#নীড়ের_খোজে
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৮
মাশরিনার গলা ফাটিয়ে চিতকার দেওয়া দেখে রানি বেগম ও ঘাবড়ে যায়। তিনি এখন কি করবেন বুজে উঠতে পারছিলেন না৷ ইতোমধ্যে সেখানে থাকা সবাই এই রুমে এসে হাজির হয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সবারই চোখ ছানাবড়া। তাদের মধ্যে কুসুম নামে একটা মেয়ে ছিল। তিনি রানি বেগমকে বললেন
– বুবু মাইয়াডার অবস্থা ভালা না। হাসপাতালে নিয়া চলেন।
– কিন্তু আমাগো যে এহান থিকা বাইর হবার নিয়ম নাই রে কুসুম। এহন আমি কি করুম।
– বুবু নিয়ম পরে দেইখোনে। আগে ওরে হাসপাতাল নিয়া চলো৷ অন্যথায় মাইডার কিছু হইয়া গেলে পুলিশি ঝামেলা হইবার পারে। তহন কিন্তু তুমি ফা’ইসা যাবা৷ ওরে ধাক্কাডা তো তুমি মা’রছিলা।
– হ রে কুসুম ঠিক কথা কইছোস। এই পুতুল এদিক আয় তো দেহি ধর ওরে উঠা। এই তোরা কেউ যাইয়া একটা গাড়ি ডাইকা দে না।
রানির কথা শুনে কুসুম ই আগে দৌড়ে যায় গাড়ি ডাকার জন্য। গলির একবারে শেষ মাথায় ওদের বাস হওয়ায় গলির মুখে আসতে হয় গাড়ি ডাকতে। কুসুম এক প্রকার দৌড়ে গলির মুখে চলে আসে। পরপর দুইটা খালি সিএনজি দাড় করাইলেও কেউ যাইতে রাজি হয় না। বেশি টাকা দিবে বললেও যেতে চায় না। পরে আর একটা সিএনজি ওয়ালাকে দাড় করায় কুসুম। তাকে বলে একজন অসুস্থ তাকে একটু হাসপাতাল নিতে হইবো। কিন্তু এই সিএনজি ড্রাইভার ও যেতে না চাইলে কুসুম জিজ্ঞেস করে কেন যাবেনা৷ তখন সিএনজি ড্রাইভার জবাব দেয়
– তোদের মতো ন’ষ্ট মেয়েলোক আমি আমার গাড়িতে উঠাইয়া গাড়ি নোংরা করবার চাই না।
– এই দাড়া দাড়া তোরে তো আমি চিনছি। তুই ওই বেডা না যে প্রায় রাত্রেই ম’দের নেশায় বুদ হইয়া মোহনার ঘরে পইরা থাকোস।
কুসুম এর কথা শুনে সিএনজি ড্রাইভার এর মুখ চুপসে যায়।
– নিজে ন’ষ্ট মেয়েলোক নিয়া ফুর্তি করবার পারো আর এখন আসছ ভালো মানুষি দেখাইতে। এই আমাগো ন’ষ্ট মেয়েলোক কারা বানাইছে। তোদের মতো কিছু মুখুশধারী ভদ্রলোক রাই তো আমাদের এই উপাধি দিছোস। আমরা এইখানে থাকি বইলা লোকে আমাগো খারাপ কয়। তোরা যে দিনের পর দিন এই পাপগুলা কইরা বেড়াস তোগো কেউ দেখে না। যাই হোক এখন এত বেশি কথা কইবার সময় নাই। তুই যাবি নাকি আমি তোর বউরে খুইজা বাইর কইরা তোর সব কথা ফাস করুম।
বউয়ের কথা শুনে সিএনজি ড্রাইভার নরম হয়।যেতে রাজি হয়।
রানি বেগম আর পুতুল দুইজন মিলে সিএনজিতে ওঠে। কুসুমকে বলে যায় এখানে সব দেখে রাখার জন্য।
🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
খাবার আনার জন্য নিচে নামছিল সাজিদ। এমন সময় পাশ থেকে স্ট্রেচারে করে একটা রোগী নিয়ে যেতে দেখল সাজিদ। প্রথমে খেয়াল না করলেও লাস্ট মোমেন্ট এ মুখের দিকে এক নজর তাকাল। একবার মুখটা দেখতেই থমকে গেল সাজিদ। এটা যে বড্ড পরিচিত মুখ। এর আগেও বহুবার দেখেছে এই মুখ। নিজেরই ডিপার্টমেন্ট এ পড়ত এই মেয়ে। মেয়েটাকে বড্ড ভালো লাগত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ওরই বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রনয় গড়ে ওঠে এই মেয়েটার। বড় ভাইয়ের ভালোবাসা বলে আর সেদিকে পা ফেলার সাহস হয়ে ওঠে নি সাজিদ এর। কিন্তু কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা শুনে বড় ভাইয়ের উপর বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছিল সাজিদ এর। ভেবেছিল সময় বের করে একবার মেয়েটাকে দেখতে যাবে। কিন্তু মেয়েটার এই হাল হলো কি করে। আর যারা ওকে এখানে নিয়ে আসছে তাদের দেখেও তো ভালো মানুষ মনে হচ্ছে না। তবে এদের সাথেই বা এই মেয়ে কি করছে। কোনভাবেই হিসেব মিলাতে পারছে না। তাড়াতাড়ি করে নিচে ক্যান্টিন থেকে খাবার এনে শাফিন এর কাছে রেখে আবার ছুটল সেদিকে যেদিকে মাশরিনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শাফিন যেখানে এডমিট ছিল সেখানেই মাশরিনাকে নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়তির কি খেলা।
সাজিদ এসে দেখে মাশরিনাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বয়স্ক যে মহিলাটা ওদের সাথে ছিল সে এখন এখানে নেই। অল্পবয়স্ক মেয়েটা অপারেশন থিয়েটার এর সামনে পায়চারি করতেছে। সাজিদ এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাড়ায়।
– নাম কি আপনার?
কেউ হঠাৎ এভাবে নাম জিজ্ঞেস করায় হাটা থামিয়ে তার দিকে তাকায়। তারপর জবাব দেয়
– আমার নাম পুতুল ।
– আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
– কি কথা?
– আচ্ছা আপনারা যাকে এখানে নিয়ে এসেছেন উনি আপনাদের কি হয়?
– সে কথা আমি আপনারে বলতে যাব কেন?
– সেটা জানা আমার জরুরি। প্লিজ বলুন না।
– আমি আপনারে এসব বলতে পারব না।
– দেখুন উনি আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। উনি আপনাদের সাথে কেন সেটাই জানতে চাচ্ছি। আপনি যদি না বলেন তাহলে আমি আইনের আশ্রয় নিব বলে দিলাম। আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে জোড় করে আটকে রেখেছেন আপনারা এটাই বলব।
– আপনার কাছে কি কোন প্রমান আছে উনি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী।
এবার চুপ মে’রে যায় সাজিদ। আসলেই তো ওর কাছে কোন প্রমাণ নেই যে মাশরিনা আর শাফিন এর বিয়ে হয়েছিল। হঠাৎ সাজিদ এর মাথায় একটা বুদ্ধি খিলে যায়। ওর খেয়াল হয় এরা তো টাকার জন্য সব করতে পারে৷ তবে টাকা দিয়েই এদের থেকে কথা বের করা যেতে পারে। সাজিদ পকেট থেকে এক হাজার টাকার দুইটা নোট বের করে পুতুল এর সামনে ধরে। বলে তুমি যদি মশরিনা সম্পর্কে আমাকে সব বলো তাহলে এই টাকা তোমার৷ পুতুলের তো টাকা দেখে চোখ চকচক করে ওঠে৷ কেউ শুধু একটু কথার জন্য এতগুলো টাকা দিবে এটা ভেবেই তো পুতুলের ড্যান্স করতে মন চাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে টাকাটা নিয়ে নেয় পুতুল। তারপর বলে কি জানতে চান বলুন?
– উনি আপনাদের সাথে কেন?
– আজ সকালে একজন এসে ওনাকে আমাদের কাছে রেখে গেছেন। তার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়ে গেছেন তিনি।
– কে দিয়ে গেছে তা কি জানেন?
– আসলে তার পরিচয় আমি অতো ভালোভাবে জানিনা। তবে শুনছি তার নাম নাকি শিমুল। বাপ মা নাই। দাদা দাদির সাথে ও অতো ভালো সম্পর্ক নাই। এখানেই থাকে।বিভিন্ন মেয়েগো পিরিতের জালে ফালাইয়া তারপর তাগো আইনা আমগো কাছে রাইখা যায়। এই বুবুরে মনে হয় জোড় কইরা তুইলা লইয়াইছে৷
– জোর করে আনছে বুজলেন কীভাবে?
– আসলে বুবুরে যখন আনছে তখন তার জ্ঞান ছিল না। পাজাকোলে কইরা লইয়াইছিল। তার উপর এই বুবু নাকি পোয়াতি। পইরা গিয়া সে পেটে ব্যাথা পাইছে। বাচ্চাটা বাইচা আছে কিনা জানিনা।
এই কথাটা শুনে সাজিদ এর বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠে। ওর এখন ওর বাবা আর ভাইয়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। তাদের জন্য মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। তারপর মনে মনে আওড়ায় সেদিন চা মা’রাটা কম হয়ে গেছে ভাই। তোমার আরো কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার ছিল।
-পুতুল এই পুতুল ওই জায়গার কি করিস? কার লগে কথা কইতাছো।
রানির ডাক শুনে পুতুল ছুটে তার কাছে চলে যায়।
তারপর বলে
– বুবু ওই লোকটা জিজ্ঞেস করল রোগী কেমন আছে আর কিছু না।
– ওহ। বাহির এর লোকের লগে কথার কোন দরকার নাই।
– আইচ্ছা বুবু।
প্রায় ঘন্টা দুই পরে ডক্টর বের হয়। রানি আর পুতুল ছুটে তার কাছে যায়। সাজিদ ও একটু দূরে দাড়িয়ে ছিল। ও ও চলে আসে সেখানে। ডক্টর জানান
– উপরওয়ালার অশেষ রহমত আছে ওনার উপর। এরকম সিচুয়েশনে ভ্রুন নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তবে এটা কিছুটা অলৌকিক এর মতোই বলা যায়। উভয়ে ঠিক আছে। তবে তাকে পুরোপুরি বেড রেস্ট এ থাকতে হবে। কোন রকম ঝুকি নেয়া যাবে না তাতে ভবিষ্যতে ক্ষতি হতে পারে। তবে একটা ব্যাড নিউজ আছে।
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে ডক্টর এর দিকে তাকায়। ডক্টর জানায়
– এই আঘাত এ-র কারণে বাচ্চার কোন একটা অঙ্গ বিকলঙ্গ হয়ে যেতে পারে।
এ কথা শুনে কুসুম ফট করে রানির দিকে তাকায় রানি মাথা নিচু করে নেয়। তিনিও হয়ত বুজতে পারছেন তিনি আসলে একটু বেশিই অত্যাচার করে থাকেন তার কাছে আশ্রিতাদের।
এসব কিছু শুনে সাজিদ এর কেন যেন চোখের কোনে জলে ভরো আসে।
#চলবে