নীড়ের খোজে পর্ব-০১

0
1014

#সূচনা_পর্ব
#নীড়ের_খোজে
#নীহারিকা_নুর

প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছে মাশরিনা। চোখ খুলে দেখার সাহস নেই। মাশরিনার সব লক্ষন গুলোই দেখা যাচ্ছে যেগুলো দেখা দিলে প্রেগ্ন্যাসির রেজাল্ট পজিটিভ আসে। যদি রেজাল্ট পজিটিভ আসে তাহলে কি করবে মাশরিনা। একজন মা হতে পারবে এই খবরটা একটা মেয়ের জন্য অনেক খুশির একটা খবর হলেও এই মুহুর্তে ভয় হচ্ছে মাশরিনার। সমাজের চোখে সে একজন অবিবাহিত মেয়ে। আর একজন অবিবাহিত মেয়ে মা হবে বিষয়টা সমাজ কতটা কটু চোখে দেখবে সে সম্পর্কে ধারণা আছে মাশরিনার।

মিনিট দুয়েক চুপ করে থাকার পরে চোখ খুলল মাশরিনা। রিপোর্ট এ চোখ বুলাল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। এটা দেখে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করা একটা মেয়ের জীবনে কতটা সুখ বয়ে আনে তা কেবল একটা মেয়েই অনুভব করতে পারে। মা হওয়ার অনুভুতি, সমাজের কটু কথার ভয়, শাফিন বিষয়টা কীভাবে নিবে সেই চিন্তা সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভুতি হচ্ছে মাশরিনার মনে।

– কংগ্রাচুলেশনস মিসেস সিনহা।

ডক্টর এর কথায় হুশ আসে মাশরিনার। এতক্ষণ যে সে ডক্টর এর চেম্বারে বসা ছিল বিষয়টা যেন মাথা থেকে কয়েক মুহুর্তের জন্য বেরিয়েই গিয়েছিল। ডক্টর এতক্ষণ চুপচাপ মাশরিনার রিয়াকশন দেখছিলেন।

মাশরিনা মাথা তুলে ডক্টরকে আস্তে করে ধন্যবাদ জানায়। ডক্টর জানতে চায়

– আপনি কি খুশি নন মিসেস সিনহা?

এই মুহুর্তে ডক্টরকে কি জবাব দিবে মাশরিনা। তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বলল জ্বি। খুশি কেন হব না। লাইফে যত গুড নিউজ পেয়েছি আজ তার মধ্যে বেস্ট নিউজ ছিল।

মাশরিনার উত্তরে ডক্টর ও মুচকি হাসি দেয়। তারপর জানতে চায় আপনার হাজবেন্ড কোথায়? উনি আসলেন না যে।

– ম্যাম উনি একটু ব্যাস্ত। তাই আসতে পারে নি।

– ওহ আচ্ছা। আচ্ছা শুনুন নিজের শরীর এর যত্ন নিতে হবে। এই সময় নিজের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। সাবধানে থাকবেন। ভারী কাজ তেমন করবেন না। খাবারে অনিয়ম করা যাবে না নাহলে কিন্তু বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগবে।

– জ্বি ম্যাম। আজ তাহলে উঠি।

– ওকে।

ডক্টর এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে মাশরিনা। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যায় রাস্তার সামনে। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে তাতে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে এখনি রিক্সা থেকে পড়ে যাবে। শক্ত করে ধরে বসে আছে যেন পড়ে না যায়। বিশ মিনিট এর রাস্তা আসতে এক ঘন্টা লেগে গেছে জ্যামের জন্য। বাসার সামনে এসে রিকশা ভাড়া চুকিয়ে এলোমেলো পা ফেলে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে মাশরিনা।

বাসার একটা চাবি ওর কাছে থাকে একটা শাফিন এর কাছে। ওর কাছে থাকা এক্সর্টা চাবি দিয়ে লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। রুমের ভিতরে পা রাখতেই কারো উচ্চস্বরে হাসির শব্দ কানে আসে। হাসিটা যে আর কারো নয় শাফিন এর এটা শিওর। তবে হঠাৎ এত হাসির কি হল সেটাই বুজতে পারল না মাশরিনা। ব্যাগটা রেখে হাসির শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে অগ্রসর হয়। এসে দেখতে পায় শাফিন ফোনে কথা বলতেছে আর হাসতেছে। মাশরিনাকে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে ফোন কে’টে দেয়। অবাক হয় মাশরিনা।

– কি ব্যাপার কার সাথে এত হাসি ঠাট্টা করছিলে যে আমাকে দেখেই ফোন কে’টে দিলে।

– তেমন কিছু না মাশরিনা। তুমি ইদানিং একটু বেশিই সন্দেহ প্রবন হয়ে যাচ্ছ। ওই যে আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড দিয়া ফোন করেছিল।

– ওহ তার সাথে বুজি আমার সামনে কথা বলা যায় না।

– আহ মাশরিনা কথা বাড়িও না তো ভালো লাগছে না।

মাশরিনা সত্যিই আর কথা বাড়ায় না। চলে যেতে নেয়। কিন্তু শাড়ীর আচলে পা বেজে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে না। নিজেকে নিজে সামলে নেয়। শাফিন সেটা দেখেও ধরার প্রয়োজন মনে করল না। দূরে দাড়িয়ে শুধু বলল কীভাবে চলাফেরা করো যে পড়ে যাও। ঠিক ভাবে হাটতে পার না নাকি। শাফিন এর কথায় বুকটা কেমন খা খা করে ওঠে। আগের দিনগুলোতে মাশরিনার সামান্য কষ্টে শাফিন যেন পা’গল হয়ে যেত। দিন যত যাচ্ছে শাফিন কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে চলে যায় মাশরিনা। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেন্জ করে নেয়। সকালেই রান্না করে রেখে গিয়েছিল। সেই খাবার দুটো প্লেটে তুলে নেয়। দুজনের ছোট্ট সংসার। এখানে ডায়নিং নেই। আসবাব পত্র বলতে কিছুই নেই। শুধু একটা খাট। আর দুজনের পড়ার জন্য দুটো টেবিল। আর জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখার জন্য একটা আলমারি। খাবার নিয়ে নিচে একটা মাদুর পেতে বসল মাশরিনা। সেখানে বসেই শাফিনকে ডাকল খেতে। মাশরিনার ডাক শুনে শাফিন ও এসে বসল পাশে। খাওয়ার সময়ই কথাটা তুলল মাশরিনা।

– শাফিন তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।

– হ্যা বলো।

– বিষয়টা সিরিয়াস। মাথা ঠান্ডা করে শুনবা।

– আচ্ছা মাথা ঠান্ডা করলাম। এবার তো বলো।

– শাফিন আমি মা হতে চলেছি।

– হোয়াটটট। কি বলছ কি তুমি

– আমি সত্যিই বলছি শাফিন আমি প্রেগন্যান্ট।

– তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।

– তাড়াতাড়ি খাব কেন?

– খেয়ে রুমে আস।

শাফিন খাবার ছেড়ে উঠে গেল। শাফিন এর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাশরিনা। কোন ছেলেকে যদি তার বাবা হওয়ার খবর দেয়া হয় তখন সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু শাফিন এর অভিব্যাক্তি দেখে মনে হল সে মোটেও খুশি হতে পারে নি। শাফিন চলে যাওয়ার পরে আর এক লোকমা ভাত ও গলা দিয়ে নামল না। ভাতের প্লেট ঠেলে রাখল সামনে। হাত ধুয়ে উঠে গেল সেখান থেকে। প্লেটগুলো গুছিয়ে রেখে হাত মুছতে মুছতে রুমের দিকে গেল। শাফিন আকাশের দিকে তাকিয়ে এক ধ্যানে বসেছিল। মাশরিনা গলা খাকরি দিতেই শাফিন ঘুরে মাশরিনার দিকে তাকায়।

– তখন এভাবে চলে এলে কেন শাফিন?

-……..

– তুমি কি খুশি নও শাফিন।

– তুমি কি খুশি হওয়ার মতো কোন নিউজ দিয়েছ?

– বাবা হতে পারা যে কতটা আনন্দের সেটা কি তুমি একটুও অনুভব করতে পারছ না শাফিন।

– না পারছি না। কারণ এই বাচ্চা দুনিয়ায় আসলে তুমি তাকে কি পরিচয়ে বড় করবে। তুমি জানো ওকে সমাজের মানুষ কি বলবে?

– কি?

– সমজে অবৈধ সন্তানের তকমা পাবে সে। সেই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সারাজীবন চলতে হবে।

– চুপপপ করো প্লিজ শাফিন। এসব কথা আর মুখে এনোনা।

– এটুকু শুনতেই সহ্য হচ্ছে না। সমাজের মানুষ যখন এর থেকেও জঘন্য কথা শুনাবে তখন কীভাবে সহ্য করবে বলো।

– শাফিন ও তো অবৈধ নয়। আমাদের তো বিয়ে হয়েছে তাহলে এ বাচ্চা অবৈধ কীভাবে হয়। এটা তো আমাদের ভালোবাসার অংশ তাই না।

– মাশরিনা তেমার আমার বিয়ে হয়েছে এটা তুমি আমি আর দুজন সাক্ষী ছাড়া কেউ জানে না। আমার বাবা তোমার মতো মেয়েকে কোন দিনও বাড়ির পুত্রবধু হিসেবে মেনে নিবে না। যেখানে কোনদিনও তুৃমি সামাজিকভাবে আমার স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না সেখানে এই সন্তান কল্পনা করাও অনর্থক।

শাফিন এর কথা শুনে অবাক এর চরম পর্যায়ে। মাশরিনা জানত যে শাফিন এত তাড়াতাড়ি এই সন্তানকে মানতে চাইবে না। কিন্তু ও যে এমন একটা কথা বলবে সেটা কল্পনারও বাহিরে ছিল। কান্নাগুলো গলার ভিতরে দলা পাকিয়ে আসছে। তারপরও কান্না চেপে রেখে শাফিনের কাছে জানতে চাইল

– তুমি তো জানতে তোমার বাবা আমাকে মানবে না তাই না?

– হুম

– তাহলে আমাকে কেন বাধ্য করেছিলে তোমার সাথে সংসার বাধতে, কেন ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলে। আর একবার যখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাহলে এখন কেন এসব বলছ?

– মাশরিনা ভার্সিটির ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের দিনের কথা তেমার মনে আছে। তুমি একটা জামদানী শাড়ী পড়ে ভার্সিটি গিয়েছিলে। চোখে টেনে কাজল দেয়া। ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। খোপায় গাজরা। ওইদিনই তোমার উপর আমার চোখ পড়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল পুরো ভার্সিটির মধ্যে এরকম সুন্দরী মেয়ে আমি দেখিনি। মনে হচ্ছিল পরি ভুল করে পরিস্থান থেকে আমাদের ভার্সিটিতে এসেছে। যে জিনিস আমার পছন্দ সেগুলো আমি নিজের করে ছাড়ি। তাই তোমাকেও বাধ্য করেছিলাম।

– তাহলে এখন কেন এই কথা বলছ।

– দেখ কোন জিনিস বেশিদিন ভালো লাগে না তাই তোমাকেও লাগছে না। আমার কথা পেচাতে ভাল লাগে না। যতটাকা লাগে নিয়ে যাও আর এবোরশন করিয়ে ফেল। এই সন্তান এর দুনিয়া দেখার অধিকার নেই।

শাফিন এর কথা শুনে কেমন যেন মাথা চক্কর দিচ্ছে। কি বলছে এসব শাফিন। একটা নিষ্পাপ প্রানকে এভাবে শেষ করার কথা বলতে পারল ও যে কিনা নিজের একটা অংশ।

– যা বলছি তাই কর। আমি এ সন্তান এর বাবা হতে পারব না। এখন তুমিই ঠিক করো কি করবে। এবোরশন করবে নাকি নষ্টা মেয়ের কলঙ্ক নিয়ে এই বাচ্চা দুনিয়ায় আনবে।

মাশরিনার হাত দুটো আপনা আপনি পেটের উপর চলে যায়। এই ছোট্ট পেটে লুকিয়ে আছে ছোট্ট একটা প্রান। হয়ত এখনো একটা ভ্রুন তবে একটা প্রান তো। এতো ধীরে ধীরে বড় হবে। কীভাবে নিজের হাতে নিজের সন্তান মে’রে ফেলবে সে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে