#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_২৫
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ
দিন কাঁটল, মাস কাঁটল, বছর কাঁটল!সময়গুলো কত তাড়াতাড়িই কেঁটে গেল।সেই ছোট নীর কয়েকদিন পর পাঁচ বছরে পদার্পণ করবে।হাতে পায়ে বেশ বেড়েছে ও।ছোট নিলু ও আর ছোট নেই।এখন তার দশ বছর।লম্বা হয়েছে আগের থেকে বেশ।চঞ্চল নীরুর ও পরিবর্তন ঘটেছে।ঘাড় অব্দি চুলগুলো আজ কোমড় অব্দি লম্বা।এই এত এত পরিবর্তনের মধ্যেও যা পরিবর্তন হয়নি তা হলো তাদের চঞ্চলতা, খুনশুটি, ঝগড়া!সেতু আনমনেই বসার ঘরে তাদের তিনজনকে দেখে আগের দিনগুলো ভাবল।পা চালিয়ে তাদের সামনে আসল।তিনজনের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনজনই চুপচাপ।অবাক হয়েই বলল,
” কি হচ্ছে এখানে?তোমাদের ঝগড়া টগড়া বাদ আজ?”
সেতুর কথায় তিনজনই তাকাল চোখ তুলে।নীর ঠোঁট উল্টে বলল,
” নিলু নীলু মামনি চুল টেনেছে তাই নীলু মামনি লাগ কলে চুপ কলে আছে।আর নিলু ভয়ে চুপ হয়ে আছে।”
সেতু সরু চোখে বলল,
” কে কার চুল টেনেছে?বুঝলাম না।”
নিলু তৎক্ষনাৎ ঠোঁট চেপে বলল,
” আমি কারো চুল টানিনি মামি। সত্যিই!নীর শুধু শুধুই এই নীরুর পক্ষই নেয় সবসময়।”
সেতু হাসল।বলল,
” জানি আমি মা, তুমি শুধু শুধু কারো চুল টানবে না।”
নীর আবারও নিলুর উদ্দেশ্যে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
” তুমি না মাত্র মামনিল চুল টেনে দিলে?”
নিলু ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
” তো তোর জন্যই তো চুল টানলাম।তোকে আর আমাকে ঘুরতে নিয়ে গেলে তোর লাভ নেই?যার জন্য চুরি করে সেই বলে চোর।”
নিলুর কথা শুনে সেতু আর নীরু হাসল সমস্বরে।নীর চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” আমি কি বলেছি তোমায় নীলু মামনিল চুল টানতে?”
নিলু এবার আর কিছু বলল না।বুকে হাত গুঁজে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চাইল।নীরু চোখ সরু করে সেদিকে একবার তাকিয়ে নীরের দিকে তাকাল।হতাশ হয়ে বলল,
” আবার নীলু!নীরু,নীরু মামনি বলে শোনাও নীর সোনা।”
নীর গোল গোল চোখ করে তাকাল।ঠোঁট উল্টে বলল,
” ন্ নীলু মামনি।”
” না, নীরু।বলো নী্ রু, নীরু। ”
” নীলু!”
নীরু কপাল চাপড়ে হতাশ গলায় বলল,
” থাক বলতে হবে না বাপ।তুই খালি মামনিই ডাক!”
নীর মুখ ফুলাল।হাত বুকে ভাজ করে অন্য দিকে তাকিয়েই ফোঁস করে শ্বাস ফেলল।নীরু এবার হাসল।এগিয়ে বলল,
” আচ্ছা ঠিকাছে, নীলু মামনিই ঠিকাছে।”
নীর এক নজর তাকাল।মুখ ফুলিয়ে সূক্ষ্ম জেদটা চোখে-মুখে ফুঁটিয়েই বলল,
” আচ্ছা।”
নীরু হাসল আবার।উঠে হেলেদুলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই বাকি দুইজনও মুহুর্তেই উঠে দাঁড়াল।পিছু পিছু ছোট ছোট পা চালিয়ে দিল দৌড়।ফলস্বরূপ নীরুর আগেই নিলু আর নীরই তার ঘরে পৌঁছাল।
.
পরপর দুইবার দরজার আওয়াজ হলো।সেতু পা বাড়িয়ে দরজা খুলল।মুহুর্তেই চোখে পড়ল ক্লান্ত নিষাদকে।ঘামে বুকের কাছে শার্টটা ভেজা প্রায়।ঝাকড়ানো চুল গুলো পেঁছনে ঠেলেই ঝুঁকে গিয়ে জুতা খুলল নিষাদ। তারপর মোজা সমেত পা বাড়িয়ে ঘরে ডুকল।সোফায় আরাম করে বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতেই সেতুর দিকে তাকাল। গোলাপি রাঙ্গা সুঁতি শাড়ি পরিহিত রমণীকে একনজর দেখে নিয়েই ঠোঁট চওড়া করে হাসল।মৃদু আওয়াজে বলল,
” তোমায় এত সুন্দর লাগছে কেন?”
সেতু দৃষ্টি সরু করল। কিছু না বলে আবারও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।নিষাদ হালকা হাসল সেদিক পানে চেয়ে।মোজা খুলে উঠে গিয়ে রুমে ডুকল।দুইবার এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে বিছানার উপর রাখল৷ মুহুর্তেই চোখের সামনে একটা চিকন হাত এগিয়ে দিল তোয়ালে।নিষাদ হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা নিয়েই সেতুর দিকে তাকাল।আর পাঁচটা বউয়ের মতো সেতুর চোখমুখে ক্লান্ত বরের জন্য কোন প্রেমপ্রেম ভাব নেই।স্পষ্ট চাহনি।নিষাদ হতাশ হয়ে বলল,
” না বলতেই সবকিছু হাজির করো কেন?আমি তোমায় ডাকব। তারপর তুমি আসবে আস্তেধীরে।তোয়ালেটা আমার হাতে তুলে বলবে, ওগো যাও স্নানটা সেরে নাও।তা নয়, রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে যেভাবে তোয়ালে দিচ্ছো মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে মায়া, দয়া, প্রেম-ট্রেম কিচ্ছু নেই।”
সেতু ক্ষীন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
” আপনার মধ্যে তো তো মায়া-দয়া, প্রেম-ট্রেম সবকিছুর সাগর আছে।তাহলে? অন্যের প্রেম ট্রেম দিয়ে আপনার কি? বুঝে উঠলাম না।”
নিষাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল তৎক্ষনাৎ,
” ছিঃ ছিঃ সেতু।অন্য কারোর প্রেম ট্রেম দিয়ে আমি কি করব?কখনো দেখেছো অন্য কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাতে? তুমি বিনা কারণে, বিনা দোষে এমন একটা কথা বলতে পারলে আমায়?কষ্ট পেয়েছি।”
সেতু মিনমিনে চোখে তাকিয়ে বলল,
” কি এমন বলে ফেললাম যে কষ্ট পেলেন?”
নিষাদ বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে শুধাল,
” এই মাত্রই তো বললে।কষ্ট পাব না এমন কথায়?”
” কি বলেছি আমি?”
নিষাদ নরম গলায় বলল,
” এই যে বললে অন্যের প্রেমট্রেম দিয়ে কি করব?অন্যের প্রেম আমি চাইলাম কখন?”
সেতু নিঃশব্দে হাসল নিষাদের অভিমান দেখে।স্পষ্ট গলায় বলল,
” একটু আগে আপনিই তো বললেন আমার মধ্যে মায়া- দয়া, প্রেম কিছুই নেই।”
” তো বউয়ের প্রেম চাইতে পারব না?কি অসহায় যুবক আমি।স্যরি, অসহায় স্বামী।যে কিনা বউয়ের প্রেমও চাইতে পারবে না।”
সেতু কথা বাড়াল না।বলল,
“গিয়ে স্নান সেরে আসুন।চা করে আনছি আমি।”
নিষাদ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।বলল,
” না বলতেই চা আনবে কেন?আমি বলবো তারপর তুমি বলবে, ওগো চা করে আনছি,তুমি একটু বসো।”
“এসব ওগো, হ্যাঁ গো তেই কি সব ভালোবাসা আর প্রেম প্রকাশ পায়?তাহলে তো ভালো না বেসে সারাক্ষন ওগো, হ্যাঁ গো করলেই দুনিয়ায় সব যুবক যুবতীর জোড়া বেঁধে যেত৷ ”
নিষাদ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
” তুমি রেগে যাচ্ছো সেতু?তোমাকে কখনো রেগে মুখ চোখ লাল করে থাকতে দেখিনি।প্লিজ রেগে যাও।আমার খুব শখ তোমার রাগ ভাঙ্গানোর।”
সেতু হতাশার চরম পর্যায়ে পৌঁছাল।সামনের লোকটার সাথে কথা না বলে দ্রুত সেই স্থান ছেড়ে বাইরে গেল।নিষাদ বোকা বোকা চাহনীতে তাকিয়ে রইল সেদিন পানে।কি এমন বলে ফেলল যে এভাবে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে?বুঝে উঠল না সে।তোয়ালে কাঁধে নিয়ে পা চালিয়ে ওয়াশরুমে গেল।কিয়ৎক্ষন পর স্নান সেরে বের ও হলো।ভেজা চুলে ঝাড়া দিয়ে রুমে এদিক ওদিক তাকিয়ে নীরকে দেখতে পেল।খাটের উপর বসে পা দুলাচ্ছে।নিষাদ হাসল।খাটের এককোণে নীরের পাশে আরাম করে বসেই শুধাল,
” কি খবর ব্রো?একা একা বসে আছেন কেন আপনি?”
নীর ঘাড় ঘুরিয়ে নিষাদের দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল,
” তুমি চকলেট আনোনি ভো?”
ব্রো শব্দটার “ভো” উচ্চারণ শুনেই নিষাদ আওয়াজ করে হেসে উঠল।বলল,
” কি বললি বাপ?আরেকবার বলো তো ব্রো।”
নীর অতি আগ্রহ নিয়ে বলল,
” ভো বলেছি।”
নিষাদ আবারও হাসল।উঠে গিয়ে দুই হাতে দুটো চকলেট আনল। নীরের দিকে এক হাতের চকলেটটা এগিয়ে দিতেই নীর ঝাপটে নিল। অপর হাতের চকলেটটা দেখিয়ে বলল,
” এটা নিবে?কি বলবে তাহলে?”
নীর জানে কি বলতে হবে।নরম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।বলল,
” এটাও নিব বাবা।”
নিষাদ অপর চকলেটটাও এগিয়ে দিল।একটা চকলেট ব্রো বলার জন্য, অপর চকলেট টা বাবা বলার জন্য।নীরের জন্য এটা নিত্যদিনের ঘটনা। নীর খুশি হয়ে চকলেট নিয়েই দৌড় দিল।নিষাদও হেসে খাটে গা এলিয়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখল।মুহুর্তেই বালিশের একাংশ ভিজে উঠল তার ভেজা চুলে।সেতু ঘরে ডুকে সর্বপ্রথম সেটাই খেয়াল করল। গরম চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখেই নিষাদের মাথার নিচ থেকে বালিশটা টান মারল।নিষাদ বন্ধ রাখা চোখের পাতা মুহর্তেই খুলল।অলস গলায় শুধাল,
” কি হলো এটা?প্রেম চেয়েছি তোমার কাছে এখন?তবে কেন এত বড় অন্যায়টা তুমি করলে সেতু?আমার ঘুমটা মাত্রই চোখে ঠাস করে আগমন করছিল,সেই মুহুর্তেই বালিশটা ছিনিয়ে নিতে হলো তোমায়?”
সেতু বালিশ হাতে নিয়ে স্পষ্ট চাহনীতে তাকাল নিষাদের চোখের দিকে।চোখজোড়ার চাহনী ক্লান্ত ঠিক, তবে ঘুম নেমে গিয়েছে কথাটা মিথ্যে।চোখে ঘুমের ” ঘ ” ও দেখা গেল না।বালিশটা খাটের এককোণে রেখে বলল,
” আপনার চোখে ঘুম নামে নি।মিথ্যে বলবেন না।আর বালিশ নিয়েছি কারণ সদ্য স্নান সারায় আপনার ভিজে চুপসে থাকা চুলে বালিশ ভিজে যাবে তাই।”
“তাহলে ভেজা চুলে ঘুমানো যাবে না?আমার তো ঘুম দরকার।”
সেতু নরম গলায় বলল,
” ঘুমানো যাবে না কখন বললাম?বললাম যে বালিশ ভিজে যাবে তাই নিয়েছি।”
নিষাদের ত্যড়া উত্তর,
” ঐ একই কথাই।তার থেকে বরং তুমি এখানে বসো।তোমার কোলে মাথা রাখছি।বালিশ ও ভিজবে না তাহলে।কি দারুণ সল্যুশন বের করেছি বলো?”
সেতু আড়ালে মৃদু হাসল।পাশ থেকে তোয়ালে এনে নিষাদের সামনাসামনি বসল।ভেজা চুলে তোয়ালেটা নিয়েই চুল মুঁছতে লাগল।নিষাদ অপলক তাকিয়ে রইল অল্প দূরত্বে বসে থাকা রমণীর দিকে।হঠাৎ করেই সেতুর হাতটা থামিয়ে তোয়ালেটা পাশে রেখে দিল।সটান শুঁয়ে পড়ে মাথা রাখল সেতুর কোলে।সেতু অবাক হলো না।নিষাদ যে এমন কিছু করতই তা তার জানা ছিল।কোমল হাতটা ভেজা চুলে বুলিয়েই বলল,
” এটা কি হলো?ভেজা চুল মুঁছে বালিশে মাথা রেখে আরাম করে ঘুমোতে পারতেন তো।”
নিষাদ চোখ বুঝে নিল।বলল,
” সমস্যা নেই,এখন আরো বেশি আরাম পাচ্ছি।”
” এভাবে ঘুমিয়ে যাবেন? উঠুন, বালিশে ঘুমান।”
নিষাদ উঠল না।ভেজা চুল সেতুর পেট ঘেষে রেখেই একইভাবে চোখ বুঝে রইল।সঙ্গে সঙ্গে সেতু নড়ে উঠল। নিষাদ চোখ বুঝে রেখেই দাঁত কেলিয়ে হাসল। বলল,
” এমন নড়াচড়া করছো কেন?ঘুমাতে পারছি না আমি।”
সেতু হতাশ কন্ঠে শুধাল,
” এই কারণেই তো বলছি বালিশে ঘুমান।”
নিষাদ আগের ন্যায় হেসে বলল,
” বালিশে ঘুমালে সুন্দর ঘুম হবে না, এভাবে ঘুমালে সুন্দর ঘুম হবে।”
” ঘুম আবার সুন্দর অসুন্দর হয় নাকি?”
” হয় তো।তুমি জানো না?সুন্দর ঘুম হচ্ছে সুন্দরময়।অসুন্দর ঘুম হচ্ছে অসুন্দর ময়।”
সেতু বোকা বোকা চোখে চাইল।নিষাদের যুক্তির আগা মাথা কিছু না বুঝে হতাশ কন্ঠে বলল,
” কোথায় শুনেছেন এমন কথা?নাকি নিজেই আবিষ্কার করলেন এই যুক্তি?”
” উহ! আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো না?”
” করি।”
” তবে চুপ থাকো।আমাকে বিরক্ত করবে না।ঘুমোতে দাও একটু।”
সেতু ফের আর কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল সেভাবে।
.
রাতে নীরু চোখ বুঝল ঠিক কিন্তু ঘুম আসল না।দুইপাশে দুই ক্ষুদে বাচ্চা তার উপর হাত পা তুলে দিয়ে আরামেই ঘুমোচ্ছে।নীরু কপাল কুঁচকে উঠে বসল।বালিশের নিচ থেকে কোনরকমে মোবাইলটাকে উদ্ধার করেই বেলকনিতে গেল।রঙ্গন নামটা মোবাইলের স্ক্রিনে খুঁজে নিয়েই ছোট্ট শ্বাস ফেলল।রঙ্গন একেবারের জন্যই দেশে ফিরেছে মাস তিনেক হলো।অবশ্য এর আগেও এসেছিল দেশে।কিন্তু এই কয়বছরে রঙ্গনের সাথে কলে বহুবার কথা হলেও সরাসরি দেখা করার সাহস করে উঠতে পারেনি নীরু।রঙ্গন এই বাড়িতে কয়েকবার আসলেও নিজেই ইচ্ছে করে একবারও রঙ্গনের সামনে যায়নি।কোথাও রঙ্গন আসবে জানলে মুহুর্তেই সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে।নীরু নিজের কর্মকান্ডের কথা ভেবে নিজেই হাসল।কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটায় কল লাগিয়েই কানের সামনে নিল মোবাইল। পরপর দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভড হলো।নীরু হাসল।চঞ্চল গলায় বলল,
” একি!ঘুমাওনি তুমি?কল দিলাম মাত্রই তুমিও কল তুলে নিলে?”
রঙ্গন ঘুমঘুম ভাব নিয়েই জড়ানো গলায় শুধাল,
” না, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিলাম। তোর কোন সমস্যা?”
নীরু শক্ত গলায় বলল,
” অবশ্যই সমস্যা।তুমি রাত জেগে জেগে স্বপ্ন দেখবে কেন?তোমাকে না বলেছি রাত জেগে দিয়া দির সাথে প্রেমালাপ করতে?সম্পর্ক জোড়া লাগাতে সর্বপ্রথম কথা বলতে হবে, আলাপ করতে হবে,ভুল বুঝাবুঝি শেষ করতে হবে,তারপর জমিয়ে প্রেম করতে হবে।”
রঙ্গনের ঘুমঘুম ভাব বোধ হয় কেঁটে গেল।মুহুর্তেই কন্ঠে চাপা রাগ ঢেলে বলে উঠল,
” তোকে ভাবতে বলেছি আমি?ওর সাথে প্রেম করি, সংসার করি, যা ইচ্ছে তাই করি তুই এতকিছু ভাবার কে?”
“আমি হলাম তোমাদের বিয়ের ঘটক!দায়িত্ব নিয়েছি না আমি?”
রঙ্গন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” কল রাখ নীরু। তোর সাথে এত রাতে এসব বলতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
নীরু উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তো কখন বলতে ইচ্ছে করে তোমার?”
” সারাদিন কি দুনিয়াতে থাকিস না?রাত হলেই তোর মনে পড়ে রঙ্গন নামে এক মানুষ আছে যাকে কল দিয়ে তার ঘুমের বারোটা বাঁজানো যায়,আবোল তাবোল বকবক করা যায়।”
নীরু বোকার মতো শুধাল,
” আবোল তাবোল?আবোল তাবোল কি বকবক করেছি তোমার সাথে?কাজের কথাই তো বললাম।”
” তোর কাজ তোর কাছে রাখ।আমি শুনতে চেয়েছি একবারও?”
” শুনতে চাও বা না চাও।আমার কি?আমি কি তাই বলে না বলে থাকব?এত বড় এক দায়িত্ব নিয়েছি। আহা!এই দায়িত্ব পালন করার পর আমার কত সুনাম হবে বুঝতে পারছো?তোমার পরিবার, তুমি,দিয়া দি সবাই তখন আমায় মাথায় তুলে নাচবে।”
রঙ্গন বিরক্ত হলো।নীরুর এতগুলো কথার জবাবে কোন কথা না বলেই কল কাঁটল।নীরু পিটপিট করে চেয়ে থাকল মোবাইলের দিকে।কত বড় সাহস!কল কেঁটে দিল?পরপর আবারো দুইবার কল দিল।তিনবারের সময় কল তুলল রঙ্গন।গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠল,
” নীরুর বাচ্চা নীরু, সামনে ফেলে তোকে মেরে দিব একদম!”
নীরু ধমকটাকে বেশ পাত্তা দিল না।আয়েশ করে বলল,
” তোমার কি মনে হয় তোমার এই ছোট্ট ধমককে আমি ভয় পাই?আমি হলাম সাহসী মেয়ে।শিরায় উপশিরায় শুধু সাহস আর সাহস!বুঝলে?”
রঙ্গন হেসে উঠল। বলল,
” বুঝলাম।যে সাহসের নমুনা!এত সাহস নিয়েই বুঝি ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকিস?দেখা করতে বললে সেকেন্ডেই ভয়ে না বলে দিস?আসলে তুই হলি ভীতু নীরু।ভীতুর ডিম বলেই আমার সামনে আসতে ভয় পাস।”
নীরু চোখের দৃষ্টি সরু করল।বলল,
” তুমি আমায় ভীতুর ডিম বললে গাধা?শোনো, ভীতুর ডিম তুমি, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী।”
” আমি কি তোর মতো ভয়ে তোর সামনে যাই না?”
” তার পেছনে কারণ আছে।আমি তোমার সামনে যাই না কারণ টা হলো তোমাকে বিশাল একটা সারপ্রাইজ দিব।আর সে সারপ্রাইজ সমেতই তোমার সামনে হাজির হবো। বুঝলে?”
রঙ্গন এবার আওয়াজ তুলে হেসে উঠল।বলল,
” সারপ্রাইজ?তুই সারপ্রাইজ দিবি?নির্ঘাত কোন হাবিজাবি প্ল্যান তাই না?আমি সে সারপ্রাইজে নিজেকে পঁচাতে চাই না।ক্ষমা কর আমায়।”
নীরু কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল। গলার চঞ্চলতা হঠাৎ কমে গেল।শান্ত গলায় বলল,
” বিষয়টা তেমন না।সারপ্রাইজটি অতি সিরিয়াস সারপ্রাইজ!তুমি নিজেই অনেক খুশি হবে সেদিন।দেখে নিও।তারপর আমায় থ্যাংকস বলবে।”
রঙ্গন ত্যাড়া গলায় বলল,
” তোকে কোন দুঃখে থ্যাংকস বলতে যাব?”
” সেটা না হয় সেদিনই জেনো।”
” কোনদিন?”
নীরুর আগের ন্যায় শান্তস্বরে শুধাল,
” নীরের জম্মদিন না কয়েকদিন পর?সেদিনই দেখো কি সুন্দর সারপ্রাইজ।আমারই সেই সারপ্রাইজের কথা ভোবে খুশি খুশি লাগছে। তুমি নিশ্চয় আমার থেকে হাজারগুণ খুশি হবে।মিলিয়ে নিও।”
” বাহ!বাহ!আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তোর মতো পাগলের সারপ্রাইজে আমি হাজারগুণ খুশি হয়ে যাব?”
নীরু মুহুর্তেই রেগে গেল।শান্ত স্বর বদলে গেল মুহুর্তেই।বলল,
” আমি পাগল?”
রঙ্গন হাসি চেপে বলল,
“তো তুই কি তাহলে?”
নীরু দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
” তুমি পাগল, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠীর সবাই পাগল।কল রাখলাম। তোমার মতো পাগলের সাথে আর কোন কথা নেই।কোন কথাই নেই।”
” কি আশ্চর্য!তুই এমন রেগে যাচ্ছিস কেন?পাগলকে পাগল বলব না তো কি বলব?”
নীরু চোখ ছোট ছোট করল।কিছু বলার জন্য জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাতেই কানে আসল নীরের বাচ্চা-বাচ্চা কন্ঠস্বর,
” তুমি কাকে পাগল বলছো মামনি?কার চৌদ্দগোষ্ঠী পাগল? কার সাথে কথা নেই তোমার নীলু মামনি?”
নীরু অসহায় চোখে পিছু ঘুরে চাইল।নীরের গোল গোল চোখে এদিকেই তাকিয়ে থাকা দেখেই বোকা বোকা হাসল।এমনটা এর আগেও বহুবার হয়ছে।রঙ্গনের সাথে কথাবলার সময় হুটহাটই নীর উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে।কখনো কখনো রঙ্গনের সাথে ঝগড়াও করে।নীরু ইশারায় নীরকে কাছে ডাকল।ওপাশ থেকে রঙ্গন বলল,
” আহা!তোর নীর সোনা না?এক পাগলের সাথে এবার আরেক পাগল জয়েন হচ্ছে তাহলে?”
নীরু রেগে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” নীরকে ও পাগল বলছো তুমি?কত বড় সাহস!নীর এদিকে আয়, তোকে আর আমাকে পাগল বলেছে এই লোক।”
নীর উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এল।তাকে পাগল বলেছে কে?বিষয়টা তাকে জানতে হবে।নীরুর হাত থেকে মোবাইলটা কানে নিয়েই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,
” কে তুমি? লগন?”
নীরু সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ করে হেসে উঠল।রঙ্গন নামটাকে “লগন” বলাটা যেন এক মুহুর্তেই তাদের পাগল বলার শোধ তুলে নিল। রঙ্গন ওপাশ থেকে শ্বাস ফেলে বলল,
” আমার নাম রঙ্গন।তুমি লগন ডাকবে না।অন্য কিছু ডাকবে৷ হুহ?”
নীর গোলগোল চোখ করে প্রশ্ন ছুড়ল,
” কি ডাকবো তোমায়?”
” তোমার মামনিকে জিজ্ঞেস করো। ”
নীর উৎসুক হয়ে নীরুর দিকে তাকাল।বলল,
” কি ডাকবো লগনকে?”
নীরু দাঁত কেলিয়ে হেসে উত্তর দল,
” ডাকবে লগন পাগলা।সুন্দর না নামটা? আমি জানি ভীষণ সুন্দর!”
নীর খুশি হলো।ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
” মামনি বলেছে তুমি লগন পাগলা।”
নীরু খিলখিলিয়ে হাসল।ওপাশ থেকে রঙ্গন সেই হাসিটা শুনেই কল কাঁটল মুখের উপর।বোধহয় বেচারা নিজের নামের এই বেহাল দশা মেনে নিতে পারল না।
#চলবে…..