নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব-২৩

0
967

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_২৩
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

নীরু তাড়াতাড়িই হাজির হলো রঙ্গনকে দেওয়া ঠিকানায়।মনে মনে এবার আর রঙ্গনের থেকে কোন প্রস্তাব পাবে এই আশা নেই।তবুও তার চোখে মুখে খুশির আভাস। রঙ্গন মানুষটাই আস্ত এক খুশির ভান্ডার তার কাছে। পার্কের ভেতরে একটা বেঞ্চে পা দুলিয়ে বসেই এদিক ওদিক চাইল নীরু ।রঙ্গন নেই।কি আশ্চর্য!তার দরকারি কথাগুলো বলার জন্য এত তাড়া।অথচ সে আগে আগে আসল না কেন?নীরু মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখল।টানা পনেরো মিনিট বসে থেকে এবার বিরক্তিটা মাথাচড়া দিয়ে উঠল। মনে হলো পনেরো মিনিট নয়, পনেরো বছর অপেক্ষা করে আছে সে।মোবাইল হাতে নিয়ে রঙ্গনকে কল দিতেই রঙ্গন কল তুলল।ওপাশ থেকে বলল,

” এখন আবার বলবি দেখা করতে ইচ্ছে করছে না?আমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই রেগে যাব নীরু।রাগ উঠাবি না একদম।”

নীরু চঞ্চল গলায় শুধাল,

” রাগ কেবল তেমারই আছে নাকি?”

রঙ্গনের ত্যাড়া উত্তর,

” হ্যাঁ, আমারই আছে।কোন সমস্যা?”

“ভালো, তবে ফোন রাখো।আমি বসে বসে মশা মারি এখানে।”

” চলে এসেছিস তুই?দুই মিনিট দাঁড়া তাহলে।”

নীরু মৃদু গলায় বলল,

” দাঁড়াতে পারছি না।বসে আছি আপাদত।”

রঙ্গন জবাবে কিছু না বলেই কল কাঁটল।নীরু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। কল কেঁটে দিল এইভাবে?হতাশ হয়ে পা দুলাল আরো মিনিট দুই। অবশেষে রঙ্গনের আসার সময় হলো।পরনে আজ ও ধবধবে সাদা রংয়ের শার্ট।হাতের ঘড়িটায় নজর রেখেই বলে উঠল সে,

” তুই এত তাড়াতাড়ি কার সাথে দেখা করতে এসেছিস এখানে?প্রেম ট্রেম করছিস নাকি কারো সাথে?”

নীরুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হলো।বলল,

” করলেই বা তোমার কি?”

রঙ্গন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” তুই প্রেম কর, বিয়ে কর, সংসার কর, হানিমুন কর যা ইচ্ছে তাই কর।আমার কোন যায় আসে না।”

“অতি ভালো।তোমার মতো গাধার আমায় নিয়ে কোনকিছুতে যায় আসুক চাই ও না আমি।”

” এখানে কেন এসেছিস বল।”

নীরুর রাগ হলো।ফোঁসফাঁস শ্বাস ছাড়ল।নিজেই তো দরকারি কথা আছে, দরকারি কথা আছে বলে মাথা খেল।অবশেষে তাকে সেই দরকারি কথা শোনার তাড়া পেয়ো এখানে আসতেই হলো।আর এখন আবার জিজ্ঞেস করছে কেন এসেছে?কত্ত বড় বেয়াদব!দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

” তোমাকে বিয়ে করার জন্য। চলো বিয়েটা করে তোমার ঘাড়টা মটকে দিই। ভালো হবে না?”

নিষাদ চোখজোড়া সরু করে চাইল সামনের মেয়েটাকে।বেঞ্চে আরাম করে বসে পা দুলাচ্ছে।হালকা বাতাসে ঘাড় অব্দি চুলগুলো উড়ছে।ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সে,

” ঐদিন না আমার বউ দেখে ফেললে কি হবে ভেবে ভেবে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলছিলি?আর আজ তো বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছিস।ছিঃ নীরু, ছিঃ!তোর মুখে এক, কাজে আরেক।”

নীরু উঠে দাঁড়াল।বলল,

” ওহ আচ্ছা,ভুলেই তো বসেছিলাম।তোমার তিয়াশা পাখির কি খবর?কেমন আছে সে?”

রঙ্গন ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তিয়াশা পাখি?কে তিয়াশা পাখি?”

নীরু ত্যাড়া চাহনীতে তাকিয়ে বলল,

” সে কি! পাখি ফুরুৎ নাকি গাধা?নাকি আমি সেদিন ভুল শুনলাম।তোমার হবু বউ এর নাম তিয়াশা পাখি না?”

রঙ্গন হাসল।বসে বলল,

” তিয়াশা পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি।তুই যদি চাস তো খাঁচায় বন্দি হতে পারিস।নিষেধ করব না।”

নীরু মুখ কুচকে নিয়ে বলল,

” কি আশ্চর্য!আমার কি ডানা দেখতে পারছো তুমি?আমি কি পাখি নাকি? আমি হলাম জ্বলজ্যান্ত মানুষ।চোখে কম দেখো নাকি? পাখি হলো তোমার দিয়াপাখি, তিয়াশাপাখি এরা।”

” ওদের ও তো ডানা চোখে পড়ল না আমার।”

” উহ!ওরা হলো তোমার মনের রাজ্যের পাখি।ওদের ডানা চোখে দেখা যায় না ঠিক তবুও তারা উড়তে পারে।তোমার মনের আকাশে।অস্বীকার করবে তুমি?কিন্তু আমি তো আর ওদের মতো উড়তে পারি না।”

“তো?”

” তো কিছুই না।এক পাখি উড়ে চলে গেল।অন্য পাখিকে উড়িয়ে দিলে কেন?”

রঙ্গন মৃদু গলায় বলল,

” সুখ।সুখ পাচ্ছিলাম না। সুখের জন্য পাখিপোষা বাদ দিয়ে দিলাম।”

নীরু আহাম্মকের মতো বলল,

” মানে?তুমি তো পাখি পুষতে দক্ষ।তুমি পাখিপোষা ছেড়ে দেবে? এটা বিশ্বাসযোগ্য?আসল কারণ বলো, দ্বিতীয় পাখি ও কি উড়ে গেল নাকি উড়িয়ে দিলে?কোনটা?”

রঙ্গন নির্দ্বিধায় বলে দিল,

” উড়িয়ে দিলাম।আর এর পেছনে কারণটা ছিলি তুই।তোর জন্যই পাখিটাকে না পুষে উড়িয়ে দিলাম।অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম তোর মাঝে সুখ খুঁজে পাই। সত্যিই বলছি আমি সুখ খুঁজে পাইনি তোকে ছাড়া। বরং আমি বিহীন সুখী নীরুকে দেখা সহ্য হচ্ছিল না আমার।”

নীরু হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে চঞ্চল গলায় শুধাল,

” কেন?তুমিও কি আমায় ভালো-টালো বাসো? ”

বেহায়ার মতো প্রশ্নটা করেই নীরু চুপসে গেল।উত্তরে রঙ্গন কি বলবে তার অপেক্ষায় রইল।রঙ্গন কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই ঠোঁট চওড়া করে হাসল।তারপর বলল,

” ভালোবাসা কি এতই সহজ নীরু?ভালোবাসা কি মুহুর্তেই হয়ে যায়?আমি তোকে ভালোবেসে উঠতে পারিনি এখন ও।সত্যি বলতে, আমি এখনও দিয়াকেই ভালোবাসি।সেই চঞ্চল, প্রাণবন্ত,রাগী,আমার উপর অধিকার ফলানো দিয়াকে ভালোবাসি। দিয়া এখন অনেক বদলেছে।এখন আর আগের মতো বাচ্চা বাচ্চা রাগ, জেদ ওর মধ্যে নেই। তবুও আমার কেন জানি সে আগের দিয়াকেই ভালো লাগত,লাগে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখনকার দিয়াকে আমার আর ভালো লাগে না।কেন জানি না আমি সেই আগের দিয়াকেই এখনো ভালোবাসি।আমার কাছে ওর ভালোবাসাটুকু বরং সে পুরাতন দিয়ার জন্যই তোলা থাক।”

নীরুর প্রশ্নে নীরু নিজেই লজ্জ্বিত হলো।কষ্ট পেল।কেন কষ্ট পেল তা জানা নেই। সে তো কোন প্রত্যাশা নিয়ে আসেনি এইবার।রঙ্গন তাকে ভালোবাসি বলবে এমন আশাও নিয়ে আসেনি।তবুও কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু সেই কষ্ট দেখানো গেল না।চোখ বুঝে ছোট্ট শ্বাস ফেলল কেবল।দুদিনেই রঙ্গনের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছিল রঙ্গনও তাকে ভালোবাসে বা এমন কিছুই বলবে। কিন্তু সে ভুল।রঙ্গন তাকে ভালোবাসে না।সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে।কিছুই বদলায়নি।কিছুই না।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,

” দিয়া দির সাথে নিষাদ গরুর যোগাযোগ হয়।দিয়া দি কিন্তু এখনও বিয়ে করেনি।শুনেছি বিয়ে করবে না শপথ নিয়েছে।তুমি চাও তো দিয়া দির সাথে আমি যোগাযোগ করব?তোমাদের সম্পর্কটা আগের মতো জুড়ে দিব?অনেক সুন্দর মানাবে তোমাদের, অনেক সুখী থাকবে তোমরা। ”

” দরকার নেই। আমি তোকে চাইছি আপাদত।”

রঙ্গনের আকস্মিক কথায় স্তব্ধ হলো নীরু।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

” চাইছো মানে?তোমার সামনেই তো আছি।”

রঙ্গন গমগমে সুরে বলল,

“সারাজীবনের জন্য চাইছি।”

“কেন?”

” ভালো থাকার জন্য।”

নীরু হাসল।রঙ্গনের পাশে বসে বলল,

” ভালোবাসাবিহীন সংসার করে কি লাভ বলো গাধা?তবে এটা ঠিক, আমি ভালোবাসা পাই বা না পাই তোমার সাথেই সংসার বাঁধার স্বপ্ন বুনেছি।আমি হয়তো একপায়ে রাজিও হয়ে যাব তোমার পাশে থাকার জন্য।কারণ আমার জন্য তো তোমার মুখ থেকে এইটুকু শোনাও সৌভাগ্যের বিষয়!”

” মানে?”

নীরু হালকা হেসে বলল,

” আমি এতগুলো দিনেও তোমার হৃদয়ে স্থান করে উঠতে পারিনি। হ্যাঁ, তোমার কথা মতো মনের খোড়াক হতে পেরেছি, সুখের কারণ হতে পেরেছি।আজ তুমি আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে গিয়েছো কারণ তুমি জানো আমিই তোমায় ভালোবাসি।তুমি নও।আমিই তোমাকে বিয়ে করে সংসার করতে চাই।তুমি নও।তুমি শুধু অপশন হিসেবেই আমাকে রাখলে।তোমার মনে হলো অপশনটা হাতছাড়া করা উচিত হবে না, তাই না?পরে যদি কোন অপশনই না পাও তাই।যখন মনে হলো এই অপশনটা সবচেয়ে উত্তম আপাদত,তখনই টুপ করে তুলে নিলে সেই অপশনটা।হতে পারে দিয়া দি তোমার জীবনে ফিরলে তোমার কাছে আমি নামক অপশনটা ফ্যাকাসে হয়ে যাব।হয়তো ছুড়েও ফেলে দিবে উত্তম প্রাপ্তির আশায়।।দ্বিতীয়ত তোমার মনে হয়েছিল নীরুই তোমার মন ভালো রাখতে পারবে।তোমার কথামতো তোমার সুখের কারণ হতে পারবে। তাই না?ভালো তো আর বাসো নি আমায়। ”

রঙ্গন কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই বলল,

” তোর সাথে যখন প্রথম সাক্ষাৎ তখন তুই একদম ছোট একটা বাচ্চামতো মেয়ে।এখনও আমার কাছে তোকে সেই বাচ্চামতো মেয়েটাই লাগে।আমি তোর দিকে কখনো প্রেমিকা নজরে তাকানোর কথা মনেও আনিনি নীরু।আমি জানতাম তুই সুন্দর বাচ্চা বাচ্চা একটা মেয়ে।এখনও তোকে সুন্দর লাগছে।তবে অন্যসব মেয়েদের মতো তোকে কখনো রূপের দিক থেকে দেখাই হয়নি।প্রেমনজরে তাকানোই হয়নি তোর দিকে।তোর দুষ্টুমি,খুনসুটি স্বাভাবিক ভাবেই বরাবরের মতোই নিয়েছিলাম। তবে জানতাম না, এটাই আমার অভ্যাস হয়ে বসবে। আমি সে অভ্যাস বদলাতে এতটা হিমশিম খাব। স্বপ্নেও ভাবিনি।আমি তোর শরীরের প্রেমে না পড়লেও বুঝতে পারলাম তোর সাথে কোথাও না কোথাও আমার টানাপোড়ন চলছে।আমার মন টান খাচ্ছে।বুঝতে পারলাম সেই টানে আমি ভালো থাকতে পারছি না, ভালো নেই।”

নীরু প্রসঙ্গ পাল্টাতে হাসল।গলায় চঞ্চলতা টেনে বলল,

” বাদ দাও।ভাবছি এতদিন পাড়ার যেসব সুন্দর সুন্দর ছেলেদের উপর ক্রাশড ছিলাম তাদের লিস্ট করব। তারপর কল করে করে কথা বলব বুঝলে?তাদেরও অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।তখন তারাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।সুন্দর হবে না বিষয়টা?”

রঙ্গন গম্ভীর সুরে শুধাল,

” আমি সিরিয়াসলি কিছু কথা বলতে এসেছি নীরু।তোর এসব ঠাট্টার কথা শুনতে আসিনি।সিরিয়াসলিই বলছি তোর কি ইচ্ছে?সবটাই তোর ইচ্ছের উপর ছেড়ে দিয়েছি।আমি শুধু তোকে জানাতে এসেছি এসব।”

নীরু খিলখিলিয়ে হেসে চোখ টিপল। উত্তর দিল,

” উহ!আমি রাজি, রাজি।তোমায় বিয়ে করতে এক পায়ে রাজি আমি।তবে আমায় তো এখন বিয়ে দিবে না।যখন বিয়ে দিবে তখন তোমার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে বলব, ঠিকাছে?তবে নীরু সবসময়ই তোমার ভালো চায়,বুঝলে?হতে পারে এর চেয়েও উত্তম কোন সুখ তোমার জীবনে এনে দিবে।তুমি চিন্তা নিও না।”

রঙ্গন বুঝল না।প্রশ্ন করল,

” মানে?”

” নীরু তো তোমার মতো স্বার্থপর নয় যে নিজের স্বার্থের জন্য হাত বাড়াবে,তোমাকে পাওয়ার আশা রাখবে।আমি ভালোবাসি বলে আমায় ভালোবাসতেই হবে কথা নেই।ভালোবাসি বলে তোমায় পেতেই হবে এমনও কোন কথা নেই।ধরে নাও,তোমায় পাওয়ার থেকেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তোমার সুখ।সেই সুখ তোমায় এনে দিতে পারলে মুক্তি তোমার।”

” মুক্তি মানে? ”

” সুখ পেলে তোমার দুঃখ তোমায় ছেড়ে যাবে না? দুঃখ থেকে তো মুক্তিই পাবে। তাই বললাম।”

রঙ্গন কথাটার মানে বুঝল কি বুঝল না কে জানে।আগের মতোই চেয়ে রইল।নীরু হালকা হাসল।বুকে কষ্ট হচ্ছে।কেন কষ্ট হচ্ছে জানা নেই।তবুও হচ্ছে, হৃদয়ের কোথাও সব জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে ।সারাজীবন একসাথে থাকতে চাওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ও সে সুখী হতে পারল না।মন শুধু বলছে,”তবে কি মনে বাস করবে এক নারী, বাস্তবতার সংসারে বিরাজ করবে অন্য নারী? ”

.

আকাশ সোফাতেই বসা ছিল।ইরা হঠাৎ ই বাচ্চা মেয়েকে কোলে তুলে সামনে আসল।গলা ঝেড়ে বলে উঠল,

” তুমি কি তোমার প্রথম বউয়ের সাথে যোগাযোগ করেছো আকাশ?মিথ্যে বলবে না, আমি সব শুনেছি।”

আকাশ উত্তর দিল না।ইরা আবারও আগের ন্যায় বলে উঠল,

“হঠাৎ প্রথম বউয়ের প্রতি প্রেম জেগে উঠেছে?প্রথম সন্তানের প্রতি মায়া উতলে পরছে?যদি ঐ সন্তানকে নিয়েও আসো এখানে, শুনে রাখো,যে ক্ষনে সেই সন্তান বাসায় ডুকবে সেই ক্ষনেই আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব।আমি ঐ আগাছা নিয়ে সংসার করতে পারব না আকাশ।”

ইরার এই রূপটা আকাশের একদমই পছন্দ হয় না।রাগে মুখটা লাল হয়ে উঠল।তবুও রাগ সামলাল।বলল,

” তুমি এত সহজেই চলে যাবে ইরা?”

ইরা ক্রুর হাসল।বলল,

” আমাকে তোমার প্রথম বউ সেতু ভেবো না যে অধিকার ছেড়ে দিয়ে মহান সেঁজে চলে যাব। আমি অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারি আকাশ। বিয়ের আগে যেমন তুমি ধীরে ধীরে আমার থেকে সরে যাচ্ছো বুঝেই তোমার বাড়িতে এসেছিলাম অধিকার মিটাতে।তোমার প্রথম বউ সেতুকে রাজি করেয়েছিলাম ডিভোর্সের জন্য?ঠিক তেমনই কোন বুদ্ধি খাটিয়ে ঐ আগাছা,মানে তোমার প্রথম সন্তানকেও সরিয়ে দিতে পারব সংসার থেকে।”

আকাশ হাসল।ইরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, যথেষ্ট চালাক।তার দ্বারা এমন কিছু করা অসম্ভব নয়।ক্লান্ত গলায় বলল,

” ইরা?তোমার আমার যখন প্রেমের সম্পর্ক ছিল তখন আমি তোমায় ভালোবাসতাম।তোমার মাঝে মানসিক শান্তি খুঁজে পেতাম।আজকাল তুমি আমার থেকে সেই মানসিক শান্তিটাই ছিনিয়ে নিয়ে গেছো।আমায় শান্তি দাও ইরা।”

ইরা সহজে মানল না।ঝাঝালো গলায় বলল,

“আমার জীবনে তুমি আপদ টেনে আনছো, তো আমি কি করে তোমায় শান্তিতে থাকতে দিই আকাশ?আমার জীবনে অশান্তি আনলে আমিও তোমায় শান্তিতে থাকতে দেব না।”

” আমি এমনিতেও শান্তিতে নেই।”

ইরার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলে।বলল,

” শান্তি তো পাবে না।এখন প্রথম বউয়ের প্রতি মায়া জম্মেছে।তোমার মতো পুরুষ মানুষদের আমি খুব ভালো করেই চিনি আকাশ।একবার এই নারীতে শান্তি পাও তো আরেকবার ঐ নারীতে শান্তি পাও।তোমাদের শান্তির থেকে অশান্তিতে থাকাটাই উত্তম।”

আকাশ চোখ বুঝে নিল।রাগ লাগছে।কিন্তু ইরার সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই।ইরা ঘটনাকে এখানেই থামিয়ে দিবে না।বরং সেই ঘটনা গড়াবে বহুদূর।তাই নিজেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন করতে চাইল।মানসিক অশান্তিতে ছটফট করে উঠল ভেতরটা।উহ! জীবনটার এমন পরিণতি না হলেও তো পারত।সব আছে, সবাই আছে, তবুও সুখ নেই। প্রতিনিয়ত সুখী হওয়ার ভান করতে হচ্ছে তাকে।

.

নিষাদ পা গুটিয়ে মেঝেতে বসল। সেতু উল্টোপাশ হয়ে ঘুমানোয় মুখ দেখতে পাচ্ছিল না বলেই উঠে এসে সেতুর মুখ বরাবর খাট ঘেষে ফ্লোরে বসে পড়ল।দুই হাত খাটের কিনারায় রেখে হাত জোড়ার উপর মুখ রাখল।তারপর চোখজোড়া মেলে রেখে তাকিয়ে রইল সামনের ঘুমন্ত রমণীর দিকে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখে পড়েছে সেই রমণীর।ফর্সা মুখে বন্ধ চোখের পাতায় মায়াময়ী বোধ হলো।মিহি ঠোঁটজোড়ায় লোভাতুর চোখে চেয়ে থেকেই হালকা হাসল নিষাদ।বারকয়েক শ্বাস ফেলে সেভাবেই তাকিয়ে থাকল।পরমুহুর্তেই চোখ গেল গলার ভাজে কালো তিলটায়।নিজের ভেতর ভয়ংকর ইচ্ছেরা কলকলিয়ে উঠতেই নিষাদ তর্জনী আঙ্গুলটা এগিয়ে ছুঁয়ে দিল সেই তিল।মুখ উঁচু করে পুরু ঠোঁটজোড়া সেই তিলে ছুঁয়ে দিল ক্ষণিকের জন্য। সেতু বোধহয় বুঝে গেল।প্রথমে নড়চড় করলেও মুহুর্তেই থেমে গেল সেই নড়চড়।নিষাদ মৃদু হেসে সরে গেল।সেতুর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ঘুমঘুম চোখের সরু চাহনী।নিষাদ পিচেল কন্ঠেই বলে উঠল,

” ওভাবে তাকানোর কি আছে?কিছু করেছি তোমায়?করিনি তো কিছুু।”

সেতুর চাহনী আরো সরু হলো।ঘুমের বারোটা বাঁজিয়ে দিয়ে এখন বলছে কিছুই করেনি?কি অসহ্য লোক!চোখ বুঝে নিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

” কিছুই করেন নি।করলেও সেসব কিছুই করেননি এর মধ্যেই পড়ে।ঘুমাননি কেন এখনো?ঘুমিয়ে যান গিয়ে।”

” আমি তোমায় কিছুই করিনি সেতু।বিশ্বাস না হলে তোমার ঐ তিলকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”

সেতু আবার চোখ মেলল।ঘুমে চোখ মেলে রাখা দায়। তবুও কোনভাবে চোখজোড়া খোলা রেখে শুধাল,

” এখন জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে না আমার।ঘুমিয়ে যান আপনি।আমি বিশ্বাস করলাম, আপনি কিছুই করেন নি।”

নিষাদ অসহায় কন্ঠে বলল,

” ঘুম আসছে না সেতু।চোখে ঘুম ধরছে না।তুমি ঘুমাও, আমি তোমায় দেখি।”

সেতুর এবার অস্বস্তি হলো।উঠে বসে মিনমিন করে তাকাল।অগোছাল চুল হাতের মুঠোয় নিয়ে বাঁধতে বাঁধতেই বলল,

” মাথা ধরেছে?চলুন কফি করে আনি।আপনি বসুন এইখানে।আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে ফেরত আসছি।হুহ?”

সেতুর প্রস্তাব পেয়ে খুশি হলো নিষাদ। সত্যিই মাথা ধরেছিল।সেতু কি করে বুঝল?যেভাবেই বুঝুক, বুঝেছে এইটুকুই তার খুশির কারণ।ঠোঁট চওড়া করে মাথা দুলাল সঙ্গে সঙ্গে।ঝাকড়ানো চুলগুলো পেঁছন দিকে ঠেলে মুহুর্তেই উঠে দাঁড়াল।সেতুর হাতের মুঠোয় বাঁধতে থাকা চুলের অংশটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিঠে ছড়িয়ে দিল।হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,

“বাঁধবে না, এভাবেই থাক।ঠিকাছে?”

সেতু উত্তর দিল না।চুলে দ্বিতীয়বার হাত না রেখে পা বাড়াল।রুমের বাইরে অল্প আলো।তবুও যেটুকু আলো সেটুকু আলোতেই কোন রকম পা চালিয়ে রান্নাঘরে গেল।তারপর রান্নাঘরের আলো জ্বালাল।চুলা জ্বালিয়ে কাজে মনোযোগ দিতেই নিষাদ এসে হাজির হলো।উঁকি দিয়ে বলল,

“কিসব যাদু টাদু করেছো বলোতো সেতু।তুমি যেখানে আমিও সেখানে চলে যাচ্ছি।না চাইলে আমার পা জোড়া আমায় টেনে নিয়ে চলে আসছে।তুমি যে যাদু টাদু জানো কোনদিন তো আগে বললেই না।কেন বললে না?কার কাছ থেকে শিখেছো এমন কার্যকরী যাদু?বললে কি আমি ছিিনিয়ে নিতাম?”

সেতু আড়চোখে চাইল।মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,

“বললে বিশেষ লাভ হতো?কিংবা এসব জেনে কি কিছু করে ফেলতেন আপনি?”

নিষাদ চোখমুখে দাম্ভিক ভাব ফুটিয়ে বলল,

” অবশ্যই করে ফেলতাম।তোমার কি আমাকে এতটাই বোকা মনে হয় সেতু?তুমি যদি আমায় বলে দিতে তবে আমি নির্ঘাত তুমি যার কাছ থেকে যাদু শিখেছো তার কাছে গিয়ে হাজির হতাম।তার হাতে পায়ে ধরে শুধু পিছু পিছু ঘুরঘুর করানোই নয়, সবকটা যাদুই শিখে ফেলতাম এক লাফে।তারপর, তারপর কি হতো তুমি ভাবতে পারছো? ”

সেতুর হাসি ফেল।নিষাদ আসলেই হাসাতে পারে খুব।মন ভালো করতে পারে এক নিমিষেই।এই মানুষটার কথা শুনলেই আজকাল সুখ সুখ অনুভব হয়।অবশ্য আগেও হতো যখন সে কিশোরী ছিল।তবে এখন একটু বেশিই।নিষাদের কথা শুনে খুব হাসি ফেলেও হাসল না সেতু।মুখে গম্ভীর ভাব টেনে বলল,

” না, ভাবতে পারছি না।তারপর কি হতো নিষাদ?”

নিষাদ হাতজোড়া বুকে ভাজ করে নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।যেন তার খুব গর্ব হচ্ছে।মুখেচোখে আলাদা ভাব ফুঁটে উঠল।ঠোঁট চওড়া করে শুধাল,

” ওহে মেয়ে, তারপর আমি সেই যাদু শিখে সর্বপ্রথম সেই যাদুতে তোমায় বশ করতাম।তারপর আমি যেমন তোমার প্রেমে উদাসীন হয়ে আছি তেমনই আমার প্রেমেতে তোমাকে উদাসীন করে রাখতাম।সারাদিন আমার পিছু পিছু টই টই করে ঘুরে বেড়াতে।আমি যেখানে যাই সেখানেই গিয়ে হাজির হতে।ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েও থাকতে। ভাবতে পারছো?কি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটত?আর তুমি বলছো লাভ হতো না?আরে, আমারই তো সবচেয়ে বেশি লাভ হতো।”

সেতু এবার না চাইতেও হেসে দিল।আওয়াজ হলো না অবশ্য সেই হাসির।ধোঁয়া উঠা কফির কাপ হাতে নিয়ে এগিয়ে দিল নিষাদের দিকে।মুখে বলল,

‘ যদি এমনটা হতো তবে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হতো নিষাদ?এখনকার মতোই ভালোবাসতেন নাকি ভালোবাসা পেয়ে অবহেলা করতেন?”

নিষাদ কফির কাপে চুমুক দিল। দাঁত কেলিয়ে বলল,

” অবশ্যই অবহেলা করতাম।চোখ বুঝে অবহেলা করতাম। শোধ তুলতাম, বুঝলে শোধ।কঠিন শোধ!আমায় যে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরাও তার প্রতিশোধ।”

” তার মানে কাল যদি আপনি টের পান আমি আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি, আপনার পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছি, আপনাকে চোখে হারাচ্ছি,আপনার প্রেমে উদাসীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আপনি আমায় দূরে ঠেলে দিবেন?অবহেলা করবেন?”

নিষাদ হাসল। অল্প আওয়াজে বলল,

” এটা সত্যি যে ভালোবাসা পেলে মানুষ অবহেলা করে।কিংবা ভালোবাসলে তার বিনিময়ে অবহেলা পেতে হয়৷তবে আমার দ্বারা বোধহয় এই কার্য সম্ভব হবে না সেতু।তুমি যদি আমায় ভালোবাসা দিয়ে সমুদ্রও বানিয়ে দাও তাও আমি বোধহয় তোমায় অবহেলা করতে পারব না।তোমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারব না।আমি বড্ড দুর্বল তোমাতে।এই দুর্বলতা মুঁছে গেলে অনেক আগেই মুঁছে যেতে পারত।এতগুলো দিনেও যখন মুঁছে দিতে পারিনি তো বোধহয় কোনদিনই মুঁছে উঠতে পারব না।”

” কেন পারবেন না?”

” নিজ স্বত্ত্বাকে কি কখনো মুঁছে দেওয়া যায় সেতু?নিজ অস্তিত্বকে বিলীন করে দেওয়া যায়?যদি যায় তবে যে আমি নিজেই নিঃশেষ।”

সেতু মুগ্ধ হলো।একটা মানুষের কথা, যুক্তি এতটা কি করে মুগ্ধকর হতে পারে? পুরো মানুষটাতেই সে মুগ্ধ।আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

” আপনি বোধ হয় সত্যি সত্যিই যাদুটা শিখে নিচ্ছেন নিষাদ।আজকাল মনে হয় সত্যিই আমায় বশ করার জন্য যাদুর প্রয়োগ করে ফেলেছেন। ”

কথাটা বলেই মৃদু হাসল সেতু।রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে বাইরে পা বাড়াল।নিষাদ কফি মগ হাতে নিয়ে স্থির সেই অন্ধকার রান্নাঘরেই দাঁড়িয়ে রইল।মুখের হাসিটা ক্রমশ উজ্জ্বল হলো।ঠোঁটজোড়া আরো চওড়া হলো।ফিসফিস করে ঠোঁট নেড়ে শুধু আওড়ালো,” তবুও তোমার যাদুর প্রভাবটাই তীব্র সেতু।”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে