নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব-২৬

0
753

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_২৬
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

তখন রাত। সারাদিনের ক্লান্তিতে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে সেতু।মুখের উপর কোন কিছুর উষ্ণ স্পর্শ বুঝে উঠেও চোখ খুলতে সক্ষম হলো না।সেতু সেভাবেই চোখ বন্ধ করে রইল।নিষাদ হেসে আবারও পুরু ঠোঁটজোড়া ছোঁয়ালো সেতুর কপালে।ঠোঁট গোল করে ফু দিয়ে উড়াল কপালের উপর পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলোকে।সেতু কোনভাবে চোখ মেলে ঘুমঘুম নজরে এবার তাকাল। মুহুর্তেই ঘরের ম্লান আলোয় চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে দেখতে পেল।আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কিছু বলল না সে।উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুঁয়ে ঘুমুঘুমু চোখ জোড়া আবারও বুঝে নিল।মুহুর্তেই উষ্ণ হাতের স্পর্শ টের পেল পেটের চামড়ায়।পেছনের মানুষটা একহাত দিয়ে পেট আঁকড়ে ধরে দূরত্ব কমাল।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

” মাঝেমাঝে তোমাকে আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয় সেতু।আবার কোন কোন সময় কোন এক কাল্পনিক চরিত্র ও বোধ হয়।আসলেই কি তুমি আমার জীবনে আছো?আসলেই আমি তোমায় পেয়েছি?আমার মাঝেমাঝে বিশ্বাস করতে মন চায় না।”

সেতু চোখ বুঝেই কথাগুলো শুনল।নিঃশব্দে ঠোঁট চওড়া করে হাসল।নিষাদ সে হাসি দেখল না।সেতুর নিশ্চুপ হয়ে থাকা ভাবল এখনও সেতু ঘুমে বেঘোর।নরম গলায় ফের বলল,

” মনে হয় এই কিছুদিন আগেও আমি তুমিহীনা ছিলাম।তোমাকে পাওয়ার আশায় ছটফট করতাম।তোমার বেদনায় দুঃখ পুষতাম।তারপর একটা সময় পর আমি আকস্মিকভাবে তোমাকে পাওয়ার পন্থা পেয়ে বসলাম। একরাশ অভিমান আর ক্ষোভ নিয়েই তোমাকে পাওয়ার নেশায় উম্মাদ হলাম আমি।আরও একবার হাত বড়ালাম তোমার দিকে।অদ্ভুতভাবে আমি নিশ্চিতভাবে তোমাকে পেয়ে বসলাম সেবার।মনে মনে তখন আমি কি ভীষণ সুখ উপলব্ধি করেছিলাম।কিভাবে যেন এতগুলো দিন কেঁটে গেল। তুমি সহ মুহুর্তগুলো কত দ্রুত কেঁটে গিয়েছে সেতু।আমাদের একসাথে পথচলা,একসাথে জীবন কাঁটানোর কতগুলো দিন পেরিয়েছে।কতগুলো বছর পেরিয়েছে।তবুও আমার মনে হয়, এইতো সেদিনই আমাদের প্রণয়ের সূচনা ঘটল।আমাদের ভালোবাসার মুহুর্তের শুরু হলো।তাই না? এত কেন অনভূতি তোমাতে?”

সেতু আবারও নিঃশব্দে হাসল।চোখজোড়া ছোট ছোট করে মেলে হালকা নড়চড় করল।হাতটা নিষাদের হাতের উপর রেখে চেপে ধরল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৃৃদু আওয়াজে বলল,

” চুপ হয়ে গেলেন কেন নিষাদ?”

নিষাদ ভ্রু কুঁচকে বলল,

” তুমি জেগে আছো?চুপচাপ এসব শুনছিলে সেতু?”

সেতু নিষাদের হাতটা আরো আঁকড়ে ধরল।ঘুমঘুম কন্ঠ ছেড়ে এবার সজাগ গলায় বলল,

” শুনতে ভালো লাগছিল।আপনার কথা মতো, না শুনলে খুশি হতেন?নাকি শুনে অন্যায় করে ফেললাম আমি?”

নিষাদ ঠোঁট চওড়া করে হাসল।বলল,

” যদি বলি অন্যায় করেছো তাহলে কি করবে?”

” অন্যায়?অন্যায়ের কি করলাম? ”

“ঘুমানোর অভিনয় করে সব কথা শুনে নিলে আমার।এটা অন্যায় নয় বলছো ?”

সেতু এবার নিষাদের দিকে ঘুরল।নিষাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এটা মোটেই ঘুমানোর অভিনয় না নিষাদ।ঘুমানোর জন্য না দিলে না একটা মানুষ ঘুমোবে কি করে?আর জেগে থাকা অবস্থায় কেউ কিছু কানের সামনে বললে শুনতে পারব না? ”

নিষাদ কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে উত্তর দিল,

” না, শুনতে পারবে না।”

সেতু নিষাদের মিথ্যে গম্ভীরতাকে বিশেষ মূল্য দিল না।মৃদু হেসে বলল,

” শুনে তো নিলামই।”

নিষাদ এবার হেসে ফেলল।দাঁত কেলিয়ে বলল,

” শুনে যখন নিয়েছো খুশি হয়ে ভালোবাসা উপহার দাও।এক আকাশ ভালোবাসা।আমি সেই ভালোবাসার গহীনে হারিয়ে যাই। ”

সেতু নরম গলায় শুধাল,

” ভালোবাসা? ভালোবাসা এতদিনেও পেয়ে উঠেননি? কখনো মুখে ভালোবাসি বলিনি বলেই এমন ধারণা নিষাদ?”

“উহ সেতু, আমি কখন বললাম তুমি এতগুলো দিনেও ভালোবাসা দাওনি?”

সেতু কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে শুধাল,

“আপনার আর আমার সময় গুলো খুব দ্রুত কেঁটে গেলেও আমার কাছে মুহুর্তগুলো সুখময়।আপনি, আপনি ময় সবগুলো মুহুর্তই আমার কাছে অনুভূতিময়।আমি চাইলেও সেসব মুহুর্ত গুলো ভুলতে পারব না। যতবারই মনে করি ততবারই ঠিক সে একই সুখ, একই অনুভূতি। আপনি মানুষটাই আস্ত একটা সুখ নিষাদ।”

নিষাদ হাসল। সেতুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

” আমার কাছে তুমি হলে এক সমুদ্র প্রশান্তি,এক আকাশ সুখ,এক মুঠো ভালোবাসা।আমার কাছে তুমি মানে একটা সাদামাটা অনুভূতি।আমার কাছে তুমি মানে শুধুই সেতু নামের মেয়েটা।অন্যদের মতো প্রিয়, প্রেয়সী, জান,পাখি ইত্যাদি ইত্যাদি আদুরে নামে আমি তোমায় ডাকতে পারি না ঠিক।তবুও আমি তোমায় ভালোবাসি। কারণ তুমি আমার কাছে শুধুই সেতু।তোমাকে ভালোবাসতে আমার অন্য কোন সম্বোধনের প্রয়োজন অনুভব হয়নি।আমি এই সেতুকেই সাত জনম ভালোবাসতে রাজি।আর এভাবেই ভালোবাসব।বয়সের ভারে নুঁয়ে গেলেও এই সেতু নামের নারীতেই আমি এক সমুদ্র অনুভূতি দান করব।”

সেতু বিনিময়ে কিছু বলল না।নিশ্চুপ থেকে হাসল শুধু।নিষাদ ঝুঁকে মুখ গুঁজল সেতুর গলায়।পুরু ঠোঁটজোড়ার উষ্ণ স্পর্শ মুহুর্তেই খিচে ধরল সেতুর গলার তিল।সেতু চোখ বুঝল মুহুর্তেই।উষ্ণ শ্বাস, উষ্ণ স্পর্শে মুহুর্তেই ভেতরে তৈরি হলো ভয়ংকর উম্মাদনা!

.

নীরু বেঁছে বেঁছে ডায়েরী থেকে দিয়ার ছবিটা বের করল।পাশাপাশি রঙ্গনের একটা ছবিও রাখল।কি সুন্দর মানাচ্ছে দুইজনকর।ইশশ!কি সুন্দর জুটি।দুটো ছবি একসাথে রেখেই মাঝখানে লাভ শেডের একটা কাগজের টুকরো রাখল।ছোট্ট শ্বাস ফেলে হাসল।তারপর বেশ আয়েশ করে মোবাইলে তুলল দিয়ার নাম্বার। এর আগেও সে বেশ কয়েকবার কথা বলেছে দিয়ার সাথে।দিয়া যে এখনও রঙ্গনকে ভালোবাসে তা স্পষ্ট।তবুও দুইজনের মাঝে দূরত্ব।নীরুর পছন্দ হলো না সেই দুরত্ব।অবশেষে দিয়াকে রাজিও করাতে পারল।সেই নিয়েই কথা বলার জন্য আবারও কল দিল।দিয়াও কল তুলল।নীরু হেসে বলল,

” কেমন আছো দিয়া দি?”

দিয়া ওপাশ থেকে বলল,

” এইতো ভালো আছি, তুমি?”

” ফার্স্টক্লাস আছি।তুমি বলো, নীরের জম্মদিনে আসছো তো?আমার কিন্তু অনেকদিনের প্ল্যান।তুমি না আসলে কিন্তু পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।”

দিয়া হেসে বলল,

” তাই?তাহলে তো আসতেই হবে।”

” হ্যাঁ, অবশ্যই আসবে।আমি তোমাদের জন্য কতকিছু প্ল্যান করে রেখেছি। সে যায় হোক,ট্রিট দিয়ে দিও অবশ্যই।”

” ছোটবোন হিসেবে বলছো।দিব না?”

নীরু চঞ্চল গলায় বলল,,

” হ্যাঁ, তাই তো। দিবে না কেন?অবশ্যই দিবে।”

” হ্যাঁ।”

নীরু আবারও উচ্ছাস নিয়ে বলল,

” আচ্ছা কি রংয়ের শাড়ি পরবে তুমি?শোনো, একটা সুন্দর শাড়ি পরবে, সুন্দর করে সাঁজবে।যাতে তোমার থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ে। হুহ?”

” কেন?আমি বুঝি সুন্দর নই?”

নীরু হেসে উত্তর দিল,

” উহ!একটু বেশিই সুন্দরী তুমি দিয়া দি।এবার বলো কি রংয়ের শাড়ি পরছো?”

” আরেহ মেয়ে,তুমি অনেকটাই বাচ্চা নীরু।বার্থডের অনুষ্ঠানের এখনোও কয়েকদিন বাকি আছে না?এখন থেকেই শাড়ি সিলেক্ট করে রাখব?”

নীরু বোকার মতো হাসল।আরো কিয়ৎক্ষন কথা চালিয়ে গেল দিয়ার সাথে।তারপর চোখ বুঝে ঘুম দিল।মনে মনে কষ্ট হলেও হৃদয়ে আলাদা তৃপ্তি।ভালোবাসার মানুষকে তার সর্বশ্রেষ্ঠ সুখটা উপহার দিবে।তৃপ্তি হবে না?

.

রঙ্গন তখন মিটিংয়ে ব্যস্ত।মোবাইলে দিয়ার নাম্বার থেকে কল আসা দেখেই মুখ টান টান হলো। চোয়াল শক্ত হয়ে আসল।কল না তুলে ঠিক আগের মতোই মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখে দিল।তারপর মিটিং শেষ হতেই রাগে টনটন করা মাথাটা নিয়ে কল লাগাল নীরুর কাছে।নীরু কল তুলল মুহুর্তেই।ওপাশ থেকে ব্যস্ততার সুরে বলে উঠল,

” উহ গাধা, আমি রান্না করছি এখন।কি রান্না করছি জানো?ইলিশ মাছ।তুমি বরং পরে কল দিও।”

রঙ্গনের রাগ দ্বিগুণ বাড়ল।কপালের রগ হালকা ফুলে উঠল।চোখের দৃষ্টি হলো কঠিন।দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

” তুই একটু বেশিই করে ফেলছিস না নীরু?আমার ভাল্লাগছে না এসব। তোকে কি আমি দায়িত্ব দিয়েছি আমার আর দিয়ার সম্পর্ক জোড়া লাগানোর?দিয়াকে আমার নাম্বার দেওয়া, কল করতে বলা।কি শুরু করে দিয়েছিস এসব?”

নীরু অবাক হয়ে বলল,

” কি শুরু করেছি? আশ্চর্য!তোমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসো, অথচ দূরে দূরে থাকছো। আমি সবটা জেনে একসাথে করব না তোমাদের?”

রঙ্গন ফের রাগ দেখিয়ো বলল,

” তুই সবটা জানিস না নীরু।আমায় রাগাবি না এসব করে।বিরক্ত লাগছে। ”

“জানি, সবটাই জানি।”

” তোর অনেককিছুই জানা নেই।মূলত তুই জানতে চাস না কিংবা জানার সাহস নেই। অনেকবার বলেছি, তোকে কিছু জানাতে চাই,দেখা কর।করিসনি । তাই আর উল্টোপাল্টা জেনে এসবে নাক গলাবি না।”

কথাগুলো বলেই মুখের উপর কল কাঁটল রঙ্গন।অপরপাশে নীরু হা হয়ে তাকিয়ে থাকল।কি এমন করে ফেলেছে সে?আশ্চর্য!

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে