নীড়ের খোজে পর্ব-০২

0
763

#নীড়ের_খোজে
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২

কোন বাবা তার নিজ সন্তানকে মে’রে ফেলার কথা বলতে পারে এর থেকে তিক্ত কথা আর কি হতে পারে। মাশরিনার কানের কাছে মনে হচ্ছে কথাগুলো বার বার বাড়ি খাচ্ছে। শাফিন যাওয়ার সময় শুধু বলে গেছে – তুৃমি যদি এবোরশন করাতে চাও আমাকে জানিও। যত টাকা লাগে আমি দিব। এই বলে শাফিন তখন বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সাথে কিছুই নিয়ে যায় নি। তাই মাশরিনা ধারণা করেছিল হয়ত সন্ধ্যায় ফিরে আসবে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো তখনো শাফিন এলো না। মাশরিনা বসে বসে প্রহর গুনছে। একটু পর পর ঘড়ির কা’টার দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়ির কা’টা টিক টিক করে তার আপন গতিতে এগুচ্ছে। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার নিজ গতিতে আবহমান। ঘড়ির কা’টা রাত দুটোর ঘর পেরুলো। শাফিন আর ফিরে আসেনি। ধৈর্যের বাধ ভাঙল মাশরিনার। এতক্ষণ কান্না চেপে রাখলেও এখন আর পারল। নেত্রপল্লব বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। পেটের উপর হাত রেখে আপন মনে বলে চলল

– তোর মা কি এত খারাপ সোনা যে তোর বাবাই তোর মাকে ছেড়ে চলে গেল। না না কি বলছি। ওই লোকটা তোর বাবাই হতে পারে না। কখনো না। যে তোকে ভালোবাসে না সে কখনো তোর বাবাই হতে পারে না। কখনো বাবা বলে ডাকবি না কেমন।

কান্না করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল টের পেল না মাশরিনা। অর্ধখোলা জানালার ফাক গলিয়ে রোদ এসে লাগছে চোখে মুখে। চোখ কুচকে নিল মাশরিনা। পিট পিট করে চোখ খুলতেই সূর্যের আলো এসে পড়ল চোখে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ল। এগিয়ে গিয়ে অর্ধ খোলা জানালাটা পুরোটা খুলে দিল। এমনিতে রাত্রবেলা জানালা একটু খোলা থাকলেই যেই মেয়ে ভয়ে কুকড়ে যেত সে পুরো একটা রাত জানালা খোলা রেখে ঘুমিয়েছিল যেখানে পুরো বাসায় সে একা। পুরো বাসায় বললে ভুল হবে। নিচতলায় এক দাদা আর দিদুন থাকে। তাদেরই বাড়ি এটা। বেশি বড় নয়। দোতলা বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরনো বাড়ি এটা। জায়গায় জায়গায় রঙ চটে গিয়েছে। শুনেছি তাদের নাকি একটাই ছেলে ছিল। সড়ক দূর্ঘটনায় ছেলে ছেলের বউ দুজনই মা’রা গিয়েছে। তবে তাদের নাকি একটা ছেলে আছে। শিমুল নাম মনে হয়। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। বাবা মা মা’রা যাওয়ার পর দাদা দিদুন এর সাথে ছিল। বড় হয়ওয়ার পরে একদিন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে বলে গেল আর ফিরে নি। দাদাভাই নাকি অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাকে এই বাড়িতে ফেরানোর তবে সে আসেনি।

মাশরিনা আর শাফিন যখন বিয়ে করেছিল তখন ওদের হাতে এত টাকা পয়সা ছিল না। বাসা থেকে পড়ার খরচ দিত। সেই খরচ দিয়েই বাসা ভাড়াও দিতে হবে। তাই এত ভালো বাসা নেয়া পসিবল হয়নি। এখানে আসার পর এই বাসাটা পেয়েছিল অল্প ভাড়ার মধ্যে। দাদা দিদুন ও দুটো মানুষ পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলেন। বুড়ো মানুষ দিন কা’টত না। তাও ওদের সাথে গল্প করার সুযোগ হতো।

মাশরিনা জানালার কাছে দাড়িয়ে ভাবছিল এমন সময় কেউ দরজায় কড়া নাড়ে। মাশরিনা ভাবে হয়ত শাফিন ওর ভুল বুজতে পেরে ফিরে এসেছে। ঠোটের কোনে এক চিলেতে হাসি ফুটে ওঠে। হাসি মুখে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। কিন্তু দরজা খুলতেই হাসি মুখটা ধপ করে নিভে যায়। শাফিন আসেনি। দরজার বাহিরে দাড়িয়ে আছে নিচতলার সেই দিদুন যার কথা এতক্ষণ ভাবছিল মাশরিনা।

– কি গো নাতনি মুখটা এমন শুকনা কেন?

– তেমন কিছু না দিদুন। তুমি উপরে আসলে যে কিছু লাগবে।

– না গো কিছু লাগব না। বেলা তো অনেক হলো এখনো নামতে দেখলাম না একজনরেও কলেজ যাইবা না নাকি। আমার নাতি কই ওরে তো কালও দেখলাম না।

– আসলে দিদুন ও একটু কাজের জন্য বাহিরে গেছে বাসায় আমি একাই। আর শরীরটা খারাপ লাগতেছে তাই যাব না আজকে।

– কি কও। কি হইছে তোমার। দেখি জ্বর টর বাধাইলা নাকি।

– না না জ্বর না। এমনি একটু খারাপ লাগতেছিল।

– দাড়াইয়া থাকোন লাগব না যাইয়া রেষ্ট নাও যাও। নাস্তা বানান লাগবো না আমি বানাইছি ওইটাই দিয়া যাবোনে।

– না না দিদুন তোমার কষ্ট করা লাগবে না।

– হোনো মাইয়ার কথা। আমি তোর আপন দিদুন হলে বুঝি ফিরাতে পারতি।

– এই না না এভাবে বলছ কেন। আচ্ছা ঠিক আছে আমিই নিচে গিয়ে খেয়ে আসব।

– আচ্ছা আসিস। আমি গেলাম নিচে।

– আচ্ছা।

দিনগুলো কে’টে যাচ্ছে। মাশরিনা নিজেকে ঘর বন্ধী করে ফেলেছে। ভার্সিটি যায় না। কারো সাথে যোগাযোগ নেই। সাবিহা( মাশরিনার সব থেকে কাছের বান্ধবী) এর মধ্যে শ দুয়েক ফোন দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কোন মতেই যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না মাশরিনার সাথে। সাবিহা শাফিনকেও ফোন দিয়েছে বহুবার। বাট তার ফোন ও নট রিচেবল দেখাচ্ছে। সাবিহার চিন্তা হয় অনেক। দুজনের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। কোন বিপদ হলো না তো। সাবিহার কাছে তো বাসার ঠিকানাও নেই। কি করবে ও কিছু বুজতে পারতেছে না। ফোন দিতে দিতে একবার ফোন তোলে মাশরিনা। মাশরিনা ফোন রিসিভ করায় ব্যাস্ত হয়ে সাবিহা। কোথা থেকে শুরু করবে কি বলবে এই মুহুর্তে যেন বাকহারা হয়ে গেছে। আর কিছু খুজে না পেয়ে বলল

– দোস্ত বাসার ঠিকানাটা দে।।বাসা থেকে রাগ করে চলে আসছি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেছি। তুই তো জানিস রাস্তায় থাকা একটা মেয়ের জন্য কতটা রিস্কি।

– কি বলিস কি। তুই বাসা ছেড়ে বের হইছিস কেন।

– আগে বাসার ঠিকানা দে। আইসা বলতেছি। আমি অনেক ক্লান্ত নয়ত রাস্তার মধ্যেই পড়ে থাকব।

মাশরিনা ভাবে সাবিহা হয়ত সত্যি সত্যি বিপদে পড়ছে। তাই বাসার ঠিকানাটা দেয়।

ত্রিশ মিনিট এর ভিতর সাবিহা বাসায় হাজির। মাশরিনা দরজা খুলতেই সাবিহার প্রথম নজর যায় মাশরিনার মুখের দিকে। চমকে যায় সাবিহা। এ কোন মাশরিনাকে দেখছে সে। চেহারায় কেমন কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। চোখের নিচ কালো হয়ে গেছে। চোখ গুলো মনে হচ্ছে লাল রঙ করা। দেখতে ভয়ঙ্কর কোন মানবী মনে হচ্ছে তাকে। সাবিহা তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে ডোর লক করে দেয়। মাশরিনাকে টেনে নিয়ে বেড এ বসায়।

– এই তুই কি ইহজগতে আছিস নাকি সন্নাসী হইছিস। এমন চেহার বানাইলি কেমনে বইন?

– কই কি হয়েছে। ভালোই তো আছি।

– কি ভালো আছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা নবাবপুত্তুর কোথায় রে সে কি দেখতে পায় নি তোর চেহারার এমন বেহাল দশা। নাকি এখন বউ হয়ে গেছিস বলে আর মায়া দয়া নেই।

– তুই বুজলি কীভাবে রে।

– কিহ। কি বুজলাম?

জ্বিভে কামড় দেয় মাশরিনা। এই মেয়ের সামনে যেন কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারে না।

– চুপ করে আছিস কেন। ভাইয়া কোথায়। আর কি হয়েছে তোর। তোকে দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে না। ডক্টর দেখাস নি। এই জন্য ভার্সিটি যাস না। আমাকে একটা বার ঔোন করলি না কেন।

– থাম ভাই। এত প্রশ্ন একবারে করলে উত্তর কীভাবে দিব।

– দেখ মাশরি খুলে বল সব।

– আমার কথা বাদ দে। তোর কথা বল। বাসা থেকে আসলি কেন।

– আমি কোন রাগ করে আসিনি। এমনি বললে তো বাসার ঠিকানা দিতি না। তাই এই কথা বলেছি। এখন বল ওই শাফিন কি করছে তোর সাথে। আর কই ও।

– ও এখানে থাকে না।

– মানে?

– হু। ও আর আমাকে চায় না আমার বেবিকেও না।

– হোয়াট। কি বলছিস তুই। বেবি মানে?

– ঠিকই বলছি। আমি প্রেগন্যান্ট। এক হতভাগী মা আমি। যার সন্তান পৃথিবী দেখার আগেই তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

– মাথা ঠিক আছে তোর মাশরি। এখন কি হবে। কি করবি তুই। এই বেবি কি করবি।

– কি করব মানে। এই বেবি দুনিয়ায় আসবে। আমার পরিচয়েই নাহয় বড় করব ওকে।

– কি হয়েছে সব খুলে বল।

🌸🌸🌸🌸

মাশরিনা শুরু থেকে সব খুলে বলল। সাবিহা সব শুনে তো রেগে গেছে। শাফিন ভাই এত খারাপ মানুষ। ওনাকে দেখে তো বোঝাই যায় না। দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। এজন্যই বলে মানুষের বাহির দেখে কাউকে বিচার করা উচিত নয়।

– মাশরিনা তুই কি ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবি।

– কি করব আমি। আমি কিছু করতে পারব না।

– তুই এত আবুল কেন। আচ্ছা দেখি চল কি করা যায়।

– তুই আবার কি করবি।

– শাফিন এর বাবার কাছে যাব।

– আমি এই অবস্থায় যাব না।

– এত কথা না বলে সুন্দর ভাবে শাওয়ার নিয়ে আয়। আর যদি কথা না শুনিস তো তাহলে আমার সাথেও আর জীবনে কথা বলবি না।

কি আর করার সাবিহার কথায় বাধ্য হয়ে তৈরি হয় মাশরিনা। শাফিন এর কাছ থেকেই একবার ওদের বাসার ঠিকানা জেনেছিল মাশরিনা। দুজন রওয়ানা দেয় শাফিনদের বাসার উদ্দেশ্য।

ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে পৌছে যায় সেখানে। গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে আস্তে আস্তে শাফিনদের বাসার গেট এর সামনে আসে। ভিতরে ঢুকতে বাধ সাধে দারোয়ান। সে কোন মতেই ভিতরে প্রবেশ করতে দিবে না। এমন সময় উপর থেকে দারোয়ানকে ডাক দেয় একজন লোক। বয়স পঞ্চাশোর্ধ হবে। দারোয়ানকে বলে ওদের ভিতরে যেতে দিতে। সাবিহা মাশরিনা দুজনই অবাক হয়। লোকটা তো ওদের চিনেনা তাহলে যেতে বলল কেন। এতকিছু ভাবতে ভাবতেই দোতলায় এসে দাড়ায় ওরা। এর মধ্যে সেই ব্যাক্তি দরজা খুলে সামনে দাড়ায়। মুখে রহস্য জনক হাসি ঝুলানো। তিনি বলে ওঠেন

– তুমি মাশরিনা রাইট।

এটা বলে উপর নিচ মাথা নাড়ায় ভদ্রলোক। তারপর কন্ঠ একটু গম্ভীর করে বলে

– একটু বেশি দেরী করে ফেললে না মেয়ে। আমি তো সেই কবে থেকে বসে আছি তুমি আসবে সেই অপেক্ষায়।

সাবিহা মাশরিনা দুজনই লোকটার মুখের দিকে তাকায়। কি বলতে চাচ্ছে তিনি।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে