিতরে সব গুলো প্যাকেটে ছোট বেবিদের ড্রেস, জুতা, খেলনা। এগুলো দেখে তো রুবি বেগম হেসেই ফেললেন। তার এই ছেলে হয়েছে আরেক পা’গল। তখনই সাজিদকে ডাকে রুবি হোসেইন।

– হ্যা আম্মু ডেকেছ?

– কি রে তুই এগুলো কি এনেছিস।

– আরে আম্মু তুমি বুজতেছ না। এগুলো সব নিউ কামার এর ড্রেস, সুজ।

– তুই এখন এগুলো কেন আনলি?

– যখন সে আসবে তখন আমি কোথায় না কোথায় থাকি বলা যায় তাই আগেই সব নিয়ে আসলাম। শত হোক সে চৌধুরী বাড়ির সন্তান। তার যেন কোন কষ্ট না হয় সেগুলো আমি দেখব তুমি এটা নিয়ে ভেব না।

ছেলের কথা শুনে রুবি নিজেও অবাক। তার এই ছেলে টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবার বৈশিষ্ঠের ছিটে ফোটাও যেন ওর মধ্যে নেই।




সাবিহার সাথে যখন কথা হয়েছিল তখন ওকে এ জায়গার ঠিকানা দিয়েছে মাশরিনা। সাবিহা প্রায়ই আসে দেখা করতে। প্রায়ই ভার্সিটির পরে এখানে আসে। সন্ধ্যা প্রযন্ত আড্ডা দেয়। তারপর চলে যায়। সাবিহার সঙ্গ পেয়ে মাশরিনার ও একাকিত্ব দূর হয়।

মাশরিনাকে কাজে হেল্প করে যে মেয়েটা ও বড্ড কেয়ারিং। প্রেগন্যান্সির আট মাস হতে চলল। এমনিতেই সেই আঘাত এর পর থেকে কোন কিছুই করতে পারেনা ফুল বেড রেস্ট এ থাকতে হয়। এখন তো চলাফেরা করতে অনেকটা কষ্ট হয়ে যায়। সেই মেয়েটার সহায়তায়ই এখন সব করতে হয়।

ডক্টর জানিয়েছে মাশরিনার সি’জার করার দরকার হবে। সে বিষয়ে ভয় নেই মাশরিনার তবে ওর যা হেলথ কন্ডিশন তাতে খারাপ কিছু হয়ে যাওয়ার রিস্ক আছে। এই মুহুর্তে মা কে বড্ড বেশি দেখতে ইচ্ছে করতেছে। কিন্তু ওর মায়ের কাছে ফোন দিলে এই মুহুর্তে কি বলবে ও সেই ভয়েও ফোন দেয়া হয় না। ওকে এভাবে উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকতে খেয়াল করে রুবি। তিনি এসে ওর পাশে বসে। মাশরিনা ঘাড় গুড়িয়ে একবার তাকে দেখে আবার দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিং দেখায় মন দেয়। বেশ কিছুক্ষন নিরবতা চলে দুজনের মাঝে। এরপর নিরবতার রেশ কা’টিয়ে মাশরিনাই প্রথম কথা বলে।

– মা একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

– হুম বল শুনি।

মাশরিনা জিভে ঠোট ভেজায়। নিজেকে প্রস্তুত করে এতদিন মনের ভিতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন টা করার জন্য। তারপর জিজ্ঞেস করে

– আচ্ছা মা যেখানে আপনার ছেলে, স্বামী কেউই আমাকে মেনে নেয় নি সেখানে আপনি কেন আমাকে এত ভালোবাসা দিচ্ছেন। আমি কি যোগ্য এই ভালোবাসা পাওয়ার।

রুবি সাথে সাথে কোন জবাব দেয় না। কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। হয়ত ভাবছেন কি জবাব দিবেন, কেনই বা তিনি মাশরিনার জন্য এসব করছেন। এরপর বলেন

– তুই যে এসব কথা আমাকে অনেক দিন আগে থেকেই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিস সেটা আমি বুজতে পেরেছি। তবে সব কিছু শোনার সঠিক সময় এখনো হয় নি৷ একদিন সব বলব তোকে আমি। শুধু এটুকু জেনে রাখ আমি দুটো জীবনকে শেষ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করলাম। আজ থেকে আঠের বছর আগে যে কাজটা আমি করতে পারিনি সেই কাজটাই এখন করলাম। এখন আর কিছু জানতে চাস না দয়া করে।

-………..

– তোর মন খারাপ কি কারনে সেটা কি জানতে পারি?

– আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়তেছে।

– দেখা করতে চাস?

– কীভাবে দেখা করব কোন মুখে দাড়াব তার সামনে।

– বুজেছি। আমি দেখতেছি তুই ভাবিস না।




মেয়ের এরকম অবস্থা দেখে এসে থেকে থেমে থেমে কান্না করতেছে জবেদা। তার মেয়ে এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারে। হয়ত তারই গাফলতির ফল এটা৷৷ তিনি মেয়েকে ভালোভাবে দেখে রাখতে পারে নি বলেই হয়ত আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে। রুবি তাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝায় সবটা৷ এমন একটা সিচুয়েশনে রাগারাগি করাটা ঠিক হবে না এটাও বোঝায়। রুবির কথায় কাজ হয়। কান্না থামায় জবেদা। তবে তার মেয়ের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ রয়েই গেছে। এত কষ্ট করে যে মেয়েকে মানুষ করল তার এমন কাজে কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে রুবি বেগম তাকে অনুরোধ করে এই কয়টা দিন মেয়ের পাশে থাকার জন্য। তিনি পারলে তিনিই থেকে যেতেন। কিন্তু তিনি অপারগ। জবেদা প্রথমে ভয় পাচ্ছিল জারিফ এর বাবা হয়ত তাকে থাকতে দিবে না। তিনি জারিফকে কথাটা বললে জারিফ তাকে থেকে যেতে বলে আর বলে ও ওর বাবাকে বোঝাবে। সেই দিন এর পর থেকে ওর বাবা এখন আর বাড়িতে ঝামেলা করে না। ওর মায়ের উপর ও নির্যাতন করে না৷ হয়ত বুঝে গিয়েছে যে এখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ আছে। বাবার পরে মেয়েদের ভরসার স্থল হয় তার স্বামী। কিন্তু সেই ভরসার হাতটা কখনো মাথার উপর পায় নি জবেদা। এখন এই নিজের ছেলের এতটুকু ভালেবাসা যেন তার অন্তর ছুয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা সন্তানেরই উচিত তার বাবা মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া।

দুই মায়ের যত্নে দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কে’টে যায় মাশরিনার। অবশেষে সেই সুদিন আসে যেদিন সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে পৃথিবীর আলো দেখে মাশরিনার মেয়ে মায়া।

নাতনিকে কোলে নিয়ে জবেদার সব রাগ যেন পানি হয়ে গেল। রুবিরও অন্তস্থল প্রশান্তিতে ভরে যায়।

খবর শুনে সানওয়ার চৌধুরীও হসপিটালে এসেছিল সাথে শাফিন ও। সানওয়ার চৌধুরী এসে নিজ স্ত্রীর সাথে খুব চিল্লাপাল্লা করে হসপিটালে একটা সিনক্রিয়েট করে। তার অযান্তে মাশরিনার খোজ রেখে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে রুবি। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও রুবি অনড়। তার মবে হচ্ছে সে কোন অন্যায় না বরং ভালো কাজ করেছে। এখানে ঝামেলা করার কারণে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সানওয়ার চৌধুরীকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। অন্যান্য পেসেন্ট এর সমস্যা হচ্ছে বলে। যাওয়ার আগে শাফিন কয়েক বার মুখ ঘুরিয়ে জবেদার কোলে থাকা পুচকুকে দেখছিল। কি সুন্দর কোলের মাঝে তোয়ালে পেচানো ছোট একটা পুতুল। খুব করে মন চাচ্ছিল কাছে গিয়ে একটু আঙুল ছুয়ে দিতে, একটু কোলে তুলে নিতে। এ যে ওরই সন্তান। তবে ওর করা ভুল ওকে এই মুহুর্তে বাবু টার কাছে যেতে দিচ্ছে না। ও চাইলে হয়ত জোর করতে পারবে কিন্তু নিজের ইগোকে বড় করতে গিয়ে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে বাবাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায় শাফিন।





প্রায় আড়াই বছরের মতো কে’টে গিয়েছে। মায়াও এখন বড় হয়েছে একটু। ওর ছোট ছোট পা দিয়ে যখন পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায় তা দেখে যেন সমস্ত দুঃখ কষ্ট ঘুচে যায় মাশরিনার। মেয়েকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কে’টে যাচ্ছে। পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু শ্বাশুড়ি আর মায়ের অনুপ্রেরণায় সেটা আবার শুরু করে মাশরিনা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে মায়াকে আর কারো পরিচয়ে নয় বরং ওর মায়ের পরিচয়ে বড় করবে। মাশরিনাকে এই ফ্লাটে থাকতে দেয়া নিয়ে সানওয়ার চৌধুরীর অভিযোগ এর শেষ নেই। তিনি কোন মতেই থাকতে দিবেন না। তাই রুবি হোসেইন জবাবে জানিয়ে দিয়েছে এটা নিয়ে যদি আর কোনদিন কথা ওঠায় সানওয়ার চৌধুরী তাহলে এই ফ্লাট তিনি মাশরিনার নামে করে দিবেন। সানওয়ার চৌধুরী বুজে যায় যে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তিনি পারবেন না কারন তার স্ত্রী অনড়।

সাজিদ আর সাবিহার বিয়ের প্রায় দেড় বছর হতে চলল। মায়ার ওয়ান ইয়ার বার্থ ডে সেলিব্রেট করার জন্য সাবিহা, সাজিদ, রুবি সবাই এই বাসায় এসেছিল। সেদিন রাতেই সাজিদ মাশরিনাকে জানিয়েছিল সাবিহার কথা। এ বাসায় উভয়ের আসা, যাওয়া খুনশুটির মাঝে কবে যে প্রণয় গড়ে উঠেছিল এদের মাঝে মাশরিনা ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। মাশরিনা সঙ্কিত ছিল যে সানওয়ার চৌধুরী ওদের সম্পর্ক টা নিয়ে না আবার কি ঝামেলা করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় তাকে যখন রুবি প্রস্তাব রেখেছিল তিনি রাজি হয়ে যান। হয়ত সাবিহার বাবার অর্থবিত্তই তাকে সিনক্রিয়েট করতে দেয়নি। যাই হোক ভালোই হয়েছে। সাজিদ ছেলেটা বড্ড ভালো। ওর সাথে সাবিহা সুখেই থাকবে এই ভেবেই ভালো লাগছে মাশরিনার।

তবে শাফিন এখনো বিয়ে শাদী করেনি। কেন করেনি তার কোন উত্তর জানা নেই কারো। মাশরিনা আর শাফিন এর ডিভোর্স টাও হয়নি। মায়ার জন্মের কয়েক মাস পরেই পেপারে টায় সই করে দিয়েছিল মাশরিনা। তবে শাফিন আজও সেই পেপারে সই করেনি৷ ওর মনের ভিতরে কি চলছে কারো জানা নেই। তবে ও যাই চাক না কেন সে ব্যাপারে কোন মাথা ব্যাথা নেই মাশরিনার৷ ও ওর মেয়েকে নিয়ে, পড়াশোনা এখন বেশ আছে।




বড় কাপড়ের গোডাউন এ আগুন লেগে সব কিছু পুড়ে যাচ্ছে। দমকল বাহিনি পুরো দমে চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। কিন্তু কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। রাতের আধারে লেগেছে আগুন। এখন প্রায় পুরো গোডাউন পুড়ে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সানওয়ার চৌধুরী। তার সব কিছু চোখের সামনে ঝলসে যাচ্ছে। তিনি শাফিনকে ফোন করে যাচ্ছেন ফোন সুইচড অফ বলছে। এমন সময় ছেলেটা কোথায় গেল জানা নেই কারো। বিডিতে এই দূর্ঘটনা এখন ব্রেকিং নিউজ প্রচারিত হচ্ছে ওর তো এতক্ষণে জানার কথা তাহলে ও এখানে না এসে কোথায় আছে। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে সানওয়ার চৌধুরীর। এত বড় ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করার কথা না সানওয়ার চৌধুরির। তবে তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে কারণ শাফিন কাল এই গোডাউন এ-র উদ্দেশ্য এসেছিল। কি যেন হিসেব গড়মিল হচ্ছিল। তাই প্রোডাক্ট গুলো চেক করার জন্যই মূলত এসেছিল গাড়িটা বাহিরেই রাখা আছে। আর শাফিন এর কোন খোজ নেই।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে